ভালোবাসা

ভালোবাসা
“হিমু ভাইয়া, কেমন আছেন?” মাজেদা খালার বাসায় এসেছি কিছু সময় আগে। খালুর সাথে নাকি ওনার বেশ কয়েকদিন ধরে ঝগড়া চলছে। বাড়িতে ঝগড়ার ব্যাপারে তেমন কেও জানে না। মাজেদা খালা আমাকে চিঠি মারফত জানিয়েছিল কয়েকদিন আগে। আমার কাছে ছোট বাটন ফোন আছে। যেটা কেবল খুব প্রয়োজন ছাড়া আমি ব্যবহার করি না। মাজেদা খালা বারবার ফোন দিত। ওনার উপর বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম আমাকে চিঠি লিখতে, ফোনে কথা বলা ভালো লাগে না। উনি আমার দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে বলেছিলেন “জায়িন, তোর হাবভাব আমার কাছে কেমন যেন লাগছে। তুই কি পাগল হয়ে যাচ্ছিস?”
ওনার দিকে কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলেছিলাম “আমাকে হিমৃ বলে বলে ডাকতে, জায়িন নামটা ভালো লাগে না। আর শোনো, পাগল হলে তুমি ইতপূর্বেই আমার মাঝে পাগলামো দেখতে পেতে। যারা পাগল হয় তারা পাগল শব্দটা নিয়ে কখনো কথা বলে না। পাগলের খালি বলে ‘বেটা তুই পাগল’।”মাজেদা খালা কথা বলেনি আর। উনি আমার উপর সুরোজ রাগ দেখিয়ে থাকেন। এ জন্য আমাকে ওনার খুব ভালো লাগে। উনি রাগও করে না। আবার রাগ দেখায়। আজব মনে হয় আমার কাছে। আজ বেশ ভোরেই উনি ওনার বাড়ির দারোয়ানের মাধ্যমে আমাকে একটি চিঠি পাঠায়। আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়ে দেখি “জায়িন, তোর খালুর সাথে ঝগড়াটা মনে হচ্ছে অনেক সিরিয়াস হতে যাচ্ছে। তুই একটু বাড়িতে আসবি?” চিঠিটা পড়ে আমি একটু আগেই মাজেদা খালার বাসায় চলে আসি।
দরজা ঠেলে যখন ভিতরে প্রবেশ করবো দেখি কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে খালার মেয়ে জেরিন বাইরে যাচ্ছে। আমার সামনে পড়তেই আমাকে প্রশ্ন করে “হিমু ভাইয়া কেমন আছেন।” মেয়েটার দিকে তাকালাম আমি। ঠোঁটের উপরে একটা কালো তিল। চোখগুলো কাজল ছাড়াই কেমন যেন আমার কাছে কালো কালো মনে হয়। মেয়েটাকে লাল পোশাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগে। সেদিন পহেলা বৈশাখের বিকেলে ওর হাতে দুটো লাল জবা ফুল এনে দিয়েছিলাম। আমার দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল “তোমার কি লাল রং পছন্দ? কিন্তু তোমাকে কখনো লাল ড্রেস পরতে দেখিনি। সবসময় নীল পান্জাবি পরো কেনো?” ফুলগুলো হাতে দিতে দিতে বলেছিলাম “লাল ফুল আমার পছন্দ। কিন্তু আমি তো হিমু, তাই নীল পান্জাবি পরি। অবশ্য হিমুরা হলুদ পান্জাবি পছন্দ করে। আমার নীলহিমু হতে ইচ্ছে করে।””ভিতরে আয়, ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?” মাজেদা খালার ডাকে সামনে তাকায়। দেখি উনি সোফায় এসে বসছেন। জেরিন আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাঁসল। মেয়েদের হাসি সুন্দর হয়। সুন্দর হয় তাঁদের চুল। এ জন্য ছেলেরা বারবার পরিবর্তন করে অন্য মেয়েদেন প্রেমে পড়ে। দোষটা ছেলেদের না, মেয়েদেরই। তারা এতটা সুন্দর না হলেো পারতো। সবই বিধিতার বিধান। জেরিন চলে যায়। আমি খালার পাশে এসে বসলাম।
– কি হয়েছে থালা,তুমি এত জরুরিভাবে ডাকলে যে?
– তোর খালুর সাথে ঝগড়া বাঁধে আমার রোজ।
– ঝগড়া করা ভালো, এতে মনের আকুতি,মনের চাপা রাগ, অভিমানও প্রকাশ পায়। যার ঝগড়া বা কথা বলার কেও নেই সে কিন্তু হিংস্র মানব হয়ে ওঠে। এ জন্য একা একাও বিড়বিড় করে কথা বলা দরকার। আমি যেমন স্যার আইনএস্টাইনের সাথে রাতে কথা বলি। ওনার খোঁজ খবর নিই। দুজনে বিজ্ঞান নিয়ে তর্ক করি। আমি জানি, উনি জিনিয়াস তবুও নিজেকে মুখে বড় করি। বাঙালি বলে কথা।
– দেখ জায়িন, তোর সাথে ফালতু পেঁচালের সময় নেই। যে জন্য তোকে ডেকেছি। তোর খালুর সাথে আমি মোটেো ঝগড়া করতে চাইনা। উনি খুবিই বিরক্ত লোক। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ওনার সংসার ছেড়ে চলে যায়।
– কেনো? তিক্ততা চলে এসেছে? অবশ্য এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। যাকে বেশি ভালো বাসা হয় তার উপর বিরক্তবোধ চলে আসে। আমার উপর যে তুমি রাগ করো আমার খুব ভালো লাগে। কারন তুমি আমাকে ভালোবাসো বলেই রাগ দেখাও।
– চুপ থাক। তোকে সব বলছি। চা খাবি তো?
– হুম। চলবে, তবে দুটো বিষ্কুট দিও।
খালা কাজের মেয়েকে চা আনতে বললো। আমি বাড়ির ভিতরটা দেখছি। অবশ্য বাড়িতে আমি নতুন আসছি সেটা না। সপ্তাহে চার পাঁচ দিন আসা হয়। তাও রাতের খাবার খেতে। প্রায়শই খালা রাতের খাবার বেঁড়ে দেয়। তবে আজকাল দেখি জেরিন আমার খাবার বেড়ে দেয়। আমি যখন রাতে আসি মেয়েটা আমাকে দেখা মাত্রই জেরিন বলে “হিমু ভাইয়া, তোমর জন্য বেগুন ছানা,আলু ভাজি করেছি সাথে পাতলা ডাল আছে। তোমার জন্য অপেক্ষা করি আসবে কখন?” মেয়েটার দিকে আমি অবাক হয়ে তাকায়। খাবার খেতে খেতে বলি “অপেক্ষা বেশি করতে নেই, অপেক্ষার ফলে কি হয় জানিস? অপেক্ষা করার ফলে প্রেম হয়। বেশি অপেক্ষা প্রেমে পড়ার লক্ষন। যখন মন পরিপূর্নভাবে প্রেমে পড়ে তখন অপেক্ষা করতে ভালো লাগে।” জেরিন বাঁকা চোখে তাকিয়ে কপাল রাগ মেশানো কণ্ঠে বলে “ধুর তোমার এমন আজাইরা মার্কা কথা শুনতে কেমন লাগে।” আমি মুচকি হাসি, মানুষ যখন লজ্জা পায় তখন কথা এড়ানোর কিংবা তাকে বুঝতে না দেওয়াে জন্য অনেক কিছুই বলে। “জায়িন,তোর খালুর উপর সন্দেহ হচ্ছে আমার। ও নিজের অফিসের কোনো মেয়ের সাথে ইটিশপিটিশ করছে।” চা খেতে খেতে খালার কথা শুনলাম। আমার জবাবের জন্য তিনি তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি পুরো চা আর বিস্কুট শেষ করে খালার দিকে তাকিয়ে বললাম..
– এই বয়সে এসব কি করছেন উনি?
– সেটাই তো। আমিও সেটাই বলছি বলে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। আমি কিছু জানিনা, তুই তোর খালুর উপর নজর রাখবি। প্রতিটা মুহুর্তের খবর আমাকে দিবি।
– আমার কাছে ফোন নেই। আর এভাবে খবর রাখে নাকি কেও? অন্য কাজ দাও।
– জায়িন তুই সামনে থেকে যা আমার। একটা কাজ তুই ঠিক মত করে দিতে পারিস না।
– আচ্ছা যাও নজর রাখবো।
– গুড বয়,সকালে খেয়েছিস?
– নাহ
– দাঁড়া তাহলে খাবার নিয়ে আসি।
খালা চলে গেলো। আমি সোফাতে হেলান দিলাম। চুলগুলো আজ বেশ কয়েকদিন ধরে কাঁটিনি। দাঁড়ি গোফও বেশ তাড়াতাড়িই উঠছে। কালো প্যান্টের সাথে নীল পান্জাবি আজ এক সপ্তাহ ধরে পরছি। খালি পায়ে হাঁটতে পারিনা। তাই চটিচান্ডেল ব্যবহার করি। হিমু হিমু একটা ভাব নিয়ে চলি। অবশ্য এলাকার এখন সবাই জানে আমি হিমু চরিত্র ফলো করি। এ জন্য মজা হোক কিংবা ভালোবেসে অনেকেই হিমু বলে ডাকে। হিমুর মত আমি একপেঁশি কথা বলি। সেদিন নিউটনের সাথে কথা বলছিলাম বিছানায় শুয়ে শুয়ে।
– ইয়া লাহাদা ওয়ামি ছুমতা লাকা হুম বুম ফুম আমার মুখে এমন কথা শুনে নিউটন চমকে ওঠে। আমার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে বলে..
– জাহিমু (ওনার দেওয়া নাম), এসব কি ধরনের ভাষা?
– বিজ্ঞানের ভাষা স্যার। কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করেছি।
– বাহ, নতুন শব্দ তো কেমন আছি বলার ক্ষেত্রে। ভাষা নিয়ে একটু গবেষনা করতে হবে।
– নাহ স্যার, আমার ভাষা নিয়ে একদমই গবেষনা করবেন না। সবকিছু নিয়ে গবেষনা করতে নেই। বিরক্ত চলে আসে। আর সবকিছুর রহস্য জানতে নেই।
– কেনো?
– আমি আমার ঐ ভাষায় আপনাকে যদি তখন গালি দিই আপনি বুঝে ফেলে আমাকে মারবেন।
– জাহিমু তুমি যে একটা ফাঁজিল তা জানো?
– নাহ, প্রতিটা মানুষের মাঝে অনেকগুলো দিক থাকে। যার সবটাই মানুষ জানে না। আমি বুঝি না, আপনার মাথায় আপেলই কেনো পড়তে যাবে? দেশি কতগুলো ফল আছে, স্যার যদি একটা কাঁঠাল পড়তো আপনার মাথায় তাহলে বেশ হতো।
– যাও তো তুমি সামনে থেকে। আমি এখন তোমার ভাষা নিয়ে গবেষনা করবো।
– ইন্না আহ তাকলু ওয়ালি দাকা ফু ফা হু য়া ভু।
– ঐ কি বললে তুমি?
– গালি দিলাম। গবেষনা করে জেনে নিবেন কি গালি দিয়েছি।
ওনার সাথে আর কথা বলিনি। কল্পনা করতে করতে হেসেছি খুব। আচ্ছা হিমুরা তো হাসে না। না মানে হুদাই হাসে না। পাগলেরা অকারনেই হাসে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দরজার দিকে তাকালাম। জেরিন আসছে ভিতরে। আমার সামনে এসে বসতেই বলল…
– হিমু ভাইয়া, আমাকে লাল শাঁড়িতে কি লাল রুপার মত লাগবে?
কি বলে মেয়েটা? মেয়েটার হাব ভাব দিনদিন কেমন যেন মনে হয় আমার। উদ্ভট কথা বলে আমার সাথে। আজকে যে ক্লাস না করেই ও চলে এসেছে সেটা বুঝেছি। কিন্তু মেয়েটার এমন আচরণের পরিবর্তন কেনো হল? সেদিন আমার কাছে এসে মাথায় লাল ওড়না দিয়ে বলে “দেখো তো আমাকে হিমুর রুপার বউয়ের মত লাগছে কিনা?” সেদিন কোনোরকমে কাটিয়ে চলে গিয়েছিলাম।
– তোর ক্লাস নেই?
– ক্লাস করবো না আজকে। বলো আমাকে লাল শাঁড়িতে কেমন লাগবে?
– বাজে লাগবে।
– উহু। তোমার কাছে ভালো লাগবে আমি জানি। আচ্ছা তোমার মাথা থেকে এসব ভুত নামবে কবে? পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করতে পারো না? বিয়ে করবা, বউ হবে।
– হিমুরা চাকরি করে না।
– তুমি করবা। আচ্ছা দেখো না, আমার হাতে মেহেদি দিয়েছি কেমন হয়েছে?
জেরিন হাত বাড়িয়ে দেয় আমার সামনে। স্পষ্ট হাতের উপরে লেখা ‘Z’ মানে জেট স্কয়ার,মানে দুটো জেট। আমাকে এটা দেখানোর জন্যই মেয়েটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি বসলাম না। টেবিলের উপর কাগজ ছিল, সেটাতে খালার জন্য একটা মেসেজ লিখে দিয়ে চলে আসলাম। দিনদিন জেরিনের কান্ডগুলো বড্ড অদ্ভুত লাগছে আমার। মেয়েটা আমাকে নিয়ে ভাবছে বেশি। মানুষ দুইভাবে প্রেমে পড়ে। হুট করে আর ভাবনা থেকে। হুট করে প্রেমে পড়া জিনিষের ব্যাখা ব্ড্ড গোলমেলে তবে কারো প্রতি ভাবতে ভাবতে প্রেমে পড়াটা বড়ই কঠিন বিষয়। যা তৈরী হয়ে গেলে সেখান থেকে ছোটানোটা বড্ড কঠিন হয়। খালুর অফিসের সামনের কড়ুই গাছের নিচে বসলাম। একটা মেয়েকে দেখলাম খালুর সাথে গাড়ি থেকে নামছে। মেয়েটা মোটামুটি খালার বয়েসেই। নাহ তার থেকে বয়েস কম হবে। জেরিনের থেকে বয়সে বড়। খালুর সাথে বেম জমিয়ে কথা বলতে বলতে অফিসে ঢুকছে। খালুর দিকে তাকিয়ে গর্ব হচ্ছে। এই বয়েসে মেয়ে পটানো উনি দেখছি বেশ পারে। গর্ব হচ্ছে আমার? হায় উপরওয়ালা গর্ব হবে কেনো? ফোন বেজে ওঠে আমার। খালার নাম্বার।
– জায়িন, তুই না খেয়ে চলে গিয়েছিলি কেনো? কোথায় তুই? তোর খালুর খবর জানিস?
– হুম, দেখলাম একটা মেয়ের সাথে বেশ রসিয়ে আলাপ করতে করতে অফিসে ঢুকছে। মনে হয় ঘুরতে গিয়েছিল।
– কিহ? আজ আসুক লোকটা। বোঝাবো মাজেদা কি জিনিস।
– তোমরা তোমাদেরকেই জিনিস বলো, আর বর্তমানে ছেলেরা মেয়েদের মাল বললেই দোষ। চুপ থাকো তো, ব্যাপারটা আগে বুঝতে দাও। এমনো হতে পারে আমরা ভুল দেখছি।
– সব খবর আমাকে দিবি। রাখছি.. দাঁড়া জেরিন কি যেন বলবে নে কথা বল। “হিমু ভাইয়া, আমার জন্য একজোঁড়া লাল চুঁড়ি আনবে তো? আর এক পায়ে নুপুর পরবো।” ফোন কেঁটে দিলাম। মেয়েটার আচরণে আমি প্রতিনিয়ত অবাক হচ্ছি। এমন করে আবদারটা করলো শুনে বুকের ভিতরটা খচ খচ করা শুরু করে দিয়েছে। আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালম। খালুর অফিসে ঢুকবো দারোয়ানের সাথে দেখা।
– হিমু স্যার, কেমন আছেন? (দারোয়ান লতিফ)
– হিমুরা সবসময় ভালো থাকে। ভাবির কি খবর বলুন।
– ভাবির সাথে ঝগড়া চলছে আমার। আমি নাকি তাকে ভালোবাসিনা।
– ধুর পাগল, এটা নিয়ে ঝগড়া হয়নাকি? মেয়েরা ভালোবাসা পেতে চাই বলে এই কথাটা বলে। আজকে ভাবিকে রাতের বেলায় চটপটি খাওয়ার অফার দেন দেখবেন ভাবি খুব খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরবে।
– আইচ্ছা হিমু স্যার।
ভিতরে ঢুকলাম। অফিসের অনেকেই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। কারন এবার আমি খালি পায়ে অফিসে প্রবেশ করছি। সোজা খালুর কেবিনে চলে আসলাম। কোনো অনুমতি ছাড়াই রুমে ঢুকলাম। দেখি সেই মেয়েটা সামনে বসে আছে। আর খালু ওনার দিকে তাকিয়ে আছে। আসি সোজা ওনার পাশে যেয়ে বসলাম।
– জায়িন তুমি এখানে?
মেয়েটার দিকে তাকালাম। মাজেদা খালার থেকেও সুন্দরি। আমারই তো প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করছে,খালুর কি দোষ দেবো। ছেলেদের কোনো দিক নির্দেশনা নেই। ছেলেরা চরম লেভেলের আহম্মক হয়। কখন কার প্রেমে পড়ে তারা নিজেরাই বুঝে উঠতে পারে না। বয়সে বড় কারো প্রেমে পড়ে আবার বউ ছাড়া অন্য কারো প্রেমেও পড়ে। তবে সবাই এক না। এটা নিয়ে স্যার জৌতির্বিজ্ঞানী আ্যারিস্টটলের সাথে একটা চা পানের আসর জমিয়ে আলাপ করতে হবে। আমি খালুকে বললাম..
– মাজেদা খালা পাঠিয়েছে আপরার উপর নজর রাখতে। আপনি নাকি এই মহিলার সাথে ইটিশ পিটিশ করছেন। আপনার শার্টের পকেটে নাকি একটা দুল পেয়েছে খালা। সেটা নিয়ে সন্দেহ করছে।
– কিহ? আর ইউ পাগল? এই হল খালুর সমস্যা। অর্ধেক বাংলা অর্ধেক ইংরেজিতে কথা বলেন। আমি কোনোদিন দেখিনি উনি কখনো পুরো ইংরেজি বাক্য ব্যবহার করেছেন। কিন্তু উনি অবাক কেনো হচ্ছে?
– আমি খালাকে যেয়ে বলবো তুমি হাবিজাবি করে বেড়াও।
– চুপ থাক ফাজিল। এই তুমি যাও, অফিসের কাজ করো।
– মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিলে কেনো? থাকতো পাশে। ভালোই তো দেখতে।
– জায়িন, আমার কিন্তু প্রচুর বিরক্ত লাগছে।
– মোটেই না, আপনি রেগে যাচ্ছেন।
বিরক্ত হলে মানুষ আগে রাগ দেখায়। রাগ হুট করে আসে। আর বিরক্তবোধ সময় নিয়ে হয়। কখনো কোনো মানুষ প্রথমবারে কারো উপর বিরক্ত হয়না। অনেকগুলো দিক নিয়ে বিরক্ত হয় মানুষ। আমার বন্ধু রাহাতকে তো তুমি চেনো। আমি এখন ওর উপর বিরক্ত। বেটা হুট হাট করে মেয়েদের মত রাগ করে। এখন ঠিক আছে, একটু পর খুব সামান্য বিষয় নিয়ে রাগ দেখিয়ে ওর মত চলে যায়। তবে আমি কিন্তু ওর উপর রাগ করিনা, বিরক্ত হই। আমি না সবাই এর এমন স্বভাবে বিরক্ত হয়ে থাকে। সে চাইলে নিজেকে ঠিক করে নিতে পারে। তবুও তাকে ভালোবাসি।
– হয়েছে হয়েছে, তুই সামনে থেকে যা। আর তোকে না বলেছি চাকরি করতে। এসব ফকির মার্কা ধ্যান ধরেছিস যা সহ্য করা যায় না।
– এটা ফকির গেটাপ না। হিমু স্টাইল।
– হিমু টা আবার কে?
– আমার বন্ধু। এখন খালাকে যেয়ে কি বলবো বলো?
– দেখ বাপ, ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তুই কি জানিস, তোর খালা পাশের বাড়ির ভাড়াটিয়ার সাথে হাবিজাবি করে বেড়ায়। খালি ঝগড়া করে আমার সাথে। আমার থেকে চলে যাওয়ার একটা ছুঁতো খোজে।
– এহ? কি বলো এসব?
– হুম, তুই একটু নজর রাখ না তোর খালার উপর। দেখবি সে কি করে। সব খবর আমাকে জানাবি।
কি বলবো বুঝতে পারছি না। খালা পাঠালো খালুর উপর নজর রাখতে। আর খালু বলছে খালার উপর নজর রাখতে। হিমু হওয়া কি আমার হবে না? ডিডেকটিভের চাকরি নেবো আমি? না না আমি হিমু হবো। হিমু হয়ে ডিডেকটিভ হবো।
– তাহলে তোমার পকেটে যে দুল ছিল, সেটার রহস্য কি?
– সব তোকে পরে বলবো তুই এখন যা। গা থেকে গন্ধ আসছে। কয়দিন গোসল করিস নি?
– গোসল রোজই করি। কিন্তু গায়ের কাপড়টা পরিষ্কার করা হয়নি।
– যা সামনে থেকে যা। বমি আসবে না হলে।
– ঠিক আছে, পাঁচশো টাকা দাও। জেরিনের জন্য চুড়ি কিনবো। ওর আবদার আমি যেন চুড়ি কিনে আনি। না হলে খালার উপর নজর রাখবো না।
বেরিয়ে আসলাম। মহিলাটার উপরে আরেকবার তাকালাম আমি। উনি আমার দিকে কেমন করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি বেরিয়ে আসলাম। হাঁটছি আমি। ভালো লাগছে না। গরম লাগছে খুব। নিউটন স্যারের সাথে একটু কল্পনাতে কথা বলা দরকার।
– ওয়াক চি চুং চাং চা চিং চু।
– জাহিমু এটা কোন ধরনের ভাষা? (নিউটন)
– স্যার এটা বাংলাচায়না ভাষা। চ দিয়ে শুরু।
– তোমার কোনো ভাষা আমি সঠিক করে বুঝতে পারিনা।
– আমিও পারি না তাই বলি।
– তোমাদের এখানে অনেক গরম।
– ধুর কি বলেন স্যার, আচ্ছা স্যার আপনার ওয়াইফের সাথে কোনো রোমান্টিক মোমেন্ট আছে? থাকলে বলুন তো।
– সেদিন ছিল বাসর রাত, বৃষ্টি হচ্ছে। আমি আর আইনএস্টাইন সাপ লুড খেলছিলাম। তোমার ম্যাডাম এসে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে দেখছিল। এটাই আমার কাছে বেশ রোমান্টিক ছিল।
– আহা, কি রোমান্টিক আপনার এই রোমান্টিক ঘটনা শুনে আমার একটা সাহসি ঘটনার কথা মনে পড়ছে বলবো স্যার?
– বলো।
– সেদিন বাগানে যেয়ে দেখলাম দুটো বাঘ শুয়ে আছে। যেয়ে লেজ ধরে টানতেই…
– হুট গাধা, লেজ ধরলে কেনো? আগে মাথা ধরতা,মাথা কেটে ফেলতা।
– আগেই তো কোনো একজন মাথা কেটে নিয়ে চলে গিয়েছিল।
– কিহ? এটা তোমার সাহসি ঘটনা? আর বাগানে কি বাঘ থাকে?
– হুম থাকে, সাপ লুডু খেলার সময় নতুন বউ উকি দিলে সেটা রোমান্টিক গল্প হতে পারে,এটাও সাহসি ঘটনা হতে পারে।
– ফাজিল। যাও তোমার প্রেয়শিনির জন্য চুঁড়ি কেনো।
কল্পনা করতে করতে চুড়ির দোকানে চলে এসেছি। কিন্তু জেরিন আমার প্রেয়শী? না না এটা কি করে সম্ভব? আমার মত উদ্ভট ছেলে কারো কল্পনায় ঠাই পাবে না। চুড়ির দোকানে যেয়ে এক গোছা লাল চুড়ি কিনলাম। কি মনে জল এক পাতা লাল টিপ, লাল আলতা, আর লাল নখ পালিশও কিনে নিলাম। পাশের দোকানে দেখলাম নুপুর বিক্রি হচ্ছে। খুজে খুজে লাল নকল মুক্তা বসানো একজোড়া নুপুর কিনলাম। কি সব করছি আমি? নিজেই অবাক হলাম এমন কাজের জন্য। বাজার থেকে বেরিয়ে দেখলাম অফিসের সেই মহিলাটি হসপিটালে ঢুকছে। পিছু নিয়ে দেখলাম ওনার মা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। মহিলাটি খালুর নাম ধরে বলছে “স্যার বলেছে চিন্তা না করতে তোমার অপারেশনের টাকা দেবে।” বুঝলাম খালু এটার জন্যই মেয়েটার সাথে মিশছে। কিন্তু খালা ভুল বুঝে ঝগড়া করেছে। খালাদের বাড়িতে আসতে রাত হয়ে গেছে। বাড়ির কাছে আসতেই ভিতর থেকে শুনছি খালা আর খালুর মধ্যে বেশ চুপিচুপি ঝগড়া হচ্ছে। ঝগড়ার হেতু আমাকে নিয়ে। আমি খালুকে গোয়ান্দাগিরির ব্যাপারটা জানিয়েছি সে জন্য। ঝগড়া শুনতে পেলাম। ঝগড়ার এক পর্যায়ে খালু সব সত্যি বললেও খালা বিশ্বাস করছে না। আমি দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করবো দেখি দরজার সামনে জেরিন দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই বলল..
– এত দেরি করে আসলে কেনো?
– তুই কি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলি?
– নাহ, একটা হাঁদারামের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
– হিহিহি, নে তোর জন্য দেখ কতকিছু এনেছি।
জেরিন সেগুলো নিয়ে যায়। আমি খালুদের রুমের কাছে এসে কেঁশে বললাম ভিতরে আসবো? ওনারা চুপ হয়ে অনুমতি দেয়। আমি খালুর দিকে তাকালাম। রাগে ওনার মুখ লাল হয়ে আছে। খালাকে বললাম..
– খালু ঠিক কথা বলছে। খালু এমন কিছুই করেনি। তোমাকে খালু অনেক ভালোবাসে। আমাকে বলেছে মাস শেষে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে অনেক দুরে। তোমার জন্য কতকি সারপ্রাইজ রেখেছে। কিন্তু তুমি নাকি পাঁশের বাড়ির কার সাথে চোখাচোখি করছো?
– জায়িন কি বললি তুই? আরে ঐ লোকটাই তো বলেছিল তোর খালুর কথা। বাজারে নাকি উনি তোর খালুকে দেখেছে মহিলাটার সাথে। সেজন্য লোকটার সাথে কথা হয় আমার তোর খালুকে নিয়ে।
– আহা, বেশি ভালোবাসা থাকলে যা হয়। ভাগ্যিস তোমাদের রোমান্টিক মুহুর্ত নিউটন স্যার দেখিনি। না হলে কবেই অজ্ঞান হারিয়ে জ্ঞান খুজতে যেতো।
– কি বলিস এসব? (খালা)
– কিছু না, তোমরা প্রেম করো। যা হয়েছে সব ভুল বোঝাবুঝি। আমি গেলাম।
– আচ্ছা খেয়ে যাস।
– হুম।
বাইরে আসলাম। ড্রয়িং রুমের খাবার টেবিলে দেখি জেরিন বসে আছে। হাতে লাল চুঁড়ি। গায়ে লাল শাঁড়ি। নোখ গুলোও লাল নেইল পালিশে ঢাকা। আমাকে দেখেই খালি পা মেলে দেয়। যেন আমি পায়ে আঁলতা পরেছে সেটা দেখতে পারি। কল্পনাতে অনুভব করলাম রোমান্টিক লেখক হুমায়ন আহমেদ আমার পাশে এসে কাঁধে হাত রেখে বলল..
– কি ব্যাপার মি. নকল হিমু? তোমার রুপা তো সামনেই বসে আছে। কিন্তু জানো তো, হিমুদের রুপা কেবল কল্পনাতে থাকে। হিমু কল্পনায় রুপার সাথে থাকে। কিন্তু তোমার রুপা বাস্তবে সামনে। তুমি এখনো হিমু হওনি। হিমুরা প্রেমে পড়ে না, তারা কল্পনায় কেবল নিজের সঙ্গী রুপাকে খোজে। অনুভব করলাম হুমায়ন স্যার চলে যাচ্ছে হাসতে হাসতে। আমি জেরিনের দিকে তাকালাম। আগে কখনো জেরিনকে এতটা আকর্ষনীয় লাগেনি। আমি কোনো কথা না বলে চলে আসতে যাবো জেরিন ডাক দেয়।
– হিমু?
– হুম।
– আমার পায়ে নুপুর পরিয়ে দেবে না?
সম্মোহিত আহ্বনে আমি ঘুরে জেরিনের দিকে তাকালাম। টেবিলের উপরে বসে এক পা মেলে আমার দিকে মুচকি হেসে তাকাচ্ছে। আমার মাথায় আসছে না জেরিন কেনো আমার প্রেমে পড়লো? ধুর প্রেম ভালোবাসা মধ্যে তো কোনো কেনো,কি,কিভাবে এসব যুক্তি থাকে না। তবে কি সত্যিই সে আমার প্রেমে দিশেহারা হতে যাচ্ছে? আমি এগিয়ে গেলাম। আমি বসলাম ওর সামনে। হাঁটুর উপর পা তুলে নিলাম। ওর হাত থেকে নুপুর নিয়ে ডান পায়ে পরিয়ে দিলাম। বা পা টা নিতে যাবো তখনি বলল..
– উহু, আমার এক পায়ের নুপুর পরে তোমার সাথে রাতের ল্যামপোষ্টের রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটার বড্ড ইচ্ছে।
অনুভব করলাম, হিমুরা প্রেমে পড়ে না। তারা অনুভুতিও প্রকাশ করে না। নারী দেহ তাদেরকে আকর্ষন করে না। হিমুদের কল্পনার জগত থাকে। যেখানে সে তার রুপাকে নিয়ে ময়ুরাক্ষীতের বেড়াতে যায়। আমারো তো কল্পনায় একটা নদী আছে যার নাম দিয়েছিলাম “সমদ্বীপ।” আচ্ছা জেরিনকে নিয়ে যদি রুপার মত সমদ্বীপে নিয়ে যায়? কিন্তু জেরিন তো আমার বাস্তবে। আর তাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে আমার। মনের চোরা চোখের সামনে সে ভেঁসে চলেছে। আমি এখন পারছি না নিউটন স্যারের সাথে কথা বলতে, পারছি না হুমায়ন স্যারের সাথে রোমান্টিক আলাপে ব্যস্ত হতে। তবে কি আমার মনে প্রেম জাগ্রত হয়েছে? কল্পনার রুপ নয়, বরং সম্মুখে মনের বিলাশে বাস্তবিক রুপা আমার সামনে লাল জবা ফুলের মত ফুটে উঠেছে, বলে আমি কি সম্মোহিত হয়ে গিয়েছি? নারী মানে বড়ই ব্যাখ্যাহীন এক প্রানী। তাদের আকর্ষনে সবকিছু যেন নস্যি মনে হয়। আমার যে ইচ্ছে করছে এখন জেরিনের আবদার পূরণ করতে। ইচ্ছে করছে তাকে নিয়ে ঘুরতে পিচঢালা রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটতে। তবে কি আমি হিমু হতে পারিনি? সবাই হিমু হতে পারে না। হিমু কেবল হুমায়নেই মানায়।
– নিয়ে যাবে আমাকে, তোমার সাথে? (জেরিন)
– হুম।
– আমার চুলের খোপায় লাল জবা গুজে দিও।
– হুম।
– তাহলে দেরি কিসের? চলো না আজকে হারিয়ে যায় চেনা রাস্তার ভিঁড়ে অচেনা কল্পনাতে। ভালোবাসায় উজ্জিবিত করি হিমুর রঙিন বাসর।
জেরিনের হাত ধরলাম। এক প্রকার টেনে নিজের কাছে এনে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হাত ধরে বাহিরে নিয়ে এলাম। রাত ন’টা বাজে। ল্যামপোষ্টের আলো পড়েছে রাস্তায়। আমি ওর হাত ধরে হাঁটছি। সে লাল শাঁড়ি পরেছে,খোঁপায় লাল জবা ফুল। আর আমার গায়ে নীল পান্জাবি। ওর চুড়িদ্বারে ঝনঝন শব্দ হচ্ছে। এক পায়ে নুপুরের এলোপাঁথাড়ি শব্দও শুনতে পাচ্ছি আমি। সে আমার কাছে আসল। আমাকে জড়িয়ে নিয়ে কাধে মাথা রেখে হাঁটতে লাগল। দুজন উদিয়মান কপোতকপোতি চেনা রাস্তায় হাঁটছি। ওর মনে রয়েছে আমার প্রতি অজস্র ভালোবাসা, আর আমার মনে রয়েছে “এবার হিমু হিমু ভাব ছাড়ো, কাল থেকে চাকরি খোজার কাজে লেগে পড়ো। না হলে তোমার লালরুপা কল্পনাতেই থাকবে, বাস্তবে হবে তার বিলীন।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত