অনেকক্ষণ ধরে মোবাইল এর রিংটোন বেজেই চলেছে।
ঘুম ভেঙ্গে ইরা এক চোখ কোনভাবে খুলে দেখে মোবাইল স্ক্রিন এ
“বিরক্তিভাজন ”
লিখা উঠছে।
ইরা রেগে গেল, আজ ওর পরীক্ষা, সারা রাত পড়ে একটু ঘুমাতে আসলো আর ওমনি এই লোকটা ফোন করে বিরক্ত করা শুরু করে দিয়েছে।
ইরা ফোন রিসিভ করে কড়া কিছু বলার আগেই, ও পাশ থেকে ভেসে উঠে,
” প্রথমেই বলে দিচ্ছি আমি ফোন করতে চাই নি, কিন্তু সকাল ৮ টা বাজে, তুমি এখনো ঘুম থেকেই উঠো নি, তোমার না ৯.৩০ থেকে পরীক্ষা?
ঘুমের ঘোরে ইরা তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আসলেই সকাল আটটা বাজছে।
ওর অদ্ভুত লাগছে এই লোকটা কিভাবে জানলো ও তখনো ঘুমাচ্ছিল? বিছানার পাশে জানালার পর্দা উল্টে দেখে কাউকে দেখা যাচ্ছে কি না।
এদিকে ফোন যে এখনো কাটা হয়নি তার খেয়াল ও ওর নেই।
ও পাশ থেকে আবার আওয়াজ ভেসে উঠে,
” কি আশ্চর্য! তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে কোথায় ready হবা তা না, গোয়ান্দাগিরি শুরু করেছো কেন?”
ইরা বিরক্ত হয়ে, আপনি আসলে কে বলুন তো? আমাকে আর কতোদিন এইভাবে বিরক্ত করবেন? ৩ মাস তো হলো। এইবার ছাড়ুন, প্লিজ!
” কি অদ্ভুত! তোমাকে আমি পরীক্ষায় যাওয়ার জন্য ডেকে দিয়ে উপকার করলাম, কোথায় Thank you বলবা, উল্টা অকৃতজ্ঞ এর মতো কথা বলছো। আর পচ্ছন্দের মানুষকে তো বিরক্ত করা যায়ই।
ইরা কিছু বলার আগেই,
all the best for your exam বলে কলটা ওপাশ থেকে কেটে গেল।
ওই লোকটা, যার নামও সে জানে না, সে এই রকমইও। হঠাৎ ঈ ফোন করবে হঠাৎ ঈ রেখে দেবে।
ইরা আর কিছু চিন্তা না করে varsity এর জন্য তৈরী হতে গেল।
পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে ইরার বেস্ট ফ্রেন্ড আফরিন ওকে দেখে হাত নাড়লো,
” কিরে এতো দেরিতে আসলি হলে, একটু কথা বলতেও পারি নি তোর সাথে। পরীক্ষা কেমন হলো?”
ইরা: আর বলিস না, সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দেরি হয়ে গেল।”
আফরিন: তুই তো এমনেই ভালো স্টুডেন্ট। এতো রাত জেগে পড়ার কি দরকার? তুই তো এমনেই টপ করবি!
ইরা: দেখ একদম মজা করবি না। মুড ভালো নেই। তার উপর
সকালে ঐ বিরক্তিকর লোকটা ফোন করেছিল। যদিও ফোন না করতো আজকে হয়তো পরীক্ষার দিতে পারতাম না।”
আফরিন: বাহ! তোকে আসলেইও অনেক ভালোবাসে ছেলেটা। দেখ, তোকে পরীক্ষার জন্য ফোন করে ডেকে দিচ্ছে, আজকাল তো বয়ফ্রেন্ড রাও এতো কেয়ার করে না। এইরকম lover যাতে সবাই পায়।
আফরিন এ বলে হাসতে থাকে।
ইরা এইদিকে রেগে গজ গজ করছে,
” দেখ আফরিন, আমি এমনিতেই অনেক টেনশনে আছি। তুই একদম ফাইজলামি করবি না। একে তো এই উটকো লোক যে ফোন করে করে বিরক্ত করে, আর এই semister এর math subject টা আমার মাথা পুরো খারাপ করে দিচ্ছে। সামনে ফাইনাল এক্সাম। এইবার আমার সিজিপিএ এর বারোটা বেঁজে যাবে”
আফরিন: আচ্ছা বাবা, সরি ভুল হয়ে গেছে। আর কিছু বলবো না। তুই ওই লোকটাকে বলে দে যে তোর বয়ফ্রেন্ড আছে, যাতে তোকে কল না দেয় বা ব্লক করে দে”
ইরা: আরে অই ব্যাটা, আমার history, biography সব জানে।ভালো করেই জানে আমার রিলেশান নেই। আর ব্লক! যেই নাম্বার ব্লক করি, পরে অন্য নাম্বার থেকে কল দেয়, এতো বেশি নাম্বার ব্লক করে, আমি নিজেই রিকুয়েস্ট করলাম, যাতে একটা নাম্বার থেকেই কল দেয়, যাতে আমি সেইভ করে রাখতে পারি। ”
আফরিন : যাই বলিস দোস্ত, ছেলে কিন্তু সিরিয়াস”
উফ! রাখ তোর সিরিয়াস ” বলে ইরা আঁতকে উঠে,
” এইসব বাদ দে! আমার math এর জন্য কিছু কর”
আফরিন: তুই এক কাজ কর, আইবিএ ডিপার্টমেন্ট এর রৌদ্র ভাইয়া নাকি ম্যাথে খুব ভালো। infact, মাস্টার্স এর রেজাল্ট দিলেই নাকি উনি টিচার হিসেবে জয়েন করতে পারেন। আর উনি কি সুন্দর করে কথা বলেন। আর দেখতেও বেশ handsome ”
ইরা: আরে ধুর, আমি উনার চেহারা দেখে কি করবো? তবে উনার নাম শুনেছি অনেক। এখন আমি গেলে কি উনি পড়াবেন? personally তো চিনেনও না”
আফরিন: আরে, রাহাত এর কাজিন তো উনি। রাহাত কে বললে ঠিক ব্যবস্থা করে দিবে। তুই আগে ভেবে দেখ পড়বি কি না?
ইরা: হ্যা, হ্যা আমি পড়বো। আর ২ মাস পর সেমিস্টার ফাইনাল। আমি আর রিস্ক নিতে চাই না।
আফরিন রাহাতে সাথে কথা বলে জানাবে জানায়। ইরা ও বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
বাসায় এসে নাওয়া- খাওয়া শেষে ইরা রেস্ট নিচ্ছে, তখন ফোন আসে, সেই বিরক্তিকর কলারের।
ইরা প্রথমে রিসিভ না করলেও বার বার কল করাতে রিসিভ করতেই ছেলেটা বলে উঠে,
” কি ব্যাপার? পরীক্ষা ভালো হয় নি?
ইরা উল্টা প্রশ্ন করে, ভালো হবে না কেন?
“তাহলে ফোন ধরছিলে না কেন?”
ইরা: কি অদ্ভুত! আপনি কে যে আপনি ফোন করলেই আমাকে রিসিভ করতে হবে? কতোবার বলেছি আমাকে কল দিবেন না,
তারপরও কল দিয়েই যান, লজ্জা ও লাগে না একটু?
” এইটা কি বললা? ভালবাসার মানুষের কাছে আবার কিসের লজ্জা? আমি তো জানি তুমি মনে মনে চাও তোমায় আমি কল দি? আর কেন আমার কল রিসিভ করবা না? ইনকামিং কল রিসিভ করলে তো টাকা কাটে না, তুমি আরামসে আমার সাথে কথা বলতে পারো।”
ইরা: উফ! আপনার মতো বেশরম মানুষ আমি জীবনেও দেখি নি।আর এতো ভালোবাসেন ভালোবাসেন করেন কই নিজের পরিচয় তো দেন না? কথাবার্তা শুনে মনে হয় সারাদিন খাওয়া দাওয়া কিছু করেন না, আমার ভালোবাসা নিয়েই বেচে আছেন”
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ আর থাকে না, অনেকক্ষণ পর থেমে বলে উঠে, ” রাগলে তোমাকে আমার আরো বেশি ভালো লাগে জানো সেটা?
আর আমার নামটা কি জানা জরুরি? আমি তো মিথ্যা নামও তো বলতে পারি। তবে এইটা বলতে পারি আমি তোমার খুব কাছেই থাকি, এতোটাই যে তুমি বুঝতে পারো না”
ফোন হাতে নিয়ে ইরা অনেকক্ষণ চিন্তা করে, লোকটা যখন বলেছে আমার কাছের কেউ তাহলে এলাকার কেউ হতে পারে।
পরের কয়েকদিন ইরা ভার্সিটি যাওয়ার সময় তার এলাকার আশেপাশের ছেলেদের দিকে লুকিয়ে নজর রাখতে থাকে, বিশেষ করে কেউ ওর দিকে বারবার তাকালেই ওর মনে হয় এই বুঝি সেই লোকটা, কিন্তু পরে যখন তাদের কন্ঠস্বর শুনে বুঝে যায় তার খোজ এতো সোজা হবে না।
আফরিনের কল্যাণে ইরার ফাইনালি রৌদ্রের সাথে দেখা হলো। রাহাত সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আগামী ২ মাস ইরা রৌদ্রের কাছে Math করবে তবে রৌদ্রর সময় কম হওয়াতে ভার্সিটির লাইব্রেরীতেই ইরাকে ওর সময়মত পড়াবে।
ইরা তাতে কোন আপত্তি করে নি। যেভাবেই হোক পড়তে পারলেই হল।
ইরা রৌদ্রকে প্রথম যেদিন দেখে বুঝতে পারে, আফরিন মিথ্যে বলে নি, উনি খুব সুন্দরভাবে কথা বলেন। আর দেখতেও সুদর্শন। তবে যা ইরার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে তা হলো উনার ব্যক্তিত্ব।
খুব কম কথা বলেন তবে পড়ার বিষয়ে অনেক সিরিয়াস।
কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মধ্যে মোটামুটি ভালো understanding হয়। তবু রৌদ্র প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া তেমন কিছু বলতো না।
ক্লাসে খাতায় আজকের তারিখ লিখতে গিয়ে সে থমকে যায়। এই তারিখ টা সবসময় ভুলে থাকতে চায়, তারপরও কেন জানি কারণেঅকারণে এই তারিখ ওর চোখে পড়ে যায়।
রৌদ্রর কাছে পড়তে গিয়েও মন বসছিল না পড়ায়। রৌদ্র জিজ্ঞাসা করলে, শরীর খারাপ লাগছে বলে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসে।
মনটা খারাপ ওর অনেক।
এই সময় সেই বিরক্তিকর লোকটার ফোন বেজে উঠে যদিও আজকাল ইরা ওতো রাগ করে না ওই লোকটার উপর। ও বুঝে গেছে এই লোকটার সাথে কথার যুদ্ধে জয় লাভ করা যাবে না, অথবা হয়তো ওর অভ্যাস হয়ে গেছে লোকটার কথা শুনার।
ইরা ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলে।
ওপাশ থেকে,
” কি ব্যাপার, বেশি মন খারাপ?”
ইরা চুপ করে থাকলেও মনে মনে ভাবে কেউ জানুক আর নাই জানুক ওর মনের খবর ঠিকই লোকটার কাছে পৌছে যায় কিভাবে?
ইরা তবুও মিথ্যে বলে, কই নাতো!
” আচ্ছা, তাহলে আজ সারাদিন মুখ টাকে এভাবে কালো করে রেখেছিলে কেন?”
ইরা কিছুটা বিরক্ত হয়ে,
আচ্ছা আপনি কি সারাদিন আমাকে follow করেন?
” তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি?”
ইরা: আপনিও তো কখনো উত্তর দেন না?
” আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার মন বোধহয় বেশি খারাপ। আমি পরে কল দিব তোমায়”
ফোন রাখার আগেই ইরা প্রথমবারের মতো বলে উঠে,
” প্লিজ ফোন রাখবেন না। আমার মনটা আসলেই অনেক খারাপ।”
“হুম, তাতো জানিই। এখন বলো কেন খারাপ?
ইরা: আমি তখন hsc ist year এর student. আমার ইয়ার ফাইনাল দেওয়ার জন্য বের হয়েছি, রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। জানতে পারি, রাস্তায় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে গুরুতর অবস্থা। আমি সেদিকে না তাকিয়ে অন্য পথে কলেজের জন্য রওনা দি। সেদিন রাত্রে জানতে পারি, সেই এক্সিডেন্ট এ আর কেউ নয়, আমার বেস্টফ্রেন্ড ইমি মারা যায়।
আংকেল আন্টি যখন আমাকে ধরে কান্না করেছিলেন, আমি একটিবারের জন্যও বলতে পারি নি, আমিও দায়ী ইমির মৃত্যুর জন্য। আমি যদি সেদিন ওই স্পটে আহত ব্যক্তিকে বাঁচাতে যেতাম, তাহলে আজ ও আমাদের সাথে থাকতো।
ইরা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে নি, কান্না শুরু করে।
ইরাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য বলে উঠে,
” দেখ, নিয়তি বলে কিছু আছে এইটা তো জানো। সেদিন হয়তো তুমি ওখানে গিয়েও ওকে বাঁচাতে পারতে তার কোন নিশ্চয়তা আছে? কিছু কিছু জিনিস আমাদের হাতে থাকে না। তুমি শুধু তোমার ফ্রেন্ড এর জন্য দোয়া করো। আর চেষ্টা করো, যাতে পরবর্তীতে অন্য কোন ইমির প্রয়োজনে সাহায্য করতে, তখন তোমার অপরাধ বোধ অনেকটা কমবে।”
ইরা চুপচাপ কথা গুলো শুনছিল।
ছেলেটা আবার বলে উঠে,
” আচ্ছা আমি এখন রাখি তাহলে। আর শুনো Thanks ”
ইরা অবাক হয়ে বলে কেন?
” তোমার কষ্টগুলো আমাকে বলে, তোমার কাছের কেউ হিসেবে আমাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য”
ফোনটা রাখার পর ইরা নিজেই চিন্তা করতে থাকে,
” আসলেই কি ইরা এই বিরক্তিকর লোকটাকে, যাকে সে চিনেই না, তাকে আর কাছের কেউ ভাবতে শুরু করেছে??”
ইরার মোটামুটি Math নিয়ে weakness কেটে উঠেছে। যার পুরো কৃতিত্ব রৌদ্রের। আর এক সপ্তাহ পর ফাইনাল পরীক্ষা। রৌদ্র কে thanks বলে বিদায় নেওয়ার বেলায় রৌদ্র এই প্রথম বলে উঠে,
শেষবার ক্লাস করলে, এক কাপ কফি তো খাওয়াই যায়, কি বলো?
রৌদ্রের কথায় ইরা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারি নি, রৌদ্র আসলেই এই কথা বলেছে।
কফিশপে বসে তাদের মাঝে অনেক কথা হয়।
ইরা অবাক হয়ে দেখে যে ছেলেকে মিতভাষী ভাবতো সে মোটেও কম কথা বলে না। আর এতো হাসাতে পারে ও নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতো না। মনে হতে লাগলো এই ২ মাসে যে রৌদ্রকে সে চিনতো আর যে তার সামনে বসে আছে পুরো আলাদা মানুষ।
কফিশপ থেকে বের হয়ে ইরা বাসার জন্য রওনা দিবে তখন রৌদ্র বলে,
চল তোমাকে আমি ড্রপ করে দিয়ে আসি।
ইরা প্রথমে ইতস্তত করলেও মুখের উপর নাও করতে পারে নি।
গাড়িতে রৌদ্র যখন ওর প্রিয় গানটা ছাড়ে, ইরা অবাক হয়ে শুনে এটা ওর ও প্রিয় গান। রৌদ্রের সাথে চোখাচোখি হতেই রৌদ্র একটা মুচকি হাসি দেয়।
ইরার মনে হয়, রৌদ্রকে সে শুধু ২ মাস না, কয়েক বছর ধরে চিনে।
বাসায় এসে ইরা ফ্রেশ হয়ে আবার পড়তে বসে যায়।
তখনই ফোন বেজে উঠে,
ফোনের দিকে না তাকিয়ে সে বুঝতে পারে, এইটা সেই ছেলেটারই ফোন।
এতোদিনে তার কল করার সময়সূচি তার জানা হয়ে গেছে।
ইরা ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কড়া আওয়াজ শুনা যায়,
” ছেলেটা কি হয় তোমার?”
হঠাৎ এমন আচরনে ইরা চমকে উঠে, বলে,
” আপনি এইভাবে কথা বলছেন কেন?”
” আগে বল, ওই ছেলেটা তোমার boy friend?
ইরা: আপনি কি অধিকারে এইভাবে কথা বলছেন আমার সাথে?
“just shut up!! যা বলছি তার উত্তর দাও, তুমি কি ওকে ভালোবাসো?”
লোকটার হঠাৎ এইভাবে কথা বলায় ইরা রেগে যায়, বলে,
” হুম! ভালোবাসি! অনেক ভালোবাসি! কোন সমস্যা আছে তাতে আপনার?”
কয়েক সেকেন্ড নিরবতার পর ছেলেটি বলে উঠে,
” তুমি যদি সত্যিই ওকে ভালোবেসে থাক, তাহলে আমার কিছুই বলার নেই।
সরি, গত পাঁচ মাস তোমাকে অনেক বিরক্ত করেছি। হয়তো এইদিনটা একদিন আসবে জানতাম।
তাই নিজের নামটা বলার কোন সাহস পাই নি।
ইরা, আমার থেকে আর কোন যোগাযোগ করা হবে না।
তুমি ভালো থেকো!”
ফোনটা রাখার পরও ইরা বুঝে উঠতে পারে নি,
এই বিরক্তিকর ফোনের আলাপন অবশেষে শেষ হলো।
আজ থেকে ইরার সেমিস্টার ফাইনাল শুরু।
সকালে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হওয়ার জন্য মোবাইল নিতেই ইরা খেয়াল হলো আজকেও আর কোন ফোন আসে নি ওই নাম্বার টা থেকে।
ইরার পরীক্ষা আর তাকে all the best বলার জন্য কল বা ম্যাসেজ আসে নি, এই কয়েক মাসে এমনটা হয় নি।
হয়তো লোকটা সত্যিই আর ফোন করবে না। মাঝে ইরা ফোনে কল দেবার ট্রাই করে ছিল, তবে সে নাম্বারটা বরাবরই বন্ধ ছিল।
পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে ইরা আর আফরিন কথা বলছিল। তাদের কথার মাঝে রাহাত এসে বললো, রৌদ্র ইরাকে খুঁজছে আর ওকে বলেছে ক্যাম্পাসের পিছন দিকটায় ওর জন্য অপেক্ষা করছে।
ইরা কাছে আসতেই হেসে জিজ্ঞাসা করলো,
” কেমন হলো পরীক্ষা?”
ইরা: এইতো ভালো।
রৌদ্র: তুমি ভালো আছো?
ইরা হাসিমুখে মাথা নাড়লো,
বললা, আপনি ভালো আছেন?
রৌদ্র: হুম ভালো। আচ্ছা শোনো, আমার চাকরি হয়ে গেছে। জবের জন্য আমাকে 2 months এর মধ্যে London চলে যেতে হবে। আম্মু- আব্বু চাচ্ছেন, আমি লন্ডন যাওয়ার আগে
যাতে settled হয়ে যাই।
তাই বলছি,
” ইরা, আমাকে বিয়ে করবে? ”
রৌদ্রর কথা শুনে ইরা রীতিমত শক খেল,
আমতা আমতা করে বললো,
” বি..য়ে..??”
রৌদ্র : হুম কেন? কোন সমস্যা?
ইরা: না মানে, আপনি হঠাৎ করে এইভাবে বললেন তো আমি আসলে কিভাবে react করবো বুঝছি না। আমি কখনো সেইভাবে কিছু ভাবি নি তো”
রৌদ্র : ভাবো নি তো কি হয়েছে? এখন ভাববে। তবে বেশি দিন সময় নেই তোমার হাতে। ১ সপ্তাহের মধ্যে জানাতে হবে। আব্বু- আম্মুকেও তো বলতে হবে নাকি?
ইরা কিছুটা চুপ থেকে,
” আচ্ছা, আপনাকে দেখে আমার কখনো মনে হয়নি আপনি আমাকে পচ্ছন্দ করেন। তাহলে হঠাৎ বিয়ে এর কথা বললেন?
রৌদ্র : হুম। আম্মু যখন খুব করে বলছেন তখন তোমার কথা মনে হলো, আম্মুর তোমাকে ভালো লাগবে। উনার তোমার মতো মেয়েই পচ্ছন্দ।
ইরা: ওহ! তারমানে আপনি আমাকে ভালোবাসেন না?
রৌদ্র : ভালো হয়তো বাসি না কিন্তু পচ্ছন্দ তো করি। এইটাও কম কি?
ইরা: জানেন, এই প্রশ্ন টা যদি আমি ওই লোকটাকে করতাম সে কিন্তু নির্দ্বিধায় বলতো সে আমাকে ভালোবাসে।
রৌদ্র অবাক হয়ে কোন লোকটা?
ইরা : কিছু না। শুনুন, এক সপ্তাহ সময় লাগবে না, আমি আজকেই আপনাকে আমার মতামত জানিয়ে দিচ্ছি।
সরি, আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।
এই বলে ইরা চলে যেতে চাইলে রৌদ্র ওকে আটকায় আর জিজ্ঞাসা করে
” তুমি আমাকে না বলতেই পারো কিন্তু তার কারণ টা তো আমি জানতেই পারি? ”
“কারণ হলো” ইরা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে
” কারণ, আমি ঐ লোকটাকে ভালোবাসি ”
বাসায় আসার পর ইরা শুধু অই নাম্বার টাতে কল করতেই থাকে। বন্ধ শুনার পর, আজ পর্যন্ত ব্লক করা সব নাম্বার গুলো তে একে একে কল দিতেই থাকে। কিন্তু সব নাম্বারই বন্ধ।
ইরা আর নিজের চোখের পানি আটকাতে পারে না। সে এখন কি করবে? তার তো নামও জানে না যে খুঁজে ফিরবে।এখন শুধু সেদিনের জন্য অপেক্ষা ছাড়া ইরার কিছুই করার নেই, যেদিন সেই নাম্বার থেকে আবার কল আসবে।
দেখতে দেখতে ১ মাস চলে গেল। আজ ইরার শেষ পরীক্ষা। মাঝখানে ২ দিন অফ থাকবে তারপর আবার ক্লাস আবার পড়ালেখা। এইবার ঠিক করেছে ও কিছুদিনের জন্য কোথাও ঘুরে আসবে। এই কয়দিন পরীক্ষার জন্য নিজেকে শান্ত রেখেছিল কিন্তু আজ আর কোন বাধা নেই। ভার্সিটির পাশেই একটা পার্ক আছে। ইরা প্রায় এই পার্কে আসে। বিশেষ করে পুকুরপাড় টা ওর খুব পচ্ছন্দ। অন্যদিন আফরিন পাশে থাকলেও আজ একাই বসে আছে।
দুপুরবেলা আশেপাশে তেমন মানুষ ও না থাকায় ওর আরো ভালো লাগছে । আসলে ওর বাসায় যেতে একদমই ইচ্ছে হচ্ছে না। পুকুরের দিকে তাকিয়ে ও এতোই মগ্ন হয়ে গিয়েছিল, কখন রৌদ্র ওর পাশে এসে বসেছে ও বুঝতেও পারে নি।
রৌদ্র : কি এতো চিন্তা করছো?
ইরা রৌদ্রের কথায় চমকে উঠে।
রৌদ্র : আরে, ভূত দেখার মতো এতো চমকে উঠলে কেন?
ইরা কিছুটা লজ্জা পেয়ে,
” না, আসলে আপনাকে আসতে খেয়াল করি নি তো ”
রৌদ্র : হুম! খেয়াল করবে কিভাবে? তোমার তো খুব প্রিয় জায়গা এটা। অন্য কাউকে তো আর চোখে পড়ে না তোমার।
infact তোমাকে প্রথম আমি এখানেই দেখেছিলাম।
ইরার মনে হলো উনি কিভাবে জানলেন আমার এই জায়গা খুব পচ্ছন্দ আর উনার সাথে তো আমার দেখা ভার্সিটিতে উনি এখানে বলছেন কেন?
ইরা: আপনার ভুল হচ্ছে আপনার সাথে আমার দেখা এইখানে না, ভার্সিটিতে।
রৌদ্র : আমি তোমার না, আমার কথা বলছি। প্রায় ১ বছর আগে, তোমাকে এখানে প্রথম দেখি, একটি পথশিশু ব্যাথা পেয়ে কান্না করছিল দেখে, তুমি তাকে কোলে নিয়ে এখানে বসে তাকে আদর করছিলে। সেদিন তোমার ওই শিশুটির জন্য যতো মায়া লাগছিল, তার চেয়েও বেশি মায়া সেদিন আমার তোমার উপর পড়ে গিয়েছিল।”
ইরা রৌদ্রর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
রৌদ্র সেটা না বুঝার ভান করে বলেই যাচ্ছে,
” এরপর তোমাকে ভার্সিটিতে বেশ কয়েকবার দেখলাম তবু কথা বলা হয় নি কারণ তুমি তো কখনো আমার আশেপাশেও তাকাতে না। পরে জানতে পারলাম, তুমি রাহাতের ক্লাসমেট। রাহাত আমাকে বললো তুমি এমনই।
ছেলেদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা বলো না। বুঝে গেলাম, এখন যদি তোমাকে গিয়ে বলি, তোমাকে ভালো লাগে, তাহলে তুমি ঠিকই ” No entry ” বোর্ড লাগিয়ে দেবে সামনে। এভাবে কয়েক মাস চলে গেল। শেষে রাহাত বললো আমি যদি তোমাকে কিছু না বলি, তাহলে অই সব তোমাকে জানিয়ে দেবে। ওর জন্য বাধ্য হয়ে, তোমাকে প্রথম ফোন করা। তুমি যে কড়া ভাবেই কথা বলবে, তা তো আগেই জানা ছিল। তারপরও খুব ভালো লাগতো তোমাকে বিরক্ত করতে, তোমার সাথে কথা বলতে, তোমার কন্ঠস্বর শুনতে।
যখন তুমি আমাকে উটকো লোক, বিরক্তিভাজন এইসব সম্বোধন করতে মনে হতো, এরচেয়ে বেশি আমার তোমার কাছে চাওয়ার নেই।
মাঝে ভাগ্য আমার সুপ্রসন্ন হলো। তোমাকে পড়াবার ছলে তোমার সাথে সামনাসামনি কথা বলার সুযোগ হলো।
তারপরও মনে হতো তুমি আমার সামনে থেকেও সামনে নেয়।
পরে মনে হলো তুমিও আমাকে পচ্ছন্দ করো। কিন্তু কোন রৌদ্র কে? যে তোমার সামনে থাকে নাকি যে তোমাকে আড়াল থেকে ভালোবাসে। তাই ইচ্ছে করে ওইদিন তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। তোমারও তো বুঝা দরকার ছিল তুমি আসলে কি চাও?
সরি, এতোদিন মোবাইল অফ করেছিলাম।আজ থেকে কখনো অফ থাকবে না”
রৌদ্র যেন এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে গেল।
ইরা শুনে বিশ্বাসই করতে পারছিল না ওই উটকো লোকটাই রৌদ্র।
ইরা: আপনি মিথ্যে কথা বলছেন।আপনি অই লোকটা নন। আপনার সাথে ওর কন্ঠস্বরে কোন মিল নেই।
রৌদ্র : মিল নেয়, কারন আমি voice changing app use করতাম। তুমি বিশ্বাস না হলে একবার কল করেই দেখ।
ইরা ফোন নিয়ে কল দেয়।
হুম এতোদিন পর মোবাইলে রিং পড়ছে। ফোনটা রিসিভ করে রৌদ্র হ্যালো বলতেই ইরা সেই পুরোনো কন্ঠস্বর শুনতে পায়।
এই স্বর যা সে এতো খুঁজেছে কখনো ভাবতে পারে নি এইটা নকল হবে।
ইরা রেগে ” আপনি আমার সাথে কেন এমন করলেন? আমি আপনার কি ক্ষতি করেছিলাম? আপনি জানেন গত ১ মাস আমি কিভাবে আপনার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম? আপনি অনেক নিষ্ঠুর ”
রৌদ্র : আর আমি তো ১ বছর ধরে অপেক্ষা করছি। তাহলে তো তুমি আরো নিষ্ঠুর! ”
ইরা: কেউকে জেনে কষ্ট দেওয়া আর না জেনে কষ্ট দেওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। আপনি আমাকে ইচ্চে করে এইসব করেছেন”
রৌদ্র কান ধরে,
” আচ্ছা, সরি! আর কখনো এমন হবে না। তুমি যদি বল কান ধরে উঠা- বসাও করবো। কিন্তু প্লিজ কান্নাকাটি করিও না”
ইরা: একদম ঢং করবেন না। কান ধরা কি আপনি এই পুকুরে ঝাপ দিলেও আমি মোটেও মাফ করবো না।”
রৌদ্র : আরে কি আশ্চর্য! আমি পুকুরে ঝাপ দিব কেন? এমনেই সাতার কাটতে পারি না, পুকুরে নামলে তো পুরো অক্কা পাবো। তোমাকে ভালোবাসি ঠিকই কিন্তু এতোটাও না যে এই অল্প বয়সে আমি আত্নহত্যা করবো। ছি: ছি: এইগুলো ভাবলেও পাপ! আর আমি মারা গেলে তোমার কি হবে? এই কঠিন পৃথিবীতে তুমি একলা কিভাবে থাকবে? না আমাকে তোমার জন্য হলেও বাঁচতে হবে।”
ইরা আরো রেগে গিয়ে,
” উফ! আমি আসলেই আপনার মতো লজ্জাহীন মানুষ দেখি নি”
রৌদ্র হাসতে হাসতে,
” আচ্ছা সরি বলতাম তো, আর কখনো কখনো হবে না।
যদি হয় আমি এই পুকুরে এসে সত্যি সত্যি ঝাপ দেব।
একদম প্রমিজ!!”
ইরা রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে,
” আপনাকে দেখে মনে হয় না, আপনি এতো কথা বলতে পারেন!”
রৌদ্র হেসে,
” কি করবো বলো, মানুষ প্রেমে পড়ে কবি হয় আর আমি বাচাল হয়ে গেছি”
ইরা “উফ” বলে কপালে হাত দেয়।
রৌদ্র ওর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে,
” শোনো, আমি আম্মুকে তোমার কথা বলেছি।
তুমি এখন লন্ডন যাওয়ার জন্য প্যাকিং শুরু করে দাও”
ইরা হাতটা সরিয়ে,
” মোটেও না, আমি বাংলাদেশ ছেড়ে কোথাও যাবো না।”
রৌদ্র : আরে আসবো তো দেশে বছরে দুএকবার।
ইরা: জী না! আমি কেন যাবো আমার সবকিছু এখানে ফেলে?
রৌদ্র ইরার হাত ধরে বলে,
” কারন, ভালোবাসি তোমাকে”।