বিষন্ন প্রকৃতি;মনে হয় এখনি অঝোরে কাঁদতে শুরু করবে।
প্রতিদিনের মত আজও ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে চিরচেনা জায়গায়টি,যেখানে শুয়ে আছে তার ভালোবাসা।
এমনটাতো হওয়ার কথা ছিল না। প্রতিজ্ঞা করেছিলে কখনো ছেড়ে যাবে; ছেলেটি এসব ভাবছে আর নীরবে চোখের পানি ফেলছে।
ছেলেটির কষ্ট যেন প্রকৃতি সইতে না পেরে তার সঙ্গে কাঁদতে শুরু করলো।
ছেলেটির নাম অাদিত্য। অনেক হাস্যজ্জল ও প্রাণবন্ত একটি ছেলে। যদিও নিজের অাপন বলতে একমাত্র তার এক দুঃসম্পর্কের এক মামা ছিলেন। তিনিও গত হয়েছেন মাস খানেক হলো। বাবা মা গত হয়েছেন অনেক ছোটবেলায়। সড়ক দুর্ঘটনায়। তখন সে অনেক ছোট।
বাবা মা মারা যাওয়ার পর ঐ মামার কাছে মানুষ।
কিন্তু সেও চলে গেছেন তাকে ছেড়ে। মামা মারা যাওয়ার পর সেই মামার বাসায় আর থাকা হয় নি তার।কারণ মামির নিকট সে ছিল উটকো ঝামেলা।
ছেলেটির যদিও কেউ নেই তবুও সে প্রাণবন্ত। দেখে মনে হবে না এর মাঝে কোনো সুপ্ত কষ্ট অন্তরে লালন করছে প্রতিনিয়ত।
যা হোক আসল ঘটনায় আসা যাক।
সেদিন ছিল কলেজের নবীন বরন অনুষ্ঠান । আদিত্য মেয়েটিকে সেদিন প্রথম দেখতে পায়। এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি।
পুরোটা সময় জুড়ে আদিত্য শুধু সেই অপরিচিতাকেই দেখছিল।একবারের জন্য চোখের পলক ফেলেছে বলে মনে হয় না। সেদিনটা এভাবেই কেটে গেলো।
প্রতিদিনের মত আদিত্য বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ সে শুনতে পেলো-
মেয়েটি- এই যে শুনছেন।
আদিত্য চারদিকটা দেখলো হয়তো ভুল শুনেছে ভেবে। আশেপাশে তেমন কেউ নেই সে আর ঐ মেয়েটি ছাড়া।
তাই সে উত্তর করলো-
জি, আপনাকে বলছেন?
মেয়েটি- এখানে আপনি ছাড়া আর কি কেউ আছে।
আদিত্য – না মানে..
মেয়েটি- থাক বলতে হবে না। আচ্ছা কাল আমাকে ঐভাবে দেখছিলেন কেন?
আদিত্য মেয়েটির এমন প্রশ্ন শুনে কি উত্তর করবে ভেবে পাচ্ছে না।
মেয়েটি আবার বলল কি হলো বলুন কেন দেখছিলেন?
আদিত্য কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েই বলল কই না তো। বলেই আর বাসের জন্য অপেক্ষা না করে সে প্রস্থান করলো সেখান থেকে।
আদিত্য ছেলেটি কখনো কোনো মেয়ের আশেপাশে যাওয়ার চেষ্টা করে না। বন্ধু মহলে এরজন্য তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে বন্ধুরা। আদিত্যর বন্ধু ছিল মাত্র ২জুন।
নীল আর আকাশ।
আদিত্যে এমন হওয়ার পেছনে কারণটা হলো তার নাকি মেয়েদের সাথে কথা বলতে লজ্জা লাগে
কিন্তু ঐদিন মেয়েটির সাথে তার কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো কারণ মেয়েটি আর কেউ নয় সেই অপরিচিতা ছিল।
বন্ধু, কলেজ, আড্ডা এসব নিয়েই দিন কাটে আদিত্যর। একদিন নীল, আকাশ ও সে কলেজ মাঠে বসে আড্ডা দিতেছিল তখন আদিত্যের চোখ পড়লো সেই অপরিচিতার দিকে। সে শুধু দেখেই যাচ্ছিলো তাকে।
কখন যে মেয়েটি তার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে
সে বুঝতেই পারে নি।
এই যে আপনি আজও দেখছেন?
আদিত্য হকচকিয়ে চোখগুলো নিচে করে বললো কই না তো।
আমি দেখলাম আপনি বার বার শুধু আমার দিকে তাকিয়েই থাকেন।-( মেয়েটি বললো)
আদিত্য কি বলবে বুঝতে পারছে না। আদিত্যর এমন ভাবভঙ্গিমা দেখে কিছু না বলে চলে গেলো।
এভাবে কেটে গেলো বেশ কিছুদিন।
ও হ্যা আরেকটি কথা মেয়েটিও কিন্তু তার সাথেই পড়ে কিন্তু কথা বলার সাহস হয়ে উঠে এখনো। যার কারণে নামটিও সে জানে না।
সেদিন অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল। যার কারণে কলেজে উপস্থিতি খুব কম ছিল। আর আদিত্যের দুই বন্ধু আসেনি।
সে ক্লাশ রুমে বসে বই পড়ছিল।
এমনসময় তাকে অবাক করে দিয়ে সেই অপরিচিতা এলো
তার সামনে তার এমন ভাব কেন তা জানার জন্য। যদিও সবাই জানে আদিত্য কেন এমন কারণ আদিত্য ক্লাসের প্রথমদিনই তার জীবনের আংশিক ঘটনা সকলকে শেয়ার করছে।
মেয়েটি এসেই বলল আপনি এমন কেন?
আদিত্য তার কথার গুরুত্ব না দিয়ে আনমনে বই পড়েই যাচ্ছে।
মেয়েটি আবারো জানতে চাইলে আদিত্য উত্তর না দিয়ে পারল না। কারণ সে ঐ অপরিচিতাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে ততদিনে।
আদিত্য বলল এমনি।
মেয়েটি কি যেন একটা ভেবে কথা বাড়িয়ে তার ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল বন্ধু হবেন?
আদিত্য কিছু না ভেবেই সেও তার হাতটি বাড়িয়ে দিল।
কলেজের প্রথম দিন থেকেই অনেক মেয়েই বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করছে তার সাথে কিন্তু আদিত্য সংকোচ করতো আর লজ্জা পেত।কিন্তু বর্ষা যখন হাত বাড়িয়ে দিল তখন কেন যেন তার কোনোকিছু দ্বিধা লাগছিল না। অনায়েশে সে হাতটি বাড়িয়ে দিল।
ও হ্যা মেয়েটির নাম বর্ষা।
এখন দিনের বেশির ভাগ সময়টা সে বর্ষার সাথেই কাটায়।
এর কারণ তার অজানা। হয়তো চোখের আড়াল হলে কেউ যদি বর্ষাকে চুরি করে নিয়ে যায় এই ভেবে।
আদিত্য আর বর্ষার বন্ধুত্ব কলেজর সকলের হিংসা করবার মতো।
এদিকে বর্ষাও আদিত্যকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে।
অন্যদিকে আদিত্য তার মনের কথাগুলো না বলে থাকতে পারছিল না। তাই সে ঠিক করলো সে ১৪ই ফেব্রুয়ারীতে তাকে প্রোপজ করবে।
দেখতে দেখতে সময় যখন এসে পড়ল।
আদিত্য আগের দিন কলেজে থেকে ফেরার পথে বর্ষাকে বলে সে যেন কাল একটু আগে আসে।
বর্ষা কেন জানতে চাইলে আদিত্য বলে তার নাকি গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তার সাথে।
বর্ষা ঠিক আছে বলে বাসায় ফিরে। কারণ সে জানে কাল কী; তাই সে মনে মনে অনেক খুশি হয়।
অন্যদিকে আদিত্য ভাবতে থাকে কীভাবে প্রোপজ করবে তাকে,সে রাজী হবে তো?এসব ভাবতে ভাবতে আদিত্য ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন আদিত্য কলেজে গিয়ে বর্ষার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
হঠাৎ তার নজর পড়ে কলেজ গেট দিয়ে কোনো এক অপরূপ রূপসী রমণী তার দিকে হেটে আসছে।
আদিত্য হা করে দেখেই যাচ্ছে।
এমন সময় বর্ষা কাছে এসেই বলে কিরে এভাবে কাকে দেখছিস হা করে।
তোমাকে না মানে তোকে।- (আদিত্য বলল)
বর্ষা- কেন আমায় দেখিস নি আগে??
আদিত্য -আজ তোকে পরীর চেয়েও সুন্দরী লাগছে
বর্ষা খানিকটা লজ্জা পেয়ে বলল কি যেন বলবি বলছিলি
আদিত্য আর কিছু না ভেবে হাটু গেরে হাতে দুটো গোলাম নিয়ে বলতে শুরু করলো-
“যেদিন তোমায় দেখেছিলাম প্রথমবার
হৃদয়ে হয়েছিল মোর তোলপাড়,
ভালোবেসে শেষ সময় অবধি হাতখানা –
ধরার দিবে কি অধিকার। ”
বর্ষা কিছু না ভেবে একদম জড়িয়ে ধরে বলে-
“ভালোবাসি তোমায় প্রিয়তম আমিও,
দিলাম তোমায় আমি আমার হাত ধরার অধিকার। ”
এভাবেই শুরু আদিত্য আর বর্ষার প্রেমকথন।
নিয়ন আলোয় দুজনে হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো, ক্লাস বাঙ্ক করে ঘুরতে যাওয়া,খুনসুটি,ভালোবাসা।
দেখতে দেখতে ৪টি বছর কেটে যায় তাদের সম্পর্কের।
একদিন আদিত্য তাদের দুজনের পছন্দের জায়গাটিতে বসে বর্ষার জন্য অপেক্ষা করছিল। কারণ সেদিন তার অপরিচিতার জন্মদিন ছিল।আদিত্য বর্ষাকে অপরিচিতা বলেই ডাকে।
কিন্তু হঠাৎ আদিত্যের ফোনে আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। কলটি ধরতেই ওপাশে থেকে বলে ওঠে –
আপনি আদিত্য বলছেন।
আদিত্য- হ্যা বলুন
লোকটি – আপনাকে এখনি হাসপাতালে আসতে হবে।
একটি লাশ ভেরিফাই করতে হবে। আসলে ডেট বডির ব্যাগে আপনার নাম্বারটা পেয়েছি তাই আপনাকে ফোন করেছি।
আদিত্য – লাশ!
আদিত্য ভীত হয়ে যায় তার অপরিচিতার কিছু হয় নি তো।
সে বর্ষাকে ফোন দেয় কিন্তু বর্ষা ফোন তুলছে না।
আদিত্যের চিন্তা হতে লাগল।
সে কোনোকিছু না ভেবে সোজা হাসপাতালে চলে যায়।
হাসপাতালে গেলে একজন ওয়ার্ডবয় তাকে একটি বন্ধ অন্ধকার ঘরে নিয়ে যায়।
আদিত্য উদ্দেশ্য করে ওয়ার্ডবয়টি বলে-
দেখুন চিনতে পারনে কি না?
আদিত্য ভয় ভয় করে বডিটি দেখে এবং যা দেখে তার জন্য সে মোটেও তৈরি ছিল না।
স্ট্রেচারে শুয়ে আর অন্যকেউ নয় তার অপরিচিতা
তার বর্ষা। শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে।
আদিত্য জানতে চাইলো কিভাবে এমন হলো?
ওয়ার্ডবয়টি বলল- বাস এবং সিএনজি সংঘর্ষে
আদিত্য কিছু বলছে না। তার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে
পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে।
এরপর আর আদিত্য কিছু বলতে পারে না কারণ সেদিন অঙ্গান হয়েছিল।কিন্তু আদিত্য সেদিনের পর থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।
এরপর থেকেই আদিত্য বর্ষার সমাধির পাশেই থাকে।
কখনো নিজ মনে হাসে, কখনোবা কাঁদে!!
সমাপ্ত
