স্পর্শানুভূতি

স্পর্শানুভূতি
তিন বছর পর এই প্রথমবার মা আমাদের বাড়ির ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠির একপাশে আমার নিজের নাম লেখা, অন্যপাশে মায়ের। চিঠিটা খুলতে গিয়ে হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। এতোদিন ধরে হৃদয়ে যে ক্ষোভের দেয়াল তৈরি করেছি সেই দেয়াল ভেঙ্গে চিঠি খোলার সাহস তৈরি করতে অনেক সময় লাগলো। বাবার সাথে অভিমান করে মা চলে যাওয়ার পর বুকের ভেতরে যেই পাথরচাপা কষ্টটা ঘাঁটি গেড়েছিল, সেই কষ্টটা মুহূর্তেই পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। চিঠিতে শুধু মা একটি লাইন লিখেছে- “খোকা এক বারের জন্য তর বাবাকে নিয়ে আসবি ?” আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এই প্রথম বার চিঠি পাঠিয়েছে, অথচ চিঠিতে মা একবার ও জানতে চায়নি আমি কেমন আছি। জানতে চায়নি দিনগুলো আমার কিভাবে কাটছে। খাইয়ে না দিলে যে ছেলেটা খেতে পারতো না, সে ছেলেটা ঠিক ভাবে খাচ্ছে তো! এসব কথাগুলো ভাবতে গিয়ে কেন জানি মনে হলো- মা ভালো নেই।
মা খুবই অভিমানী, মাকে পুরো এক জীবনে কখনোই বাবার কাছে হার স্বীকার করতে দেখিনি। যেদিন মা বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। যাওয়ার সময় স্পষ্ট গলায় বলেছিল- বেঁচে থাকতে কখনোই আর যোগাযোগ হবে না। মায়ের মুখে এতো কঠিন কথা শুনেও ভেবেছিলাম মা ফিরে আসবে। আমার ভাবনা ভুল ছিল, এই তিনটি বছর অনেক চেষ্টা করেও মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি, অনেক খুঁজেছি। নেই, মা কোথাও নেই। অভিমানী মা আজকে নিজে থেকেই চিঠি দিয়ে যোগাযোগ করেছে। আমাকে আর বাবাকে দেখা করতে বলছে, মা এতো পাল্টে গেলো কিভাবে ? মায়ের কোন সমস্যা হয়নি তো ? ভাবতেই মনটা বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। যে মায়ের প্রতি তিন বছরে হৃদয়ে এতো ক্ষোভ জন্মেছে, সামান্য একটা চিঠিতে মায়ের কথা ভেবে হৃদয়ের ভেতরেটা এমন করছে কেন বুঝতে পরছি না!
চিঠিতে লিখা একটি লাইন কতবার পড়েছি হিসেব নেই। পড়ার সাথে সাথে সময় বাড়ছে, কমে আসছে অফিস থেকে বাবার ফিরে আসার সময়। মায়ের কথা রাখবো কিভাবে এটা ভাবতে গিয়ে টেনশনে সবকিছু এলোমেলো লাগছে। চিঠির কথা শুনে বাবা কি ভাববে ? চিঠির খামে দেওয়া মায়ের যে ঠিকানা লিখা আছে বাবাকে সেই ঠিকানায় নিয়ে যেতে পারবো তো ? মা চলে যাওয়ার পর বাবা এক বারের জন্য ও বিয়ের কথা ভাবেনি। বাড়ির সবকিছুই আগের মতো চলছে, খুব চেষ্টা করে আমাকে হাসিখুশি রাখতে, মায়ের অভাব যেন খুব বেশি টের না পাই তাই মায়ের কথা মুখ দিয়ে একবার ও উচ্চারণ করে না।
মা চলে যাওয়ার আগে সন্ধ্যার পর প্রায় সময় বাবা-মা দু’জনে বসে তাদের শৈশবের কথাগুলো বলতো। ভালবেসে বিয়ে হয় দু’জনার, তাদের ভালবাসা মেনে না নিয়ে যেদিন মায়ের বিয়ে ঠিক করা হয়, সেদিন রাতেই শত বাধা জয় করে, সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মাকে নিয়ে বাবা পালিয়ে আসে চট্টগ্রাম শহরে। এখন সন্ধ্যা হলেই শৈশবে কাটানো তাদের অসাধারণ মুহূর্তের ঘটনা গুলো শুনতে ইচ্ছে করে, খালি পকেটে চট্টগ্রামে এসে ভালবাসার শক্তি দিয়ে সবকিছু জয় করার ঘটনা গুলো বারবার শুনতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছার কথা বাবাকে বলা হয় না। মা চলে যাওয়ার পর বাবা ড্রয়িং রুমে টানানো মায়ের ছবিটি সরিয়ে ফেলেছে। অফিস থেকে আসার পর হারমোনিয়াম হাতে গুনগুনিয়ে কি যেন বলেন, স্পষ্ট বুঝা যায় না। তবে এতটুকু বুঝতে পারি মাকে ভুলে থাকার জন্যই সন্ধ্যার সময়টা হারমোনিয়াম নিয়ে কাটানোর চেষ্টা করেন। কি দরকার আছে পুরোনো গল্পের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বাবার ভেতরে কষ্ট তৈরি করার ?
বাবা অফিস থেকে ফিরে এসেছে। হাতে ছোট একটি কেক। আগামীকাল আমার জন্মদিন। প্রতি বারই জন্মদিনের কয়েকটা দিন আগে আমার কাছে মনে হয় বাবা দিনটির কথা মনে রাখতে পারবে না, অফিসের এতো ব্যস্ততার মাঝেও ঠিকই মনে রাখে। কিভাবে মনে রাখে কে জানে ? বাবা এসেই আমাকে দরজার কাছে দেখে হাসিমুখে বললো, তাড়াতাড়ি কেক টা হাতে নাও এখনি রান্না শুরু করতে হবে। রান্না ঘরে রাতের খাবার সবকিছুই আছে। তবু ও বাবা কেন রান্না করবে ? কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, বাবা সত্যিই তুমি রান্না করবে ? কেন করবো না ? আজ তোর জন্ম দিন, জন্ম দিনে তোর সবচেয়ে পছন্দের খাবার বিরিয়ানি আমি নিজ হাতে তৈরি করবো। কিরে, কি খুশি হয়েছিস ? নাহ, একদমই খুশি হইনি। যদি আমার কথাটি রাখতে পারো তবেই খুশি হবো। কি কথা বলে ফেল। আগামীকাল তোমাকে সাথে নিয়ে নতুন এক জায়গায় ঘুরতে যাবো, যাবে ? বাবা, না করবে না প্লিজ। আচ্ছা ঠিক আছে। অনেকদিন হলো এমনিতে ও ঘুরতে বের হওয়া হয় না। তর জন্মদিনের পুরো সময়টা না হয় ঘুরে কাটালাম।
শেষ রাতে টেনশনে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কোন কিছু না বলেই বাবাকে যখন মায়ের সামনে নিয়ে দাঁড় করাবো বাবা কি ভাববে ? বাবা যাকে ভুলার চেষ্টা করছে, তাকে সামনে দেখার পর এক বারের জন্য ও চোখ তুলে তাকাবে তো ? বাকি রাতটা ভাবনায় আসা এসব প্রশ্ন গুলো নিয়ে ভেবে ছটফট করে কাটলো। চেষ্টা করে ও ঘুমাতে পারলাম না।
সকালের কুয়াশা কেটে বাইরে রোদ উঠতে উঠতেই দশটা বেজে গেলো। আমার সাথে ঘুরতে বের হওয়ার জন্য বাবা পঞ্জাবী পড়েছে। পঞ্জাবী পড়ায় বাবাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। বাবাকে সাথে নিয়ে রেল স্টেশনে আসলাম। ট্রেনে উঠার পর বাবা আগ্রহ নিয়ে বললো, কোথায় যাচ্ছি ? ট্রেন যেখানে থামবে ঘোরার মতো ভালো কোন জায়গা আছে তো ? আমি জবাব দিলাম না। বাবার হাতটি শক্ত করে ধরে চুপচাপ বসে রইলাম। ট্রেন ছুটে চলছে। আমি তাকিয়ে আছি সবুজে ঘিরে রাখা প্রকৃতির দিকে। ট্রেন থেকে নেমে বাবাকে সাথে নিয়ে চিঠিতে লিখা ঠিকানায় আসলাম। চিঠির খামে দেওয়া ঠিকানায় যে বিল্ডিংয়ের নাম লিখা, তার পুরোটাই হসপিটাল। আশ্চর্য, এমনটা তো হওয়ার কথা নয়! মা তাহলে ভুল ঠিকানা দিয়েছে ? মা এমনটা কেন করলো ?
বাবাকে দাঁড় করিয়ে পকেট থেকে চিঠির খামটি বের করে হাসপাতালের রিসিপশনে থাকা ভদ্র লোককে দেখালাম। ভদ্রলোক বললো, এই নামের মহিলাটি তিন তালায় জরুরী ইউনিটের কেবিনে আছে। ভদ্র লোকের কথা শুনে বাবার কাছে আসতেই বাবা বললো, ঘুরতে এসে এখানে কেন ? হাসপাতাল বুঝি ঘুরা ফেরা করার জায়গা ? হাতে থাকা চিঠির খামটি বাবার হাতে দিতে ভয় হচ্ছে। মায়ের কাছে নিয়ে আসার জন্যই ঘুরতে বের হওয়ার কথা বলেছি, এটা শুনলে কি ভাববে ? চোখ বন্ধ করে বাবার হাতে চিঠিটা দিয়ে দ্রুত গলায় বললাম, এই চিঠিটা মা দিয়েছিল। চিঠিটা হাতে নিয়ে বললো, তোর মা এখানে আছে ? হ্যাঁ, বাবা। আছে তিন তলায় জরুরী ইউনিটের কেবিনে। বাবা চিঠির ভেতরের লিখাটা না পড়েই সিঁড়ি বেয়ে পাগলের মতো উপরের দিকে উঠতে শুরু করলো। আমি বাবার পেছনে পেছনে ছুটলাম। বাবার ছুটে চলার দ্রুততা দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর কোন শক্তি নেই আজ বাবাকে থামিয়ে রাখবে।
হাসপাতালে মায়ের কেবিনে ঢুকে নার্সের কাছে শুনলাম মা ক্যানসার নামক মারাত্মক রোগে ভুগছে। শ্বাস নেওয়ার জন্য মায়ের মুখে সিলিন্ডার দিয়ে অক্সিজেন দিয়ে রাখায় মা কথা বলতে পারছে না। মায়ের দুটি হাত বাবা শক্ত করে ধরে রেখেছে, বাবাকে দেখার পর থেকেই মা অবিরাম কেঁদেই যাচ্ছে। শুয়ে থাকায় চোখ দিয়ে সেই পানি গড়িয়ে পড়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। বাবাকে কখনোই কাঁদতে দেখিনি, আজকে বাবার চোখ দিয়ে বাঁধভাঙা কান্নার পানি দেখে মায়ের খুব কাছে দঁড়িয়ে থাকা আমারও চোখ বেয়ে পানি পড়তে শুরু করলো। এই তিনটি বছর মাকে না পেয়ে বুকের ভেতরে হাহাকারময় যে অনুভূতিগুলো ছিল তা ভুলে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। ধরতেই নার্স এসে বললো, এই মুহূর্তে রোগীর কাছে বেশি ক্ষণ থাকা উচিত নয়। আপনারা কেবিন থেকে বাইরে এসে বসুন।
নার্সের কথা শুনে হাতটি সরিয়ে নিতেই মা পিঠে হাত রেখে গভীর সুখে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখলো। মমতাময়ী মায়ের হাতটি সড়ানোর একটু ও চেষ্টা করলাম না। যে প্রবল মমতায় আগলে রেখেছে তা উপেক্ষা করে সামান্য দূরে আসার ক্ষমতা ও আজ আমার নেই। আমার চোখের জল থেমে গিয়েছিল, তা আবার ভিজে উঠেছে আনন্দ অশ্রুতে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত