আয়না’র ভালোবাসা

আয়না’র ভালোবাসা
–আয়না আপা, স্বামীর জন্য আপনি নিজে না খেয়ে সারাটাদিন প্রায় অনাহারে থাকেন, কষ্ট হয়না আপনার?
— বহুত কষ্ট হয় রে বোইন, পেটের ভিতরে জ্বালা করে
তয় যখন মানুষডারে পেট ভইরা ভাত খাইতে দেহি, তখন আমার সক্কল ব্যথা-বিষ পালাই যায় নিমিষেই। মনডার ভিতরে কি এক খুশি শান্তি লাগে, তা আপনারে বুঝাইতে পারুম না আপা৷ আয়না আপা আমাদের বাড়িতে নতুন, আম্মুকে কাজকর্মে সাহায্য করেন। প্রতিদিন সকাল আটটার দিকে আসেন আর দুপুর দু’টো নাগাদ বাড়িতে চলে যায়। আমাদের বাড়ি থেকে ওনাদের বাড়ির পথ বেশ দূরে। এতদূর কাজ করতে আসেন শুধুমাত্র আম্মু ওনাকে খাবার বেশি করে দেন বলে আর ওনার অসুস্থ স্বামী’র ঔষধ এর অর্ধেক ব্যয়ভার আমাদের সেই সাথে হাফ কেজি চাল পান রোজ রোজ। অবসর সময়ে সুযোগ পেলেই আয়না আপার সঙ্গে গল্প করি আমি, শুনি ওনার জীবনের নানান গল্প।
ওনার জীবন এমন কষ্টের ছিলো না, স্বামী ও বড় ছেলে দিনমজুর ছিলেন। ভালোই চলে যেত সংসার, কিন্তু দুঃখ নেমে আসে যখন ওনার স্বামী একটা দূর্ঘটনায় পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে যায়। চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা খরচ হয়, ঋণের বোঝা’ও বাড়ছে দিন দিন। সাহায্যের জন্য আসতো আমাদের বাড়িতে, তো আম্মু একদিন কাজের প্রস্তাব দিলে বলেন অন্য বাড়িতে কাজ করতো আগে কিন্তু তাদের পোষাইত না জন্য ছেড়ে দেয়। শেষে কাজ শুরু করে আমাদের বাড়িতে। এতো হাসি-খুশি প্রাণবন্ত একজন মহিলা, ওনাকে দেখে অনেক কিছু শেখার আছে কিভাবে জীবনের এতো কঠিন সময়েও ধৈর্য ধরে হাসিমুখে চলতে পারে একজন মানুষ। সকালে নাস্তা দেওয়া হয় ওনাকে তো শুকনো খাবার হলেই পলিথিন এর ব্যাগ এ তুলে রাখেন স্বামীর জন্য। আমি চিন্তা করি একজন নারী কিভাবে এতটা ভালোবাসতে পারে নিজের অসুস্থ স্বামীকে। আর দুপুরের খাবার বক্সে করে বাড়িতে নিয়ে যায়।
— আচ্ছা আয়না আপা, যে খাবার নিয়ে যান বাড়িতে সেটা কয়জনে মিলে খান আমি তো দেখি দুই জনের খাবার দেয় আম্মু বড়জোর তিনজন খেতে পারবে সেটা।
— আর কইয়েন না আপা, আপনার ভাইয়ে(ওনার স্বামী) বেশির ভাগ ভাত খাইয়া লয় তারপর যা থাকে সেইডা আমার যমজ পোলা দুইডার সাথে ভাগাভাগি করে খাই। দুই তিন নলা’র উপড়ে পেটে আর কোনোই যায় না। পোলা দুই ডারও কষ্ট অয়,তয় আমার শান্তি তাগোর আব্বারে পেট ভইরা খাওনে।
— আপনি কিন্তু অসুস্থ হয়ে যাবেন আপা এভাবে না খেয়ে থাকলে, এখন তো আপনি নিজে একমাত্র উপার্জন করেন পরিবারের জন্য। একবার বিছানায় পড়লে কি হবে আপনার সংসারের সেটা কি ভেবে দেখছেন? তবে আপনি যেভাবে আপনার স্বামী কে ভালোবাসেন, আর উনি আপনার কথা না ভেবে একাই নিজের পেট ভরায়। এটা কিন্তু স্বার্থপরতা আপা।
— আমার কুনু হইবো না আপা, রাতে তো ভাত রাইন্ধা পেট ভইরা খাই সক্কলে। নিত্য দিন না হইলেও একদিন পর একদিন ভিক্ষা করতে যায় মানুষডা চেয়ারে বইসা থাহে, পোলা দুইডাও যায় লগে আমি যাইতে না করি শরীল খারাপ হবো বইলা তাও যায়। তয় জলদি ফিইরা আহেন আমি বাড়িতে যাওনের আগেই। না আপা আমারে মেল্লা (অনেক) ভালোবাসে মানুষটা, সেই কত্তো ছোডকালে নেকা হইছে আমাগোর তখন থাইকা দেইখা রাখছে আমারে। এখন অচল মানুষডারে কই ফ্যালাই কন তো আপা, ওনার ভুগ(ক্ষুধা) বেশি নানান ঔষুধ খায় বইলা।
— তা ঠিক বলছেন, তবে আপনার বড় ছেলে?
— তার কথা কইয়েন না আপা, বাপে মরি যায় তবুও খুঁজ লয় না, নেকা কইরা হেয় পৃত্থক বাড়ি করছে। কুনু খুঁজ নাই তার আমরা মরি না বাঁচি। আর বড় মাইয়াডার ও তো নেকা দিছলাম ভালা পোলা দেইখা, এখন শুনতাছি মাইয়াডারে পিডায় সেই ব্যাটায়।
— আপনার জীবনের অনেক কষ্ট আপা, আল্লাহ আপনার প্রতি সহায় হন।
— কষ্ট নাই আপা, সকালে উইঠ্যা আর রাতে শুইতে গ্যালে তো লোকটার মুখ খান দ্যাখতে পারি।
এইডাই বহুত কিছু জানের (জীবন)জন্য, আমার আর কিছু লাগবো না। তয় আপায় তো নেকা করেন নাই, করলে বুইজবেন স্বামী কি! কতডা পরাণের আর মায়ার। ওনার এই কথা শুনে এবার আমি লজ্জা পেয়ে চলে আসি সেখান থেকে। আজ কয়েকদিন হয় আয়না আপা কাজে আসে না, খোঁজ করে ওনাদের বাড়িতে গেলাম আম্মু সহ। আমাদের দেখে খুশি হওয়ার সাথে সাথে কেঁদে উঠে আপা। শুনলাম ওনার স্বামীর কিডনির সমস্যা, ডাক্তার বলে দিয়েছে বেশি দিন বাঁচবেন না তিনি। শুনে খারাপ লাগছে আমার, কারণ আয়না আপার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তো তিনি।
চলে আসলাম সেখান থেকে, তার কয়দিন পর আয়না আপা আবার কাজে আসা শুরু করেন। কিন্তু যতই হোক ওনার স্বামীকে আমার একটু স্বার্থপর মনে হয়, বউ এতো ভালোবাসে অচল স্বামীকে আর স্বামী কিনা বউয়ের কথা ভাবে না একবারও। চলে গেলো এভাবে একবছর, একসময় আয়না আপার স্বামী খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আপা পাগলের মতো কাঁদতেন আমাদের কাছে, আব্বু তখন অনেক টাকা সাহায্য করেন ওদের। অনেক বার শহরে চিকিৎসা করার জন্য আয়না আপারা নিঃস্ব হয়ে যায় বাড়ির জমিটুকু বন্ধক রাখে শেষ পর্যন্ত শুনেছি। নিজের কিডনি দিতে চান স্বামী কে কিন্তু ডাক্তার বলেন আপার কিডনি তে হবে না অন্য কিডনি লাগবে এমনটাই শুনছিলাম আপার মুখে। শেষ বারের মতো আম্মুর কাছে কিছু টাকা ধার নিয়ে আপা স্বামীর চিকিৎসা করার জন্য এবং নিজের কিডনি বিক্রি করতে শহরে আসেন। ওনার আশা ছিলো নিজের কিডনির বিনিময়ে ওনার স্বামী কে নতুন একটা কিডনি কিনে সুস্থ করে তোলা।
আপা কিডনি বিক্রি করুক এটা ওনার স্বামী চাইতেন না। আপা কিডনি বিক্রি করার আগেই ওনার স্বামী এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। আপার সেদিনের কান্না দেখে আমারও চোখ থেকে পানি ঝাড়ছিলো, এতটা কষ্ট ওনার। বলছিলেন ওনার জীবনের আর কোনো মূল্য নেই আত্নহত্যা করবেন উনি, কিভাবে ঘুমাবেন আর সকালে উঠবেন তিনি, কিভাবে সহ্য করবেন বিছানায় নেই সেই মানুষটা। হয় ঘুমে যেন আল্লাহ ওনারে তুলে নেন কিংবা অন্ধ হয়ে যেতে চাইছেন, যে চোখ দিয়ে নিজের স্বামী কে আর দেখতে পারবেন না সেই চোখ আর রাখতে চান না তিনি৷বলছিলেন ওনার কলিজা টা কে যেনো জোর করে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। হৃদয়ের বন্ধন তাহলে কতটা গভীর ছিলো আপার। আশেপাশের মহিলা গুলো সামলাতে পারছিলেন না আপাকে।
জীবনসঙ্গী কে হারানোর বেদনা এতোটা গভীর ভেবে মনে মনে ভাবলাম জীবনে আর বিয়েটাই করবো না। মাঝে মধ্যে খোঁজ খবর নেয়া হতো আয়না আপার তারপর, সবাই যার যার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ি। অনেকদিন খবর নেওয়া হয় না তাদের । আয়না আপা আর ওনার স্বামীর কথা প্রায় মনে পড়তো আমার কিন্তু খবর নেওয়া হতো না।
অনেকদিন পর আয়না আপা একদিন বিকেলে আমাদের বাড়িতে আসলেন, আম্মুর কাছে ধার করা টাকা শোধ দিতে। আমরা অবাক হয়ে গেলাম, তাছাড়া ও টাকার আশা আম্মুও করে নি কখনও। যার জন্য নেওয়া সেই মানুষটাই যখন মৃত তাহলে কি মূল্য এই টাকার।
–আপা কি নতুন কাজ করছেন? এতো টাকা পাইলেন কোথায়? কিছু না বলে আপা ডুকরে কেঁদে উঠে।
— আমি কইছিলাম না আপা মানুষডা ভালা,
আমাগোর লাইগা ঘরে মাটির ভিতরে একটা কলসে কইরা টাকা জোগাইতেন চুপচুপ কইরা, অচল হওনের পর লোকজন দ্যাখতে আইসা হাতে কিছু টাকা দিলে আর আমি জানতে না পাইলে সেই টাকা কষ্ট কইরা পুঁইতা রাখতো, ভিক্ষার চালও বিক্রি কইরা রাখতেন টাকা। আমি জানলে খরচ কইরা ফালামু জন্য নিজের এতো কঠিন সময়েও মুখ পেট থাইকা বাইর করে নাই ওই টাকার কথা। ওই টাকা শুধুই আমার জন্য, চইলা যাওনের আগে হাসপাতালে আমারে দিয়া কসম কাটায় ওই টাকা দিয়া আমি অন্য কিছু না বাড়িতে একটা দোকান খুইল্লা চলবো ঋণ শোধ করবো, তবুও মানুষের বাড়িতে কাম করতে দিবো না আমারে। আপনাগোর থাইকা বহুত সাহায্য পাইছি জন্য প্রত্থম আপনাদের ঋণ শোধ করতে আইছি। আপা এহন কন ওনি মরার পর আমি চলবো ক্যামনে, সেইডাও ঠিক কইরা গ্যাছেন মানুষডা তাহলে কি মানুষডা স্বার্থপর। আপনেই তো কইছিলেন একদিন।
আমি ভুল বুঝেছিলাম আপা, মনে কিছু করবেন না অনুগ্রহ করে। আর ঋণ শোধ নয়, এই টাকা নিয়ে যান আপনি আমার আর আম্মুর উপহার হিসেবে আপনাদের অমর ভালোবাসার জন্য। এই ছোট উপহার দিয়ে দোকানের কিছু জিনিসপত্র বৃদ্ধি করে বাকি ঋণ গুলো ধীরে ধীরে শোধ করেন আপা। টাকা ফেরত নিতে না চাইলেও জোর করে দিলাম। ভালোবাসা অফুরন্ত, যার কোনো ধ্বংস নেই, বেঁচে থাকুক এমন বিশুদ্ধ ভালোবাসা গুলো।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত