১…
চোখ বন্ধই থাকবে, হাতড়ে হাতড়ে বালিশের তলা থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিতে হবে।
একটা সিগারেট ঠোঁটে চেপে চোখ খুলে লাইটারের খোঁজ। পুরো সিগারেট বিছানায় থেকেই শেষ করে তবেই দিনের শুরু।
আজ বৃহস্পতিবার। তিনঘন্টার একটা হার্ডওয়্যার ল্যাব আছে। মনে পড়তেই শরীরের সব জোর চলে গেল। ব্যাজার মুখে বিড়ি টানছি, আনন্দ’র ফোন।
আনন্দ আমার কলেজের বন্ধু। আটজনের যে বিশাল গ্রুপ ছিলাম তখন- আনন্দ তাদেরই একজন। ভার্সিটিতে উঠে তো সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম, আর আমিও…।
– হ্যাঁ, দোস্ত।
– কই তুই?
– আমি তো ময়মনসিং। ক্যাম্পাসে। কেন?
– মানে! রওনা দিসস না এখনো?
ওহহো… আনন্দের ভাইয়ের বিয়ে তো কালকে। সেই উপলক্ষ্যে আমাদের গ্রুপটার একটা রি ইউনিওন হবে- এই রকম পরিকল্পনা ওর।
আমাকে আরো আগেই বলেছে। ভুলে গেছি একদম।
আমি বললাম, দোস্ত, আজকে পাঁচটা ক্লাশ। এটেন্ডেন্স খায়া দিবে একদম। আমি সন্ধ্যায় রওনা দেব রে!
২…
একেকটা বাস ভ্রমণ নতুন করে আরেকটা পুরনো জন্মের মতই। কিংবা মৃত্যু- শুনেছি মরবার আগে নাকি পুরো জীবনটা এক ঝলক দেখতে পাওয়া যায়।
গত হওয়া প্রেম যদি হয় দগদগে ঘা, সময়ের ব্যস্ততায় নিজের নিয়মেই সব ঘা ই শুকাতে থাকে। কমতে থাকে পরিধিও।
সেই জায়গা থেকে এই যাত্রাকে বলতে পারা যায় লাল লোহার ছুরি- যা কেবলই ক্ষতগুলোকে নতুন জীবন দান করে।
মনে পড়ে, কারো একজনের কাধে মাথা রেখে হয়ত চলা যেত পথটুকু। ইত্যাদি ইত্যাদি।
রোজকের ব্যস্ততায় ডুব দেয়া সেই নিষ্ঠুর প্রশ্ন- “আচ্ছা, তুমিও কি এখনো কষ্ট পাও?” একদম অস্তিত্ব জুড়ে নেয়।
তুমিও। প্রথমেই মেনে নিই আমি তো পাইই। এ যেন পরম পরাক্রম কোন বীরের কাছে খেলাচ্ছলে আত্মসমর্পণ।
নিজের ইগোকে অন্তত কারো কাছে তুচ্ছ করবার সুখ, ছদ্মরূপ ঝেড়ে ফেলবার শান্তি। এই নতজানুত্ব মহিমাময় হতে পারত, সুখের ছিল- এই বোধ জাগ্রত হয়।
সুখী অতীতেরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে নিজেদের, আর এই সময় যেন শুধুই হাত পাতা ভিখারী।
দূর থেকে দেখতে পাওয়া বড় ছলছলে উৎসব যে এক সময়ের আমারই চির-বর্তমান ছিল এ কথাই অবিশ্বাস্য লাগে। নিজেকে হিংসে হয়, করুণা জাগে।
এবার মনে আসে “এখনো”। আপাতনিরীহ এই শব্দই হাজির করে আরো বিষাদ।
এক সময় সে যে কষ্ট পেতই এই নিয়ে কোনওরকম সন্দেহও নেই যখন মনে, ঠিক তখনই আশঙ্কা করি- আর বুঝি মনেও নেই আমার কথা।
সময় গেলে ঘটনাগুলো ভুলতে থাকি, আরো বেশি করে জাপটে ধরে তীক্ষ্ণত্বর আবেগেরা।
আর তাই দিয়েই সব যুক্তি খন্ডন করে একটা রূপকথার শুভ সমাপ্তিই একমাত্র স্বাভাবিক মনে হয়। তখনই মনে পড়ে মাথায় ঝুলছে ‘এখনো’।
সময় বয়ে গেছে অনেক। আমিই শুধু বয়ে যাইনি। সবকিছুই যেন প্রতিপক্ষ। বনাম একলা আমি।
এ যুদ্ধে এতিমই হোক বাঁ সাতকূল ভরা লোক- সকলেই একা।
মনে আসবে আমার আগেও মরে যাওয়া কত মানুষের কথা- যারা মরে গিয়েই নিশ্চিহ্ন হয়েছে চিরকালের মত।
তখন যেন কষ্ট কানে কানে বলে ওঠে, “তোমরা প্রেম বলে যা ভাবো তা-ই যদি প্রেম হবে তবে কেনই বা প্রেমের হিশেব রাখো আমার এককে?”
আর আমি… তখনও বসে ভাবি, “আচ্ছা, তুমিও কি এই কথা ই ভাবছো?”
ভালবেসে ফেললে তো আর কোনভাবেই কিছু আটকানো যায় না, না? ইমা?
৩…
রাত্রি সাড়ে এগারোটা। গল্পের ক্লাইম্যাক্স সৃজনের উৎকৃষ্ট সময় যদিবা এটা, বাস পাবার নয়। আমরা দাঁড়িয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে।
আমরা বলতে৪ আমরা সেই আটজন। আনন্দ এসেছে সী অফ করতে।
আমি যাব মোহাম্মদপুরে। আমার আরেক বন্ধু সোহাগেরমেসে। আমি ঢাকায় যাচ্ছি শুনেই বলে রেখেছে। যাই হোক, বাস পাওয়া গেল। প্রায় খালি বাস।
হৈ হৈ করে উঠলাম এবং তৎক্ষণাৎ টের পেলাম বিবাহ মিলনোত্তর বিষাদ জাপটে ধরেছে আমায়।
অন্ধকার রাত, প্রায় খালি বাসে পুরনো বন্ধুর দল আর খুব ছোট্ট যাত্রা- এই বুঝি জীবন? এত মনোটোনাস!
অবশ্য কারো কথাবার্তায় বিষাদ টিষাদের নামগন্ধও নেই, জমানো সব হাসিঠাট্টা বয়ে চলছে। মাঝে মাঝেই কেউ কেউ নেমে যাচ্ছে অন্ধকার রাস্তায়।
আমারই কেবল মনে হচ্ছে যেন কি যেন হবার ছিল, হল না, হচ্ছে না। খালি বাস প্রকট করে ধরে রাখে চলে যাওয়া।
শেষজন নামল শংকর। আমার যেতে হবে আরেকটু বেশি।
৪…
মোহাম্মদপুর থেকে লেগুনায় মহাখালি। টাকার জন্যে আটকাত না, সময়ের জন্যে রিকশা নিলাম না আমরা। আমি আর সোহাগ। এবার বাস।
লোকাল বাস যায়, আমরা একটা লাক্সারি বাস দেখে উঠে পড়লাম।
ভাড়া দিচ্ছে গৌরী সেন, আমার কিসের চিন্তা! মিস্টার গৌরী সেন সোহাগ আর আমি যাচ্ছি তার সাম্প্রতিকতম প্রেমিকার সাথে ‘মিট’ করতে।
ওর বাসায় পৌছেই জানলাম এই খবর। শেষবার দেখা হবার পর তার চারবার প্রেমিকা পরিবর্তন হয়েছে।
আমাকে বলল- দোস্ত, কালকে তো বসুন্ধরা যাবো। তোর যাওয়া ই লাগব সাথে।
না, তার প্রেমিকা তো একা আসছেন না- সাথে বান্ধবীও আছে। তারা যখন একটু আড়ালে যাবে তখন আমার তাকে সময় দিতে হবে!
আমি বললাম- এখনকারেরটা চিনি আমি?
-নাহ। ইস্ট ওয়েস্টের মাইয়া। নতুন।
কি সুন্দর! যতদিন ভাল্লাগে- আমরা আমাদের। শেষ হলেই মিউচুয়াল ব্রেক আপ। প্রেম যতদিন সুখের ততদিনই তারা প্রেম করে।
প্রেমের তো আর অভাব নেই! সোহাগের কাছে প্রেম ভালবাসা কপচানো অন্তত আমার শোভা পায় না! সে বলল যে মেয়ে আসবে সে নাকি সিঙ্গেল!
আমি বললাম- এমনিতেই তোর সাথে যাবো। তোর লোভ দেখাতে হবে না!
ফ্লাইওভার অবধি যাবো বাসে। সোহাগ জানালার ধারে (সে নিজের বৌয়ের জন্যেও বোধহয় এই সিট ছাড়বে না, আমার জন্যে কি দায়!)।
এক কানে হেডফোন দিয়ে বসে আছি, মাঝে মধ্যে ছেলেটা কিসব বলছে- নিজের ডিএসএলআরের গুনগান করছে, বসুন্ধরার কাশবনের কথাও বলল।
সেই সময় আমার চোখে পড়ল আমার অন্যধারের সিটে বসেছে একটা মেয়ে। চোখাচোখি হল।
আশ্চর্য!
হাসল। বিব্রত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। নামবার সময় তাকালাম আরেকবার। দেখলই না যেন! কি চেয়েছিল? আমি দেব ভুবনডাঙ্গার হাসি?!
ফুচকার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওরা, ফোনে যোগাযোগ হয়েছে। রিকশা নিলাম।
৫…
একবার শুধু হাঁটু কেঁপে গেল। আরেকবার মনে হল সবটাই বুঝি সাজানো। এক্ষুনি সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি ঝপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম।
ইমা দেখল সবটাই। তারপরে না দেখার ভান করে বলল- আরে! তুমি যে! হাই!!
সোহাগ অবাক- তোমরা চেন নাকি নিজেদের?
আমি কিছু বলার আগেই ইমা বলল- চিনব না! একসাথে কোচিং করেছি উদ্ভাসে! খুব ভালো ছেলে।
যাক! অন্তত এটুকু বুঝলাম সোহাগের সামনে কি সাজতে হবে আমাদের। বন্ধু!! ইমা এখন আমার বন্ধু!
নিজেকে তো চিনি আমি, অল্পেই ভেঙে পড়ি, কষ্ট মন খারাপ…
আজ এই রকম পরিবেশে, যার থেকে বেশি কষ্ট সারাজীবনেও পাবো কি না সন্দেহ- আমি স্বাভাবিকই থাকলাম প্রায়। ইমা পরিচয় করাল শিখার সাথে।
আমি হাসিমুখে হাই বললাম। নিয়ম তো! আমার সামনেই ইমা আহ্লাদ করে বলল- এই ছেলে, তাত্তাড়ি আমার পাশে বসো তো!
সোহাগ গিয়ে বসল। শিখা এল এইদিকে। মাত্র বিকেল হয়েছে। কাছেই কয়েকটা গাড়ী থেমেছে। সবাই ক্যামেরা এনে ছবি তুলছে।
সোহাগের কাছেও ক্যামেরা, আগেই জানি উদ্দেশ্য ভিন্ন। খালি মেয়েটা ইমাকেই হতে হল! ও দেখতে আরো ভালো হয়েছে।
শাড়িতে খুব মানায়ও ওকে। শিখা টিশার্টে। আগুনের শিখা একেবারে। ভালো লাগছে। মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে আমার দিকে, সত্যিই বোধহয় সিঙ্গেল।
ইমা বলল- তাহসিন, তুমি তো ভালো কবিতা বলো। আমাদের ডেডিকেট করে একটা শোনাও না!
সোহাগ বলল- দোস্ত! ইমারে কালকা কইছি আমার বন্ধু ভালা কবিতা জানে, আর আজকে সে ক্রেডিট নিতেছে। দেখ অবস্থা!
শিখা আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে। আচ্ছা, ইমা, আমার দিকে তাকালেও বোঝা যায় না ছেলেটা একদমই মরা? নাকি মুখাগ্নি দেবে বলেই এসেছো আজ?
আচ্ছা, চিনেছোই তো আমাকে…আর কিছুই কি মনে নেই? তোমার আমার একলা সময়?
পাগলী, তোমার সঙ্গে? জয় গোস্বামী? সবটাই ভুলে গেছো? আমি যে ভুলিনি!
আমি গায়ের সমস্ত শক্তি এক করে বললাম- একটা ফুচকা তো খাওয়া শালার!
শিখা বলল- এড়িয়ে যাচ্ছো যে বড়!
ইমা বলল- সে কি আর আমাদের জন্যে কবিতা শোনাবে? তার কতজন আছে…
আমি হুট করে বলে বসলাম- নাহ! এখনও নেই।
সোহাগ ইমার হাত ধরে একটা টান দিল, সে কপট রাগ দেখিয়ে বলল- উফ! কি সমস্যা!
সোহাগ বলল- যাবা না?
আমি তাকিয়ে আছি। ইমা তাকালও, বলল- ফুচকা না খেয়েই?
শিখা তাড়াতাড়ি বলে উঠল- আমরা ততোক্ষণ খাই। তোরা আয়।
যাবার আগে সোহাগ ওর ক্যামেরাটা দিয়ে গেল আর একটা চোখ টিপে গেল।
ওরা চলে গেলে শিখা বলল- ইমা কি রকম বন্ধু তোমার?
– ওই…একসাথে কোচিং। সেখানেই পরিচয়।
– ওর সমস্যা কী? এত এত বয়ফ্রেন্ড পালটায় কেন!
এটা প্রশ্ন ছিল না জানি। জানিয়ে দিল ও এত বয়ফ্রেন্ড পালটায় না। আমি বললাম- সোহাগই বাঁ কম কিসে! দুটিতে মিলেছে বেশ!
শিখা হেসে উঠল। তারপর যেন হিশেব করে বলল
-নাহ! আমার থাকবে একটা প্রিন্স চার্মিং। যে শুধু আমাকেই ভালবাসবে।
শিখা, একবার যদি জানতে আমার ভেতরে কি চলছে এখন! কিইবা করতে! তুমি প্রাণোচ্ছল মেয়ে, আমি যে মরে যাচ্ছি প্রতি পলে? নালিশ দেব কাকে!
শিখা বলল- তোমার কেমন মেয়ে পছন্দ?
ঠিক এই মুহূর্তে কেন জানি মনে হল মরুক ইমা। মরুক। আমার জীবন আমাকেই বাঁচতে হবে।
শিখা আর যাই হোক ইমার থেকে বেশি কষ্ট তো দিতে পারবে না- তারমানে সহ্য করতে পারব। এরসাথে প্রেম করি না কেন?
এই হাইওয়ের পাশে ফুচকার দোকান, হুশ করে কিছু গাড়ি পার হয়ে যাচ্ছে হঠাত হঠাত, কাছেই কাশফুল ফুটে আছে, সেখানে কত মানুষ জোড়ায় জোড়ায় ঘুরছে,
এমনকি আকাশে মেঘটাও যেন এসেছে সব মেলানকলিগুলো ধুয়ে মুছে নিজের বুকে নিয়ে নিতে!
মনে হল যেন- এই যে পাশাপাশি বসে আছি, হাত ধরলেই প্রেম হয়ে যাবে। আর প্রেম হলেই যেন হঠাত করে বদলে যাবে জীবন,
দমবন্ধ জেগে থাকা আর পুড়ে পুড়ে খাটি হতে থাকার হাত থেকে রেহায় পেয়ে যাবো। এই ছোট জীবনে কতখানি আর খাটি হবো বলো শিখা!
আমি বললাম- আচ্ছা, কত লোক এর আগে বলেছে তোমাকে যে তোমার চোখটা খুব সুন্দর?
হাসল।
-কেউ বলেনি। উমম… দুয়েকজন! তুমি কি বললে বলে ধরে নেব?
ঠিক এই সময়ে, এই জীবনে, এক দমকা বাতাস বওয়ার কোনও দরকার ছিল না। প্রেমের প্রয়োজনেই কি না- সেটাই হল!
বাটারফ্লাই ইফেক্টের নাম শুনেছিলাম, আজ উপলব্ধি করলাম! ওর চুলের সামান্য একটু নড়নচড়ন আমার ভেতরে যেন ঝড় এনে ফেলল।
ইমা যাবার পর যে কেউ কাছে ঘেঁষতে চায় নি এমন নয়, আমিই চোখে চোখ রাখারও সুযোগ দিই নি কাওকে।
শিখার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালাম, ও ও তাকিয়ে আছে।
৬…
ওরা ফিরল। ততক্ষণে আমরা একটা করে কফিও খেয়ে শেষ করেছি।
শিখা বলল, “কফি খাবি তোরা?”
সোহাগ উত্তর দিল, “এখন কিছুই আর মিষ্টি লাগবে না… যা খাইলাম!”
ততক্ষণাত টের পেলাম এই শব্দগুচ্ছ আমায় সারাজীবনের জন্য তাড়া করে যাবে।
একসময় হয়ত ওর কথা মনে থাকবে না, এই শব্দগুলো প্রত্যেকে থেঅকে যাবে। এটা আর যাই হোক, জাস্টিস না!
বললাম, “একটা বিড়ি খাবো।”
একটা সিগারেট জ্বালিয়ে আনলাম। সোহাগ বলল,” মাইয়াদের সামনে খাবি?”
“তোর বৌয়ের দিকে ধোয়া দেব না।”
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইমা বলল,” তুমি সিগারেট খেও না। খুব খারাপ।”
“তোমার জামাই কক্ষনো খাবে না আশা করি।”
সোহাগ বলল, “হ! ওর জামাই হবে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মালিক। মদ খাবে!”
ইমা বলল, “আর তোমার বৌ হবে কালো।”
“কেন? কালো মাইয়া সুন্দর হয় না? বিশ্বসুন্দরী একটা নিগ্রো, জানো? আমার বৌ সুন্দর হইলেই হইছে, কালা সাদা মানি না।”
বলে সোহাগ আমার দিকে তাকাল, “আই ব্লকের দিকে যাবি? চল যাই।”
একটা রিকশায় ওরা, আরেকটা রিকশায় আমরা। আমি আর শিখা।
সোহাগ বলল, “তোরা আগে যা। আমরা আসছি পেছনে।”
রিকশায় উঠেই আমি বললাম,”শিখা, জানো তো কোথায় নামতে হবে?”
“ওইদিকে কাশফুল আছে… ওইখানেই বোধহয়। ছবি তুলবে। আচ্ছা, তুমি ছবি তোলো?”
আমি বললাম, “সোহাগের থেকে ভালো!”
“ইশ! কি সুইট!”
যেখানে যাবার কথা যাওয়া গেল না। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, মেয়ে সাথে করে এখন ওদিকে যাওয়া বারণ।
অগত্যা বেওয়ারিশ কিছু পা ফেলা গেল চারজন….।
একখানে কিছু খালি জমি পাওয়া গেল ঘাস ছাওয়া, বসতে চাইতেই ইমা বলল, “এমা! ঘাসের উপর!”
সমস্যা কি মেয়ের! একসাথে যখন ছিলাম নদী পার হয়ে ঘাসে বসিনি? এখন…ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল।
ইমার এক বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড কোন একটা অনামী ভার্সিটিতে পড়ে, সেই নিয়ে মেয়েটা নাকি লজ্জিত।
বন্ধুদের বলতে চায় না ছেলে কোথায় পড়ে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমরা ঘাসেই বসলাম।
ইমার আপত্তির জবাবে সোহাগ বলল, “আমরা ভাই জমিদার ঘরের না তোমার মতন, মাটি দিয়াই তৈরি। আমাদের সমস্যা নাই।”
সূর্য নিভে যাচ্ছে, তখন একটা রিকশা টুংটুং করতে করতে এল।
দেখেই ইমা বলল, “আরেকবার যাইতে ইচ্ছা করছে। যাবা?” বলে সোহাগের দিকে তাকাল।
সোহাগের লাজ লজ্জা কম, বলে বসল, “এক দিনে এত মিষ্টি! কি কপাল!”
রিকশা ঠিক করা হল। ইমা আহ্লাদীর মতন জিগ্যেস করল, “আচ্ছা, রিক্সার নিচে হারিকেন জ্বলছে কেন?”
সোহাগ কি যেন উত্তর দিল, আমি শুনছি না আর কিছু। আমাকে এইটুকু দয়া করা যেত না?
সবটাই আমার সামনেই ঘটতে হবে! কতরকম মানুষ এই দুনিয়ায়!
আমি আর শিখা বসলাম একসাথে। শিখা অনেকক্ষণ থেকেই চুপচাপ, আমি কথাটথা বলছি না বলেই বোধয়… ওকে কি করে সবটা বুঝাই!
৭…
ফুচকার দোকানে আবার একসাথে। আমার অবস্থাটা এখন যেন কি ঘটছে না ঘটছে কিচ্ছু আসে যায় না এরকম।
সবটা দেখছিও না যেন ভালো করে। ইমা আর সোহাগ পাঞ্জা ধরেছে। ধুপ করে কাত করে দিল সোহাগ।
আমি একটু চমকে তাকালাম। এই ব্যাটা…. এমনিই তো জিতবি, কষ্ট দেয়ার কী হল? ইমা আমার দিকে কেমন যে একটা হাসি দিল!
সব গুলিয়ে যাচ্ছে… সব। মেয়েটার একটুই লেগেছে, বেশি হবে না…. হাসি দেখে মনে হল যেন কত কষ্ট ওর! এতকিছুর পরও তোমার কাছে হেরে যাচ্ছি।
যাক। শিখা…. ফেরবার আগে শিখাকে বললাম, “চলি গো, বোন!”
সে কোনদিনই বুঝবে না বোধহয়, আমিই কি ছাই বুঝি? সে আর কখনো আমার নামটাও শুনতে চাইবে না হয়তো, যায় আসে না।
আমি চেষ্টা করেছিলাম তো। হয় না।
আমি আর সোহাগ বাসায় ফিরছি। শাঁইশাঁই করে জীবনের মতই পেরিয়ে যাচ্ছে বাসটা,
রাস্তার দুধারের সারি সারি গাছ যেন বরণডালা সাজিয়ে রেখেছে এগিয়ে চলার অভ্যর্থনায়।
এই বাসের সহযাত্রী কোনো মেয়ের চকিত চাহনি আমায় ভাবাবে না এ জন্মে- জেনে যাওয়া শেষ। আমি দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে জানলা দিয়ে তাকালাম।
রাস্তার পাশের বরণডালা সাজানো গাছ – যারা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে এই বাসেরই আলোয়, তাদের ছাড়িয়ে অন্ধকারে তাকালাম।
আস্তে অন্ধকার সয়ে যাওয়া চোখে দেখা গেল রাস্তার পাশের পুকুর ধারের গাছ, নুয়ে আছে পুকুরের প্রতি আজন্ম।
ঝড়ে ভেঙে পড়া ছাড়া পুকুরকে ছুঁতে পারার আর কোনই সুযোগ নেই তার। এ জন্মে।