অনেক ভালোবাসি

অনেক ভালোবাসি
কিছুক্ষণ আগে প্রাক্তনের মৃত্যুর খবর পেলাম। ঠিক প্রাক্তন বলা যায় না সাদাত ছিলো আমার প্রথম ভালোবাসা, আমার পুরোটা জুড়ে শুধু তারই আনাগোনা ছিলো। অনেক ছোট থেকেই সে আমার খেলার সাথী ছিলো। পাশাপাশি বাড়ি হওয়াতে একসাথে স্কুলে যাওয়া, প্রাইভেটে যাওয়া সব সময়কার সাথী ছিলো সে আমার। ভালোবাসা কি বুঝার অনেক আগেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এইচ এস সি শেষে যখন আমরা পুরো পরিবার ঢাকায় শিফট করলাম, তখনও আমরা শুধুই বন্ধু ছিলাম। ঢাকায় আসার পরই আমি প্রথম শূণ্যতা কি তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। সব থেকেও কেনো যেনো একটা চাপা হাহাকার কাজ করতো। কিন্তু ইগোর কারনে হোক বা যাই হোক কখনোই মুখ ফুটে সাদাতকে বলতে পারিনি যে আমি তাকে প্রচন্ড ভালোবাসি।
বলিনি ভয়ে, যদি বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়। ঢাকায় আসার ৫ দিন পর তার সাথে প্রথম ফোনে কথা হয়, ফোনের ওপাশে তার দীর্ঘশ্বাসই বলে দিচ্ছিলো সে ভালো নেই। কারন জানতে চাইলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলো। সব সময় মনে হতো আবার গ্রামে ফিরে যাই। নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করতাম। সবার অগোচরে চাপা কষ্টে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। ঢাকায় আসার ১৫তম দিনে খুব ভোরে কলিং বেলের আওয়াজ পেলাম, উঠে গিয়ে দেখলাম দরজায় সাদাত। আমি তাকে দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়ি। ঐ দিনটার কথা মনে হলে আজও ঠোটের কোণে মনের অজান্তেই হাসি ফুটে উঠে। ১৫ দিন আমার কাছে ১৫ বছর মনে হয়েছিলো। এরপর সেও ঢাকায় এসে পরে। যদিও ঢাকায় থাকার মতো পরিচিত কেউ তার ছিলনা। শুধুমাত্র আমার জন্যই তার ঢাকায় আসা।
আমাদের বাসায় বাবা তার থাকার ব্যবস্থা করে দেন। দুজন ভার্সিটি ভর্তির জন্য উঠে পড়ে লাগলাম। ফলাফল সে সুযোগ পেলো রাজশাহীতে আমি ঢাকাতে। আবারও দুজন দুদিকে ছিন্ন হয়ে গেলাম। রাজশাহী চলে যাবার আগে সাদাত প্রথম আমাকে বলেছিলো, সে আমাকে ভালোবাসে, আর সেই ভালোবাসাটা অনেক বেশী তীব্র। আমি সেদিন খুব কেদেছিলাম, খুশিতে কেদেছিলাম যে অবশেষে ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। সে পড়তে রাজশাহীতে চলে যাবার পর, আবারও আমার মধ্যে সেই চাপা কষ্ট। প্রতি মাসেই সে আমার সাথে দেখা করতে আসতো। তার পরিবার অতটা স্বচ্ছল ছিলনা, টিউশনি করিয়ে তার চলতে হতো, তার উপর প্রতি মাসে ঢাকায় আসা যাওয়া। সবই বুঝতাম কিন্তু অবুঝ মন তখন তা বুঝতো না।
আমি একটু একটু করে টাকা জমাতাম ওকে সাহায্য করার জন্য। ভোরে ঢাকা আসতো সারাদিন একসাথে ঘুরতাম আবার রাতেই রাজশাহী ফিরে যেতো। ভালোবাসা এতোটাই ছিলো যে সেই কষ্ট টাকেও কষ্ট মনে করতো না। আসার সময় আমার জন্য আমার পছন্দের সব খাবার নিয়ে আসতো। মাসের বাকী দিন গুলি কাটতো গুনে গুনে যে কবে সেই তারিখটা আসবে যেদিন ভোরে সাদাত আসবে। তার আশায় পথ চেয়ে থাকতাম। দেখতে দেখতে ৪ বছর কেটে যায়। সব ভালোই যাচ্ছিলো, হঠাৎ বাসা থেকে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলে আমাকে না জানিয়েই বাবা কথা দিয়ে ফেলেন। আমি সাদাতকে বাবার সাথে কথা বলতে বলি কিন্তু সে সময় চায় যা আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব ছিলো না সে সময়। রাগে তার সাথে কথা কাটা কাটি হয় আমি কথা বলা বন্ধ করে দেই। আশায় থাকি সে হয়তো কল করবে, বলবে, আমি আসছি। কিন্তু সে কল করে না। ১ দিন পাড় হয়ে যায় সে কল করে না। প্রচন্ড রাগ হয়, নিজেই কল করি কিন্তু ফোনটা বন্ধ। ফেসবুকে অনেক মেসেজ দিলাম কিন্তু একটাও সিন হলো না।
রাগটা আরোও বেড়ে যায়। তার সাথে আমার কখনোই ১ দিনের বেশি কথা বন্ধ থাকেনি যতোই রাগারাগি হতো সব ভুলে গিয়ে হলেও আমরা আবার শুরু করতাম। কিন্তু এবার ৭ দিন পাড় হয়ে গেলো তাকে পাচ্ছিনা। কোনো ভাবেই যোগাযোগ করতে পারছিলাম না।মনে মনে এতটাই রাগ হলো যে কিছুই চিন্তা করতে পারছিলাম না। সাদাত কি তাহলে আমাকে বিয়ে করতে চায় না! মাথায় শুধু এই একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতো। মনে হতো হয়তো সে আর আমাকে চায় না তাই এই ব্রেকাপ। প্রচন্ড রাগে নিজের আবেগ ভালোবাসা কে নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলাম। ভিতরে ভিতরে দুমড়ে মোচড়ে মরে যাচ্ছিলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম তার ফিরে আসার। কিন্তু সে আসেনি। ঠিক ৩ মাস পর আমি তার মৃত্যুর খবর পাই। গ্রামের বাড়ি থেকে এক আত্মীয় এলে তার কাছেই সাদাতের মৃত্যুর খবরটা পাই। সাদাত ঢাকা আসার পথে ৩ মাস আগেই নির্মম ভাবে খুন হয়। একদল সন্ত্রাস কুপিয়ে তাকে খুন করে। খবরটা শুনে নিজেকে সামলাতে পারিনি। সবার সামনেই চিৎকার করেই জ্ঞান হারাই। এরপর নিজেকে সামলাতে আমার বেশ সময় লাগে। যখন আমার বয়স ৫ তখন থেকে সাদাত আমার বন্ধু ছিলো।
কখনোই ভাবিনি তাকে এইভাবে হারিয়ে ফেলবো। তার সাথে দেখা সব স্বপ্ন গুলি স্বপ্নই রয়ে গেলো। এখনো মাসের সেই তারিখটায় তার অপেক্ষায় থাকি। হয়তো সে একদিন ফিরে আসবে। হয়তো আমি আবার তাকে দেখতে পাবো। হয়তো সে আমার প্রাক্তন না আমার ভবিষ্যৎ হবে। সব হয়তো গুলিই প্রতি রাতেই আমাকে একরাশ চাপা কষ্টে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাকে হারিয়েছি আজ ৪ বছর শেষ হলো। মনে হয় এইতো সেদিন সে আমাকে প্রথম বলেছিলো অনেক ভালোবাসি ভালোবাসাটা তীব্র…..
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত