“এই রূপা!” ডাক শুনেও রূপা দাঁড়ালো না, দিব্যি হেঁটে চললো।
“রূপা, আমি সরি। আর কক্ষনো এসব বলবো না।” মনে মনে হাসলো রূপা। কী বোকা ছেলে! ভালবাসার কথা বলে এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। রূপা
হাঁটার গতি বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি একটা রিকশা ডাকলো। রিকশায় উঠে দেখে রাকিব অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে আছে। সেটা দেখে তার খারাপই লাগলো। কারণ সেও রাকিবকে ভালবেসে ফেলেছে। রাকিব আজ ক্লাস শেষে ইউনীভার্সিটির অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল। রূপা পাশ কাটিয়ে যাবার সময় সে বলেছিল, “রূপা, আই লভ ইউ!”
রূপা মনে মনে বলেছিল, “আমি জানি।” কিন্তু মুখে বলল, “কী! এত সাহস তুমি কোত্থেকে পাও বলো তো?” রাকিব তখন থেকেই রূপাকে সরি বলা শুরু করেছে। কিন্তু নির্বিকার রূপা। সে অভিনয় করে পরীক্ষা করছে রাকিবকে যে, সে রূপাকে কতটা ভালবাসে।
বাসায় ফিরে রূপা, রাকিবকে ফোন দিলো। রাকিব ধরতেই বলল, “আমায় ভালবাসো?”
“রূপা, তুমি ফোন দিয়েছো? বিশ্বাস হচ্ছে না।”
“বাজে কথা ছাড়ো। যা বললাম তার উত্তর দাও।”
“হ্যা, ভালবাসি।”
রূপা নিশ্চুপ।
রাকিব বলে, “আমার মতন কে আছে বলো বাসবে তোমায় এত ভাল?”
“সিনেমার ডায়ালগ ছাড়ো।”
“ও তুমি সিনেমাও দেখো। জানতাম না তো।”
“জানলে কী করতে?”
“সিনেমা হলে নিয়ে গিয়ে তোমার সাথে প্রেম করতাম।”
“ইডিয়ট!”
“গালি দাও.. খুব করে গালি দাও।
তোমার এই ইংরেজিতে গালি দেবার
স্টাইলটা না জোশ।”
“তুমি গিরগিটির মত রং বদলাও…. আই কান্ট বিলিভ ইউ।”
“কী করেছি বলো তো?”
“সেদিন রিমার সাথে অত হেসে হেসে কথা বলছিলে কেন?”
“কী আমি! আরেকবার শুনি?”
রূপা বিরক্ত হয়ে হেয়ালী করে বলে, “রাকিব।”
“আহা, এভাবে নাম ধরে ডাকলে সারাটাজীবন তোমার দাস হয়ে থাকবো কথা দিচ্ছি।”
“কী করছো রাকিব?”
প্রশ্ন শুনে আৎকে ওঠে সে। কারণ সে তখন বন্ধুদের নিয়ে মদ খাচ্ছিল।
“কী করছি.. উমম কোক খাচ্ছি। রূপা, আমি পরে কথা বলছি? বাই।”
লাইন কেটে দেয় রাকিব। হঠাৎ এভাবে লাইন কাটায় রূপার ভ্রু কুঁচকে যায়।
এদিকে রাকিবের বন্ধু সোহাগ বলে, “দোস্ত, কে রে ফোনে ছিল?”
“রূপা।”
“তোর ক্লাসমেট রূপা?”
“হুম।”
“হুম খুব জোশ কিন্তু মেয়েটা।”
রাকিব ওর মাথায় গাট্টা দিয়ে বলে,
“নজর দিও না.. অন্যখানে গিয়ে মেয়ে খোঁজো।”
একদিন বিকালে…
পার্কে বসে আছে রূপা আর রাকিব।
রূপা বলল, “এই তুমি মদ খাও?”
“না!”
“সোহাগের কাছে শুনলাম তুমি মদ খাও।”
“সোহাগকে কীভাবে চেনো?”
“ও সেদিন তোমার বন্ধু বলে পরিচয় দিয়ে আলাপ করলো।”
“ও আচ্ছা।”
গম্ভীর হয়ে যায় রাকিব। রূপা বলে, “এরপর যদি এসব শুনি তাহলে কিন্তু ব্রেক-আপ।”
সেই মুহূর্তে লজ্জিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার রইলো না রাকিবের।
সন্ধ্যায় কফি হাউজে আড্ডা মারার জায়গাতে গিয়েই সোহাগের গায়ে হাত তুললো রাকিব। বন্ধুরা তো অবাক।
কারণ জিজ্ঞাসা করতেই রাকিব বলল,
“ওকে মেরে ফেলব আমি! আমার প্রেমটাকে রাক্ষসের মত গিলে খেতে চায় ও!”
এই বলে আবারও হাত চালাতে যাবে তখন বন্ধুরা কোনোমতে আটকালো।
সোহাগ মার খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “বন্ধু! তোর ভাল করতে চাইলাম এই তার প্রতিদান দিলি? তুই মদ খেলে রূপা কষ্ট পাবে
তাই তুই যাতে মদ খাওয়া ছেড়ে দিস সেজন্যই আমি রূপাকে এসব কথা বলেছি।”
এটা শুনে রাকিব আরও রেগে গেল। বলল, “এখন সাধু সাজো? নাটের গুরু হয়ে সন্দেশ খাও, না? সব তোদের প্ল্যান।
আমি প্রেম করছি তো তোদের সহ্য হচ্ছে না। জানিস, ও আজ ব্রেক-আপ করবে বলেছিল।”
সোহাগ হাসার চেষ্টা করে বলে, “ধুর বোকা! মেয়েরা কি এত সহজে ব্রেক- আপ করে? তারা যখন সত্যিকারের প্রেমে পড়ে তখন অনেক দূরদর্শী হতে শিখে যায়। তার প্রেমে একটা জোরালো বন্ধন তৈরি হয়।”
কিন্তু কথাগুলো আমলে নিলো না রাকিব। বলল, “আজ থেকে তোদের সাথে আমার সম্পর্ক শেষ! আর কখনোই আমাকে তোরা পাবি না।” এটা বলেই সে চলে গেল।
এদিকে রূপার সাথে তার প্রেম চলছে। সোহাগ ও তার বন্ধুরা তখন সত্যিই আলাদা ছিল ওর থেকে। এভাবে দু’মাস গড়ালো। একদিন রূপা বলে, “রাকিব, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।”
রাকিবের মাথায় হাত। অনেক ভেবেচিন্তে তারা পালাবার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু থাকার জায়গা খুঁজে পেল না। বাড়িতে এলে রাকিবের বাবা অনেক বকাঝকা করে
তাদের মেনে না নিয়ে তাড়িয়ে দিলেন। এরপর হঠাৎ পথ দিয়ে যাবার সময় সোহাগের সাথে দেখা। ততদিনে রাকিবের রাগ কমে এসেছে। সে সব ঘটনা খুলে বলতেই সোহাগ হেসে বলে, “আরে ধুর, এটা কোনো ব্যাপার হল নাকি? আমার মামা-মামী ছয়মাসের জন্য ইন্ডিয়ায় গেছেন। তাদের বাড়িটা খালি পড়ে আছে। তুই সেখানে উঠে
পড়।”
“কিন্তু চলবে কীভাবে?”
“রিযিকের মালিক আল্লাহ্। আমরা বন্ধুরা এই ছয়মাস তোদের জন্য ব্যবস্থা নেব।”
রাকিব খুব একটা ভরসা পাচ্ছিলো না। কিন্তু এই মুহূর্তে এরচেয়ে ভাল উপায়ও ছিল না। সোহাগের মামার বাড়িই শেষপর্যন্ত তাদের ঠিকানা হল। এরপর মাসে মাসে বন্ধুরাই খরচ দিতে লাগলো। এভাবে তিনমাস কাটার পর রাকিব নিজেই কোচিং আর টিউশনি খুঁজে নিলো। শুরু হল মোটামুটি গোছানো জীবন। একদিন কোচিং
থেকে ফেরার পথে তার ফোনটা বেজে ওঠে। রূপার ফোন। সে রিসিভার কানে নিয়ে বলে, “হ্যালো।”
রূপা উদ্বেগ নিয়ে বলে, “তুমি কোথায়। জলদি এসো। আমি মারা যাচ্ছি।”
“কী হয়েছে রূপা।” ওপাশটা নীরব।
“রূপা!” নিশ্চুপ!
বাসায় এসে রাকিব, রূপার নিশ্চল দেহ আবিষ্কার করে। সে তাড়াতাড়ি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তার জানায় রূপার ব্রেইন টিউমার ধরা
পড়েছে। অপারেশন করতে হবে। পাঁচ লাখ টাকা খরচা লাগবে।
রাকিব অসহায়ের মত তার শ্বশুরবাড়ি গেল, সব জানালো। কিন্তু তার শ্বশুর কোনো আবেগ দেখালো না, বরং একরকম তাড়িয়ে দিলো। রাকিব তার বাবার কাছে গেল। সেখানেও একই পরিস্থিতি। শেষ সম্বল বন্ধুরা। সব শুনে সোহাগ বলে, “ধুর ব্যাটা, পাঁচ লাখ কোনো ব্যাপার?”
শুরু হলো টাকার জন্য ছুটাছুটি। ফেসবুকে পেইজ খুলে বিজ্ঞাপন… পত্রিকায় সাহায্যের আবেদন.. সবাই নিজেদের যা সামর্থ্য তা থেকে কিছু দিলো—
এভাবে এক সপ্তাহে পাঁচলাখ ম্যানেজ হবার পর অপারেশন হল রূপার। সে সুস্থ হবার পর রাকিব, সোহাগকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়। বলে,
“তোরাই আমার আপনজন। তোদেরকে আমি ভুল বুঝেছিলাম। আমায় তোরা ক্ষমা করে দে।”
বন্ধুরা সকলেই এই আবেগঘন মুহূর্তে একটু একটু করে চোখের জল ফেলল। অদূরে দাঁড়িয়ে রূপা সেই দৃশ্য দেখতে লাগলো আর মনে মনে বলল, “অটুট থাকুক এ বন্ধন।”