ভ্যালেনটাইনস ডে আসছে, আসছে পহেলা ফাল্গুন। চারদিকে প্রেমের গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে, বইতে শুরু করেছে ভালোবাসার সৌরভ। যার আঠারো বছর বয়সে বিয়ে
হয়ে যায়, এসব উত্তেজনাকর দিবসগুলো তার কাছে তেমন কোনো অর্থ রাখে না।
তবু সেই আঠারো না পেরোতেই বিয়ে হয়ে যাওয়া আমিও ভালোবাসার কথা বলি। আমার ফেসবুক বায়ো- ‘লাভ ইজ মাই অনলি প্রেয়ার’। বাংলাদেশে থাকতে একবার
ভালোবাসা দিবসে সহকর্মীদের নিয়ে পার্টি করেছিলাম, একটা কেক অর্ডার করেছিলাম যার ওপরে লেখা ছিল- ‘লাভ ইজ অল ইউ নিড’।
আমি প্রায়ই ভাবি- কোনটা বেশি সুখের? ভালোবাসা পাওয়া, না দেওয়া? কাউকে এতো বেশি ভালোবেসে ফেলা যে জাগতিক সমস্ত হিসাব নিকাশ তুচ্ছ হয়ে যায়, নিজের
সবকিছু উজাড় করে দিয়েই জীবনকে সার্থক মনে হয়, বিনিময়ের আকাঙ্ক্ষা থাকে না। এরকম করে ভালোবাসা বোধ হয় খুব বেশিবার যায় না।
আমি নিজে এমন করেই একজনকে ভালোবেসে তার সাথে ছ’বছর ধরে ঘর করছি। ভালো যে বাসি সেটা তাকে নিয়ে কবিতা লিখে, তার সাথে ছবি তুলে, তার পছন্দের
খাবার রান্না করে, তার কাছের মানুষগুলোকে আপন করে নিয়ে জানান দিতে ভালো লাগে। বিনিময়ে সে কতটুকু দিলো, তার চেয়ে আমার এই উজাড় করে দেয়া তাকে
কতটুকু আনন্দ দিচ্ছে সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এমন করে ভালোবাসতে পারার যে সুখ, ভালোবাসা পাওয়ার মধ্যে সে সুখ আছে কী না আমার জানা নেই,
তেমন ভালোবাসা আমি পাইনি কখনো ।
কিন্তু জীবনের পথে পথে যে টুকরো টুকরো ভালোলাগার মুহুর্তগুলো কেটে যায়, যেসব মানুষকে ঘিরে সেই মুহুর্তগুলো আসে আর চলে যায়, তাদের মূল্যও কি খুব কম?
সত্যিকারের ভালোবাসার চেয়ে এরকম হালকা মুহুর্তগুলোর সংখ্যা অনেক বেশি। আমার স্মৃতির পাতাকে সম্মৃদ্ধ করে রেখেছে এরকম অনেকগুলো মুহুর্ত,
অনেকগুলো মানুষ যাদের নাম পরিচয়ও আমার জানা নেই।
তখন এসেক্সে মেয়েকে নিয়ে একটা ছোট্ট বাসায় থাকি। প্রতিদিন বাসে, ট্রেনে করে লন্ডন শহরের বারমন্ডসি এলাকার একটা কলেজে পড়াতে যাই। বাসার ঠিক সামনেই
বাস স্টপ। দুই স্টপ পরেই একজন প্রচন্ড হ্যান্ডসাম, চুল আর গায়ের রঙ-এ দেখতে ভারতীয় মনে হয়, ভদ্রলোক বাসে ওঠে। অফিস টাইমে বাসে প্রচন্ড ভীড় থাকে,
বসার জায়গা মেলে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই লোকটাকে দেখি। তার পরনের দামি স্যুট আর ওভারকোট, টাই, ম্যাচিং টাইক্লিপ আর কাফলিংক, চকচকে জুতো, গলায়
ঝুলানো উলের স্কার্ফ, হাতঘড়ি- কোনো কিছুই আমার দৃষ্টি এড়ায় না, কিন্তু সে কখনো আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। কারো দিকেই তাকায় না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সে
নিবিষ্ট মনে বই পড়ে।
তার এই না তাকানো, এই বই পড়া সবকিছুই ভালো লাগে আমার। নিঃসন্দেহে খুব বড় কোনো ফার্মে বড় চাকুরী করে লোকটা। এদেশে ট্রাফিক জ্যাম এড়াতে অনেক
হোমড়া চোমড়া লোকেরাও বাসে-ট্রেনে চলাচল করে। বার্কিংসাইড টিউব স্টেশনে প্রতিদিন একই সাথে বাস থেকে নামি আমরা, ট্রেন ধরি, তারপর একসময় আমাদের
পথ আলাদা হয়ে যায়। লোকটা কি বিবাহিত, নাকি সিংগল? এক এলাকায়ই তো থাকি, তার সাথে এই অফিসযাত্রা ছাড়া কি কখনো দেখা হতে পারে না?
একদিন সত্যিই দেখা হয়ে গেল। এক শনিবারে মেয়েকে নিয়ে বার্কিংসাইড হাইস্ট্রিটে বাজার করতে গেছি। হঠাত দেখি সেই লোকটা! ডোমিনোজ থেকে বিশাল দু’টো
পিতজার বাক্স হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। আমার কৌতুহলী চোখ তাকে অনুসরণ করে, রাস্তার পাশে পার্ক করা খুব দামি একটা মার্সিডিজের পাশে গিয়ে থামে
লোকটা। সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছে অপরূপ সুন্দরী একজন ভারতীয় নারী, পেছনের সিটে দুই দেবশিশু। পিতজার বাক্স দেখে তারা আনন্দে হৈ হৈ করে
ওঠে। অপরূপ সুন্দর একটা দৃশ্য। এমন দৃশ্য আমার জীবনে কখনো আসেনি, আর আসার সম্ভাবনাও নেই। আমার বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে। এমন করে হয়তো কখনো
কোনো প্যাসেঞ্জার সিটে বসব আমি, হয়তো ডোমিনোজ পিতজা থেকে আমার জন্য খাবার নিয়ে আসবে কোনো প্রেমিক পুরুষ, কিন্ত পেছনের সিট থেকে শিশুরা হৈ
হৈ করে উঠবে না। জীবনে সব চাওয়া পূর্ণ হয় না, তবু অন্যের সুখ দেখতে ভালো লাগে। আনন্দ আর কষ্টের মিশ্র একটা অনুভূতি নিয়ে আমি মেয়ের সাথে হাইস্ট্রিট ধরে
হেঁটে যাই।
কলেজ থেকে সেন্ট্রাল লাইনের টিউব ট্রেনে বাসায় ফেয়ার পথে আরেকজন সুদর্শন পুরুষ প্রায় প্রতিদিনই আমার বিপরীতে বসে। ইংরেজ এই লোকটাকে সকাল বেলায়
দেখি না কখনো, তার অফিস শুরুর সময়টা হয়তো আমার সাথে মেলে না। টিউবে পাওয়া ফ্রি নিউজ পেপারে সুডকু আর ওয়ার্ড পাজল মেলাতে মেলাতে আমি অনুভব
করতে পারি একজোড়া আগ্রহী চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমিও পত্রিকার পাতা থেকে চোখ তুলে তাকাই। আশ্চর্য ব্যাপার, লোকটাও সুডকু পাজল মেলাচ্ছে আর ফাঁকে ফাঁকে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি আড় চোখে
তাকিয়ে বুঝবার চেষ্টা করি তার পাজল কতটুকু মিলল, আমার চেয়ে বেশি না কম। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে, আমিও হাসি। কয়েক স্টপ পরে লোকটা
নেমে যায়। এভাবেই কেটে গেল অনেকগুলো মাস।
একদিন ট্রেন আবার চলতে শুরু করলে দেখি লোকটা বাইরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। আমি আশেপাশে তাকিয়ে বুঝবার চেষ্টা করি, আর কাউকে নয়তো?
না, আমাকেই। আমিও হাত তুলে টা টা বলি। এরপর লোকটাকে আর কখনো দেখিনি। সে কি জানত এই পথে সেদিনই তার শেষ যাত্রা? তাই কি বিদায় জানিয়ে গেল?
প্রথম যখন এদেশে আসি, তখন অপরিচিত মানুষদের সাথে এরকম হালকা পাতলা আদান-প্রদানকে ঠিক নির্দোষ ভাবতে পারতাম না। তখন আমার বয়স বড়জোর
ঊনিশ। একদিন টিউব থেকে বেরিয়েই দেখি গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। সাথে ছাতা নেই, ওড়নার একপ্রান্ত মাথায় তুলে দিয়ে হাঁটছি। আমার ঠিক পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে
কালো একটা লোক, তার মাথায় একটা খবরের কাগজ ধরা। অনেকখানি পথ এভাবে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ার পর হঠাত সে আমার দিকে ফিরে বলল, ‘ইউ লুক গুড
ইউথ ইউর হেড কাভারড।’ এই বলে লোকটা দ্রুত রাস্তা পার হয়ে অন্যদিকে চলে গেল। আমি এতোটাই হতভম্ব হয়ে গেলাম যে ধন্যবাদ বলা হলো না।
আরেকবার হোম ভিজিট করতে গিয়েছি এক কাউন্সিল এস্টেটে। বিল্ডিংগুলোয় কিছু একটা মেরামতের কাজ চলছে। একজন মিস্ত্রির কাছে আমার গন্তব্যের দিক
নির্দেশনা চাইলাম। সে বললো জানে না। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘আয়ম লুকিং ফর আ বিউটিফুল এসিস্ট্যান্ট, আর ইউ ইন্ট্রেস্টেড?’
আমি নিজের দেশে পথেঘাটে পুরুষের কাছ থেকে নোংরা মন্তব্য আর আক্রমণ শুনতেই অভ্যস্ত। পুরুষ মানেই বাসে, ট্যাম্পুতে, বাজারের ভীড়ে আমার গায়ে হাত
দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছে বলেই জেনে এসেছি সবসময়। এদেশে আসার পর অবাক হয়ে ভাবতাম, এরা কেমন করে পারে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত নারীকে
এতো সাবলীল এবং সুন্দরভাবে কম্পলিমেন্ট দিতে? সবসময় ওদের সাবলীলতার সাথে তাল মিলিয়ে উত্তর দিতে না পারলেও এই ঘটনাগুলো আমাকে মানুষের ওপর
বিশ্বাস আনতে শিখিয়েছে। পৃথিবীটা খুব খারাপ স্থান নয়, পুরুষ মাত্রেই আমার গায়ে হাত দেয়ার জন্য ব্যস্ত নয়- এই আবিষ্কারটা খুব স্বস্তিকর ছিল। খুব ছোট হলেও পথ
চলতে চলতে সুন্দর কিছু মুহুর্তের জন্ম দেয়া অপরিচিত এই পুরুষগুলোকে আমি ভুলি না, ভুলতে চাইও না।