মার্চের ১৭ তারিখ ক্যাম্পাস ছুটির ঘোষণা হলে। আমি আর উনি, অনেক খুশী ছিলাম। বাড়ি যাবো, ঐ দিন দুজন অনেক ঘুরাঘুরি করি। ১৮ তারিখ বাসের টিকেট কাটলাম, রাত ১০ টায় আমাদের বাস ছাড়বে। আর আমি সব সময়, তাকে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতাম। তারপর আমার বাড়ি যেতাম। ঐদিন তাকে পৌঁছে দিলাম, তবে অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছিলো। হাতটা ছাড়তে ইচ্ছে করছিলো না, অনেক ক্ষণ ধরে রাখি। হঠাৎ সে বলে, এই যে প্রেমিক পুরুষ! এইটা গ্রাম, আপনার শহর না। মানুষ দেখবে, আমি বললাম আমার বউয়ের হাত আমি ধরে রাখবো। দেখলে দেখুক, ও একটা হাসি দিয়ে বলে। জামাইয়ের দেখি অনেক সাহস হইছে, তাহলে চলো আমার আব্বু কাছে। আমি বললাম একটু ভয় পাই বলে খোঁচা দেও। একদিন দেখবা ঠিকই যাবো।
ও হাসতে হাসতে শেষ, তুমি যাবে। আল্লাহ এতো সাহস কোনো দিনও হবে না। দেখবা আমাকেই জানাতে হবে।
আমি বললাম আচ্ছা আচ্ছা দেখা যাবে। পরে ও বলে, যাও এখন। আমিও যাচ্ছি, আর সাবধানে যাবে। বাসায় ঠিক মতো খাওয়াদাওয়া করবে, সময় গোসল, আর নামাজ যেনো মিস না হয়। আমি বলি জ্বি ম্যাডাম সব ঠিকঠাক করবো, তুমিও করবা আর নিজের খেয়াল নিবা। আচ্ছা যাও এখন। অনেক ভালোবাসি, আমিও অনেক ভালোবাসি। তারপর বিদায় নিলাম। ওর বাড়িতে নেটওয়ার্ক পেতো না, তাই বাড়ি গেলে নেটে আসতো না। তাই সে বাড়ি গেলে কোনো যোগাযোগ হতো না, এমন সময় গেছে ১ মাস যোগাযোগ হতো না। আর এই ব্যাপারে আমি অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম, প্রথম দিকে খারাপ লাগতো। কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
এভাবে দিন যাচ্ছিলো। আর এই দিকে ছুটি লম্বা হচ্ছে, তার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। তাকে অনেকবার ফোন দিছি! তার নম্বর বন্ধ, ভাবতাম নেট নাই তাই হয়তো। দিন দিন একাকিত্ব আর বিষন্নতা ঘিরে নিচ্ছে আমার প্রতিটা মূহুর্ত। (২ই নভেম্বরের তার এক বান্ধবী আমাকে ফোন দিয়ে বলে। আরিয়ান ভাইয়া, আমি আদিবার বান্ধবী। আমি সবার প্রথম প্রশ্ন করি, আদিবা কোথায়। ওর ফোন বন্ধ, আমি কতো চেষ্টা করছি। ওরে একটু দিবেন, একটু কথা বলি ওর সাথে। বিপরীত পাশ থেকে বলো, ভাইয়া আপনি আমার সাথে দেখা করতে পারবেন। আমি বললাম কোনো কিছু হইছে কি, বলে আপনি ৪ তারিখ আমার সাথে দেখা করেন। আমি সব বলবো, আমি বললাম ঠিক আছে।
তখন আমি অনেক চিন্তায় পরে গেলাম। ৪ তারিখ দেখা করলাম, ও একটা ডায়রি দিলো আর কিছু জিনিস। আমি বললাম এই সব কি, ও বললো আদিবা দিছে আপনাকে। তোমাকে কেনো দিবে, ও কোথায়। বলে আপনি বাসায় গিয়ে ডায়রিটা পড়বেন! আপনার উওর গুলো পাবেন। আমি বললাম এইটা কি ধরনের মজা। পরে ও বললো, ভাইয়া আমি তাহলে যাই। আর আপনি পড়বেন বাসায় গিয়ে।আমিও তেমন ভাবে চিন্তা না করে বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে। বলে আমিও চলে আসলাম, ও চলে গেলো) আমি বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে, সব কিছু আমার বিছানার উপরে রাখলাম।
আগে দেখলাম কি কি দিছে, একটা ওড়না, ৭৫ টা চিঠি, আর একটা ডায়রি আর আমাদের স্মৃতির কিছু জিনিস। আমি প্রথমে ডায়রি নিয়ে পড়া শুরু করলাম। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ( আরিয়ান আমাকে ক্ষমা করে দিও। ২৪ই এপ্রিল আমার বিয়ে হয়ে গেছে। যেদিন বাসায় গেলাম ঐদিন আমার ফোন নিয়ে নিছে। আমি কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারি নাই। ৩৭ বয়সে একজনের সাথে আমার বিয়ে দিছে। যে কিনা আমার থেকে ১৫ বছরের বড়। ছেলের অনেক টাকা, অনেক জায়গায় জমি। আমাদের গ্রামের সব থেকে ধনী পরিবার। আমার কোনো কিছুই করতে হয় না। খাওয়া ঘুম ছাড়া, তবে কোনো শান্তি নাই। জানো আরিয়ান আমার প্রতিটা রাত খুব যন্ত্রণা হয়। ঘুমানোর আগে মদ খাই নিয়মিত, আর খুব বাজে ভাষায় বকাবকি করে।
আমার মুখে, ঠোঁটে, হাতে, গলায় শুধু কামুড়ের দাগ। আমার খুব কষ্ট হয়! যখন স্পর্শ করে ঘৃণা লাগে। আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে। আমি কাউকে এই সব বলতে পারি না। ডায়রি আর চিঠি গুলো লিখি লুকিয়ে, যেনো কেউ না দেখে। আরিয়ান আমি তোমাকে অনেক মিস করি। এখানে দম হয়ে আসে, আমি জীবন্ত লাশ হয়ে গেছি। মৃত্যু ছাড়া আর মুক্তি নাই। জানো আরিয়ান জুন মাসে আমি প্রেগন্যান্ট হয়। কিন্তু আগস্ট মাসে নষ্ট হয়ে যায়। তবে আমার আফসোস হয় না। আর উনারা বলে, আমি নাকি ইচ্ছা করে নষ্ট করছি। আমাকে অনেক মাইর দিলো ঐ দিন, পেটে অনেক গুলো লাথি দেয়। আমার রক্তপাত হয়ে গেছিলো, ৪ দিন এভাবে চলে। আমি উঠে দাড়াতে পারি না। ৫ দিনের দিন সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলো, অনেক গুলো পরিক্ষা দিলো। কিন্তু কিছুই করালো না। হাসপাতাল থেকে ব্যাথা কমানোর মেডিসিন দিলো।
ঐ গুলো খাইতে দিলো, বাহির থেকে কোনো ওষুধ কিনে আনে নাই। শরীর রক্ত কমে যায়, রাতে রক্ত দিলো। ৫ দিন পর বাড়িতে নিয়ে আসে। জানো আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। তোমাকে মিস করছিলাম, খুব ইচ্ছা করছিলো জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু আমার ভাগ্যে, জানো আমার আব্বু আম্মু আসে নাই। দুই পরিবারের জায়গা নিয়ে কি ঝামেলা হইছে। এই জন্য নাকি আসে নাই। আর আমি লিখবো না, এই গুলো যে কারে দিয়ে তোমার কাছে পৌঁছাবো আল্লাহ জানে। আমি এখন অসুস্থ, কিন্তু কোনো মেডিসিন দেয় না। শুধু ব্যাথা ট্যাবলেট ছাড়া। এখন তো আমি নেই, নিজের খেয়াল নিও। সব কিছুই সময় মতো করবে। আমার জন্য কষ্ট পাবে না, এই সব কিছুই আমার ভাগ্যে লিখা ছিলো। তবে এই দুনিয়ায়তে এক হতে পারলাম না। তো কি হইছে পরের দুনিয়ায় এক হবো। আর এক ওয়াক্ত নামাজ যেনো মিস না হয়। ভালো থেকো ভালোবাসা। আল্লাহ হাফেজ।)
এই গুলো পড়ে, আমার শরীর পাথর হয়ে গেছে আর চিৎকার দিয়ে কান্না করতাছি। কি করবো, কি করা উচিত কিছুই জানি না। হাত পা কাপছিলো, ছটফট করতেছিলাম। হঠাৎ দেখি তার বান্ধবী ফোন দিলো। ফোন ধরে কান্না করতে করতে বললাম। এই সব কিভাবে হলো। ও উওর দিলো ভাইয়া আমরা শহরে চলে গেছি। গ্রামের বাড়ি গিয়ে শুনি এই সব কাহিনি। তাই ওর সাথে দেখা করতে যায়। গিয়ে দেখি, শুকিয়ে কি হইছে। চিনা যায় না, পরে ও সব বললো। আমাকে পেয়ে অনেক খুশী, ডায়রি আর চিঠি গুলো আপনাকে দিতে পারবে।
আর একটা নিউজ আছে, ভাইয়া ১৭ ই সেপ্টেম্বর আদিবা মারা গেছে। কিহ্! কি বলছো এই সব। এইটা হতে পারে না।
ভাইয়া আপনি মাথা ঠান্ডা করেন! কিভাবে হইলো, ভাইয়া রাতে ওর জামাই মদ খাচ্ছিলো। পরে ও কি জানি বলে, তারপর ওর জামাই লাথি মারে। সে নিছে পরে যায়, আর ব্লিডিং হচ্ছিলো। বন্ধ হওয়ার কোনো নাম নাই। আর জামাই মাতাল হয়ে পরে ছিলো। ঘরে রক্ত পরে বেসে গেছিলো, সকালে হাসপাতাল নিলো। কিন্তু রাতেই মারা যায়। ব্যাথা সহ্য করতে পারে নাই।
আমি এই সব কাজের মহিলা কাজ থেকে শুনছি। আমি ফোনটা কেটে দিলাম, দিয়ে জোরে চিৎকার দিলাম! নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি নাই। আমার ঘরে ফুল ফ্যামিলি আসলো। সবাই জিজ্ঞেস করতেছিলো , কিন্তু আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ আসছিলো না। অনেক বার জিজ্ঞেস করার৷ পর সব বললাম। সবাই যেনো পাথর হয়ে গেছিলো। আম্মু জড়িয়ে ধরে, আমাকে শান্ত করতে চাচ্ছে। কিন্তু পারে নাই, হঠাৎ আমি সেন্সলেস হয়ে গেলাম। প্রায় ১৬ ঘন্টার পর সেন্স আসে, তখন আমি হাসপাতালে বেডে শুয়ে আছি। পরের দিন ছুটি দিয়ে দিলো। এখন বাসা, মসজিদ, ওড়না, চিঠি, ডাইরি এই গুলো আমার সম্বল। আমার প্রতিদিন সঙ্গী, এই গুলো নিয়ে দিন শুরু এবং শেষ হয়।
জানি না আমরা দু’জন কি পাপ করছিলাম। তাই আল্লাহ আমাদের এতো বড় শাস্তি দিছে। এখন একটাই চাওয়া, মৃত্যুর পর যেনো ও আমার হয়। প্রতিবার মোনাজাতে আল্লাহর কাছে চাই, ওর সমস্ত গোনাহ্ ক্ষমা করে দেয় এবং জান্নাত দান করেন। আর এভাবে যেনো কারো ভালোবাসা না হারায়। সবার ভালোবাসা যেনো পূর্ণতা পায়।
২০২০ সাল প্রতিটা মানুষের জন্য হয়তো অভিশপ্ত বছর।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা