১
অনেকদিন ভোর দেখা হয় না।রাতের অন্ধকার গহবরে মনে হয় সব কিছুই আজকাল হারিয়ে যাচ্ছে।অহন আকাশের দিকে তাকালো।
হাজার হাজার তারা মিটমিট করে জ্বলছে।থোকা থোকা মেঘ চারপাশে।আজকাল রাতে তার ঘুম হয় না।
আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে ইচ্ছে করেনা।সব কিছুই পানসে লাগে…কড়া চায়ে ডুবানো চুপশে যাওয়া টোষ্ট বিস্কুটের মত।
অন্ধকারের এই হাহাকার দেখতে দেখতে সে বড্ড ক্লান্ত।মানুষের জীবনে যখন প্রাপ্তির পাল্লাটা খুব বেশি ভারী থাকে তখন স্বপ্নগুলো কেন যেন মরে যেতে থাকে।
মরে যেয়ে এতটাই পঁচে যায় যে, তাদের শেষ অস্তিত্ব পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় না।আনমনে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে অহন।
এখন শুধু আগামীকালের ভোর দেখায় অপেক্ষা।
শহরের শেষ প্রান্তের পাহাড়ের মত উঁচু এই জায়গাটা খুব অদ্ভুত।দূর থেকে দেখলে মনে হয় একটা ঘুমন্ত বৃদ্ধ মানুষের মুখ।
সবাই যেন তাই এই পাহাড় কে “বুইড়া পাহাড়” বলে ডাকে।এলেবেলে মেটে মেটে পথ।
কতগুলো বাচ্চা খেলতে এসে এর সবচেয়ে উঁচু চূড়ার কাছে ইট দিয়ে একটা বেঞ্চির মত করে দিয়েছে।অহন হালকা চালে হেটে আসতে থাকে।
সময় কতই বা হবে এখন?ভোর ৪টা বা সাড়ে ৪টার মত।গোটা শহরটা যেন হালকা কুয়াশার চাদর পরে আছে।মৃদু ঠান্ডা বাতাস।
সারা রাত না ঘুমানোর ক্লান্তিতে অহনের চোখ জড়িয়ে আসে।তবুও সে ইটের সেই বেঞ্চিতে বসে নিশ্চুপ হয়ে থাকে।
খুব ছোটবেলা থেকে সে আর কিছু চিনুক বা না চিনুক অর্থ খুব ভাল করে চিনেছিল।তারপর আর পিছনে ফিরে তাকানো হয়নি।
যখন তাকানো হয়েছে তখন অবাক হয়ে অহন আবিস্কার করেছে এত অর্থ দিয়ে সে কি করবে তা সে ঠিক করতে পারছে না।
তার বন্ধু নেই,প্রেমিকা নেই,পরিবার নেই।পৃথিবী নামক অদ্ভুত এই গ্রহতে সে একা।তারপর থেকে আর নিজেকে খুঁজে পায়না অহন।
বাসায় থাকলে দম বন্ধ হয়ে আছে।মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে কোন ভালবাসার মানুষের হাত দুটি খুব শক্ত করে ধরে দেখতে।
অহন জানে এমন কিছুই হবেনা।কোন এক অদৃশ্য জালে সে আটকে গেছে।অনেক শক্ত অভেদ্য এক জাল।
আকাশটা হালকা হতে শুরু করেছে।নাম না জানা কিছু পখি তারস্বরে ডাকতে ডাকতে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়।অহন চমকে যায়।
ঘোর কাটে একটু ওর।কয়েক গজ দূরে একটা ঝাপসা আবছায়া দেখে ও দ্বিধান্বিত হয়।কি এইটা!!নিজের অজান্তেই বিড় বিড় করে উঠে সে।
একটা মেয়ে হ্যা…সামনের লম্বা কিছু ফারগাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে।লম্বা চুল মাথায় ঘোমটার মত করে স্কার্ফ বাঁধা।
অহন চোখ কচলায় এই ভোরে এইখানে তো কারো আসার কথা না।কোন মেয়ে তো ভুলেও এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত এই পাহাড়ে আসেনা।
অহন ভাল করে তাকায়…একহারা গঠনের একটা মেয়ে,চেহারা দেখা যাচ্ছে না…অনেক দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
বাতাস আসছে বাতাস যাচ্ছে…মেয়েটার স্কার্ফ একটু একটূ উড়ছে…মেয়েটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আর সব চেয়ে ভয়ঙ্করভাবে চোখে পরছে মেয়েটার নির্বিকার ভাব।অহন অবাক হয় একটু…পৃথিবীতে কত মানুষ আছে।কত অদ্ভুত এদের জীবন।
আজকে সে কষ্ট আর হতাশা থেকে পালাতে চলে এসেছে।আর ঠিক তার সামনেই আরেকটি মানুষ,আরেকটি স্বত্তা ঠিক যেন তেমনি একটা কষ্ট নিয়ে এসেছে।
অহন আর ভাবতে চায় না।পূবে সূর্যটা উঁকি দিয়েছে।মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে এখনো…অহন বাড়ির পথে পা বাড়ায়।তার মাথা ব্যথা করছে।ঘুমানো দরকার।
২
ঘরের ছোট্ট গ্রীলের জানালায় ২টা চড়ুই পাখি কিচির মিচির করছে।এক ফালি রোদ এসে জানালার পাশটা উষ্ণতায় ভরিয়ে দিচ্ছে।
কিচির মিচির শব্দে অহনের ঘুম ভাঙ্গে।তাকিয়ে দেখে একটা চড়ুই কেমন যেন আলাদা হয়ে মাথা তুলে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।
সাথে সাথে মনে পরে অহনের ভোরবেলায় দেখা সেই মেয়েটির কথা।সব কিছুই তার অবিশ্বাস্য লাগতে থাকে।
মনে হয় হেলুসিনেশান ছিল,কিন্তু তবুও সারাদিন সে মেয়েটির কথা মাথা থেকে বের করতে পারে না…
নিজের অজান্তেই অপেক্ষা করে আগামীকালের ভোরের জন্যে।রাত ফুরালেই অহন মন্ত্রমুগ্ধের মত করে সেই ঘুমন্ত বুড়োটে পাহাড়ের চূরায় চলে যায়,
এবং চমকে যেয়ে দেখে মেয়েটি ঠিক আগের মত করেই দাঁড়িয়ে আছে।অহন সেই বেঞ্চিতে স্থির হয়ে বসে থাকে।
আজও মেয়েটার চুলে স্কার্ফ আছে,নীলচে স্কার্ফ,হালকা বাতাসে তা উড়ছে…অহন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।হঠাৎ মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।
অহন অদ্ভুত এক আকর্ষনে তাকিয়ে দেখে মেয়েটি চেহারা অন্যরকম মায়াময়,চোখগুলো ভীষন বিষন্ন।
ভোরের হালকা আলোয় যেন মেয়েটি চেহারা থেকে দুত্যি বের হয়ে আসছে।মেয়েটি বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।তারপর চোখ নামিয়ে চলে যায়।
এরপরের দিন গুলোতে অল্প অল্প করে এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে অহন।রাতে ভালো ঘুম হয়না তার,ভোর হলেই ছুটে যায় পাহাড়ে।
ইটের বেঞ্চিতে বসে থাকে।ধোয়াশায় চারপাশ মৃদু একটা চাদরের প্রলেপ মেখে থাকে।
একটু একটু করে চিনে নেয় সে মেয়েটি কে… “লানা” তার নাম,খুব কম কথা বলা মানুষ।নিজের ব্যাপারে কিছু বলতে চায় না সে।
শুধু মাঝে মাঝে অহনের পাশে বসে ধোয়াটে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।অহনের বুকের মাঝে মাঝে লানার জন্যে অদ্ভুত মমতা কাজ করে।
অহন এর মনে হয় তার যেন লানা ছাড়া কেউ নেই।প্রতিটি ভোরের সূর্যাস্থ একসাথে দেখা ওদের নিত্যদিনের কাজ হয়ে যায়।
রাত ফুরালেই অহন ছুটে যায়।মাঝে মাঝে হাতে করে লানার জন্যে নিজের বাগানের কাঠগোলাপের তোড়া বানিয়ে নিয়ে যায়।
লানার একটা হাত ধরে কালচে আকাশে রঙ বদলাতে দেখে।এভাবেই স্বপ্নময় দিনগুলো কাটতে থাকে।অহন যেন নিজের একটা সীমান্ত খুঁজে পায়।
একটা আশ্রয়, একটা মেঘ যা তাকে আগলে রাখবে সর্বদা।
৩
-বাবুসাব,অনেকদিন থেকে একটা কথা বলব ভাবছি,যদি সাহস দেন তো বলি?
অহন কাঠগোলাপের তোড়া সাজাতে সাজাতে তার সবচেয়ে পুরোনো,বৃদ্ধ মালিটির দিকে তাকায়।
-বলো…
-বাবুসাব,অনেক দিন থেকে দেখছি,আপনি প্রতিরাতে ফুল নিয়ে কাকে যেন দেন।ভোরের সময় ঘর থেকে বের হয়ে যান।
আমি মাঝে আপনাকে লয়ে বড় চিন্তায় ছিলাম তাই…তাই…
মালি আমতা আমতা করতে থাকে।
-বলো তুমি কি হয়েছে।অহন একটু থমকে প্রশ্ন করে।
-আপনার পেছনে পেছনে যেয়ে দেখি আপনি বুইড়া পাহাড়ের উপর বইসে একা একা কথা বলছেন।আপনে কি বাবু অসুস্থ?
-একা একা না তো!আমার এক বন্ধু থাকে আমার সাথে।একসাথে ভোরে গল্প করি।
-বাবু কেউ তো ছিলনা।আমি ৩দিন গেছি আপনার পেছনে।ভাবসি আপনি অসুস্থ বলে…বনমালি একটু বিব্রত হয়ে চুপ করে যায়।
অহনের মাথা ঘুরে উঠে।সে কাঠগোলাপের তোড়াটা নিয়ে ঘরে এসে ছটফট করতে থাকে।লানার সাথে দেখা করতে হবে।
সে একা একা কথা বলে এরমানে কি!রাতে ফুরাতেই চায়না।অহন সারা ঘরে পায়চারি করতে থাকে…দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর ভোর চারটা বাজে।
অহন ছুটে যায় লানার কাছে।গিয়ে দেখে চূড়ার কাছে ফারগাছের পাশে কারো লালচে স্কার্ফ উড়ছে না।কেউ নেই।
অহন অপেক্ষা করতে থাকে,কিন্তু লানা আসেনা।অহনের মনে হয় অদ্ভুত কালচে ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে তার পৃথিবী,
সব কিছুই ঘোলাটে…নিজেকে তার নিঃসঙ্গ…বধির…অন্ধ…ও পরিত্যক্ত মনে হয়…যেন পুরো পৃথিবী তাকে নিয়ে তামাশা করছে…
হা হা হা করে অট্টহাসি দিচ্ছে…অহন উন্মাদের মত করে লানা কে খুঁজতে থাকে।কিন্তু আর পায়না।পালাক্রমে দিনের সূর্যদয় আর সূর্যাস্থ হতে থাকে…
অহনের চোখের দৃষ্টি বুনো হতে থাকে…গোলার ভেতর পিন্ড হয়ে কান্না জমে থাকে।সে লানার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে…
কখোনো বা ঘুমিয়ে গেলে স্বপ্ন দেখে…একটা বিশাল উত্তাল সমুদ্রের বালু বেলায় লানা দাঁড়িয়ে আছে…লানার নীলচে স্কার্ফ উড়ছে।
সমুদ্র থেকে গর্জন আসছে।আর ঢেউ এসে লানাকে একটু একটু করে দূরে নিয়ে যাচ্ছে।চারপাশ থেকে মুখোরিত হচ্ছে ফিসফিস করে বলা লানার কথা…
“হয়ত এভাবেই অপেক্ষায় থাকবো… থাকবো সুখ হারা, আমায় দেখে হাসে, ঝরা পাতা, ফুলের পাপড়ি, রৌদ্রধারা…
তবুও বলি ফিরে এসো… না হয় মিছেই ভালোবেসো…”
অহন ঘুমের মাঝেও কষ্টে কোকড়াতে থাকে…চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তার।
শেষ কথাঃ
খেয়ালী লেখকের ডায়েরীটায় এরপর আর কোন পাতা নেই…আমি আতিপাতি খুঁজতে থাকি পরের পৃষ্ঠাগুলো…নেই,কিছুই নেই…পেছনের মলাটও নেই।
আজ সকালে অনেক দিন পর নীলক্ষেতে পুরোনো বইয়ের দোকানে….
কিছু বই বিক্রি করতে যেয়ে হাতে লেখা এই নীল সোনালী মোটা মলাটের ডায়েরীটা দেখে চোখ আটকে যায় আমার।
তারপর বাড়ি এসেই পড়তে বসি।আমি বুঝে উঠতে পারছি না এইটা কি কারো লেখা গল্প নাকি সত্যি কোন এক অহন আর লানার ঘটনা।
অহন বলেকি সত্যি কেউ আছে? অহনের জীবনে লানা বলে কি কেউ ছিলকি? নাকি লানা ছিল অহনের দুর্বল মনে আঁকা কোন প্রতিচ্ছবি।
কাল্পনিক অনুভূতি!!!আমার কেন যেন খুব মন খারাপ হতে থাকে।
অজানা, অচেনা এক অহনের জন্যে আমার বুকের মাঝে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
আমি ডায়েরীর পুরোনো বাদামী হয়ে যাওয়া পাতাগুলোয় হাত বুলাই।
কি যেন ছিল লানার বলা লাইন গুলো- “তবুও বলি ফিরে এসো না হয় মিছেই ভালবেসো…”
হঠাৎ টূপ করে বইয়ের ভাঁজ থেকে একটা শুকনো কাঠগোলাপ মাটিতে পরে যায়।
আমি অবাক হয়ে থাকিয়ে থাকি একটা মরচে পরা, শুকনো, ছোট্ট কাঠগোলাপের দিকে..