রাকিব চোখ মারতেই স্যারকে বলে দিলাম,– স্যার রাকিব আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মেরেছে। আমাদের অঙ্কের স্যার ভীষণ বদমেজাজী, তার ক্লাসে কথা বলা’ই বারণ সেইখানে চোখমারা! ক্লাসে সবার সামনে রাকিবের মাথাটা বেঞ্চের তলে ঢুকিয়ে পাছায় সপাং সপাং বেত্রাঘাত। ক্লাসের সবাই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে সেই করুন হৃদয় বিদারক দৃশ্য। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। ভবিষ্যতে রাকিব যদি আমাকে দেখে – মাইয়া ও মাইয়ারে তুই অপরাধী রে, গানটা গায়, চুপচাপ হজম করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকবে না।
রাকিবের জন্য ঘটা করে আমার মনে একগাদা অনুভুতির উদয় হইলো। আজ বুঝলাম বাংলা সিনেমায় যা-কিছু দেখায় একেবারেও ভোকাস না, এইভাবে নায়ককে ধোলাই খেতে দেখেই নায়িকার মনে প্রেমের উদয় হয়।
পরপর তিনদিন স্কুলে আসেনা রাকিব, তার ডিউটি এখন রাস্তার ধারে, আমগাছে, জামগাছে, আনাচে-কানাচেতে; উদ্দেশ্য আমাকে সায়েস্তা করা। কিন্তু আমাকে সায়েস্তা করা কি এত্তো সোজা, সায়েস্তাখানের নাতি আসলেও আমাকে অত সহজে সায়েস্তা করতে পারবে না।
আরও কয়েকদিন পরে যখন পরিস্থিতি মোটামুটি ঠান্ডা। একা একা রাস্তায় হেটে স্কুলে যাচ্ছি, হঠাৎ ধড়মড় করে রাস্তার পাশের আমগাছের ডাল ভেঙে পড়লো, ভয়ে বুক কেঁপে উঠল আমার, এতবড় ডাল তো এমনি এমনি ভেঙে পড়ার কথা নয়, ভূতের কাজ! ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম ভাঙা ডালটা নড়ছে রাস্তার ওপর! তারপর দেখলাম ডালপালা পাতা সরিয়ে একটি মাথা বেরোলো, এম্মা, এ মাথা ভূতের নয়, রাকিবের। আমাকে সায়েস্তা করার ফন্দি করে আমগাছে উঠে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে আমগাছের ডাল ভেঙে পড়লো বেচারা। সহানুভূতির বদলে হাসতে হাসতে আমার অবস্থা কাহিল। আড় চোখে আমার দিকে এক নজর তাকিয়ে বিরস বদনে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেটে চলে গেল। আবার রাকিবের জন্য আমার মনে দরদী দরদী একটা ভাবের উদয় হলো।
করোনা পরিস্থিতিতে অভাবের সংসারে মনে এত ভাবের উদয় হইলে– আই-এম-ইন-লাভ, গান গাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। নিজেকে সংযত করে স্কুলে চলে গেলাম। দু’বছর কেটে গেছে এভাবেই, রোজ আমার পেছনে ঘুরঘুর করেছে সত্যি, কিন্তু কখনও কোনো বাজে মন্তব্য করেনি, ডিস্টার্ব করেনি, রোজ অন্তত একবার নজরে পড়েছে যাতে রোজ আমি ওর কথা ভাবতে বাধ্য হই। এসএসসি পাস করার পরে বিদায় অনুষ্ঠান শেষে দেখলাম আমার পিছু নিয়েছে। মৃদু ভয়ও করছে আমার, বদটা বিদায়ের দিনে আবার কোনো হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে নাকি! বারবার পেছনে তাকাচ্ছি আর দ্রুত পায়ে হাটছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম কিছু একটা ছুড়ে মেরেছে আমার দিকে, নিজেকে রক্ষা করতে নুয়ে পড়লাম, দেখলাম দুমড়ে মুচড়ে ভর্তা আকৃতির একটা কাগজ এসে পড়েছে আমার সামনে। কাগজটা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দেখলাম রাকিব গায়েব।
কাজটা খুললাম। কাগজে লেখা– যত্ন করে ভালোবাসা দিলাম প্রিয়, ভালোবাসা না দিলেও, ভালোবাসার মূল্য দিয়ো। কত গভীরতা এই ছোট্ট তিন লাইনে! আবার সেই অনুভূতি। আমিও যে লোকটার প্রেমে পড়েছি তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এত জলদি ধরা দেয়া যাবেনা। ইন্টার পাস করলাম, বিয়ের সম্বন্ধ আসে। দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে আমার বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া আসা রাকিবের। তবু সাহস করে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনা বদমাশটা! বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ একদিন ডেকে বললাম– এই যে, অফার কিন্তু প্রায় শেষ।
: কিসের অফার?
: কয়েকবছর লাইন তো মারলেন, বিয়ে করবেন আমারে? বিয়ের সম্বন্ধ আসতেছে কিন্তু।
: ইয়ে মানে, ইয়ে…
: আপনি ইয়ে ইয়ে করতে থাকেন, ততক্ষণে অন্য কেউ আমাকে বিয়ে করে নিয়ে যাক।
আসলে রাকিব কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না আনন্দে, মনে হচ্ছে আমার কথায় আনন্দের ওভার ডোজে ভিরমি খাবে।
আমি চলে আসলাম। বাসায় আমার কাছে জানতে চাওয়া হলো পছন্দের কেউ আছে কিনা। আমি সোজাসাপটা রাকিবের কথা বলে দিলাম। তারপর পরিবারের সবাই রাকিব সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করলো।
রাকিবের ভালোবাসা যদি সত্যি না হতো, তবে বছরের পর বছর আমার জন্য অপেক্ষা করতো না, সত্যিকারের ভালোবাসার মূল্য যারা দিতে না জানে, তারা বোকা, আমি এমন বোকামি করতে চাইনা। এরকম একজনের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে বিন্দুমাত্র ভাবার প্রয়োজন আমি মনে করিনা। আমার পরিবার রাকিবকে পছন্দ করলো, বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হলো। তারপর আমাদের বিয়েটা হয়ে গেল। জীবনসঙ্গী হিসেবে রাকিবকে বেছে নিতে আমি যে মোটেও ভুল করিনি সেটা খুব করে উপলব্ধি করছি। দিনের পর দিন রাকিবের ভালোবাসা বেড়েই চলেছে, শক্ত করে আরও বাঁধছে ভালোবাসার মায়ায়। রাকিব এখন নিশ্বাসে পরিনত হয়েছে আমার, বেঁচে থাকতে চাই অনন্তকাল রাকিবের নিখুঁত ভালোবাসায়। প্রত্যেকটা মেয়েই যেন রাকিবের মতো জীবনসঙ্গী পায়।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা