চলার পথে বিপরীত লিঙ্গের কত জনকেই না ভালো লেগে যায়। আমারও ভালো লেগেছিল। তবে, আমার ভালো লাগা ছিল একজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
সেই দিনটির কথা আমার এখনো বেশ মনে আছে। ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরছিলাম। পতিমধ্যে হটাৎ মুসুল ধারার বৃষ্টি শুরু হয়। সঙ্গে এমন কিছু ছিল না যা দিয়ে বৃষ্টি প্রতিহত করা সম্ভব। কিন্তু বৃষ্টি থেকে তো বাঁচতে হবে। কোনো উপায় না পেয়ে পাশের একটি মুদির দোকানে আশ্রয় নেই।
এখান থেকে আমার বাড়ি বেশি দূরে নয়। কয়েক মিনিট হাঁটলেই পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজতে আমার ভালো লাগে না বলেই এখানে থামা।
পথের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি পড়া দেখছিলাম। হঠাৎ চলন্ত একটি রিক্সার দিকে তাঁকিয়ে আমার চোঁখ আটকে যায়। রিক্সায় কাকভেজা হয়ে একটি মেয়ে বসে আছে। অসম্ভব সুন্দর তার চোঁখ। বৃষ্টির পানিতে চোঁখের কাজল লেপ্টে গেছে মুখ গহরে। মুক্ত চুল হতে পানি টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে সমস্ত শরীরে। ভেজা কাপড়ে শরীর লেপ্টে থাকায় শারীরিক গঠন ফুঁটে উঠেছে কাপড়ের ভিতর দিয়ে। পথের উস্মুক জনতা কামুক চাহনি নিয়ে তাঁকিয়ে আছে তার শরীরের দিকে। যেন, কারো ইঙ্গিতের অপেক্ষায় রয়েছে। অনুমতি পেলেই ঝাপিয়ে পড়বে হায়েনার মত।
তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে কল্পনার রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছি। যখন বাস্তবে ফিরলাম, ততক্ষণে রিক্সা অনেক দূরে চলে গিয়েছে। মেয়েটিকে আমার ভালো লেগে যায়। তাই আগেপিছে কিছু না ভেবেই, আমি একটি রিক্সায় চেপে মেয়েটিকে অনুসরণ করতে থাকি। আমি যে তাকে অনুসরণ করছি, সে হয়ত তা বুঝতে পেরেছিল। তাই কিছুক্ষণ পর পর পিছনে ফিরে তাঁকাচ্ছিল।
একটি বাড়ির সামনে এসে রিক্সা থেমে যায়। আমিও কিছু দূরূত্ব রেখে থেমে পড়ি। রিক্সা ভাড়া দিয়ে, মেয়েটি একবার আমার দিকে তাঁকিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। আমিও আমার বাড়ির পথে রওনা দিই। যখন বাড়িতে পৌঁছাই, তখন আমার সমস্ত শরীর ভিজে একাকার। আমাকে ভেজা শরীরে দেখে তো মা অবাক। যে ছেলে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দেখে না, সে আজ বাড়ি এসেছে ভিজে একাকার হয়ে।
সেইদিনের পর থেকে, মেয়েটির বাড়ির সামনে দাঁড়িতে থাকা আমার রুটিন হয়ে দাঁড়ায়। তাকে দেখার জন্য প্রতিদিন একবার করে হলেও সেখানে গিয়ে দাঁড়াই। প্রতিদিন অবশ্য তার দেখা পাওয়া যায় না। তবে, যেদিনই দেখি সেদিনই তার হাতে কোন না কোন বই থাকে। হতে পারে, গল্প কিংবা কবিতা পড়তে ভালোবাসে।
একদিন রাতে কি যেন হল। কোন ভাবেই ঘুম আসছিল না। চোঁখ বন্ধ করতেই মেয়েটির কথা মনে পড়ত। ঘড়িতে তখন সময় রাত এগারটার মত। হঠাৎ মনের মধ্যে তাকে দেখার নেশা চেপে বসে। কিছু না ভেবেই রওনা দিলাম তার বাড়ির দিকে। যখন পৌঁছাই ঘড়িতে তখন এগারটা বিশ। গিয়ে দেখি, সে বেলকুনিতে বসে বই পড়ছে। সেই দিনই বুঝেছিলাম, মেয়েটি কতটুকু বই পাগল।
আমি যখন চিন্তায় বিভোর, কিভাবে তার কাছাকাছি যাওয়া যায়। তখন কিভাবে যেন বইয়ের কথা মাথায় আসে। মেয়েটি তো বই পড়তে ভালোবাসে। ভালোবাসার জিনিস উপহার দিলে সে নিশ্চয় ভীষন খুশি হবে। যেই ভাবা সেই কাজ, আমার পছন্দের কয়েকটা বই কিনে একটি ছেলের দ্বারা পাঠাই তার কাছে।
একদিন, বিকেলে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ মেয়েলি কন্ঠে কে যেন বলে উঠল,”এই ছেলে।” পিছনে তাঁকিয়ে দেখি সেই মেয়েটি। রিক্সায় করে কোথায় যেন যাচ্ছিল। আমার সামনে এসে রিক্সা থামাল।
মেয়েটিকে আজকেও ভীষন সুন্দর লাগছে। পরনে নীল রঙ্গা শাড়ি।
হালকা মেকাপ করেছে, চোঁখে লাগিয়েছে কাঁজল। চুলগুলোও খোলা রেখেছে। মুক্ত চুলগুলো বাতাসে উড়ছে অনবরত। আমি মুগ্ধ নয়নে তাঁকিয়ে রয়েছি তার দিকে। ইচ্ছে করছে এই মিষ্টি বিকেলে এক জোড়া কদম ফুল হাতে তাকে প্রেম নিবেদন করতে।
— “আপনিই আমাকে প্রতিদিন ফলো করেন। তাই না?”
তার কথায় বাস্তবে ফিরলাম। তোতলাতে তোতলাতে বললাম,
— “কই না…তো!”
— “মিথ্যা বলতেছেন কেন? আর বইগুলোও আপনিই আমাকে পাঠিয়ে ছিলেন, তাই না?”
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াই।
— “বইগুলো সুন্দর। আমার ভালো লেগেছে।”
— “বইগুলো আমার খুব পছন্দের।” বলেই জিহ্বায় কামড় দিলাম। ধ্যাত, এটা বলার কি প্রয়োজন ছিল।
— “আপনি কী আমাকে ভালোবাসেন?”
ভয়ে ভয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। মেয়েটি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
— “উঠে আসুন, রিক্সায়।”
— “রিক্সায় কেন?”
— “আপনাকে উঠতে বলছি না। চুপচাপ উঠে বসুন।”
আমি রিক্সায় উঠে বসি। প্রথমবারের মতো কোন মেয়ের সাথে একই রিক্সায় বসলাম। রিক্সা চলতে শুরু করল।
— “আপনার নামটা কী একবার বলবেন।
আমার কথা শুনে, সে হাসলো। পাগল করে দেয়ার মতো হাসি। হাসি থামিয়ে বলল,
— “আপনি আমাকে ভালোবাসেন অতচ আমার নাম জানেন না।”
আমি কিছু বললাম না। মাথা নিচু করে বসে থাকলাম।
— “আমার নাম অবন্তিকা। অবন্তিকা চৌধুরী।
— “আমার নাম রাসেল মাহমুদ।”
দুজনেই চুপ করে বসে আছি রিক্সায়। রিক্সা চালাচ্ছে মধ্যবয়সী একজন চাচা। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে রিক্সা। গন্তব্য আমার অজানা। আমি নিরবতা ভেঙ্গে বললাম,
— “আচ্ছা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
— “বই কিনতে। আজকে, আপনার পছন্দ মতো বই কিনব।”
— “আপনি কী আমাকে ভালোবাসেন?”
আমার কথা শুনে অবন্তিকা হাসলো। হ্যাঁ সূচক হাসি।
তার মানে সেও আমাকে ভালোবাসে।আজকে নিজেকে ভীষন ভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছে।
রিক্সায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, “ধন্যবাদ বৃষ্টি!”
তুমি না হলে আজকে এরকম মুহূর্ত হয়ত কখনোই দেখতে পেতাম না।
হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। মুসুল ধারার বৃষ্টি। কে জানে, আজকের বৃষ্টি হয়ত আমাদের উৎস্বর্গ করে।
বৃষ্টিতে ভিজছি, আমি আর অবন্তিকা। বৃষ্টিতে ভিজতে কেন জানি খারাপ লাগছে না। খারাপ না লাগার কারণটা হয়ত অবন্তিকা।