আজকে টিউশনি টা তাড়াতাড়ি শেষ হয়েছে হৃদয়ের। মনটা ভীষণ ভালো ;২-৩টা টিউশনির টাকা একবারে আজকে পেয়েছে…! এমনি তেই মাসের প্রায় শেষ দিক এ সময় পকেটে টাকা পয়সা একদম থাকেনা বললেই চলে … না থাকাটাই স্বাভাবিক ;পুরো মাস শেষ হবার আগেই সব টাকা এদিক ওদিই পাওনা পরিশোধ করতে করতেই শেষ হয়ে যায়;তার মধ্যে এমন সময় এ টাকাগুলো পাওয়া ;এ যেন সোনায় সোহাগা।
.হৃদয় ছেলেটা জন্মগতভাবেই এতিম..!ও কে? ওর বাবার কে কিংবা তাদের পরিচয় কিছুই জানেনা সে।শুধু এতটুকুই জানে ওকে নাকি এক মহিলা ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পেয়েছিলো! ওকে দেখে নাকি মহিলাটির অনেক মায়া হয় কিন্তু কথায় আছেনা” পরের বিপদ নিজের ঘাড়ে কে নিতে চায়?”ঠিক সেই রকমই ছিলো ব্যাপারটি! মহিলাটি ওকে পাশের এক এতিমখানায় রেখে দিয়ে চলে যায়।সেই থেকে ওই এতিমখানা টাই হয়ে উঠে ওর আবাসস্থল!! নাম ছিলোনা কোনো ;ওইখানের কোনো এক ভদ্র লোক /মহিলা হৃদয় নামটা দেয় ;সেই থেকেই ছেলেটা হৃদয় নামে পরিচিত।
ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলো হৃদয়।পড়ালিখার প্রতি একটা ঝোক ছিলো কিন্তু এতিমখানা তো;অখানে কি আর পড়ার পরিবেশ থাকে নাকি?? এই পৃথিবীতে যেখানে ওর জন্যে বেচে থাকা ~~একটা আবাসস্থল পাওয়া ~~তিন বেলা খাবার পাওয়া এক পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার ;সেখানে আবার পড়ালিখা!!
এতিমখানা টির লোকগুলো ভালো ছিলো :ওদের নিরন্তর সহযোগীতা আর নিজের অক্লান্ত চেস্টায় আজ ও ঢাকা মেডিকেল এর স্টুডেন্ট। পার্থক্য টা হলো ও এখন আর সেই এতিমখানা টায় থাকেনা ;”বড় হয়েছি ;আর তাদের ঋণের বোঝা বাড়াতে চাইনা;পড়ালিখা করেছি ~~সেই পড়ালিখার কি লাভ যার প্রতিফলন বাস্তব জীবনে হয়না?আমার কোনো ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে সম্ভব হলে মাফ করে দিবেন”’এরকরম সাত পাচ বলে একদিন বের হয়ে আসে সেখান থেকে হৃদয়!!
বন্ধুদের ও এলাকার কিছু বড় ভাই দের সাহায্যে কিছু টিউশনি পায় আর মেডিকেলের ওইদিকের এক মেসে উঠে পড়ে ছেলেটা।নিজের খরচ নিজেরই চালাতে হয়;বই কিনা কাপড় কিনা ;ঢাকার রাস্তাঘাটে চলা শুধুমাত্র টিউশনির টাকায় হয়না তাই ছোটখাটো একটা কাজ করে। এভাবেই কাজ+টিউশনি +পড়ালিখা করতেই কেটে যায় ওর দিন।
মাঝে মাঝে এতিমখানা টায় যায় দেখা করতে ;লোকগুলোর খোজ খবর নিতে। ব্যাস এইতো ওর জীবন!!
.
.যাইহোক আজকে কিন্তু ও বেশ খুশি মাসের এসময় টাকা পাওয়া নেহাতি ভাগ্যের ব্যাপার!!
.
.-মেসের সেই ঐতিহাসিক খিচুড়ি খেতে আর ভালো লাগেনা। যেহেতু সাথে টাকাও আছে আর রাত ও হয়ে এসেছে আজকে না হয় ভালো কোনো এক হোটেল থেকে খেয়ে যাই অন্তত একটা দিন ভালো করে খাওয়া যাবে। এই ভেবে একটা মধ্যস্তরের হোটেলে ঢূকে ওয়েটারকে ডাক দিলো
.
..
—-এক্সকিউজ মি ভাই!!
.
—-জি স্যার বলুন কি খাবেন??
.
—ইয়ে মানে রাতে খাবার কি কি আছে??
.
ওয়েটার খাবারের মেনুর এক ভাষণ হৃদয় কে শুনিয়ে দিলো আর এগুলোর মধ্যে কি খাবে তা জানতে চাইলো
.
.
হৃদয় পকেটের টাকার দিকে একবার চোখ বুলালো ;এই টাকাগুলো দিয়েই ওকে পূরো মাস চালাতে হবে তাই কোনো আজে বাজে খরচ করা যাবেনা..
.
.–এসব খাবারের মধ্যে আপনার মতানুযায়ী সব থেকে সস্তা যে খাবার সেটা নিয়ে আসেন ভাই ওইটাই খাবো
.
.
ওয়েটার যাচ্ছিলো ওর কথানুযায়ী খাবার আনতে এমন সময় ও পিছন থেকে আবার ডাক দিলো
.
.
–ভাই শুনেন
.
—বলুন স্যার আরওও কিছু অর্ডার করবেন??
.
—না আমি শুধু এটা জানানোর জন্যে ডাকলাম যে আপনি আমাকে যে খাবারের ম্যেনু শুনালেন সেগুলোর একটা খাবার তো দুরের কথা নামও শুনিনি কখনো সেই জন্যে আপনাকে বলেছি আপনার পছন্দানুযায়ী খাবার নিয়ে আসুন কিছু মনে করবেননা
.
.–আচ্ছা স্যার
.
.
অতঃপর খেয়ে দেয়ে বিল চুকিয়ে হৃদয় হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লো
.
.রাত তখন গভীর হওয়া শুরু করেছে.. নির্জন ঢাকা তখন তার রাতের রুপ ধারণ করা শুরু করেছে…কেউ মানুক বা না মানুক রাতে ঢাকার রাস্তাগুলোর আসল সৌন্দর্য রাতে প্রকাশ পায়…
.
.
.দুই পাশের ল্যাম্পপোস্ট এর আলো ;দুই ধারের সারিঘেরা গাছের মাঝখানের সেই চিকন ফুটপাতে হৃদয় হাটছে…! পাশের রাস্তায় যানবাহন চলছে। গন্তব্য মেস।
.
.
–মনে মনে গান বলতে বলতে পকেটএ দুইহাত দিয়ে হেটে যাচ্ছিলো হৃদয় এমন সময় পিছন থেকে একটা বিকট স্বরে ডাকার আওয়াজ পেলো। পেছনে তাকিয়ে দেখে একটা মেয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে হাপাচ্ছে।খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে ”আ..উউউ….ইইই…..অওঅঅ”এরকম অক্ষরে কিছু একটা বলতে চাইলো মেয়েটি আর হাত দিয়ে দৌড়ে আসার পথের দিকে ইশারা করে কাদতে লাগলো।
.
.
.
—কিচ্ছু বুজতে না পেরে ”এই মেয়ে কি বলছো তুমি কিচ্ছু বুঝতেসিনা…স্পষ্ট করে বলো কি বলবে??”
.
.মেয়েটি আবারো ইশারা + সেই বিকট শব্দ একইরকমভাবে করতে লাগলো
..
.
.বিরক্ত হয়ে…. ”শোনো মেয়ে যা বলবে ভালো করে বলো ;বলতে সমস্যা নাকি ;এতরাতে রাস্তায় কি করছো;ধুর আমিই বা কেন দাঁড়িয়ে এই ন্যাকা মেয়ের কথা শুনছি ;বলেই যেতে লাগলো হৃদয়
.
..
মেয়েটা ওর হাত ধরে বসলো
.
.–কি করছো মেয়ে তুমি??হাত ছাড়ো; আজব তো!!চেনা নেই জানা নেই অচেনা অজানা মেয়ে তুমি.. আমার হাত ধরছো কেন??(হৃদয়)
.
.
—মেয়েটা আবার কাদতে লাগলো… এদিক ওদিক কি যেন খুজতে লাগলো মেয়েটা একটা খোয়া পেল(ইটের টুকরো বিশেষ) হুট করে সেটা তুলে নিলো কাছের কোনো এক দেয়ালে হৃদয় কে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো আর হৃদয় কে ত্থামিয়ে দেয়ালে একে একে লিখা শুরু করলো…..
.
.
:”আমি নীলা! আমি পালিয়ে এসেছি ওদের থেকে ”
.
.হৃদয় পূরও অবাক!! কি বলছে মেয়েটা!! আচ্ছা তোমার বাসা কোথায়??
.
.মেয়েটা কম্পিত হস্তে আবার লিখলো ”আমি উত্তরা থাকি ”
.
.এই মেয়ে তুমি এভাবে লিখে বলছো কেন??মুখে মুখে বললেই তো পারো ;লিখে বলার প্রয়োজন নেই
.
.মেয়েটা এরপর যা লিখলো তা দেখে বড় মায়া হলো হৃদয় এর ~~মেয়েটি বোবা তাই লিখে মনের ভাব প্রকাশ করছে..
.
.এখন তো বেশ রাতও হয়ে গেছে… এতো রাতে তুমি কোথায় যাবে.. আর কেনো পালিয়ে এসেছো তুমি??
.
.
.ইটের টুকরো তখন শেষ হয়ে গেছে আর লিখতেও পারছেনা চোখে মুখে ব্যাকুলতা…
.
.
হৃদয় ঘটনা টা বুঝতে পেরে নিলাকে বললো :’:আচ্ছা সমস্যা নেই ;কালকে বলিও কেমন? আমার মেসে তো মেয়ে allowed না তাই তোমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া যাবেনা ;আজকের রাত টা এখানেই পাড়ি দিতে হবে আমার মনে হয়..
.
.
.মেয়েটা স্বস্তির। নিঃশ্বাস ফেললো… চোখ মুখ দেখে মনে হয় সারাদিনে কিছু খায়নি….একজন মানুস হিসেবে ওকে জিজ্ঞেস করলাম। ”কিছু খাবে”।মেয়েটি মাথা নাড়ালো আসে পাশে যা পেলাম নিয়ে এসে ওকে দিলাম মেয়েটা খেলো
।
.
.সেই দিনের রাতটি কোনো রকমে অচেনা সেই অপরিচিতা নিলাকে নিয়ে রাস্তার ধারের সেই যাত্রী ওয়েটিং সীট এ কাটিয়ে দেয় হৃদয়!!
.
.
.সকালে মেয়েটাকে ডাক দিলাম!! মেয়ে আমার হাতের স্পর্শ পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো….
.
.
কাছের একটা ষ্টেশনারী শপ থেকে একটা খাতা আর একটা কলম কিনে ওর সামনে দিয়ে বললাম.. :’তোমার পূরো পরিচয় এখানে ঠিক ঠাক দাও…!!
.
.
দীর্ঘ ৩০মিনিট লিখার পর মেয়েটা আমাকে পূরো খাতাটা দিলো…..
.
.আমি আস্তে আস্তে পড়তে লাগলাম… অনেক বড় ইতিহাস সং ক্ষেপে বলি…
.
.”মেয়েটি নিলা ;থাকে উত্তরা খালার বাসায় ;ও বোবা কথা বলতে পারেনা ;ওর খালা ওকে পাচার করতেরতে চেয়েছিল এ কথা কোন এক উপায়ে জানতে পেরে সে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে…. লাস্টে লিখেছে :’আমাকে সেখানে দয়া করে পাঠা বেননা আর ওতো রাতে আপনাকে ছাড়া আর কাউকে দেখিনি তাই আপনার সাহায্য চেয়েছি আমাকে দয়া করে একটা সেফ জায়গায় পৌছে দিন…!!
.
.
.
—কিছুক্ষন চিন্তা করলাম তারপর ওকে নিয়ে সোঝা এতিমখানা টায় গেলাম আপাতত মেয়েটা ওইখানেই থাকবে।
.
.
.সপ্তাহে ২-৩বার যেতাম মেয়েটাকে দেখতে!! মনে হয় আমার জন্যেই অপেক্ষা করে মেয়েটা.. কখনো কাপড় কখনো ফল ফলাদি নিয়ে যেতাম শুধু ওর জন্য না পুরো এতিমখানার বাচ্চাদের জন্যে…
.
.
.ওসব আনতে অনেক কস্ট হতো কিন্তু কিভাবে জানি কাকতালীয় ভাবে ম্যানেজ হয়ে যেত। দেখতে দেখতে অনেক দিন কেটে গেলো
.
.
এতদিনে ওই মেয়ের প্রতি হৃদয় এর মায়ার জন্ম হয় হয়ত এটা মায়া নয় ভালোবাসা!!যা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়
.
.মেডিকেল শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সে নিলাকে বিয়ে করবে
.
.
.মেডিকেল শেষ করে আজ হৃদয় একজন বিশিষ্ট ডাক্তার! আল্লাহের রহমতে টাকা পয়সা সব আছে.. সে অবশেষ এ নীলাকে বিয়ে করে!! এবং পরিক্ষা করে জানা যায় নিলার ভোকাল কর্ড সমস্যা :;তা অপারেশন করে নিরাময় করা সম্ভব!! এক সময় নিলাও সেরে উঠে! এখখন সে কথা বলতে পারে!!
.
.আর ওদের কোল জুড়ে আসে এক কন্যা হৃদয় নিলার নাম নিয়েই ওদের নাম হয় ”রোদেলা”
.
.শেষ হয় এক বোবা মেয়ের সাথে এতিম ছেলের প্রেম কাহিনী