মায়ের চিৎকারে সাগরের ঘুম ভেঙে গেল। প্রতিদিনের মতোই মা বাবাকে বকাঝকা করছেন, ‘তোমার সংসারে এসে আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। আমার বাবা যে কেন এমন অকর্মণ্য লোকের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল! এই রাবণের বংশকে টানতে টানতে ঠিকমতো খাওয়া-ঘুমানোর সময় পাই না।’
সাগর আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ে। আজকে সে একদম মন খারাপ করবে না। আজকের দিনটা তার জন্য একটা বিশেষ দিন।
সাগর অভ্যাসমতো দাদুর ঘরে উঁকি মারে। ঘরে ঢুকতেই বিশ্রী গন্ধ নাকে আসে। সাগর চোখ-মুখ কুঁচকে বলে, ‘দাদু, আজকেও তুমি বিছানায় বাথরুম করেছ! বাথরুম পেলে তুমি মাকে ডাকতে পারো না!’
দাদু ধমকে ওঠেন, ‘ব্যাটা বুরবক, আমি বিছানায় বাথরুম করব কেন! তুই প্রতিদিন বিছানায় বাথরুম করিস। তোকে আমি এই হাতের তালুতে করে মানুষ করেছি, আমি জানি। তুই বিছানায় পেশাব করতে করতে এত বড় দামড়া হয়েছিস।’
দাদুর কথায় সাগর হেসে ফেলে। চারপাশের এই মানুষগুলোর ভালোবাসা উপেক্ষা করা যায় না বলেই আরও অনেক দিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে।
বাইরে আসতেই বাবার সঙ্গে দেখা হয় সাগরের, ‘কিরে ব্যাটা, আজকে এমন উদাস হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? অফিসে যাবি না?’
সাগর হেসে বলে, ‘না বাবা, আজকে সারা দিন বাসায় থাকব। তোমাদের সবাইকে বিরক্ত করব। আজকে জাগতিক সব কাজ থেকে আমার ছুটি।’
বাবা হাসেন, ‘চল তাহলে, আজকে বাপ-ব্যাটা দুজন মিলে বাজারে যাই।’
সাগরের মনে পড়ে অনেক ছোটবেলায় সে বাবার হাত ধরে বাজারে যেত। কত দিন বাবার সঙ্গে কোথাও যাওয়া হয় না!
সাগর ভেবে রেখেছে আজ সারা দিন সে মন খারাপ করবে না। আজ তার আনন্দে থাকার দিন। প্রতিদিন যে বাচ্চাগুলো বল মেরে তার জানালার কাচ ভাঙে, আজ সে তাদের ঝাড়ি দেবে না। প্রতিদিন যে কাজের ছেলেটা ভুল করে চিনি ছাড়া চা দেয়, আজ সে তাকেও ধমকাবে না।
আজ সে সন্ধ্যায় কাউকে ফোন করে বলবে না, ‘আমি বাসায় এসেছি। দয়া করে এবার আমার জন্য চিন্তা করা বন্ধ করো। আর আগামী কয়েক ঘণ্টা একদম বিরক্ত করবে না। আমি এখন ঘুমাব।’
সন্ধ্যায় সাগরের অস্থির লাগে। বাসায় যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। আনন্দে থাকার পরিকল্পনা কাজ করছে না। আচ্ছা, হলুদ পাঞ্জাবি পরে মহুয়ার গায়ে হলুদে চলে গেলে কেমন হয়! কিংবা কাল বরযাত্রীর সঙ্গে মহুয়ার বিয়ের প্যান্ডেলে ঢুকে গেলে! ছেলেমানুষি চিন্তাগুলো মাথায় আসায় সাগরের হাসি পেল।
পায়চারি করতে করতে সে মা-বাবার ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। মা-বাবা গুটুর গুটুর করে কথা বলছেন। সারা দিনের ঝগড়া-বিবাদ সব গায়েব! সাগর নিজের মনে হাসে। মায়া অদ্ভুত এক জিনিস। দেখা যায় না, অথচ বোঝা যায় সে আছে। এই টানটা আছে বলেই মানুষ কখনো সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে বিবাগি হয়ে যেতে পারে না।
হাঁটতে হাঁটতে সাগর বারান্দায় চলে আসে। আকাশের দিকে তাকিয়ে রাগে তার গা জ্বলে গেল। জোছনায় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। সে অন্ধকার চেয়েছিল। প্রকৃতি চায় না সে অন্ধকারে থাকুক। প্রকৃতির কাছে তার ইচ্ছার কোন দাম নেই। বারান্দায় বসে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে নিজেও জানে না।
খাঁচায় রাখা পাখিগুলোর কিচিরমিচিরে তার ঘুম ভাঙে। সে তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে খাঁচা খুলে পাখিগুলো আকাশে উড়িয়ে দিল। মা বারান্দায় এসে অবাক হয়ে যান, ‘তোর এত শখের পাখিগুলো ছেড়ে দিলি কেন!’
সাগর হাসে, ‘মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই মা। মায়া খুব খারাপ জিনিস। একবার মায়া বাঁধিয়ে ফেললে যুগ যুগ সে জিনিসটার ভেতরে আটকে পড়ে থাকতে হয়।’
মা ধমকে ওঠেন, ‘এসব আবোলতাবোল কী বলছিস? সারা রাত এখানে বসে ছিলি?’
সাগর মুচকি হাসে, ‘আজকে মহুয়ার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে মা। মানুষকে কষ্ট দেওয়ার জন্য প্রকৃতি কত রকম আয়োজন করে রেখেছে। তাই আমি চিন্তা করেছি আমি প্রকৃতির এই নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব।
আমাকে কষ্ট দিতে চাইলেও আমি কষ্ট পাব না। আমি আজ জোর করে হলেও আনন্দে থাকার চেষ্টা করব।’
বলতে বলতে সাগর মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।