ভালবাসার বর্ষণ

ভালবাসার বর্ষণ

ছোট্ট আদৃতার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেঁজুতি। কি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।অথচ ঘুমানোর আগে কত শত বায়না তার। আর রাজ্যের সব বায়না গল্প নিয়ে। আজ পরীর দেশের গল্প তো কাল বাঘের গল্প,নয়তো নিজের ছোটবেলার গল্প কিংবা সেঁজুতির ছোটবেলার গল্প।গল্প বলতে বলতে সেঁজুতির দুচোখের পাতা যখন ভারি হয়ে যায়,আদৃতা অস্ফুট স্বরে বলে উঠে ,

……”তুমিতো স্লিপিং বিউটি হয়ে গেলে মা।”
……”মার আজকে খুব ঘুম পাচ্ছে সোনা।আজ ঘুমোও,আরেকদিন বলব।”
……”না না মা আজ তোমার ছোটবেলার গল্প বলবে বলেছিলে।”

চোখের পাতা টানটান করে হলেও গল্প বলতে হয় সেঁজুতির। গল্প শোনার ফাঁকে ফাঁকে আদৃতা বলতে থাকে,

……”মা ঐযে ঐ গল্পটা বলনা,একদিন লাটিম খেলতে খেলতে মামা তোমার পায়ে লাটিম ছুঁড়ে দেয়। তুমি যে কত্ত ব্যাথা পেয়েছিলে। তারপর তুমি মামার সাথে দুদিনের আড়ি নিয়েছিলে।কিভাবে ভাব হয়েছিলে মা?”
……”অত কিছু কি আর মনে আছেরে?”
……”উহ,আছেতো মনে।তোমাকে একটা চকলেট দিয়ে ভাব নিয়েছে।”
……”তুমিই তো সব বললে,আবার শুনতে চাও কেন?”
……”আচ্ছা তাহলে ঐটা বল,তোমাকে একটা হাওয়াই মিঠাই কিনে দিয়ে তোমার সব জমানো টাকা আর মার্বেল নিয়ে যেত যে।”

আদৃতার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে শুরু করে নতুন গল্প। গল্প বলার যোগারপাতি না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়বে ও। জীবনটা যদি গল্পের মত হত কি অমন ক্ষতি হত। স্মৃতি হাতড়ে চলে যাই সুদূর অতীতে।কোথায় যেন যেয়ে থমকে দাঁড়াতে হয়। শেষ যেদিন বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম সেদিন নাকি হঠাৎ থমকে যাওয়া কোন এক কাঁকডাকা ভোরে। জীবনটা এত সাজানো না বলেই হয়তো অনেক কিছু বুঝে উঠার বয়সে পা দেওয়ার আগে নেমে আসে প্রথম ঝড়। কোন এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বাবা বিরস মুখে বসে আছে আর পুরো বাড়ি ফাঁকা। মা আর ভাইয়ার কোন হদিস নেই। কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে ছুটে যেতেই বাবা মাথায় হাত রেখে বলে,

…….”মায়ের জন্য কাঁদছ মামনি? তোমার মা কদিনের জন্য নানুবাড়ি গেছে। কয়েকদিন পরই চলে আসবে।”
…….” ভাইয়া কোথায় গিয়েছে বাবা”
……”ও তোমার মায়ের সাথে গিয়েছে। বলেছিতো চলে আসবে।”

গলার আওয়াজ আরও এক কাঠি উঠিয়ে আরও জোরে কেঁদে উঠে বলি।

…..”আমাকে না নিয়ে কেন গেল?”

চুপ হয়ে যায় বাবা।বুঝিনি তখন আর বলার কিছুই ছিলনা।

এরপর থেকে শুধু দিন গোনা। অপেক্ষা শুধু অপেক্ষা হয়েই থাকত। ধীরে ধীরে বাস্তবতার বেড়াজালে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর,ভাইয়া আর মাকে ছাড়া একেকটা দিন যেন বিষবাষ্পের মত ধোঁয়া ছড়াত। আমি ছিলাম ভাইয়া বলতে অন্তঃপ্রান। সারাদিন দুজন আঠার মত লেগে থাকতাম। কখনও ভাইয়া আমার সঙ্গী হত রান্নাবাটি খেলায় কিংবা আমি ভাইয়ার সাথে ব্যাট-বল নিয়ে দৌড়াতাম। মনে পড়ে,একবার খেলতে যেয়ে ভাইয়া মায়ের শোকেসের কাঁচ ভেঙ্গে ফেলে আর কপালে জোটে মায়ের হাতে মার। আর আমার সেকি কান্না। সারাদিন কিছু খাইনি,রাতে এলো ভীষণ জ্বর। জ্বরের ঘোরে নাকি বকছিলাম,

“মা,ভাইয়াকে আর মেরোনা।”

সেইযে জ্বর আর নামার নাম নেই। মায়ের সাথে ভাইয়াও সারারাত বসে ছিল। একটু পরপর কপালে হাত দিয়ে দেখছিল।

এগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। প্রায় দশ বছর ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। কতভাবেইনা খোঁজ করার চেষ্টা করেছিলাম। প্রতিদিন তীর্থের কাঁকের মত অপেক্ষা করতাম,কোন এক ভোরে যেমন আমার জীবন থেকে বিলিন হয়ে গিয়েছিল তেমনি আরেক ভোর হয়তো আমার জন্য মঙ্গল প্রদীপ হয়ে জ্বলবে। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর আর শেষ হতোনা। কেমন যেন ঘরকুনো হয়ে গিয়েছিলাম আমি। অনেকটা আসামাজিকের মত। সোশ্যাল নেটওয়ারকিং সাইটগুলোও যেন ছিলনা আমার জন্য। মাঝে মাঝে মুখবইতে ভাইয়ার নাম লিখে খুঁজতাম। কখনও পুরো নাম,কখনওবা নামের একাংশ। খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে অনেকটা অভিমানী হয়ে যেতাম। হঠাৎ একদিন দেখি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের খাতায় একটা নাম আটকে আছে। আহনাফ আহমেদ। ভাইয়ার নাম আহনাফ কবির দীপ। বাবার নামের অংশটুকু বদলে ফেলে নতুন নাম দিয়েছে নাকি অন্য কারো নাম বুঝতে পারছিলামনা। তবুও ভস্মীভূত ছাই থেকে জেগে উঠা ফিনিক্স পাখির মত আশা জেগে উঠেছিল মনে। বন্ধু খাতায় নামটা টুকে নেওয়ার একটু পর পর মুখবইয়ে ঢু মারতাম।নিজ থেকে কিছু বলতেও পারছিলাম না। অপরিচিত মানুষের সাথে নিজ থেকে কথা বলার বাতিক নেই। ঠিক একদিন পর একটা ম্যাসেজ এলো,

“কেমন আছিস বুড়ি?”

কয়েক মিনিট শুধু শব্দগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছিল।মনে হচ্ছিল পুরো পৃথিবীটা মাথার উপর ভনভন করে ঘুরছে। কি করব না করব কিচ্ছু ভেবে পাচ্ছিলাম না।সব রকম কাঁপাকাঁপি,ঝাপাঝাপির পর অভিমানের ঝাঁপি খুলে বসেছিলাম। ভাইয়া নির্বিকারভাবে সব কথার জবাব দিচ্ছিল যেন সব দোষ মাথা পেতে নিয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থনটুকু পর্যন্ত করার নেই। তারপর ভাইয়াকে মুঠোফোনে করেছিলাম বন্দী। কত যে কথা।

” তুই দেখতে কেমন হয়েছিস? আগের মতো রোগা পটকা আছিস? হাতে গলায় শিকল ঝুলিয়ে ঘুরিস?ঠোঁটের নিচে স্টাইল করে দাড়ি রাখিস? কত লম্বা হয়েছিস তুই? কোথায় থাকিস কিসে পড়িস?” মাকে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হাজার কথা।

……” তোর একটা ছবি দিসতো।”
……” ছবি দিব কিরে, দেখা-ই করব বুড়ি।”
……” সত্যি দেখা করবি? তুই আমাকে চিনতে পারবি?”
……” পাগলি একটা। তুই বুঝি হাতিমার্কা মোটা হয়ে গেছিস? ”
……” হুম, ছাই হয়েছি।”

তারপর যেন সময়গুলো কাটছিলইনা। সেকেন্ডের হিসেব কষছিলাম সারাক্ষণ। অবশেষে যেদিন দেখা হবে বলেছিল, ঠিক সময়ে জায়গামত যেয়ে বসে ছিলাম।তখন আর ভাইয়ার আসার নাম নেই। কখন থেকে অপেক্ষা করছিলাম। ভাইয়া কি আগের মতো আছে নাকি গালভাঙ্গা মফিজের মতো হয়েছে।কত কিযে ভাবছিলাম।এরমাঝে আবার পাশের টেবিলে একজোড়া ছেলেমেয়ের কুটকুট হাসির শব্দ কানে এসে লাগছিল। বসে বসে ভাবছিলাম ভাইয়া কি এখনও আগের মতো প্রান খুলে হাসে, হাসলে কি টোলটা আরও গভীর হয়ে জাগে।আবার হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছিল পায়ের নিচে ষোল বাই ষোল টাইলসগুলো দুলে উঠছে। ভাইয়া কি ঠকঠক শব্দ করে মাটি কাঁপিয়ে আসবে নাকি সন্তর্পণে পাশে এসে বসবে।এরপর হঠাৎ খুব চিরচেনা একটা ঘ্রান পেয়ে চমকে উঠেছিলাম।ঘুরে দেখলাম আলুঝালু চুলের নীলরঙ্গা শার্ট পরা খুব চেনা একটা মুখ। যেন মনে হল সাক্ষাত রাজপুত্র। ভাইয়াটাকে দেবদূতের মতো লাগছিল। তারপর ভাইয়া যখন আমার পাশে এসে বসল, আমি শুধু ওকে দেখছিলাম। আমার মুখ থেকে কোন কথা সরেনা। দুজনে চুপ করে ছিলাম,যেন নির্বাক চলচিত্র।নিরবতা ভেঙ্গে ভাইয়াই কথা বলেছিল কিন্তু কেমন জানি দূরের মানুষের মতো। পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটেঘুঁটে ছাইপাঁশ বলছিল। আর আমি চোখরাঙ্গা করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

…”বাব্বা আগের মতই অভিমানী আছিস,আইসক্রিম খাবি বুড়ি?”
…”তুই কি ভেবেছিস তুই-ই শুধু বদলে মহামানব হয়ে গেছিস?আর আমি আগের মত
বুদ্ধু আছি,আমাকে রাগিয়ে তারপর আইসক্রিম দিলেই গলে যাব।”
…”এত রাগিসনা বুড়ি,তোকে পেত্নির মত লাগছে।দেখি তোর গালটা একটু টেনে
দেই।শোন বুড়ি,,।”
…”হুম,বল।”
…”এ কদিন ধরে কথা বলছি,একবার ও তো ভাইয়া বলে ডাকলিনারে।”

কথাটা শুনেই কেঁপে উঠলাম,কিচ্ছু বলতে পারছিলামনা শুধু দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছিল।আর কোন কিছু চিন্তা না করে ভাইয়াকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করেছিলাম।মনে হচ্ছিল ভাইয়ার বুকের মাঝে মান্নাদের সেই গানটা বাজছিল,

“সে আমার ছোট বোন, বড় আদরের ছোট বোন।”

আমি শুধু কেঁদেই যাচ্ছিলাম। আর ঠিক তখনই আমাদের ভালবাসার বৃষ্টি হয়ে এক পশলা বৃষ্টি নেমেছিল।আর ভাইয়া আমার হাত ধরে বলল,

…”টুনটুনি বাইরে তাকিয়ে দেখ ।বৃষ্টি নেমেছে,কেন জানিস?তোর অশ্রু ধুয়ে
দিতে।চল ছোটবেলায় হারিয়ে যাই।”

সেদিন ইচ্ছেমত ভিজেছিলাম দুজন।জীবনটা এক মুহূর্তের জন্য অসম্ভব সুন্দর হয়ে গিয়েছিল তখন। মনে হচ্ছিল আহারে এভাবে যদি সারাটাজীবন একসাথে থাকতে পারতাম। সেইযে শেষ বৃষ্টিতে ভেজা,ভাইয়াকে শেষ দেখা। মাঝে মাঝে দেখা হয় স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের মাঝামাঝি কিছু একটায়। আর আদৃতা যখন বলে উঠে ,

……”মা আকাশের কোন তারাটা আমার মামা।”

কোন তারাটা নিজেই জানিনা, শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকা তারাটাকে খুঁজে বেড়াই।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত