ঘুম ভেঙেছে? হুঁ। হুঁ কী? ভেঙেছে। এই যে তোমার দেয়া সব অলংকার। বাড়ির চাবি। গাড়ির চাবি। সব দিয়ে গেলাম, শুধু মেয়েকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। নিয়ে যাচ্ছি মানে? যা বলেছি তাই, এর নতুন কোনো মানে নাই! এই বলে নিশি রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে আর তুহিন হুইল চেয়ারে বসে নিশির দিকে তাকিয়ে আছে! “তুহিন আর নিশি সম্পর্কে তারা স্বামী স্ত্রী। দশ বছর হলো তাদের বিয়ে হয়েছে। চার বছর প্রেম করে ভালোবেসে বিয়ে করেছে, তুহিন আর নিশি। ভালোবাসার সংসারে একটা পাঁচ বছরের ফুটফুটে বাচ্চাও আছে তাদের। কাল রাতে ঝগড়া হয়েছে দুজনের!” ভালোবাসার সংসারে মাঝে মান অভিমান ঝগড়া না হলে ভালোবাসায় মরিচা ধরে। এই মরিচা দূর করতে হলেও মাঝে মাঝে ঝগড়া হওয়া দরকার। কিন্তু কালকের ঝগড়ায় নিশি কষ্ট পেয়েছে, প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে!
ঝগড়াটা যদিও তেমন মারাত্মক লেভেলের ছিল না। তবু নিশি প্রচণ্ড অভিমানে একটা উদ্ভট সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হুট করেই। তুহিনের সাথে এক ছাদে সে আর থাকবে না। মেয়ে নিয়ে চলে যাবে বাপের বাড়ি! ঘরের দরজা পর্যন্ত নিশি যেতেই তুহিন আবার ডাক দিলো, নিশিকে এই শুনো নিশি? আমার নাম নিশি নয়, নিশাত আঞ্জুম কথা শেষ না হতেই তুহিন বলতে লাগলো, ‘আমি তো গত চৌদ্দ বছর ধরে নিশি নামেই ডাকি তোমাকে, তাই না? গত চৌদ্দ বছর আর কাল থেকে আজকের সকাল, এর মাঝে অনেক তফাত। আশা করি বুঝতেছো। তুমি রেগে আছো এখনও? জানি না। আমাকে ডেকে লাভ নেই। তোমার জীবন তোমার মতো গুছিয়ে নাও। আমি আমার ব্যাগ গুছাতে যাই! বাবা? বাবা, মা কাঁদছে কেন? জানি না। কেঁদে কেঁদে ব্যাগ গুছাচ্ছে কেন? জানি না। আমরা কী নানু বাসায় যাব? জানি না।কী জানো তুমি? কিছুই জানি না। বাবা, তুমিও কাঁদছো কেন? জানি না।
“নিশাতের ‘নি আর তুহিনের তু’ নিয়ে আদর করে নাম দেয় দুজনে নিতু। নিতু তাদের পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু। মা-বাবার এমন ব্যবহার সে আজই প্রথম দেখলো। দেখে উদ্ভট প্রশ্ন করতেছে। বাবার কান্না দেখে নিতু দৌঁড়ে নিশির কাছে যায় আবার।” মা, মা, এই মা? কী? বাবাও কাঁদতেছে। কেন কাঁদছে? জানি না। তুমি কেন কাঁদছো? জানি না। তুমিও জানো না, বাবাও জানে না, কেউ জানে না। তবে জানে কে? জানি না। নিশি হঠাৎ নিতুকে জিজ্ঞাসা করলো, আচ্ছা মা, তুমি কার কাছে থাকবে, আমার কাছে না-কি তোমার বাবার কাছে? নিতু চুপ হয়ে আছে। কী বলবে সে ছোটো মানুষ! বলো মা তুমি কার কাছে থাকবে? আমি তোমাদের সাথে থাকব। না যেকোনো একজন বলো, হয় আমার সাথে নাহয় তোমার বাবার সাথে। বলো কার সাথে থাকবে? তোমার সাথে!
নিশি কোলে তুলে নিয়ে কপালে চুমু কাচ্ছে নিতুকে। আর বলছে, আমি জানতাম তুমি আমার কথা বলবা আমার সাথে থাকবা। কাল রাতে ঝগড়ার কারণ ছিল তুহিনের পঙ্গুত্বের জীবন। তুহিনের ধারনা নিশি তাকে দয়া করে তার পাশে আছে আচ্ছা নিশি একটা কথা বলি? নিশি বলল, ‘আগে কফি দেই?’ তুহিন বলল, ‘না, আগে কথা।’ এত সিরিয়াস? হুঁ। আচ্ছা মশাই বলেন কী কথা। সত্যি করে বলো তো, আমি তোমার বোঝা না? ভ্রু কুঁচকে নিশি বলল, আজ ওষুধ খাওনি? ওষুধের কথা বলছি না, যা বলছি তার উত্তর দাও, সোজাসুজি। তুমি বোঝা হবে কেন? এই যে আমার অক্ষম জীবন, পঙ্গুত্ব! এই জন্য বলেছো? হুঁ। তবে শোনো, তুমি আমার বোঝা না তবে আমার সাথে কেন আছো? দয়া করতেছো আমাকে? দয়া? হু।
এই দয়ার কথা শুনেই নিশি কষ্ট পায় এবং রেগে যায়। তাই আজ সে চলে যাচ্ছে। নিশি নিজের ব্যাগ, আর নিতুকে গুছিয়ে তুহিনের সামনে আবার দাঁড়ালো, আর বলল তুহিন? জবাবে তুহিন, ‘হু।’ আমি চলে যাচ্ছি। আর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল নিশি ভালো থেকো তুমি। তোমাকে ছাড়া ভালো থাকব কীভাবে? যেভাবে আজ সকালে একা একাই হুইল চেয়ারে বসেছো, এভাবেই। আমি তো হুইল চেয়ার থেকে কাল রাতে নামিইনি, বসব কীভাবে? নিশি চুপ। কাল রাতে চলে গেলা রুম থেকে রাগ করে: রাতে আর আসোনি। সারারাত হুইল চেয়ারেই ছিলাম আমি। নিশি এবারও চুপ।তুমি জানো আমি তোমাকে ছাড়া অচল, হুইল চেয়ার থেকেও নামতে পারি না। এবার নিশি বলল, ‘তুমি ডাকোনি আমাকে!’ তুহিনও চুপ! “একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে দুজনেই কাঁদতেছে, নিতু পাশে দাঁড়িয়ে আছে!”
তুহিন হুইল চেয়ারটা একটু এগিয়ে নিশির কাছে এসে বলতে লাগলো নিশি আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার এই পঙ্গুত্ব জীবনের অসহায়ত্ব দিয়ে নয়, হৃদয় থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি! আমাকে দয়া করে হলেও আমার সাথে থাকো, আমার সাথে থাকো। পি-জনিশি আবার ক্ষিপ্ত কন্ঠে জবাব দিলো, আবার দয়া?কীসের দয়া? তুমি ভালোবাস? আমি বুঝি ভালোবাসি না? তুমি মাঝরাতে গান গেয়ে আমাকে ঘুম পারাও, ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমার কপালে চুমু দাও। এইসব তোমার ভালোবাসা। আর আমি কিছু করলেই দয়া? না-কি এই চুমু, এই গান গাওয়া এগুলোও দয়া? না-কি আমি তোমার যত্ন করি দেখে আমার পারিশ্রমিক? চুপ করে আছে তুহিন। নিশি বলল, চুপ করে থেকো না জবাব দাও। তুহিন বলল, আই এ্যাম স্যরি! “নিশি বলল, কোনো স্যরি নাই। আমি চলেই যাব।” বললাম তো, স্যরি! নিশি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো!
দেখো নিশি, আমি পঙ্গু, অক্ষম একটা মানুষ। তুমি চেয়ার থেকে নামালে আমি নামতে পারি, তুমি খাবার দিলে আমি খেতে পারি। এছাড়া আমি কিছুই পারি না। আমি পুরোটাই তোমার উপর নির্ভরশীল। তুমি যদি চলে যেতে চাও, তোমাকে জোর করে বা তোমার হাতটা ধরে যে বলব, নিশি যেও না, এই ক্ষমতা বা শক্তিটুকুও নাই আমার! তুমি যেয়ো না। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি বুঝতে পেরেছি আসলে ভালোবাসায় কখনো দয়া হয় না। ভালোবাসার প্রতিদান ভালোবাসাই হয়। স্যরি আমি! নিশি বলল, ক্ষমতার চেয়েও অধিকার অনেক বেশি শক্তিশালী, আমাকে ধরে রাখবার সবটুকু অধিকার আজও তোমার, শুধুই তোমার! কারণ আমিও তোমাকে ভালোবাসি!
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা