ভালবাসার সন্ধানে

ভালবাসার সন্ধানে

রফিজ আলীর বয়স প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই,এই বয়সে কোন রকমে ভাড়ার রিক্সা চালিয়ে যা আয় হয় তা রিক্সার মালিককেই প্রায় অর্ধেক দিয়ে দিতে হয়।সামান্য কিছু টাকা থাকে যা দিয়ে নিজের বউ আর চার সন্তান নিয়ে কোনরকমে সংসার চালায়।
.
রফিজ আলী অনেকক্ষণ ধরে উদ্দেশ্যবিহীন রিক্সা চালাচ্ছে কিন্তু গন্তব্য কোথায় সে নিজেই জানে না,তাছাড়া দোষটা তো আর রফিজ আলীর না। আসলে তার রিক্সায় একটা মেয়ে উঠেছে, মেয়েটা নির্দিষ্ট করে কিছুই বলেনি যে, সে কোথায় যাবে,মেয়েটির নাম ফাতেমা ফেরদৌস।এদিকে ফাতেমাও রফিজ আলী কে দেখছে,রফিজ আলী শরীরে-একটা ছেড়া জামা আর ময়লা মিশ্রিত একটা লুঙ্গী, পায়ে ফুটো স্যান্ডেল তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।স্যান্ডেলের উপর যে পায়ের ছাপে আঙ্গুলের দাগ পড়ে গেছে, তবুও সেটা পায় দিয়েই রিক্সা চালাচ্ছে।
.
এদিকে রফিজ আলী প্রায় প্রায় পিছনের দিকে তাকাচ্ছে,হয়তো বোঝানোর চেষ্টা করছে কিছু।রফিজ আলীর মুখে অনেকখানি ক্লান্তি আর একটু বিরক্তির ছাপ তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।বিকেলে রোদের তেজ কমলেও চারদিকে ভ্যাপসা গরম। রফিজ আলীর শরীর থেকে ঘাম পড়ছে টুপ টুপ করে,ঘামগুলো বার বার গামছা দিয়ে মুছে নিচ্ছে।রফিজ আলী অবশেষে একটু বিরক্তি নিয়ে বলল-
-আফামনি কই যাইবেন?
-কোথাও না, এমনি ঘুরছি।
– ও আইচ্চা। (বেশ বিরক্তির স্বরে)
-ভালবাসা খুঁজতে বের হয়েছি,পেয়ে গেলে ঘোরা বন্ধ করে দিব।
-তাইলে সারাজীবনেও ঘোরা বন্ধ হইবো না।এই দুনিয়ায় ভালবাসা বলে কিছু নাই।সবাই আছে নিজের ধান্দা লইয়া।
-দেখি খুঁজতে থাকি।তা চাচা আপনার ছেলে-মেয়ে কয়টা?
-চার জন।দুই ছেলে আর দুই মাইয়া।
-পড়াশোনা করে তো?
-রফিজআলী একটা রহস্যর হাসি দিয়ে বলল-দুই বেলা ঠিকমতন খাওন দিতে পারি না আবার পড়াশোনা।ভাড়ার রিক্সা দিয়ে কতই বা আয় হয়,অর্ধেকই মালিক কে দিতে হয়।তই ছুডো পোলা আর ছুডো মাইয়া স্কুলে যায়।আর বড় পোলা আর মাইয়ারে লেহা পড়া করাইতে পারি নাই।
অভাবী সংসার, তবে বড় পোলাটারে একটা গ্যারেজে কামে লাগায় দিছি সামান্য কিছু টেহা পাই।তাতে কোনরকমে সংসারে উপকার হয়।
.
ফাতেমা আর কিছু বলল না,কথাগুলো শুনে যেন ফাতেমার চোখের এককোণে পানি জমে গেল।ফাতেমা রফিজ আলীর রিক্সা থামিয়ে একটা দোকান থেকে দুইটা কলা আর একটা রুটি কিনে দিলো।
রফিজ আলীর চোখ দুটো কেমন ছলছল করে উঠল।রফিজ আলী নিজে না খেয়ে গামছা দিয়ে পেচিয়ে রাখল রুটি আর কলাগুলো।
ফাতেমা অবাক হয়ে বলল-
-খাচ্ছেন না কেন?
-আমি খামু না।বাড়ীতে নিয়া যামু ছুডো
পোলাটার লাইগা।গরীব মানুষ এইগুলা কিন্না দিতে পারিনা।
আজকে পাইলে খুশি হইবো।ছুডো
মাইয়াটা আবার পুতুল এর বায়না ধরছে।
গরীবের কি এত বায়না ধরলে চলে। আইজকা একটা ছোট পুতুল কিনুম। বাপ যখন হইছি বায়না তখন মিটাইতেই হইবো।
>রফিজ আলীর কথা শুনে ফাতেমারও কেমন চোখে পানি চলে আসল।সেটা ফাতেমা বুঝতে দিলো না।ফাতেমা আবারও রফিজ আলী কে কলা আর রুটি কিনে দিলো তাকে খাওয়ার জন্য।
.
রফিজ আলী খাচ্ছে আর ফাতেমা তা উপভোগ করছে।এমন ভাবে খাচ্ছে মনে হয় কতকাল সে এসব খায়নি।
খাওয়া শেষ করে রফিজ আলী পরম তৃপ্তি নিয়ে বলল-
-আফামনি কই যাইবেন এবার কন?যা খাওয়াইলেন তাতে অনেকক্ষণ রিক্সা চালাইতে পারুম।
-আপনি সামনে এগোতে থাকেন আমি বলে দিচ্ছি।
>রফিজ আলী ফুরফুরে মেজাজে রিক্সা চালাচ্ছে। কিছুক্ষণ চালানোর পরেই ফাতেমা আবারও থামতে বলল।ফাতেমা রিক্সা থেকে নেমে একটা দোকান থেকে পুতুল কিনে রফিজ আলীর হাতে ধরিয়ে দিলো,সাথে কিছু টাকাও দিয়ে দিলো।রফিজ আলী টাকাগুলো নিতে না চাইলেও অনেক জোড় করেই ফাতেমা টাকা দিয়ে রফিজ আলীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলো,আর বলে গেলো প্রতিদিন যেন ফাতেমা কে ভার্সিটি থেকে আনতে যায়।আর রফিজ আলী এক দৃষ্টিতে ফাতেমার চলে যাওয়া দেখছে।
.
ফাতেমা অনেক বড় ঘরের মেয়ে,কিন্তু তার স্বভাব চরিত্র অন্যসব বড়লোকের মেয়েদের মত অহংকারী নয়।তার এমন স্বভাব চরিত্র থেতে কেউ বুঝতেই পারবে না যে সে এত বড় ঘরের মেয়ে।বাবা-মার একমাত্র মেয়ে হলেও তার বাবা-মা তাদের কাজ কর্মে ব্যস্ত।তাদের মেয়েটাকে যে সময় দিবে সেই সময়টুকু তাদের নেই।ফাতেমার বাবা তার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত আর মা একটা সামাজিক সংগঠনের সভাপতি।এসব নিয়ে আর ফাতেমা ভাবে না।সে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে এমন পরিবেশে।
.
ফাতেমা কে একটা ছেলে ভালবাসে।ভীষন রকমই ভালবাসে ছেলেটার নাম মাহিন।দুজনে একই সাথে পড়াশোনা করে।কিন্তু ফাতেমার মনেই হয় না যে ছেলেটা সত্যি ভালবাসে।অনেকদিন যাবত ছেলেটা পিছু পড়ে আছে ফাতেমার।ফাতেমাও ভাবছে মাহিন কে ভালবাসার কথাটা বলে দিবে হয়তো সে সত্যিই ভালবাসে।ছোট বেলা থেকে বাবা-মার ভালবাসার খুবই কমই পেয়েছে, তাই সে নিজে চাই কেউ তাকে ভীষন রকমের ভালবাসুক।
.
পরেরদিন ভার্সিটি থেকে ক্লাস শেষ করে রফিজ আলীর জন্য অপেক্ষা করছে ফাতেমা।এরই মধ্যে রফিজ আলী চলে আসল,রফিজ আলী বলল-
-আফামণি একটু দেরি হইয়া গেলো।মনে কিছু কইরেন না।
-না, না চাচা কিছু মনে করিনি।
>আরো কিছুক্ষণ রফিজ আলী আর ফাতেমা একটু হাসাহাসি করে কথা বলছিলো।এরই মধ্যে মাহিন এসে ফাতেমার হাত চেপে ধরে বলল-
-ফাতেমা বিশ্বাস করো আমি তোমাকে সত্যি ভালবাসি।
-প্রমান কী যে আমাকে ভালবাসো?
-তুমি যা বলবে তাই করতে রাজি। তোমার জন্য মরতেও পারি।
>ফাতেমা একটু যাচাই করার জন্য বলল-
-না,না,মরতে হবে না।শুধু তোমার জন্য আফসোস হচ্ছে।
-মানে,কিসের আফসোস?
-এই যে একটা রিক্সাওয়ালার মেয়েকে ভালবাসো।।
>কথাটা শুনেই মাহিন ফাতেমার হাতটা ছেড়ে দিলো।আর রফিজ আলীও চোখ বড় বড় করে তাকালো ফাতেমার দিকে।
-তোমার বাবা রিক্সাওয়ালা?
-হ্যাঁ এই যে আমাকে নিতে এসেছে আমার বাবা।
-তাহলে তুমি মোজাম্মেল সাহেবের বাসা থেকে বের হও কেন?
-আরে উনার একটা ছোট্ট মেয়ে আছে না,তাকে পড়াতে যায়।
.
>মাহিন আর কিছু বলল না।মাথা নিচু করে চলে গেলো।রফিজ আলী কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চাইলো-
-আফামণি আপনি এমনডা করলেন যে?
-হ্যাঁ,এটা না করলে জানতেই পারতাম না মাহিন আমাকে সত্যি ভালবাসে কি না।
-সত্যিটা কইয়া দিতেন।
-ও যদি সত্যি আমাকে ভালবাসতো তাহলে রিক্সাওয়ালার মেয়ের কথা শুনে চলে যেতো না।ও আমার বাবার টাকা পয়সা দেখে আমাকে ভালবাসতো আমাকে না।আর আমি এমন একজন কে চাই যে আমাকে ভালবাসবে,আমার বাবা কে দেখে নয়।
-আফামণি আল্লাহ আপনার ভালা করুক।
-হ্যাঁ চাচা দোয়া করবেন।
-হ মা করুম।
.
>রফিজ আলীর অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই,রফিজ আলী ভাবছে মেয়েটা যেমন ভাল তেমন বুদ্ধিমতি।রফিজ আলী বলল-
-আফমণি কইছিলাম না,এই দুনিয়াই ভালবাসা বইলা কিছুই নাই।
-না চাচা ভালবাসা আছে।
-তার প্রেরমান তো অহনই পাইলাম।
-হুমম তা ঠিক বলেছেন।
-তা আফামণি চলেন আফনারে দিয়া আসি।
-চাচা আপনার বাসায় যাবো?
-কী কইলেন? [একটু অবাক হয়ে]
-আপনার বাসায় যাবো,নিয়ে যাবেন?
-এই গরিবের বাড়ীতে আফনি যাইবেন?
-হ্যাঁ,সেইজন্য বললাম আপনাকে,কেন নিয়ে যাবেন না?
-কেন নিয়া যামু না,অহনই যাইতাছি।
.
>রফিজ আলী আর কিছু বলল না,রিক্সা চালাতে শুরু করল।একটা দোকানের সামনে এসে রফিজ আলীকে দাঁড়াতে বলল কিছুক্ষণ।বেশ কিছুক্ষণ পরে ফাতেমা হাতে কিছু ব্যাগ নিয়ে বের হলো।রফিজ আলী কোন কিছুই জানতে চাইলো না।
এরই মধ্যে রফিজ আলী তার বাড়ীতে চলে এলো।ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রফিজ আলীর বউ জামেনা বেগম জানতে চাইলো অনেক কিছু।রফিজ আলী শুধু বলল আফমণিরে বসতে দাও।জামেনা বেগম একটা ভাঙা চেয়ার আচঁল দিয়ে মুছে ফাতেমাকে বসতে বলল।ফাতেমার যেন সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সে বাড়ীটা দেখছে একদম ভাঙাচোরা।একটা মাত্র রুম,চাল গুলো কেমন ফুটো ফুটো হয়ে গেছে একদম পরিত্যাক্ত মনে হচ্ছে।এখানেই নাকি ছয়জন মিলে থাকে।
.
রফিজ আলী জামেনা বেগম কে কিছু নাস্তা দিতে বলল।ফাতেমা শুধু বলল- এক গ্লাস পানি খাওয়াতে।পানি খেয়ে ফাতেমা রফিজ আলীর হাতে ব্যাগগুলো দিয়ে চলে আসল।রফিজ আলী কিছুই বুঝতে পারলো না।ব্যাগগুলো খুলে দেখে কিছু পোশাক আছে তার মধ্যে।রফিজ আলী ফাতেমা কে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে।রফিজ আলী মনে মনে ভাবছে মেয়েটা কী পাগল নাকি।নিজে নিজেই এসব ভাবছে আর ফাতেমার জন্য দোয়া করছে।
.
এরপর কিছুদিন রফিজ আলী ভার্সিটিতে গিয়ে ফাতেমা আনতে যেতো,কিন্তু ফাতেমাকে পায়নি।তবুও রফিজ আলী প্রতিদিন ঠিক ঐ সময়টাই ফাতেমার জন্য অপেক্ষা করতো আর প্রতিদিনই নিরাশ হতো।রফিজ আলীর মনে যেন কেমন একটা শূন্যতা অনুভব করছে।নিজের মেয়ে না, তবুও মেয়েটার প্রতি কেমন মায়া পড়ে গেছে রফিজ আলীর।
.
আরও কিছুদিন পর এক সন্ধায় রফিজ আলী ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ীতে ঢুকে দেখে তার বাড়ীর সামনে একটা নতুন রিক্সা।রফিজ আলী জামেনা বেগম কে ডাক দেয়ার সাথে সাথে ঘরের ভেতর থেকে ফাতেমাসহ সবাই বেরিয়ে আসল।রফিজ আলী ফাতেমা কে দেখে অবাক হয়ে বলল-
-আফামণি আফনে কই আছিলেন?আফনারে প্রতিদিন আনতে যায়,কিন্তু আফনারে পায় নাই।
-ফাতেমা হেসে বলল-হ্যাঁ চাচা জানি আপনি প্রতিদিন আমাকে আনতে যেতেন।
-হ্যাঁ আফামণি কত খুজছি আফনারে,কেথাও পায় নাই।
-চাচা এত কেন খুজছিলেন?
-আফনার জন্য কেমন জানি লাগছিলো।
-কেমন লাগছিলো?
-আমি কইতে পারুম না।তই খুব কষ্ট পাইছি।
-থাক বলতে হবে না, চাচা এই রিক্সাটা আপনার জন্য।আমার ভালবাসার উপহার।
-কী কইলেন? [অনেকটা অবাক হয়ে]
-হ্যাঁ এটা আপনারই,আপনাকে আর ভাড়ার রিক্সা চালাতে হবে না।
>রফিজ আলী কথাটা শুনেই চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেলো,কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে রিক্সাটাই হাত বুলোচ্ছে আর অঝোরে কাঁদছে।ফাতেমা কে না পেয়ে যে কষ্ট বুকে জমে ছিল,সব যেন এই খুশীর কান্নার সাথে মিশ্রিত হয়ে গড়িয়ে পড়ছে চোখ দিয়ে।জামেনা বেগমও নিজেকে ধরে রাখতে পারল না,তার চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পড়ছে। আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন তিনি।ফাতেমারও চোখের এককোণে পানি জমে গেলো।
.
ফাতেমা বলল-চাচা আপনার ছেলে-মেয়েদের ফ্রী পড়াশোনা করানোর সুযোগ করে দিয়েছি।ওদের কে ঠিকমত পড়াশোনা করাবেন,আর কোন সম্যসা হলে আমাকে বলবেন।রফিজ আলী ফাতেমার মাথায় কাঁপা কাঁপা হাত মাথায় রেখে দোয়া করে দিলো,ফাতেমা বলল-
-চাচা আমাকে একটু বুকে নিবেন?
>রফিজ আলী কেমন বাকরূদ্ধ হয়ে গেছে।নিজের দুটো হাত দিয়ে ফাতেমা কে বুকে টেনে নিলো।ফাতেমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ভালবাসার সন্ধান করতে লাগলো।
.
ফাতেমা চলে যাচ্ছে,আর রফিজ আলী সহ সবাই ফাতেমার চলে যাওয়া দেখছে।ফাতেমা যেতে যেতে পিছন ফিরে তাকিয়ে বলল-চাচা আমি কিন্তু ভালবাসা পেয়েছি,একদম সত্যি ভালবাসা।রফিজ আলী আর কিছু বলতে পারল না শুধু কাঁন্না জড়িত কন্ঠে একটা মুচকি হাঁসি দিল।
.
আর ফাতেমাও পরম তৃপ্তি নিয়ে চলে গেলো।একদম সত্যিকারের ভালবাসা নিয়ে।যেই ভালবাসায় কোন সার্থ নেই,নেই কোন মোহ।মাহিনের সার্থের ভালবাসার চেয়ে এইরকম খাঁটি ভালবাসা সেই ভালবাসার থেকে অমূল্য।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত