আমার বউ

আমার বউ
বিয়ের ছয় মাসের মাথায় বউকে নিয়ে নতুন বাসায় ওঠার পর বউ আমার পুরোপুরি ঘরকন্নায় ব্যস্ত হয়ে গেলো। সদ্য হোম ইকনোমিকস থেকে অনার্স মাস্টার্স করা আহ্লাদী আনাড়ি মেয়েটা নিজের বাবার সুরম্য ফ্ল্যাট ছেড়ে স্বামীর মাত্র দুই রুমের ভাড়া বাসার বৈভব হীন সংসারে এসে একেবারে মহাসমুদ্রে পড়লো।
সে ভাতের মাড় গালতে পারেনা, বাজার থেকে কেটে নিয়ে আসা কাঁচা মাছ ফ্রীজে রাখতে গেলে সে প্যাকেট করে না রেখে ডীপের ড্রয়ারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে দেয়, যেটা রান্না করার আগে জমাট বাঁধা বরফ থেকে আলাদা করতে পারেনা। আমি তাকে দায়িত্ব নিয়ে রান্না বান্না শেখালাম, বাসার পাশেই মীনাবাজার থেকে বাজার করা শেখালাম।
একদিন দেখলাম সে ব্যাংক জবের বই কিনে এনে খুব মন দিয়ে পড়ছে। আমার খুব মায়া লাগলো, সারাদিন একা একা থাকে, কীভাবে সময় কাটে একলা একটা মানুষের? আমি অনলাইন এপ্লিকেশন করে ওকে একটা স্বনামধন্য ব্যাংকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে গেলাম বার দুয়েক। দুইবারই সে রিটেনে কোয়ালিফাই করলো, কিন্তু ভাইভাতে বাদ পড়লো। এ নিয়ে তার আর দুঃখের সীমা নেই! আমি ওকে আস্বস্ত করে বললাম, রবার্ট ব্রুসের কথা মনে নেই তোমার?
সে চোখ বড় বড় করে বললো, তার মানে আমাকে সাতবার পরীক্ষা দিতে হবে?
-দরকার হলে সাত দুগুনে চৌদ্দবার দিবা। অসুবিধা কোথায়? না, চৌদ্দবার পরীক্ষা দেয়া লাগেনি, পঞ্চম বারেই তার চাকরি হয়ে গেলো।সে চাকরি পাওয়ার পর আমার কাছ থেকে নেয়া মাসিক হাত খরচের টাকা আরও বাড়িয়ে দিতে বললো! চাকরি পাওয়ার আগে তাকে আমি সংসার খরচ বাদ দিয়ে বাড়তি যে টাকাটা হাত খরচ হিসেবে দিতাম, চাকরি পাওয়ার পর তার অফিসে আসা যাওয়া বাবদ যে টাকাটা খরচ বাড়লো সেই টাকাটাও আমাকে বাড়তি দেয়া শুরু করতে হলো প্রতি মাসে!
আমি মাঝেমধ্যে কোন ওয়ার্কিং ডে’তে ছুটিছাটা পেলে ভর দুপুরে বউয়ের ব্যাংকে চলে যেতাম, গুলশানে। আমরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে প্রেমিক প্রেমিকার মতো ডেটিং করতাম, দুপুরে একসঙ্গে লাঞ্চ সেরে আমি একা একাই বাসায় ফিরে আসতাম বিমর্ষ চাহনি নিয়ে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, বেতনের একটা টাকাও সে কখনো ব্যাংক থেকে তুলতো না, আমিও তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতাম না। কারণ, খুব বেশি বিত্ত বৈভব না থাকুক, আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাদের সংসারে কোন অভাব ছিলোনা। একদিন বিকেলের দিকে অফিস থেকে সে ফোন দিয়ে বললো, সাভারে একটা ভালো জমির সন্ধান পেয়েছে। ওর বড় বোন কানাডা থেকে ফোন দিয়ে বলেছে, তোরা যদি সাথে থাকিস তাহলে জমিটা কিনবো। আমি বললাম, তুমি তো জানোই যে আমার কাছে জমানো টাকাপয়সা বেশি নেই! সে আমাকে আশ্বস্ত করে বলল, আমি তোমাকে হেল্প করবো। এতো চিন্তা করছ কেন? সেই প্রথমবার ওর ব্যাংকের জমানো টাকায় হাত পড়লো। ওর সংযম আর দূরদর্শিতায় আমরা নিজস্ব একখণ্ড জমির মালিক হলাম! এবং জমিটা সে আমার নামেই রেজিস্ট্রি করালো।
এরপর আরও একবার ওর জমানো টাকার সন্ধান পেলাম, যখন ফ্ল্যাটের টাকা বুকিং দিতে যাই! একগাদা টাকার চেক লিখে এনে আমার একাউন্টে জমা দেয়ার সময় আমার ব্যাংক বিপত্তি বাঁধাল! সেসব কথা আর নাইবা বললাম!
সংসারের সম্পদ গড়ার কোন বড় কাজ ছাড়া ওর জমানো টাকার হদিস পাওয়া মোটামুটি অসম্ভব! আমি এটা নিয়ে বেশ এনজয় করি প্রতি বছর রমজানে, যখন যাকাতের টাকাপয়সার হিসেব নিকেশ করতে বসি। নিজের অল্পসল্প তল্পিতল্পার হিসেব শেষ করার পরে ওকে যখন জিজ্ঞেস করি, তোমার একাউন্টে কত টাকা আছে? সে বিস্মিত হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে, সেটা নিয়া তোমার এতো মাথাব্যাথা কেন?আমি বলি, যাকাত কী এবার তুমিই দিবা? ঠিক আছে তাইলে দেও! সে তখন জিহ্বায় কামড় দিয়ে অস্ফুট কন্ঠে জবাব দেয়, কতো আর আছে? ধরো ****** টাকা! আমি চোখ কপালে তুলি প্রতিবার! গত সাড়ে সাত বছরের চাকরি জীবনে সে অসংখ্যবার চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা একবারও কার্যকর হয়নি। বিশেষ করে বাচ্চা হওয়ার পর থেকে এই অব্দি বাচ্চা আর সংসারের চাপে সে নাস্তানাবুদ হয়ে বহুবার আমার অসন্তোষের সামনে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।
মুখে মুখে রাজি হলেও মন থেকে সে চাকরি ছাড়ার ব্যাপারে একেবারেই রাজি ছিলোনা কখনই। কিন্তু গতমাসে সে নিজে নিজেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলো, চাকরিতে এবার রিজাইন দিবেই দিবে। কারণ, এবার আমার শ্বাশুড়ি হজ্জে যাচ্ছেন, সাথে আমার ছোট ভায়রা আর ওর মা। ওদের কোন ভাই নেই, তিন বোন তিন জায়গায়। বড় বোন কানাডায়, আমরা বনশ্রী থাকি বউয়ের বাপের বাড়ির কাছেই, আর ছোটটা মিরপুর। অতএব আমার শ্বশুরমশায় আর আমাদের বাচ্চা একলা হয়ে যাচ্ছে দেড় দুই মাসের জন্য। আমার বউয়ের ওপর তার নিজের সংসার, মায়ের সংসার, আর ছোট বোনের সংসারের দায়িত্ব একসঙ্গে এসে পড়লো। এবার ঠেলা সামলাও! সিদ্ধান্ত হলো, সে জুলাই মাস থেকে আর চাকরি করবেনা। কিন্তু, এবার বিপত্তি বাঁধালো তার বস স্বয়ং! উনি স্ট্রেইট বলে দিলেন, তোমাকে আমরা ছাড়বো না, তুমি আমাদের কাছে অনেক ইম্পর্ট্যান্ট। তোমাকে আমি দুই মাসের ছুটি দিয়ে দিচ্ছি, আশাকরি তোমার মা হজ্জ থেকে ফিরে এলে আবার অফিস শুরু করবে।
বাসায় এসে সেদিন আমার সাথে ব্যাপারটা আলাপ করার পর আমি কেন জানি খুশিই হলাম। বউ তার অফিসে খুব পটেনশিয়াল একজন পারফর্মার, এটা শুনে কোন্ জামাই গর্বিত না হয়? এবার কিছু প্রকট ভালোবাসার কথা বলি। ও ছোটবেলায় অন্য দুই বোনের মতো নাক ফোঁড়ায় নি। আমাদের বিয়ের প্রায় সাত বছর গত হবার পর একদিন হঠাৎই আমি (নিছক দুষ্টুমির ছলে) আক্ষেপ করে বললাম, আহারে! সবার বউ নাকফুল পরে, আর আমার বউয়ের নাকে তো ছিদ্রই নাই! পরেরদিন অফিস থেকে ফিরে এসে আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, বউ তার নাকের মধ্যে কী এক আজব জিনিস লাগিয়ে বসে আছে। আমি ভ্রুঁকুচকে ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, কী ঘটেছে? সে কাতর গলায় বললো, পার্সোনায় গিয়ে নাক ফুটো করে এসেছি। এখন ব্যাথায় মরে যাচ্ছি। হাজার হোক জামাইয়ের শখ!
আমি পরেরদিনই ওকে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড থেকে একটা নোজপিন কিনে দিলাম। ইদানিং ওর রান্না ছাড়া অন্য সবার রান্না আমার কাছে বিস্বাদ লাগে! অথচ এই মেয়ে একদিন ভাতের মাড় পর্যন্ত গালতে পারতো না! কয়েকদিন আগে আমার শ্বাশুড়ির সামনেই বলে ফেললাম, মা! আপনার চেয়ে আপনার মেয়ের রান্নায় বেশি মজা। উনি ঠোঁট টিপে হাসলেন। মায়েরা বোধহয় নিজের চেয়ে নিজের মেয়ের প্রশংসা শুনতেই বেশি ভালবাসে। পৃথিবীতে এই একটা জায়গায় মেয়েরা নিজের রান্নার দূর্নাম শুনতেও দ্বিধাবোধ করেনা। উনি আমাকে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বললেন, যতই দিন যাবে, তোমার বউয়ের রান্নার মজা ততই বাড়বে, বাবা! এটাই সংসার।
আসলে এটাই সংসার! যতই দিন যাচ্ছে, আমার বউয়ের প্রতি ভালোবাসা ততই বেড়ে যাচ্ছে, ওর প্রতি ততই ডিপেন্ড্যান্ট হয়ে পড়ছি। স্বামী স্ত্রীর পারষ্পরিক ভালোবাসার পরিমাণ বোধহয় সংসারের বয়সের সমানুপাতিক! যতই সংসার পুরানো হয়, ভালোবাসা ততই বাড়তে থাকে। ঠিক সূর্য ডোবার আগের মুহূর্তের মতোন, সূর্য যতই ডুবে যেতে থাকে ছায়ারা ততই দীর্ঘ হতে থাকে!
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত