সেই তুমি

সেই তুমি
নিজের পরিবার শহর ছেড়েছি আজ পাঁচ বছর হলো! বাবা মাকে পাঁচটা বছর চোখের দেখাও দেখি না! আর কখনো তাদের সামনে দাঁড়ানোর শক্তিও পাই নি! মাঝেসাঝে মাকে ফোন দেয় কিন্তু আমার নাম্বার থেকে না দোকান থেকে ফোন করে কথা বলি! আমার সাথে যতোক্ষণ কথা বলে শুধু কান্নায় করে! আমি কেমন আছি এগুলা জিজ্ঞেস করার আগে বলে আমি কবে বাড়ি ফিরবো! খুব কষ্ট হয় তখন কিন্তু শত কষ্ট বুকে চাপা রেখেই হাসি মুখে মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যায়! ছোট বোনটি নাকি আমার আশায় পথ চেয়ে বসে থাকে, কিন্তু সেতো জানে না তার ভাইয়াটা আর কখনো তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে না! বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার আগে ছোট বোনটির কপালে একটা চুমু দিয়ে এসেছিলাম হয়তো সেটাই আমার তরফ থেকে শেষ আদর আমার বোনটির জন্য!!
এই নতুন শহরে এসে অনেক কিছু পেয়েছি আমি! কিন্তু মা বাবার ভালোবাসা আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি, সেটা হয়তো আমার কারণেই! টিউশনি করে আমার চলতে হয়। ফেসবুকে এক ছেলের সাথে পরিচিতর মাধ্যমেই এই শহরে আশা আমার! ছেলেটির নাম আবির, এই আবিরের সাহায্য নিয়েই থাকা এই শহরে! আবির না থাকলে হয়তো এতো সহজে এই শহরটিকে আপন করে নিতে পারতাম না! ফেসবুক থেকেই পরিচয় আবিরের সাথে, যেদিন এই শহরে আসি এই আবিরই আমাকে তার কাছে আশ্রয় দেই! এরপরেই আমার নতুন করে পথ চলা। পড়াশুনার পাশাপাশি কয়েকটি টিউশনি করে চলি!
মাগরিবের নামাজ শেষ করেই টিউশনি শুরু আমার একদম রাত এগারোটাই শেষ হয়! নামায শেষ করেই হাটা শুরু করি, নীলাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল চাপ দিলাম। নীলা, আমার ছাত্রী এবার এস,এস,সি পরিক্ষা দিবে, গত তিন মাস যাবত পড়াচ্ছি নীলাকে! পড়াশুনার দিক থেকে পন্ডিত না হলেও সাজসজ্জার দিক দিয়ে একদম পন্ডিত! প্রতিদিন নতুন নতুন সাজে নিজেকে উপস্থিত করে আমার সামনে! বড়লোক বাবার এক মাত্র মেয়ে কোনো কমতি রাখে না তার আবদারে! আমি নিলার চালচলনকে বিলাশীতা ছাড়া আর কিছু বলি না! দ্বিতীয় বার কলিং বেল চাপ দিতেই দরজা খুললো নিলা! প্রতিদিন নিলাদের বাসার কাজের আন্টিই দরজা খুলে কিন্তু আজকে নিলা নিজে দরজা খুললো!
যে মেয়ের কলম মেঝেতে পড়ে গেলে অন্যকেউ এসে কলমটি তুলে দিতে হয় সেই মেয়ে আজকে দরজা খুললো ভাবতেই অবাক লাগছে! সাতপাঁচ ভাবা বাদ দিয়ে নিলার দিকে তাকাতেই কিছুটা অবাক হলাম, আজকে নিলা একটু বেশিই নিজেকে সুন্দরী করে উপস্থাপন করলো! প্রতিদিনের থেকে আজকে নিলাকে বেশিই সুন্দর লাগছে!! কী ব্যাপার নিলা আজকে তুমি দরজা খুললা!? বাসায় কেউ নেই!? আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে বললো ” ভিতরে আসুন স্যার!! আমিও নিলার কথা মতো বাসার ভীতরে গেলাম! বাসায় মনে হচ্ছে কেউ নেই! এই সময় তো দেখি নিলার আম্মু রান্না ঘরে থাকে কিন্তু আজকে কাউকেই বাসায় দেখছি না! আচ্ছা নিলা আজকে বাসায় কেউ নেই!? নিলার দিকে তাকিয়ে কথাটি বললাম! একটু মুচকি হেসে নিলা উত্তর দিলো, ” না স্যার আজকে বাসায় কেউ নেই সবাই ছোট খালামনির বাসায় বেড়াতে গেছে অনেক রাত হবে সবার আসতে! নিলার কথা শুনে বললাম, অহ আচ্ছা তাহলে আমাকে ফোন করে বলে দিতে আজকে পড়াতে আসতাম না আমি!
— না স্যার কোনো সমস্যা নেই আপনি ভীতরে আসুন! কথাটি বলেই নিলা তার রুমে চলে গেলো! আমিও প্রতিদিনের মতো নিলার রুমে গেলাম পড়াতে! নিলাকে পড়ানোর ফাঁকে আমাকে প্রশ্ন করলো নিলা,
— আচ্ছা স্যার আজকে আমাকে কেমন লাগছে!?
— তুমি তো দেখতে এমনিতেই সুন্দর সুতরাং তোমাকে সুন্দরী লাগবে! বইয়ের দিকে তাকিয়েই নিলার কথার উত্তর দিলাম!
— আচ্ছা স্যার আমি আজকে কার জন্য এতো সুন্দর করতে সেজেছি আপনি জানেন!?
— নাহ জানি না!
— স্যার আপনার জন্য! স্যার আপনাকে না আমার খুব ভালো লাগে আমি আপনাকে ভালোবাসি!
নিলার কথাটি শুনে নিলার দিকে তাকালাম! দেখি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! একটা মেয়ের কতোটুকো সাহস থাকতে তার স্যারের সামনে এতো বড় কথা বলতে পারে!!
— তোমার মাথা ঠিক আছে নিলা!? আর যদি শুধু মাত্র আমাকে সম্মানের চোখে ভালোলাগে তাহলে ঠিক আছে! কারন প্রতিটা শিক্ষার্থীর উচিত তার শিক্ষকদের কে ভালোবাসা!
— না স্যার আমি আপনাকে অন্যরকম ভালোবাসি, যেমন টা একটা বয়ফ্রেন্ড তার গার্লফ্রেন্ডকে ভালোবাসে, স্বামী তার স্ত্রীকে ভালোবাসে ঠিক তেমনটাই আমি আপনাকে ভালোবাসি!!
— নিলা তুমি ভুলে যাচ্ছো আমি তোমার শিক্ষক হয়! আর শিক্ষকদের বিষয়ে এগুলা ভাবাও অন্যায়!!
— আফরান আমি তোমাকে ভালোবাসি আমি আর কিছু বুঝতে চাই না!!
— চুপ একদম চুপ নিলা আর একটা আজেবাজে কথা বললে আমি এখুনি চলে যাবো! আর কখনো তোমাকে পড়াতে আসবো না!!
— আমাকে পছন্দ হয় না আপনার!? আমাকে ভালোবাসতে আপনার প্রব্লেম কোথায়!? আমার চোখে চোখ রেখেই কথাটি বললো নিলা!
— তোমাকে ভালোবাসাও তো আমার জন্য অপরাধ নিলা! যেখানে তোমার বাবা- মা আমাকে বিশ্বাস করে তোমার পড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছে সেখানে তাদের বিশ্বাদের খেয়ানত কিভাবে করতে পারি আমি!?
— আচ্ছা আফরান আমরা চলো বিয়ে করে ফেলি তাহলেই আমার বাবা মা আমাদের সম্পর্কটিকে মেনে নিবে!!
— আমাকে কতটুকু চিনো তুমি নিলা!? কতোটুকু জানো আমার বিষয়ে!? এইটা তোমার ভালোবাসা নাহ নিলা এইটা তোমার মহো আবেগ! আর আমি এখন তোমার সাথে একটা কথাও বলবো না চলে যাচ্ছি আমি! কথাটি বলেই নিলাকে রেখে চলে এলাম!
যে ভালোবাসার জন্য আমি আমার মা বাবা কে ছেড়ে চলে আসছি সেই ভালোবাসার মধ্যে আর কখনো জোড়াবো না! যেই ভালোবাসার কষ্ট ভুলতে ভুলতে আমি পাগল প্রায় সেই ভালোবাসা চাই না আমি! পাঁচ বছর আগে যে ভালোবাসার জন্য নিজের পরিবার ছাড়তে হয়েছে আমার সেই ভালোবাসা চাই না আমি! হ্যাঁ নিজের ভালোবাসার কষ্ট বেদনা ভুলতেই আজ আমি এই অচেনা শহরে! ভালোবাসার মানুষটির পাশে থাকতে পারবো না বলেই আজ আমি নিজের পরিবার থেকে দূরে! অনেক দূরে! প্রিয় মানুষটিকে না পাওয়ার যন্ত্রণা যে কতটা সেটা তখনই বুঝা যায় যখন সেই প্রিয় মানুষটিকে পাওয়া যায় না! আমি চাই না নতুন করে আর কারো ভালোবাসার মানুষ হয়ে কষ্ট পেতে! কাউকে বিশ্বাস করি না আমি কাউকে না!!
হিয়া, আমার ভালোবাসা! আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা! আমার প্রথম প্রেম! এই হিয়ার থেকেই আমার ভালোবাসা শিখা! এই হিয়ার থেকেই আমার ভালোবাসার কষ্ট পাওয়া! কি অদ্ভুত তাই না!? যেই মানুষটার থেকেই আমি ভালোবাসার মানে বুঝলাম! ভালোবাসার আনন্দ অনুভূতি বুঝলাম আবার সেই মানুষটির থেকে ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা কষ্ট শিখলাম! দুনিয়াটা আসলেই অদ্ভুত, আর সাথে দুনিয়ার মানুষ গুলাও! আমার জীবনে যখন কোনো রঙ ছিলো না এই হিয়াই আমার জীবনে রঙ এনে দিয়েছিলো! পূর্ণতা দিয়েছিলো আমার জীবন চলাকে! আবার আমার জীবনে অন্ধকার কালো আচ্ছন্ন করে চলে গেলো!
হিয়াকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম আমার দুটি নয়ন হিয়ার মুখে তেই আটকে গিয়েছিলো! প্রথম দেখাতেই হিয়াকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম! ভালোবাসা বলতে তখনো কিছু বুঝি নাই আমি! বুঝি নাই ভালোবাসা কাকে বলে! কিন্তু সেদিন হিয়াকে দেখে বুঝেছিলাম অচেনা কাউকে দেখে বুকের মধ্যে যে অনুভূতি সৃষ্টি হয় সেটাই বুঝি ভালোবাসা! অচেনা কাউকে হঠাৎ দেখে রাতের ঘুম হারাম করাকেই বলে বুঝি ভালোবাসা! সব কিছুতেই সেই অচেনা কাউকে নিয়ে ভাবনা কে বুঝি বলে ভালোবাসা! হিয়াকে দেখার পরে এই সকল ঘটনায় ঘটেছিলো আমার সাথে! আস্তে আস্তে হিয়ার সাথে পরিচয় হয় আমার! ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয় আমাদের! যেই সম্পর্ক আমাদের দুজনকে অনেক আপন করে তুলে! ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয় আমাদের! সেই প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি যা এখনো আমাকে আনন্দিত করে!
কিন্তু হঠাৎই আমার এই ভালোবাসা আমার জীবন থেকে হারিয়ে যায়! যেই ধাক্কাটা আমার জীবনের পাতা উলটপালট করে তুলে! হ্যাঁ, এক রাতেই হঠাৎ হিয়ার বিয়ে হয়ে যায়! জোর করে হিয়ার বাবা হিয়াকে বিয়ে দিয়ে দেই! সন্ধ্যায়ও যেই ভালোবাসা আমার কাছে ছিলো রাতেই সেই ভালোবাসা অন্যকারো হাতে তুলে দেই হিয়া! মিথ্যা হয়ে যায় আমার ভালোবাসাটা! হারিয়ে যায় আমার জীবন থেকে আমার সুখ! সুখ হারিয়ে আমার জীবনে স্থান করে তুলে অর্থহীন কষ্ট যন্ত্রণা! কাউকে বুঝাতেও পারতাম না কতোটা কষ্টের মধ্যে থাকতাম আমি! কয়েকবার এই মরণ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পরে নিজের জীবনটাই শেষ করতে গিয়ে ছিলাম কিন্তু পারি নি! চোখের সামনে আমার কষ্ট দেখে বাবা- মা পরিবারের সবাই কষ্টে থাকতো! একে প্রেমের বেদনা তার উপর পরিবারের কষ্ট একদম শেষ করে দিচ্ছিলো আমাকে! তাই বাধ্য হয়ে নিজের পরিবার প্রিয় শহর রেখে এই অচেনা শহরে চলে আসছিলাম! আমি চেয়েছিলাম আমার কষ্ট যন্ত্রণা শুধু আমি একাই অনুভব করবো! আমার কষ্টের ভাগিদার আমার পরিবারকে হতে দিবো না!
আমার এই কষ্টের জীবনের মাঝে আমি চাই না আর নতুন করে কাউকে আমার জীনবে আশ্রয় দেয়! আমি চাই না আবার নতুন করে এই ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা! হিয়া সেদিন আমাকে রেখে অন্য কারো কাছে চলে গেলো কিন্তু আমাকে রেখে গেলো পাহার সমান যন্ত্রণার মাঝে! সেদিন হিয়া ঠিকি অন্য কারো কাছে সুখ খুজে নিয়েছিলো, কিন্তু আমি আমার সুখটিকে সেই রাত জাগানো নিকোটিকেই পেয়েছিলাম! আজো তোমাকেই ভালোবাসি আমি হিয়া! অনেক বেশিই তোমাকে ভালোবাসি! জানি আর কখনো পাবো না তোমাকে তবুও শুধু তোমাকেই ভালোবাসি!
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত