অনেকদিন ধরেই মোমোর জন্য মনটা আনচান করছে দীপ্তের।কলেজ থেকে ফেরার পথে রোজই দোকানটা চোখে পড়ে ওর,কিন্তু শরীর আর দেয় না যে নেমে গিয়ে এক প্লেট খেয়ে আসবে।তাই ছুটির দিনই ভরসা।তবে ওই ছাপোষা ভোলেভালা ছেলে তো একা একা খেলে আবার ওনার কেমন একটা যেন লাগে তাই “খাইবার সাথী” খুঁজে বেড়ান।একে তাকে বলেও বেড়াচ্ছে কিন্তু ওই; সব প্রেমিকার সাথে ফাইভ স্টারে খাবে তবু ওর সাতে ১৫ মিনিট দূরের দোকানে এক প্লেট মোমো খেতে যাবে না।মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় তাই ওর বন্ধুগুলোর ওপর।
যাই হোক আজ ওর মন মেজাজটা কেমন যেন থম্ মেরে আছে তাই কোচিং পড়িয়ে ফেরার পথে ঠিক করল একাই যাবে খেতে আর কারো অপেক্ষায় নয়।যেমন কথা তেমন কাজ।
দোকানে গিয়ে পৌঁছে ঘড়ি দেখল দীপ্ত।৬ টা বাজে তাই অফিস ফেরৎ খাবার ভিড়টা এখনও শুরু হয়নি,আর কোচিংগুলোও বোধহয় ছুটি হয়নি নইলে কপোত-কপোতির ক্যাচক্যাচানি লেগেই থাকত।যাই হোক।দোকানের ভেতর একবার উঁকি মেরে দেখল বসে খাবার লোক প্রায় নেই।ধড়ে যেন প্রান এলো দীপ্তের
-যাক বাবা শান্তিতে বসে খানিক খাওয়া যাবে
-“কাকু এক প্লেট নরমাল সস্ দিয়ে” বলে একখানা কাঠের চেয়ারে রাস্তার দিকে পিঠ করে বসল দীপ্ত।এই দোকানটা ওর খুব প্রিয় কেমন একটা বাড়ি বাড়ি ফিল আছে।হয়তো “wow momo” এর মতো অতো হাইফাই নয় কিন্তু ৪০ টাকায় একপ্লেট,সেরা খেতে।দীপ্তের মতো কোচিং পড়িয়ে হাত-খরচ চালানো ছেলের কাছে তাই এটাই ঠিকঠাক,পকেটও খুশি আর পেটও..
মোবাইলটা সবে বের করে জিও টা অন করে নিউজফিডটা চেক করতেই যাচ্ছিল দীপ্ত তখনই দোকানে তার প্রবেশ।হালকা নীল সালোয়ার,চোকে চশমা;মুখে রাগ,দুঃখ,ঘৃণা মেশানো এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি আর চোখে হালকা জলও বোধহয় দেখতে পেল দীপ্ত
“কাকু এক প্লেট চিকেন জলদি” -ঝাঁঝিয়ে কথাটা বলেই দীপ্তের উল্টোদিকের টেবিলে প্রায় ওর মুখোমুখি বসলেন তিনি।রাগের চোটে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেললেন।মোবাইলটাও ভালোই জোরে টেবিলে পড়ল।চশমাটা খুলে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল।দীপ্ত এরকম জীবনে দেখেনি তাই মোবাইলটা নিয়ে বিজি হওয়ার ভান্ করে কানটা খাড়া রাখল..
“এই নাও ভাই তোমার নরমাল”-বলে কাকুটা গরম মোমোটা জাস্ট রেখেছিল আর তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাত
-“কী হলো আমি আগে দিতে বললাম তো”- আবারও ঝাঁঝিয়ে উঠলেন তিনি।দোকানদারও কি বলবে বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করে কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন কি তখনই
-“আমার টেবিলে আগে চাই ব্যাস”
-“এ কী গুন্ডা মেয়ে রে বাবা,গরম মোমো সামনে সাজানো,আমার এতদিনের স্বপ্ন এটা খাওয়া আর ইনি কিনা খেতে দেবেন না?আজব তো!!”- মনে মনে ভাবল দীপ্ত কিন্তু ওই মনে যা ভাবে দীপ্তের মতো ছেলেদের মুখ দিয়ে তো তার এক কণাও বেরোও না।তাই শান্তিপ্রিয় দীপ্ত বলল
-“ঠিক আছে কাকু ওনাকেই আগে দিন আমারটা না হয় পরেই দেবেন”
-“হ্যাঁ তাই আমাকেই আগে দেবেন”বললেন তিনি
কথা না বাড়িয়ে তাই মাথা নামিয়ে ফোনেই বিজি হয়ে গেল দীপ্ত।
যথা সময়ে দুজনের টেবিলেই হাজির হলো মোমো।”আহা! এ যেন অমৃত”- মনে হলো দীপ্তের।খাওয়ার সময় অন্য দিকে নজর দেওয়াটাকে অভদ্রতা মনে করে দীপ্ত তাই একমনে খেতে খেতে তার কথা ভুলেই গেল দীপ্ত…
মোমোটা শেষ করে ভাবছে আর এক প্লেট খাবে কিনা আর তখনই উল্টোদিকের টেবিলে চোখ হেল দীপ্তের।অমন ধোঁয়া ওঠা চিকেন মোমো আর স্যুপ নেতিয়ে পড়ে আছে মুখেও দেননি ম্যাডাম একটাও।আর ইনিই কিনা একটু আগে ওর আগে মোমো খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে পারছিলেন না।এভাবে খাবার নষ্ট করাটা একদম পছন্দ করে না দীপ্ত।কেন “খাবার বলে কি মানুষ না নাকি?কত লোক খেতে পায় না আর এভাবে পয়সা দিয়ে কিনে কিনা নষ্ট করবে”ভাবল দীপ্ত।কিন্তু ওই ভীতু তো কিছু বলতেও পারছে না।
তাই হাত ধোয়ার নাম করে কলের কাছে গিয়ে ভালো করো আয়নায় দেখল এখনও দুহাতে মাথা ঢেকে বসে আছে।ফেরার পথে কী যে হলো দীপ্তের বলেই ফেললো
-“ম্যাডাম ঠান্ডা হয়ে গেল যে”
-“তাতে আপনার কোনো প্রবলেম”
এমনটা আশা করেনি দীপ্ত তাই সামলে নিয়ে বলল
-“না আপনি যেভাবে বললেন একটু আগে মনে হলো খুব ক্ষিদে পেয়েছে আপনার।কিন্তু এভাবে ফেলে রাখলেন একটাও মুখে দেননি…,তাই আর কি”
– “বেশ করেছি দিইনি আর আপনাকে কে বলেছে যে আমার ক্ষিদে পেয়েছে?আর আপনি এতো গায়ে পড়া কেনো বলুন তো।আমি আপনাকে কিছু বলতে গেছি?”
-কথাটা শুনেই ভালো মানুষ দীপ্তের আত্মসম্মানে লেগে গেল বোধহয় বলল-“দেখুন ম্যাডাম আমি আপনার গায়ে পড়িনি এভাবে টাকা দিয়ে খাবার কিনে নষ্ট করলে আমার খুব খারাপ লাগে, আপনি জানেন আমাদের দেশে কত মানুষ এখনও ঠিকমতো খেতে পায়না।আপনার পয়সা আছে বলে এভাবে খাবার কিনে নষ্ট করবেন এটা ঠিক নয়”
কথাটা বোধহয় একটু জোর গলাতেই বলে ফেলেছিল দীপ্ত।কথাটা শুনেই একটু আগের সেই গুন্ডা মেয়েই কিনা ভ্যা করে কেঁদে দিল
-“কেস করেছে” – এমনটার জন্য একদমই তৈরী ছিল না দীপ্ত।ওরও সব গুলিয়ে গেল কি করবে বুঝতে পারল না।
-” আমি খাবার নষ্ট করিনি জানেন ও আমাকে ঠকালো তাই মন ঠিক করতে খেতে ঢুকেছিলাম,কিন্তু পারছি না খেতে স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে”-কাঁদতে কাঁদতেই বললেন তিনি
দীপ্ত বুঝল জন্ডিস কেস।উল্টোদিকের চেয়ারে বসে তাই বলল-“দেখুন কাঁদবেন না।জীবন যেমন অনেক কিছু দেয় তেমন কিছু হারিয়েও যায়,মেনে নিতে হয়,নইলে সামনে এগোনো যায় না।আমি সরি আসলে বুঝতে পারিনি”
-“না না ঠিক আছে আপনি কি করে জানবেন দোষটা আমারই,আমি মানুষকে খুব তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করি আর বারবার ঠকি”
-“না না দেখুন মানুষকে বিশ্বাস করটা খারাপ না,ওটাই তো মনুষ্যত্ব,নইলে বলুন তো আজকের পৃথিবীতে কটা মানুষ অন্য মানুষকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে পারে??”
-“হুম্”
-“আর হুম্ হুম্ করতে হবে না চোখদুটো মুছে খেয়ে নিন নইলে খাবার পাপ দেবে”
-বলতেই লক্ষী মেয়ের মতো উঠে গিয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে এলো রিয়া আর তখনই ভালো করো দীপ্তের চোখ আটকালো। কোথায় গুন্ডা? হালকা কাজল,চোট্ট টিপ আর গোলাপী ঠোঁট।দীপ্তের সব তালগোল পাকিয়ে গেল যেন।
-“হাই আমি রিয়া;আপনি?”
-“আমি??”
-“হ্যাঁ আপনি নয়তো আবার কে?”
-“ওহ্ হ্যা,আমিই তো,আমি মানে দীপ্ত”
-“ইস্ দেখুন পুরো ঠান্ডা হয়ে গেছে।কাকু একপ্লেট গরম দাও না গো প্লিজ্ আর ওনাকেও এক প্লেট”
-“এই না না আমি তো এইমাত্র খেলাম”
-“আর খান তো,একদিন দু প্লেট খেলে কিছু হবে না।আর দেখুন আমি মোমো খেতে ভালোবাসি,আজ আপনি আমার মোমো খাওয়ার সাথী হলেন তাই এটা আমার তরফ থেকে ট্রিট।না না কোনো কিন্তু না চুপচাপ খেয়ে নিন”
-বাইরে ততক্ষনে অফিসের ভিড় আর কোচিং ছুটির ভীড় কিন্তু দীপ্তের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।তার তখন “মন্ মে ‘মোমো’ ফুটা” এর মতো অবস্থা।
-১৫ মিনিট এর মোমো ট্রিট যে কখন ১ ঘন্টা হয়ে গেছে খেয়ালই করেনি দীপ্ত।রিয়ার কথায় সম্বিত ফিরল -“চলুন আজ উঠি; অনেকটা দেরী করে দিলাম আপনার”
-“না না ঠিক আছে”- বলে উঠল দীপ্ত
-দোকানে বিল মিটিয়ে বাইরে এলো রিয়া।দীপ্তের ইচ্ছে করছিল যেন সময়টা থমকে যায়।কিন্তু তা তো হওয়ার নয়।তাই বুকে পাথর চাপা দিয়ে দীপ্ত বলল-“আজ তবে চলি,পরে কোথাও দেখা হবে” বলে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিতেই যাচ্ছিল আর তখনই
-“শুনুন”
-“হ্যাঁ বলুন”
-“০১৭********* এটা আমার নাম্বার সেভ করে নিন এরপর থেকে যেদিনই মোমো খেতে যাবেন আমায় ডাকবেন কিন্তু”
-“আচ্ছা ঠিক আছে জিও এর নাম্বার?আমি মিসডকল দিয়ে দিলাম সেভ করে নেবেন।”
-ফোনের রিংটোনটা খুব মন ছুঁয়ে গেল দুজনের
“তুমি রবে নীরবে
হৃদয়ে ‘মম’!!!………….
……………………………………………………সমাপ্ত……………………………………………….