পিছুটান ২

পিছুটান ২

আবার কখন নিজ শহর ঢাকাতে ফিরবো কল্পনাও করি নি।আসার তেমন একটা ইচ্ছেও ছিলো না। এত বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে কি হবে যদি সেই লেখা পড়া কোন কাজেই না লাগাতে পারলাম।আসলে চাকুরীর জন্যই এই ঢাকাতে আবার আসা। আট বছর পর ঢাকায় ফিরছি কত কত যে স্মৃতি আছে সেখানে, হয়তো গুনেও শেষ করা যাবে না।আসলে ছোট থেকেই তো ঢাকাতেই ছিলাম মাঝে একটা ঘটনার জন্য ময়মনসিংহ চলে আসি, আসতে চাই নি বাদ্ধ হয়ে ছিলাম।
.
এই মময়মনসিংহে নিজেকে মানিয়ে নিতে আমার অনেকটা সময় লেগেছিলো। আমার দেহটা এখানে থাকলেও মনটা ঢাকাতেই পরে থাকতো।আমার বাড়ি স্কুল কলেজ আত্নীওস্বজন বন্ধু বান্ধোব সবই তো ঢাকাতেই। বিশেষ করে বিথি আর সোহানকে তো কখনই ভুলতে পারিনি।ভুলবো কি করে এ দু’জন যে আমার আত্মতার সাথে মিশে আছে।
জীবনে এমন কিছু মুহুর্ত থাকে বা এমন কিছু মানুষ থাকে যাদের চাইলেই মন থেকে মুছে ফেলা যায় না।আমিও পারিনি পুরোপুরি মুছে ফেলতে আমার অতীত।
আমার অতীত এখন আমাকে পিছু টানে।
না হলে আট বছর পরে এসেও কেনো বিথি আর সোহানকে ভুলতে পারি নি?,কেনো আজ ঢাকা যেতে হবে শুনার পর থেকে ওদের মনে পরছে?
মাঝে মাঝে এই প্রশ্নবোধক কেনো গুলা আমাকে পাগল করে তুলে।
.
এখানে আসার পরে একবারের জন্যও ওদের সাথে যোগাযোগ করি নি।করতে যে চাই নি ঠিক তা না।মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হত ছুট্টে চলে আসি ওদের কাছে। এসে সেই আগের মত তিন জনে একসাথে সময় কাটাই আড্ডা দেই।কিন্তু তত দিনে পরিস্থিতি সময় অনেক কিছু বদলে দিয়েছে।সময়ের ব্যবধানে আমি অনেক দূরে চলে এসেছি যেখান থেকে চাইলেই মনের ইচ্ছেমত সবকিছু করা যায় না।
এগুলা এখন একটা চাপা কষ্টভরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই না।
.
ঢাকায় এসেছি আজ প্রায়ই একমাস। ভালোই কাঁটছে সময়।নতুন অফিস, নতুন সব মানুষ জন।নতুন করে পুরনো জায়গা চেনা মন্দ লাগছে না।এত ব্যস্ততার মধ্যেও নিজেকে মাঝে মাঝে বড্ড একা লাগে ! এত কিছু থেকেও দিন শেষে কাজ করে ঘরে ফিরলে মনে হয় আমার কিচ্ছু নেই।
.
শুক্রবার অফিসের ঝামেলা নেই। কি করবো বুঝতে পারছি না।সবসময় ব্যস্ত থাকতে
থাকতে এমন একটা অভাস্য হয়েছে যে এখন ব্যস্ত থাকতে না পারলে কেমন জেনো মনমরা মনমরা লাগে। ঘরে বসে বোর হতে ইচ্ছে করে না।তাই রেডি হয়ে বেড়িয়ে পরলাম, গন্তব্য জানি না।যেখানে চোখ আটকাবে সেখানে কিছুটা সময় কাটাবো।আর এত দিন পর পুরনো জায়গাতে এসেছি একটু ঘুরে দেখি সব আগের মত আছে, নাকি সময়ের স্রোতে পুরনো সব ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
একা মানুষ কেউ চিন্তা করবে বলে বাসায় ফিরার তাড়া নেই।
.

বাবা মা অনেক বলেছিল বিয়ে করে নিতে রাজি হইনি। বেশ তো আছি একা!
হাঁটতে হাঁটতে সেই পুরনো জায়গাতে এসে ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠল।সেই বট গাছটা এখন আছে ! কত স্মৃতি আছে এখানে।
মুহুর্তেই অতীতে হারিয়ে গেলাম চোখের সামনে বিথি মায়া সোহানের হাঁসি খুশি মুখ গুলো ভেসে উঠল।মনে হচ্ছে সেই আগের মতই ওরা এখানে ছুটাছুটি করছে।আমিও অতীতের বিথি মায়া সোহানের সাথে হেসে উঠি।পাশ থেকে বাচ্চাদের খেলনার পে পু শব্দে অতীতের ঘোর কাটলো।
কি অদ্ভুত অতীত এখন আমাকে পিছুটানে!
.
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত পাশে বেঞ্চে বসে চশমাটা খুলে আচল দিয়ে কপালের ঘাম মুচ্ছিলাম,মনে হচ্ছে কেউ পাশ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! পাশে তাকাতেই দেখি একটা চাঁদের মত ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! দেখেই মনটা ভরে গেলো।আমি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম।ও ওমুচকি হাসলো।আমি পার্স থেকে মুঠোফোন বের করে একটা ফোন করে আবার ফোনটা পার্সে রেখে দিয়ে ওই মেয়ের দিকে তাকাতেই দেখি এখন মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।ওর তাকানো দেখে হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকলাম ও মাথা নেড়ে না করলো।আমি বলাম কেনো?
– পাপা(বাবা) বলেছে এখানে চুপটি করে বসে থাকতে না হলে হাড়িয়ে যাবো।
– ওহ আচ্ছা তাহলে আমি আসি?
– ও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।আমি আমার বেঞ্চ থেকে উঠে ওর বেঞ্চে ওর পাশে গিয়ে বসলাম।
কি মায়া মাখানো মুখটা। ইচ্ছে করছে জরিয়ে বুকে টেনে নেই।ওর পাশে বসে বললাম তোমার পাপা কোথায়?
– আইসক্রিম আনতে গিয়েছে।
– তোমার জন্য?
– হুম।
– তুমি আইসক্রিম পছন্দ কর?
– হেসে বলে হুম অনেক।
– আমিও অনেক পছন্দ করি।
– তুমি তো বড়, বড়রা আইসক্রিম খায় নাকি?
– হুম খায় তো।
– কই আমার পাপা তো খায় না।
– হা হা তাই নাকি?
– হুম।
– আচ্ছা তোমার নাম কি গো?
– ও দাঁত বের করে হেসে বলে সাবা।
-ওর পোকায় খাওয়া দাঁতে দেখে আমিও হেসে বললাম বাহ্ খুব সুন্দর নাম তো তোমার! তুমি তোমার নামের মতই মিষ্টি।বলে নাকের ডগা ধরে আলতো করে টেনে দিলাম।
– হুম জানি
– অবাকের ভান করে কি ভাবে জানো?
– আমার পাপা বলে আমি খুব মিষ্টি দেখতে।
– হা হা তোমার পাপা একদম ঠিক বলে।
– আচ্ছা তোমার নাম কি?
-আমার নাম?
– হুম
– আমার নাম মায়া।
– তোমার নামও খুব সুন্দর।
– ওলে বাবালে।এমন মিষ্টি একটা বাচ্চা কে কি দেওয়া যায় ভেবেই পার্সে হাত ঢুকালাম।কিছুক্ষণ খুজার পর দুটা কিট কেট চকলেট পেলাম। অফিসের এক ছোট বোন দিয়েছিলো ওর ভাইয়া বিদেশ থেকে আসাতে।আমি চকলেট খাইনা তাই এত দিব পার্সেই পরেছিল।যাক আজকে একদম ঠিক কাজে লেগেছে।সাবা তো চকলেট পেয়ে মহা খুশি।
– এগুলা আমার?
– হুম তোমার।
– তাহলে তোমাকে আমি কি দিবো?
– তুমি আবার আমাকে কি দিবে!
– ও বেঞ্চের উপর উঠে গুটি গুটি পায়ে আমার কাছে এসে আমার গলা জরিয়ে ধরে গালে চুমু দিলো।আমি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে ওকে বুকে জরিয়ে নিয়ে ওর গালে কপালে একাধিক চুমুতে ভরিয়ে দিলাম।
ও চুপকরে আমার বুকের সাথে লেগে ছিলো।
কেনো জানি ওকে খুব আপন মনে হচ্ছে।একটা অদ্ভুত ভালো লাগা ভিতরে কাজ করছিল।
.

হঠাৎ সাবা বলে উঠল ওইযে আমার পাপা এসে পরেছে।পাপা দেখ ওই আন্টিটা আমাকে এই চকলেট গুলো দিয়েছে।
আমি সাবার বাবার সাথে কথা বলার উদ্দেশ্য পিছনে ঘুরতেই চমকে উঠলাম।
সোহান ! এটা সোহানের মেয়ে!
সোহানও আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভাবে নি আবারো
এমন করে দেখা হয়ে যাবে।
আমি পার্সটা হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম। পিছন থেকে সোহান ডাকছে।
– মায়া দাড়াও মায়া?
– আমি আরো দ্রুত হাঁটতে লাগলাম।কারন সোহানকে ফেস করার মত সাহস আমার নেই।ও আজ আমাকে অনেক প্রশ্ন করবে যার কোন উওর আমার কাছে নেই! কি করে ওর সামনে দাঁড়াবো? কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না সোহান দৌড়ে আমার সামনে এসে
– মায়া জাস্ট স্টোপ ইট! মায়া মায়া বলে ডাকছি শুনতে পাচ্ছ না?
– আপনি ভুল করছেন আমি মায়া না।
– কি তুমি মায়া না?
– না।
– তাহলে আমাকে দেখে পালাচ্ছিলে কেনো?
– আমি চুপ।
– আমি জানি তুমিই মায়া, কেনো নিজেকে লুকাচ্ছো? তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে।
– আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই।প্লিজ আমার রাস্তা ছারুন।
– কেনো করছো আমার সাথে এমন? সেদিন কিছু না বলে চলে গিয়েছিলে, কোথায় কোথায় পাগলের মত খুজেছি তুমি জানো? কিন্তু কোথাও পাইনি।
– যে ইচ্ছে করে হাড়িয়ে যায় তাকে কখন খুজে পাওয়া যায় না সোহান।
– তাহলে সিকার করছো যে তুমি মায়া?
– আমি শুধু অশ্রুভরা দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে ছিলাম।
– সোহান আমার হাত ধরে বলে কত দূরে হারিয়ে ছিলে, একটি বারও কি আমাকে মনে পরেনি? একটি বারও কি জানতে ইচ্ছে করেনি আমি কেমন আছি?
– মৃদু হেসে আমি জানতাম তোমরা ভালো আছো সুখে আছো তাই আর খোজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি।আবারো এমন করে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি।
– হুম আমিও ভাবিনি
– কেমন আছো তোমরা তুমি বিথি?
– হুম ভালো।
– আর এটা তোমাদের মেয়ে?
-সোহান সাবার দিকে তাকিয়ে ওকে কোলে নিয়ে বলে হুম এটা আমার মেয়ে।
– ভারি মিষ্টি দেখতে একদম বিথির মত।
– হুম।
– আচ্ছা বিথি কোথায় ওকে তো দেখছি না?
– মুখটা ম্লান করে বলে বিথি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে।
– মানে!
– সাবাকে আমার কোলে তুলে দিয়ে ও অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছে।কথাটা বলে সোহান বড় একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো।
.
কথাটা শুনে খুব বড় একটা ধাক্কা খেলাম। স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ লাইফও বিথি আর আমি ছিলাম আত্মার আত্মা। আমরা যতটা না বন্ধু ছিলাম তার থেকে বেশি বোনের মত থাকতাম।একজন অন্য জনের সুবিধা অসুবিধায় হুমড়ি খেয়ে পরতাম।খাওয়া দাওয়া উঠা বসা লেখা পড়া এমনকি হস্টেলেও একি সাথে থাকতাম।ভার্সিটিতে যখন প্রথম উঠি তখন থেকে সোহানের সাথে আমাদের পরিচয় হয়।এর পর থেকে যা করতাম তিনজন মিলেই করতাম। ধীরে ধীরে সোহানের সাথে আমার রিলেশন ডিপ হতে থাকে।দু’জন দু’জনকে পছন্দ করলেও সোহানি আগে আমাকে প্রপোজ করে।যেহেতু আমিও ওকে পছন্দ করতাম তাই ওর প্রপোজ টা একসেপ্ট করে নেই।তারপর থেকে বিথিকে না জানিয়েই ঘুরতে যেতাম মুভি দেখতাম শপিং একসাথে খাওয়া দাওয়া সবই করতাম। আমি বিথিকে না জানিয়ে কিছুই করি না আর ও ওআমাকে সব কিছু সেয়ার করত।
তাই যেদিন আমাদের দ্বিতীয় বর্ষের রেজাল্ট দিলো সেদিন ওকে সব বলি।
.
ও শুধু চুপচাপ আমার কথা শুনে চলে যায় হস্টেলে। আমি কয়েকবার পিছু ডেকে ছিলাম ওকে কিন্তু কোন শাড়া না দিয়ে চলে গেলো।
ঐদিন বিকেল পর্যন্ত সোহানের সাথে ঘুরে হস্টেলে ফিরে দেখি বিথি বালিশে মুখ গুজে শুয়ে আছে।আমি গিয়ে ডাকতেই উঠে বসলো খেয়াল করলাম ওর চোখ মুখ ফোলা।জিজ্ঞাস করলাম কি হয়েছে? জবাবে বল কিছু না এমনি ভালো লাগছে না।আমি সাথে সাথে ওর কপালে হাত দিয়ে বললাম জ্বর এসেছে নাকি?
বিথি আমার হাতটা ওর কপাল থেকে নামিয়ে দিয়ে বললো না।
আমি আর কিছু বললাম না তবে এটা তো সিউর যে ওর কিছু একটা হয়েছে।কিন্তু যাই হক বড্ড জেদি মেয়ে ও একবার যখন বলেছে কিছু হইনি তারমানে এই মুহুর্তে ওর মুখ থেকে একটা শব্দও বের করা যাবে না।তাই আর জোর করলাম না।
.
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি এখনও ওর মন খারাপ।হস্টেল থেকে ক্যাম্পাস খুব একটা দূর না আমরা হেটেই চলে যাই।কিন্তু আজ বিথি আমাকে রেখেই আগে আগে হাঁটছে।
রাস্তা টা কোনমতে শেষ করে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই বিথির হাত ধরে আড়ালে নিয়ে এলাম।কি হয়েছে তোর?কাল থেকে মন খারাপ করে আছিস ।এমন কি হয়েছে যেটা আমাকেও বলতে পারছিস না?
– কিছু না।
– ওহ বলবি না তাই তো আচ্ছা বলিস না আর কখন জিজ্ঞেস করবো না।বলেই হাঁটতে লাগলাম।
– মায়া দাঁড়া বলেই আমাকে ধরে কান্না শুরু করে দিলো।
– ওর কান্না দেখে আমি খালিকটা অবাক হলাম এমন কি হয়েছে যার জন্য কাঁদছে ও। চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম কি হয়েছে, কেউ কিছু বলেছে? শুধু বলে দেখ একবার কি করি।
– কেউ কিছু বলে নি।
– তাহলে কি হয়েছে?
– তোর কাছে একটা জিনিস চাইবো দিবি মায়া?
– হা হা শুধু এই কথা। তুই চাইবি আর আমি দিবো না এমন কিছু আছে নাকি? বোকার মত কাঁদছিস।
-না মায়া এই জিনিসটা একদম অন্য রকম।
– কিন্তু তোর থেকে দামি না। বল তুই
– আমতা আমতা করে আমার দুহাত ধরে বলে সোহানকে আমায় দিয়ে দিবি মায়া আমি ওকে খুব ভালোবাসি।
– ওর হাত থেকে আমার হাত সড়িয়ে না বোঝার হাসি দিয়ে বললাম কি বলছিস তুই!
– সত্যি বলছি আমি সোহানকে খুব ভালোবাসি।
– কিন্তু সোহান তো আমাকে ভালোবাসে।
– তুই এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যা। তুই না থাকলে আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে ওকে আমার করে নিবো।প্লিজ মায়া….
– ও অঝরে কাঁদছে আর আমাকে বলছে।এরপর কি বলবো আমি, কি বলা উচিৎ আমার? সত্যি বুঝতে পারছিনা।আমার হাত পা হিম হয়ে আসছিলো বাকরুদ্ধ অবস্থায় আমি দাড়িয়ে আছি। একদিকে আমার ভালোবাসা একদিকে আমার বন্ধুত্ব কোন দিকে যাবো আমি?
– জানতাম তুই এটা আমাকে কখনই দিবি না।বলা যতটা সহজ করা ঠিক ততটাই কঠিন
– কথা গুলো বলে কাঁদতে কাঁদতে বিথি চলে গেলে।আমি হাটু মুরে মাটিতে বসে পরলাম।
বুকটা ফেটে কান্না আসছিলো।
.
ঘন্টা খানেকের বেশি ওখানে বসে থেকে ধীরে ধীতে হস্টেলের দিকে হাঁটতে লাগলাম।হাঁটার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছি।মনে হচ্ছে পায়ে কেউ শিকল পরিয়ে দিয়েছে। একবার সোহানের সাথে কাটানো সময় গুলো মনে পরছে একবার বিথির সাথে সেই ছোট বেলা থেকে কাটানো সব স্মৃতি মনে পরছিলো। ধীরে ধীরে হস্টেলে এসে পৌছালাম,সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দেখি আমাদের রুমের সামনে অন্য রুমের স্টুডেন্টরা ভির জমিয়ে আছে।ওদের দেখে চোখটা ভালো করে মুছে স্বাভাবিকের ভান করলাম।কিন্তু আমাদের রুমের সামনে এমন ভির কেনো?
অনেক কৌতুহল নিয়ে সবাইকে সরিয়ে রুমের ভিতরে ঢুকে দেখি বিথি চেয়ারে নিচু হয়ে বসে আছে।সুমি আপু বলছে এমন পাগলামি কেউ করে আজ আমি না দেখলে কি হত বলতো?
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ চোখটা উপরের দিকে তুলতেই দেখি ফ্যানে উড়না বাধা!
বুঝতে আর কিছুই বাকি রইলো না।সাথে সাথে ওর হাত ধরে চেয়ার থেকে তুলে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পর লাগিয়ে দিলাম ওর গালে।ও ওর গাল ধরে আমার দিকে তাকিয়ে কেঁদে দিলো।আমার আর বিথির সম্পর্ক কেমন সেটা সুমি আপা খুব ভালো করেই জানতো তাই সুমি আপা রুম থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে সেও চলে
গেলো।
– কিরে মরতে গিয়েছিলি? নিজের কথা তো ধুমধাম করে বলে এলি আমার কথা শুনার প্রয়োজনও মনে করলি না।
– কি শুনবো তোর কথা? আমি জানি তুই কখনই আমার কথাটা রাখতে পারবি না।
– যদি বলি পারবো।
– কি?
– হুম, আমি সোহানকে ভালোবাসি বিশ্বাস কর খুব ভালোবাসি। আর তোকেও খুব ভালোবাসি।
তোরা দুজন যদি একে অপরের সাথে ভালো থাকিস তাহলে এতেই আমি খুশি।
তুই ঠিকি বলেছিস আমি না থাকলে সোহান ঠিকি একদিন না একদিন তোকে আপন করে নিবে ভালোবাসবে।
– তুই সত্যি বলছিস?
– হুম একদম সত্যি ।
.
বিথি খুশিতে আমাকে জরিয়ে ধরে কাঁদছিলো আমিও কাঁদছিলাম পার্থক্য শুধু এই যে ও ওর ভালোবাসার মানুষটাকে পেয়ে কাঁদছিলো আর আমি হারিয়ে।তখন মনে হচ্ছিলো কেউ আমার কলিজাটা ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে।শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিলে।সেই রাতে সব ঠিক করে সকালের আলো ফুটতেই ময়মনসিংহ চলে যাই নানা বাড়িতে।পুরো রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে গিয়েছিলাম। কষ্ট গুলোকে আপন করে চলে যাই, কারন নিজে সব কষ্ট সহ্য করতে পারবো কিন্তু আমার জন্য বিথি আত্মহত্যা করবে এটা কখনই মানতে পারবো না।
তাছাড়া আমি সোহানের সামনে থাকলে ও কখনই বিথিকে একসেপ্ট করতো না।
তাই চলে গিয়েছিলাম।
.
-কি হলো কষ্ট পাচ্ছো?
– সোহানের ডাকে অতীতের ঘোর কাটলো। ঘোর কাটতেই চোখের পানি মুছে সাবাকে দুহাত দিয়ে জরিয়ে কোলে তুলে নিলাম।আজ বিথিকে বড্ড মিস করছি।
– জানো বিথি যেদিন আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলো সেদিনো তোমার কথা বলেছে।
ওবলেছে পারলে যেনো পাফ করে দাও তুমি।
– প্লিজ সোহান এসব বলো না। আমি কখন ওর উপর রাগ অভিমান করি নি মাফ করার প্রশ্নই উঠেনা।
– থ্যাংস।
– হুম সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে এখন যেতে হবে।
– ওহ হে খেয়াল করিনি।
-আসি সোহান ভালো থেকে।
– হুম তুমিও।
– আমার কোল থেকে সাবাকে সোহানের কোলে দিয়ে চলে আসছিলাম।
– মায়া একটা কথা বলি?
– হুম বলো?
– কালকে একটু দেখা করতে পারবে?
– কেনো?
– তেমন কিছু না একটু গল্প করতাম।
– না আমার সময় হবে না।
– মৃদু হেসে সময় ঠিকি হবে কিন্তু তোমার ইচ্ছে করছেনা তাইনা?
– না তেমটা না কিন্তু…..
– প্লিজ…. প্লিজ!
– তোমাকে এতটাই ভালোবেসে ছিলাম যে এখন তোমার চোখে চোখ রেখে তোমার কথা ফেলতে পারি না(মনে মনে) কোথায় দেখা করবে?
– যে ক্যাফেতে আট বছর আগে বসে গল্প করতাম আড্ডা দিতাম সেখানে।
– ওকে।বলে চলে এলাম।
.
আজ রাতটা বারবার আমাকে আট বছর পিছনের দিনটাতে নিয়ে যাচ্ছে।নীরঘুম রাতটা পার করে সকালে অফিসে চলে এলাম।সাড়াদিন কাজ করে বিকেলে সেই ক্যাফেতে পৌছালাম।কাজ করতে করতে একটু দেড়ি হয়ে গিয়েছে। ক্যাফেতে গিয়ে দেখি সোহান আগে থেকেই বসে আছে সেখানে।
আমাকে দেখে ও মুচকি হাসলো আমি যেয়ে ওর বরাবর টেবিলের উপর হাত রেখে বসলাম।
– কেমন আছো? (সোহান)
– ভালো,তুমি?
– হুম আমিও ভালো।কি খাবে বলো?
– আমি কিছু খাবো না।
– কিন্তু আমি যে কফির অর্ডার করলাম তোমার ফেবারিট কফি।
– এখনও মনে রেখেছো?
-হুম কিছু বিষয় ভুলা ঠিক না।
– কি বলবে বলে ডেকেছো বলো?
– বলবো কিন্তু তোমার বর কোথায় পরিচয় করিয়ে দিবে না আমার সাথে?
-বর?
– হুম
– হা হা….
– হাসছো কেনো!
– বিয়েই করিনি বর আসবে কোথা থেকে?
– মানে তুমি এখন বিয়ে করনি?
– না।
– কেনো?
– একটা মানুষকে খুব ভালোবেসে ফেলে ছিলাম হয়তো তাই।
– তোমার হাতটা দেখি?
– কেনো বলে হাত মুষ্টিবদ্ধ করেনিলাম।
– দাও না দেখি বলেই সোহান ওর হাত দিয়ে আমার হাতটা টেনে ওর কাছে নিয়ে আমার হাতের আংটি দেখিয়ে বলে এখন আমার দেয়া আংটি টা পরে আছো? আমার হাতটা ওর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলাম।হুম
– কেনো?
-সেদিন তোমার এটা পরিয়ে দেওয়া মিথ্যা ছিলো না আর আমার পরাটাও মিথ্যা ছিলো না হয়তো তাই।
– তাহলে আমাকে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলে কেনো?
– যাওয়াটা খুব প্রয়োজন ছিলো।
– কি এমন প্রয়োজন ছিলো
– স্যার আপনাদের কফি, আর কিছু লাগবে স্যার?( ওয়েটার)
– না তুমি যাও।
– ওকে স্যার।
– সাবাকে আননি?
– না অফিস থেকে সরাসরি এখানে এসেছি তবে ও চলে আসবে।
– চলে আসবে মানে?
– কাল তোমাকে দেখার পরথেকে শুধু তোমার কথাই বলছে। রাতেও বায়না করেছিলো তোমার কাছে যাওয়ার জন্য কিন্তু আমি তো তোমার বাসা চিনি না। তাই আজ তোমার সাথে ওকে মিট করাবো বলে ড্রাইভার কে বলে এসেছি সাবাকে নিয়ে আসতে।
– কখন আসবে ও?
– ওই তো চলে এসেছে।
– ও দৌড়ে আমার কাছে এসে বলে মায়া মা!
– মামনি আমি আন্টি হই তোমার মা না।
– না তুমি মা হও।
– মায়া আমিও চাই তুমি সাবার মা হও।
– সোহান তুমিও!
– হুম আমিও।
– না এটা হয় না।
-কেনো হয়না?
– কারন বিথির জায়গাতে আমি কখনই নিজেকে বসাতে পারবো না। বলেই চলে আসছিলাম।
পিছন থেকে কেউ আচল টেনে ধরলো।ফিরে তাকাতে দেখি সাবা আচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে
কাঁদো কাঁদো সুরে বলে
আমার মাম্মাম হয়ে যাও না। সবার মাম্মাম আছে আমারি মাম্মাম নেই! আমাকে কেউ মাম্মামের মত আদর করে না। আমার গলা ধরে বলে প্লিজ আমার মাম্মাম হয়ে যাও…….
আমি সোহানের দিকে তাকাতেই
আমার হাত সোহানের হাতে উপর দিয়ে বলে ইয়েয়য়…… আমি আমার মাম্মাম পেয়ে গেছি।
আমার গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু একে দেয়।আমি খানিকটা লজ্জা পেয়ে সোহানের হাত থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে সাবাকে কোলে নিয়ে চুমু দিতেই সোহান আমাকে আর সাবাকে একসাথে জড়িয়ে ধরলো।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত