কিছুক্ষণ আগে ডাকপিয়ন এসে একটা চিঠি দিয়ে গেছে। প্রেরকের নামটা কথার অপরিচিত। পত্রমিতালী বইতে নিজের নাম ঠিকানা দেবার পর বিভিন্ন জায়গা থেকে অপরিচিত মানুষদের চিঠি আসা শুরু হয়েছে। কথা একেকটা চিঠি খুলে পড়ে আর হাসে। কারও হাতের লেখা ভয়াবহ, কী লিখেছে এখন হয়তো নিজেও পড়ে পাঠোদ্ধার করতে পারবে না। কারও কারও হাতের লেখা মোটামুটি ভালো হলেও অজস্র বানান ভুল থাকে। কেউ কেউ প্রথম চিঠিতেই প্রেম নিবেদন করে বসে। কেউবা আবার আজীবন বন্ধু হয়ে থাকতে চায়।
এখনও একটা চিঠির উত্তরও দেয়া হয়নি। আসলে উত্তর লিখতে ইচ্ছে করছে না কথার। আজকের চিঠিটা এয়ারমেইল খামে এসেছে, ডাক বিভাগের হলুদ খামে নয়। ধবধবে সাদা খাম। বর্ডারে লাল আর নেভি ব্লু রঙের খাঁজকাটা নকশা। ওপরে বিদেশী ডাকটিকেট লাগানো। কথা খুব আগ্রহ নিয়ে খামের মুখ ছিঁড়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করে।
চিঠিটা যিনি লিখেছেন, তার হাতের লেখা সুন্দর। কথা মনে মনে প্রশংসা না করে পারে না। হালকা রুল টানা প্যাডের কাগজে লেখা। রুলের নিচে ফুলের জলছাপ। পত্র প্রেরকের নাম নয়ন। বাবা মারা যাবার পর সে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা না দিয়ে এক চাচার পরামর্শ ও সহযোগিতায় আরব আমিরাতে পাড়ি জমায়। তারপর গত আটটা বছর ধরে অমানুষের মত খেটেছে সেখানে। এই আট বছরে মাত্র দু’বার দেশে আসার সুযোগ পেয়েছে। তার এক রুমমেট এবার দেশ থেকে ফেরার সময় একটা পত্রমিতালীর বই নিয়ে আসে। বইটা ঘাঁটতে ঘাঁটতেই সে কথার ঠিকানাটা পেয়ে যায়।
চিঠির বাকী অংশ জুড়ে তার মায়ের কথা লেখা। মায়ের প্রতি মানুষটার অপরিসীম ভালোবাসা দেখে কথার চোখের কোণে পানি জমে ওঠে। কথার যে মা নেই। সেই ছোটবেলায় মাকে হারানোর পর বাবা তার আদরের মেয়েকে সৎ মায়ের হাতে তুলে দিতে চাননি। এখন কথা বড় হয়েছে, কলেজে পড়ে। বাবার নিঃসঙ্গতাটা বোঝে। ওর নিজেরই তো মাঝে মাঝে খুব একা লাগে। মায়ের আদর যত্ন পায়নি। মনের কথাগুলো ভাগাভাগি করে নেয়ার মত কেউ নেই। সব কথা তো আর বাবার সঙ্গে বলা যায় না।
দুষ্টুমি করে ওরা দু’বান্ধবী মিলে পত্রমিতালীতে নিজেদের নাম ঠিকানা পাঠিয়েছিলো। সেখান থেকে এত সাড়া মিলবে, ওরা তা কল্পনাই করেনি। কথা মনে মনে ঠিক করে রাখে, নয়ন নামের মানুষটার দেয়া চিঠির সে উত্তর পাঠাবে।
দুই.
-………………………………..
-…………………….
নয়ন এ পর্যন্ত চিঠিটা চারবার পড়েছে। হয়তো আরও কয়েকবার পড়বে। চিঠিটা হাতে পেয়ে প্রথমে ভেবেছিলো, মা পাঠিয়েছেন। পরে লক্ষ্য করে দেখে, প্রেরকের জায়গায় অন্য কারও নাম লেখা। প্রথমটায় ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, তারপর সব মনে পড়ে গেছে।
চিঠিটা খুব ছোট করে লেখা। অন্তত নয়ন যেটা পাঠিয়েছিলো সেটার তুলনায় তো বটেই। নয়ন চিঠিটা আবার পড়তে শুরু করে।
জনাব নয়ন,
আপনার পত্রমিতালী হবার প্রস্তাব আমি গ্রহণ করলাম। মায়ের প্রতি আপনার অপরিসীম ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়ে আপনার চিঠিটার উত্তর লিখছি। আমার নিজের মা নেই, তাই মা না থাকার কষ্টটা আমি বুঝি। আপনি লিখেছেন, গত আট বছরে মাত্র দু’বারের জন্য দেশে এসেছেন। কেন? যে মায়ের জন্য বিদেশ বিভূঁইয়ে এত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছেন; টাকা পয়সা জমাচ্ছেন; সেই মানুষটাই যদি একদিন আর না থাকে, তখন এই টাকা পয়সা দিয়ে কী করবেন? আপনার উচিৎ, বৃদ্ধ বয়সে মায়ের পাশে থাকা। এই কয় বছরে টাকা পয়সা যা জমিয়েছেন, তা দিয়ে কি দেশে ফিরে কিছু একটা করা যায় না?
কিছু মনে করবেন না, ছোট হয়ে অনেক বড় বড় কথা লিখে ফেললাম। এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত মতামত। লিখেছেন সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেন, তাই খাওয়া দাওয়াটা ঠিকমত করবেন। তা নাহলে শরীর ভেঙে পড়বে। লেখার মত আর কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি চাইলে আবারও লিখতে পারেন। ভালো থাকবেন। শুভকামনা রইলো।
– ইতি
কথা
তিন.
-………………………………………….
-………………………………
চিঠির উত্তর পড়ে কথা হেসেই কুটি কুটি। ও কেন নয়ন নামের মানুষটাকে জনাব বলে সম্বোধন করেছে, সেটা নিয়ে মানুষটা বেজায় মন খারাপ করে বসে আছে। আরও লিখেছে, সে নিজেও কয়েকমাস যাবৎ দেশে ফিরে আসার কথা চিন্তা করছিলো। এ বছরটা পার হলেই ব্যাংকে জমানো টাকাগুলো তুলে নিয়ে দেশে পাড়ি জমাবে।
রাতে খাবার পর নিজের ঘরে এসে চিঠির উত্তর লিখতে শুরু করে কথা।
★ ★ ★
নয়নের সাথে কথার পত্রমিতালীর বয়স সাত মাস হতে চললো। চিঠি আদানপ্রদান করতে করতে কখন যে দু’জনার মনটাও চিঠির সঙ্গে আদানপ্রদান করে ফেলেছে, সেটা তারা দু’জনার কেউই বলতে পারবে না। পত্রমিতালী শুরু করার পরের মাসেই নয়ন তার ছবি পাঠিয়েছিলো। আর কথা তার নিজেরটা পাঠিয়েছে গত মাসে।
এই সাত মাসে দু’জন মিলে অনেক স্বপ্ন সাজিয়েছে। নয়ন দেশে ফিরলেই তার সাথে কথা সংসার পাতবে। ওরা ঠিক করেছে, কথার বাবা আর নয়নের মা দু’জনকে সাথে নিয়ে সবাই মিলে একসাথে থাকবে।
সামনের মাস থেকে কথার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শুরু, তাই ইদানীং চিঠির আদানপ্রদান কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া কথার পরীক্ষা শেষ হতে হতে নয়ন দেশে চলে আসবে।
চার.
——————————
——————–
ব্যবহারিক পরীক্ষাটা দিয়ে বাসায় এসে হাঁফ ছাড়ে কথা। যাক, এতদিনে তার মুক্তি মিলেছে। গত দেড় মাসে নয়নের কাছ থেকে একটা চিঠিও পায়নি কথা। একটু মন খারাপও অবশ্য হয়েছিলো। কারণ পরীক্ষা তো ওর, নয়নের নয়। চাইলে দুয়েকটা চিঠি লিখতেই পারতো। দেশে ফেরার পর এর শাস্তি ওকে পেতে হবে।
বাইরে সাইকেলের বেল শুনে উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দেয় কথা। পোস্টম্যান এসেছে। নিশ্চয়ই নয়নের চিঠি।
চিঠিটা খোলার পর শুরুতেই একটা ধাক্কা খায় কথা। হাতের লেখাটা নয়নের নয়, অন্য কারও।
মিস কথা,
পত্রের শুরুতে আমার সালাম নিবেন। দেশ থেকে আমার নিয়ে আসা পত্রমিতালীর বইটা দিয়ে আপনার সাথে নয়নের পরিচয়। নয়নের মুখে শুনে শুনে আপনার সম্পর্কে জানতে পারি। নয়ন আপনাকে খুব ভালোবাসতো। আপনাকে নিয়ে সংসার সাজানোর স্বপ্ন দেখেছিলো। সে স্বপ্ন তার আর পূরণ করা হয়ে উঠলো না।
গত মাসের ২৯ তারিখে কাজ করার সময় ক্রেন থেকে পড়ে গিয়ে নয়ন মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পায়। হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে প্রচুর রক্তক্ষরণ ঘটে। ডাক্তারেরা তাদের সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু, সবার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে নয়ন ওপারে পাড়ি জমিয়েছে।
আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময় নয়ন আমাকে ওর জমানো টাকাগুলোর ব্যাপারে কিছু নির্দেশনা দিয়ে যায়। ব্যাংকে তার জমানো টাকাগুলোর একটা অংশ নয়ন আপনাকে দিয়ে গেছে। আপনি যত দ্রুত সম্ভব আপনার ব্যাংক এ্যাকাউন্ট নাম্বার এবং সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি আমাকে লিখে জানান। আমি যত দ্রুত সম্ভব পাঠানোর ব্যবস্থা নিবো।
এছাড়া নয়ন আপনার জন্য কয়েকটি দামী শাড়ী, কসমেটিকস এবং বিয়ের কিছু গহণা কিনে রেখেছিলো। সেসব আমি আমাদের এক রুমমেটের মাধ্যমে আগামী মাসে দেশে পাঠিয়ে দিবো। মৃত্যুর পূর্বে নয়নের শেষ ইচ্ছা ছিলো আপনাকে সুখী দেখা। আপনার সুখী জীবনের জন্য শুভ কামনা দিয়ে শেষ করছি। ভালো থাকবেন আর নয়নের জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ্ হাফেজ।
ইতি-
মাহফুজুর রহমান
………………………………………………সমাপ্ত……………………………………………..