চশমার ভেতর আবছা চোখের পিনি মুছে মামুন সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে উঠে,
— রিদ ভাই আমি ফাইনাল ডিসিশান নিয়ে ফেলেছি। একটু অবাক হয়ে তাকে জিগ্গেস করলাম,
— যেমন?
— আপনার ভাবির সাথে আমার সম্পর্কটা আর বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারছিনা।
— কিন্তু এটা না, আপনাদের লাভ ম্যারিজ ছিলো?
— তো? বিশ্বাস করেন রিদ ভাই, আমি আর এগুলো নিতে পারছিনা। দু বছর আগে নিজের পরিবারকে ছেরে ওর হাত ধরে এই শহরে এসে উঠেছি। এই দুইটা বছর ও আমার জীবনটা একেবারে তেজ পাতা বানিয়ে ছারলো।
— এখন আপনার ফাইনাল ডিসিশানটা কি?
— ডিবোর্স।
দু,বছর আগেই পালিয়ে বিয়ে করেছে মামুন সাহেব ও তার স্ত্রী। আমাদের পাসের ফ্লাটেই উঠেছে তারা সে অনেক মাস। মাঝে মাঝে কফি হাতে ছাদে আসলে খেয়াল করতাম মামুন সাহেব নিজের ও তার স্ত্রির জামা কাপর রোদে শুকুতে দিচ্ছেন। অফিসে যাওয়ার আগে নাস্তা রেডি করা, অপিস থেকে ফিরে রান্না বান্না সহ বাড়ির সকল কাজ, কাপর ধোয়া এব্রিথিং অল মামুন সাহেবকে দিয়েই করাতেন তার স্ত্রী। আজ ছুটির দিন, দুপুরের খাবার শেষে সবে মাত্র বিছানায় গা এলিয়ে দিলো মামুন সাহেব। হটাৎই স্ত্রীর চেচামেচিতে ভয়ে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উটলেন তিনি।
— কি ব্যাপার এমন চেচামেচির কারন কি? মামুন সাহেবের স্ত্রী হয়তে একখানা লাঠি নিয়ে দরজার সামনে দাড়িয়ে মামুন সাহেবকে বললো,
— এই এদিকে আসো।
— আমি আবার কি করলাম?
— তোমাকে বলছি এদিকে আসতে, লাঠির বারি খাওয়ার আগে এদিকে আসে।
আর কিছু না বলে একটা শুকনো ঢোক নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো মামুন সাহেব। কথা বাড়ালে এই মুহুর্তেই তৃতীয় বিশ্ব যোদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। যেই যোদ্ধে সবচেয়ে ফাওয়ারপুল পারমানবিক শক্তিধর দেশের প্রধান মন্ত্রি তার স্ত্রী। আর মামুন সাহেবের দুর্বলতা হলো স্ত্রীর প্রতি অতি ভালোবাসা।
— তোমাকে বললাম কাপর ধুয়ে রোদে শুকুতে দাও। দিয়েছো? ধমকের শুরে।
— দিয়েছিতো।
— তাহলে ওয়াশ রুমে এখনো একটা কাপর পরে আছে সেটার কি হবে?
— ধুয়ে দিবো ওটাও।
— যাও এক্ষুনি যাও।
— যাচ্ছি, কিন্তু চিল্লাচিল্লি করোনা।
ছাদে একটু হাটা হাটি করছিলাম, তখন খেয়াল করলাম মামুন সাহেব তার ফ্লাটের ছাদে এলো। মুকটা গোমড়া করে অবশিষ্ট কাপরটা ধুয়ে ছাদে শুকুতে এসেছি। চোখে চোখ পরতেই হুস করে একটা হাসি বেড়িয়ে পরলো আমার মুখ থেকে। মামুন সাহেব সোজা হেটে নিচে চলে গেলো। মামুন সাহেবের বাসায় গেলাম, ভাবি সোফায় বসে গল্প করছে আমার সাথে মামুন সাহেবকে পাঠিয়েছে নাস্তা তৈরি করে আনার জন্য। ভাবিকে একটা প্রশ্ন করলাম,
— আচ্ছা ভাবি, আপনাদের এটা লাভ ম্যারিজ। তার মানে বুঝাই যাচ্ছে আপনারা একে অপরকে ভালোবাসেন। সারাদিন অপিস করে আসে। তার পর আবার বাড়িতে আপনি এইসব কাজ করান। আপনার কি মনে হয়না ভাইয়ের একটু কষ্ট হয়ে যায়? আপনি একজন নারি হয়ে ভাইকে শ্বাসন করা ও সব কাজ করানো ব্যাপারটা একটু বেমানান না?
— জানি এটা, কিন্তু হাজবেন্টকে একটু টাইট দিতে হয়। টাইট দিয়ে না রাখলে আবার বিগরে যাবে।
— কিন্তু ভাবি সুতা বেশি টাইট দিলেও তো ছিরে যায় তাই না।
— ওসব আপনি বুঝবেন না। একবার বিয়ে করেন তারপর দেখবেন সংসার জীবনটা কেমন? কথা বলতে বলতে মামুন সাহেব নাস্তা নিয়ে হাজির। মামুন সাহেব অফিস থেকে বাসায় ফিরে আসতেই তার স্ত্রী সামনে গিয়ে বললো,
— এতো দেরি হলো যে?
— কই, মাত্র আদাঘন্টা লেট হয়েছে।
— আধা ঘন্টা অনেক সময়, কোথায় ছিলে এতোক্ষন? কার সাথে ছিলে?
— কারো সাথে না, তুমি থাকতে আমি অন্য কারো দিকে তাকাতে পারি?
— তা বুঝলাম। আজ না তোমার মাইনে পাওয়ার কথা।
— হুম, পেয়েছিতো এই নাও। আর হ্যা, প্রত্যেক মাসে আমি তোমার হাতে গুনে গুনে পুরু মাসের বেতন এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা তুলে দিই। তুমি যেভাবে সংসারে টাকা খরচ করো তাতে আমার মনে হয়না বিশ-ত্রিশ হাজারের উপরে লাগে। আজ দুই বছর তুমি আমার কাছ থেকে এভাবে টাকা নিচ্ছো। এই দুই বছরে খরচের অবশিষ্ট টাকাগুলো কোথায়?
— কি ব্যাপার? তুমি আমার কাছ থেকে হিসেব নিচ্ছো? তোমার সাহস তো বেরে গেছে দেখছি।
— আমি হিসাব চাচ্ছি না, এটা আমার মনের একটা প্রশ্ন মাত্র।
— তোমাকে বলছিনা, আমার মুখের উপর কথা বলা যাবেনা। যাও গিয়ে অনেক কাজ জমা হয়ে আছে সেগুলো করে নাও। এই পেরাটাই হলো মামুন সাহেবের ডিবোর্সের কারন। এতো পেরা নয় যেনো এক পুরুষ নির্যাতন।
— আপনি কি সত্যি সত্যিই ডিবোর্স দিয়ে দিতে চান ভাবিকে?
— তার বিকল্প আমি আর পথ দেখছিনা। ওর সাথে আমি কখনো উচু গলায় কথা বলিনি ও কষ্ট পাবে বলে। ওর সব কথা শুনতাম যাতে ও হাসি খুশি থাকে। ওকে ভালোবেসে এই লাই দেওয়াটা এখন আমার ভয়ের কারন হয়ে দাড়ালো।
অবাক হয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম,
— ভয়?
— হ্যা, ওকে এখন দেখলেই আমার ভয় করে। ভালোবাসা আসবে কোথা থেকে? আর সংসারতো দুরের কথা।
এই মুহুর্তে মামুন সাহেবকে কি সান্তনা দিবো বুঝতে পারছিনা। রাস্তা থেকে মামুন সহেবের স্ত্রীকে ফোন দিলাম। রিসিব করে ওপাস থেকে বলে উঠে,
— আরে রিদ ভাই, হটাৎ কি মনে করে?
— আপনি আসলেই একটা বোকা। এদিক দিয়ে আপনার সংসার ভাংতে চলেছে আর আপনি বাড়িতে বসে “তা” দিচ্ছেন?
— কি হলো ভাই, খুলে বলুন তো।
— কি হয়নি সেটা বলুন? মস্ত বড় সর্বনাস হয়ে গেছে।
— আরে ভাই বুঝলাম, কি হয়েছে একটু ছেরে কাশুন তো।
— মামুন ভাইকে দেখলাম একটা রেষ্টুরেন্টে মেয়ে নিয়ে বসা।
— কি! কি বলছেন এইসব?
— জানি আপনার বিশ্বাস হবেনা। আপনি একটু কষ্ট করে অফিসের পাসের রেষ্টুরেন্ট টায় চলে আসুন নিজ চোখে দেখতে পাবেন।
কিছুক্ষন পরই মামুন সাহেবের স্ত্রী সেখানে এসে হাজির। নিজ স্বামীকে অন্যকোনো মেয়ের সাথে দেখতেই যেনো বাক রুদ্ধ হয়ে গেছে সে। কিছুক্ষন সেখানে ঠাই ভাবে দাড়িয়ে থেকে গদ গদ করে চলে গেলো বাসায়। ঘুর্নিঝড়ের পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে কিছুটা। আজ একটু দেড়ি করেই বাসায় আসলো মামুন সাহেব। তার স্ত্রীর কোনো কথা কানে না তুলে রান্না করে খেয়ে ঘুমিয়ে পরলো। মাঝ রাতে ফোন হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো মামুন সাহেব। কয়েক দিন পর, মামুন সাহেবের স্ত্রী ফোন দিয়ে কাদু কাদু গলায় আমাকে বললো, একটু তাদের বাড়ি যেতে। বুঝলাম ঢিল জায়গা মতো পরেছে। মামুন সাহেবের স্ত্রী কান্না করতে করতে বললো,
— প্লিজ রিদ ভাই আমায় বাচান, আপনার ভাই এখন আমায় ফেলে অন্য কারো দিকে চোখ দিয়েছে।
— আমার মতে ও ঠিকই করেছে। আপনি কি ওকে একটুখানি ভালোবাসা দিয়েছেন?
সারাদিন শ্বাসনের উপরেই রেখেছেন। জানি মামুন ভাই একটু সহজ সরল। কিন্তু অধিকারটা তো আপনার চাইতে তারই বেশি তাইনা। আমি যতটুকু যানি, মামুন ভাইয়ের সাথে পালিয়ে আসায় আপনার বাবা খুবই অপমানিত হয়েছে। এটাও জানি যে আপনার বাবা আপনাকে তেজ্য দিয়ে দিয়েছে। আপনি কি জানেন আপনার এই অতি শ্বাসন মামুন ভাইয়ের মাঝে তৃক্ততার উদ্ভব ধটছে? আপনার প্রতি ভালোবাসাটা ধিরে ধিরে ঘৃনায় পরিনত হচ্ছে? সারাদিন অফিস করে মামুন ভাই আপনার কাছে কি খোজে? একটুখানি ভালোবাসাইতো নাকি? আর তা যদি সে আপনার মাঝে কুজে না পায় দিন শেষে অন্যকারোর প্রতি আকৃষ্ট হবে এটাইতো স্বাভাবিক।
— প্লিজ ভাই আপনি ওকে একটু বুঝিয়ে বলুন, এখন থেকে সে আমার ইচ্ছায় না আমিই তার ইচ্ছায় চলবো।
— এই ধারনাটা তখনই মনে আনা দরকার ছিলো যখন মামুন ভাইর হাত ধরে এই বাসায় উঠেছেন। তার মনে আপনার জন্য যেই ঘৃনার সৃষ্টি হয়েছে তাতে যদি সে আপনাকে বের করে দেয় তাহলে কোথায় যাবেন আপনি? কেও আছে আপনার এই শহরে? আপনার বাবা কি একজন তেজ্য দেওয়া মেয়েকে আবার গ্রহন করে নিবে? ভাবলাম এই শহরে আপনার সবাই আছে। কিন্তু এই সমাজে ডিবোর্সি মেয়েদের কোন চোখে দেখা হব তা যানেন না? ডিবোর্সের কথা শুনে কাদতে কাদতে হাটু গড়ে বসে পরে মামুন সহেবের স্ত্রী। গলা উচু করে ডাক দিলাম, মামুন ভাই, এই মিলি আপু এদিকে আসেন তো। আমি দুজনকে ডাক দেওয়াতেই মামুন সাহেবের স্ত্রী মাথা তুলে তাকায় আমার দিকে। মামুন ভাই আর মিলি আপু আমার পাসে এসে দাড়ায়। ভাবিকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
— এই হলো মামুন ভাই যে আপনার কাছে শুধু শ্বাসন নয় ভালোবাসাও খুজে বেড়ায়। দি শেষে যখন সে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরতো। তখন আপনি তাকে কাজের ফরমেশ না দিয়ে যদি এক গ্লাস ঠান্ডা সরবত এগিয়ে দিয়ে তার চোখের দিকে চেয়ে ভালোবাসা খুজতেন, তাহলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেতো?
— ভাবি মাথা নিচু করে বলে উঠে, সরি।
— এটা আমাদের একটা সাজানো নাটক ছিলো। মিলি আপু আমাদের সাথেই অফিসে কাজ করে। মামুন ভাইয়ের বিষয়টা তাকে বুঝিয়ে বলতেই সে আমাদের এই কাজে হেল্প করে। যদি আজ এটা সত্যি হতো? যদি মামুন ভাই আপনার প্রতি তৃক্ত হয়ে অন্য কাওকে বিয়ে করে এনে আপনাকে বের করে দিতো? তখন?
ভাবি মামুন ভাইয়ের সামনে গিয়ে বলে সরি, এমনটা আর কখনোই হবেনা। আজ থেকে তুমি আমার ইচ্ছেতে নয় আমিই তেমার ইচ্ছাতে চলবো। আমি তোমার চোখে একজন সত্যি কারের নারি হবো। তবুও তুমি প্লিজ বদলে যেওনা। আর তুমি সেইদিন হিসেব চেয়েছিলে না? সকল হিসেব আছে আমার কাছে। তুমিনা বলতে নিজের বাড়িতে তোমার সংসার ঘুচানোর ইচ্ছা? তাই আমি সব হিসেব করে তোমার কাছ থেকে সব নিতাম। খুব সাবধানতার সাথে খরচ করতাম যেনো টাকা অপচয় না হয়। কয়েক বছর না হয় একটু কষ্ট করে পরে নিজের বাসায় সংসার ঘুচাবো আমরা। আমি যানি আমি তোমার প্রতি একটু বেশিই করে ফেলেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো আর কখনোই তোমায় জ্বালাবোনা। তুমি শুধু আমার হাত টা না ছেরে ধরে রেখো এতেই হবে। মামুন সহেবও একটু আবেগি মানুষ, মুচকি হেসেই ভাবিকে জরিয়ে ধরতে যাবে তখনি আমি হাত দিয়ে ইশারা করে বলে উঠি,
— এই এই এই ব্রেক মারেন। ভালোবাসা উতলে উঠেছে বুঝলাম তাই বলে আমাদের সামনে এতে গভিরে যাওয়ার দরকার নাই। আমরা আগে যাই তারপর তার পর না হয় ভালোবাসাটা গরম পানিতে সিদ্ধ করে দুজন মিলে স্লান করবেন। কিন্তু হ্যা যাওয়ার আগে একটা কথা বলি, ভালোবাসাটা একটা প্রজাপতির মতো হালকা করে ধরলে উড়ে যাবে। আবার বেশি শক্ত করে ধরতে গেলেও মরে যাবে। ইহার একটা নিয়ম মাপিক স্পর্স আছে, আর সেই স্পর্সতে আগলে রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা