পবিত্র ভালোবাসা

পবিত্র ভালোবাসা
আমি যখন গভির ঘুমে আচ্ছন্ন ঠিক তখনই পুস্পের ফোন আসে।আমি খানিকটা বিরক্ত হই।ঘুমানোর সময় কেউ ফোন দিলে আমার বিরক্ত লাগে।ঘুম থেকে উঠলে মাথা ঝিমঝিম করে।ভার হয়ে থাকে।তাই মেজাজটাও খিটখিটে হয়ে থাকে।আমি পুস্পের ফোন কোন রকমে ধরে কানের উপরে রেখে দিলাম।ওপাশ থেকে খুব সুন্দর, কোমল স্বরে পুস্প বলল,
:কি রে! কই তুই?
পুস্পের কন্ঠ সুন্দর এটা জানি।এই কন্ঠের উপর প্রচন্ড রকমে ক্রাসিত হয়েছিলেন ভার্সিটির একজন বড় ভাই।তাই পুস্পের কন্ঠ শুনে আমার ভীষণ ভালো লাগার কথা।অবশ্য আমারো ভালো লাগে।তবে সেটা আর যাই হোক ঘুমের সময় নয়।ঘুমের সময় কেবল ঘুম ছাড়া আমার অন্যকিছু মোটেও ভালো লাগে না।পুস্প আমায় এখন প্রচন্ড রকমে বিরক্ত করেছে।তাই আমার মেজাজটা খানিকটা খিটখিটে হয়ে আছে।পুস্পের কোমল কন্ঠ আমায় এখন বিমোহিত না করায় আমি ঝনঝনে কন্ঠে এপাশ থেকে বললাম,
:কি ব্যাপার? এই অসময়ে ফোন দিলি কেন? পুস্প অবাক ভরা কন্ঠে বলে,
:মানে কি? তোর না আমাকে বাস স্ট্যান্ড থেকে পিক করে হোস্টেলে নামিয়ে দিয়ে আসার কথা? এপাশ থেকে আমি কিছু বলতে পারলাম না।চোখের পাতা এক হয়ে আছে।প্রচন্ড ঘুম চোখে।চোখ লেগে আসে তাৎক্ষনাত! কি বলেছে ও বুঝতে পারি নি।কথা বলতে পারছি না।কোন মতে বললাম,
:ঠিক আছে।পরে কথা বলব। এই বলে ফোনটা কেটে দিলাম।বহু কষ্টে চোখের পাতা জোড়া একটু ফাঁক করে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে ফোনটা বন্ধ করে দিলাম।এটাই উত্তম বলে আমার মনে হয়। তা না হলে ফোন দিয়ে জ্বালিয়ে মারবে।কেন যে এত ফোন দেয় আমি বুঝি না।
প্রায় সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে।আমার ঘুম ভাঙ্গে তখন। মন মেজাজ প্রচন্ড ভালো।সম্পুর্ন ভাবে ঘুম যাওয়ায় মনের মাঝে একটা অন্যরকম অনুভুতি জাগে।বাসায় আপাতত কেউ নেই।সবাই বেড়াতে গিয়েছে।আমি যাই নি।আমার বেশি বেড়াতে ভালো লাগে না।উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।বিছানার কাছে আসতেই ফোনের উপর চোখ গেল।সাথে সাথে আমার পুস্পের কথা মনে পড়ে যায়।ও ফোন দিয়েছিল বিকেলে। কেন দিয়েছে? কি জানি বলছিল? ঠিক তখনই আমার একটা কথা মনে পড়ে যায়।কথাটা মনে পড়তেই আমার বুকের বাঁ পাশের ধপ ধপ শব্দের তীব্রতা খানিকটা বেড়ে যায়।পুস্প আমার ফ্রেন্ড। বেস্ট ফ্রেন্ড বলা চলে।
ও থাকে হোস্টেলে! এত দিন ভার্সিটি বন্ধ থাকায় ও নিজেদের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল।আজ যখন আসবে তখন আমায় বলেছিল ওকে বাস স্ট্যান্ড থেকে পিক করে হোস্টেলে দিয়ে আসতে।কথাটা শুনে আমি খানিকটা অবাকই হলাম।ও কি নিজের হোস্টেল চিনে না? তাহলে আমাকে পিক করতে বলছে কেন? এদিকে খুব একটা ধ্যান না দিয়ে ওকে বলে দিলাম যে ওকে পিক করতে আমি যাব।কিন্তু এখন? এখন কি হবে?আমি তো ওকে পিক করতে যাই নি। এই মেয়ে যে জেদি? আজ জানি কি অবস্থা করে কে জানে। আমি ফোন অন করেই ওকে ফোন দিলাম।বেশ কয়েকবার দেওয়াতেও ও ফোন ধরল না।এতে আমি খানিকটা চিন্তিত হয়ে গেলাম।আবার কি করে বসছে! খুব দ্রুত বাসা থেকে বের হলাম।আর ওকে ফোন দিতে থাকলাম।আমি নিশ্চিত, এই মেয়ে কিছু না কিছু করে বসে আছে। এদিকে আঁধার নামবে বলে তেড়ে আসছে।চারিদিক কালো হয়ে আসছে। আমি যখন গেইট দিয়ে বের হব ঠিক তখনই ও ফোন ধরেছে।আমার খানিকটা স্বস্তি ফিরে এল যেন।ফোন ধরেই ও কিছুটা সময় চুপ করে থাকল। আমি সময় না নিয়ে বলতে লাগলাম,
:কি ব্যাপার! এত বার ফোন দিচ্ছি ফোন ধরছিস না কেন? আমার কি টেনশন হয় না? পুস্প অনেকটা সময় কথা বলে না।চুপ করে থাকে। ওপাশ থেকে নাক টানার আওয়াজ পাই আমি।কাঁদছে নাকি?
:আশ্চর্য! কথা বলছিস না যে? পুস্প মুখ খোলে। ওপাশ থেকে শান্ত, কোমল কন্ঠের বদলে রাগি কন্ঠ শুনা যায়।বলে,
:তুই আমার জন্যে টেনশন করছিস কেন? তোকে টেনশন করতে হবে না।ফোন রাখ।
ফোন কাটা যায়।আমি কল লিস্ট চেক করি। চারটা বিশ-এ ফোন দিয়েছিল ও।এখন ছয়টা সাতাশ বাজে। তার মানে ও আরো আগে এসেছে? এতক্ষন কেবল বাস স্ট্যান্ডেই বসে আছে। নিশ্চই আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।আমার খানিকটা খারাপ লাগে।আমি একটা রিক্সা নিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাই।
ওর সাথে যখন কথা বলছিলাম তখন বাসের হর্ন শুনেছিলাম।হেল্পারের চিল্লানীও শুনেছি।তাছাড়া ওদের হোস্টেলের আসেপাশে কোন বাস স্ট্যান্ড কিংবা বাস চলাচলের কোন ব্যাবস্থা নেই।তাই বুঝা যায় যে মেয়েটা এখনো বাস স্ট্যান্ডেই আছে।আমি আবারো খানিকটা অবাক হলাম।ও এখনো বসে আছে কেন?একা একা যেতেই তো পারে।মূল কথা হল আমাকে ওখানে নেওয়া।আমাকে ওখানে যেতেই হবে। নিজের জেদ পূরণ করা আরকি।এক অদ্ভুত রকমের মেয়ে ও।এখন আবার কান্নাকাটি করছে।কি যে করি? আমি কাউন্টারের সামনে যেতেই দেখলাম পুস্প একটা সিটে বসে আছে। চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। চোখের গাঢ় কাজল লেপ্টে আছে চোখের চারপাশে।এত কান্নার কি আছে আমি বুঝিনা।আমি হুট করেই ওর সামনে গেলাম না। কাউন্টারে বসে থাকা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম,
:এই মেয়েটা এখানে বসে আছে কেন? ছেলেটা প্রচন্ড বিরক্ত হয়।বলে,
:আর বইলেন না ভাই।সেই কখন আইসা বইসা আছে!কত বার বললাম যে আমি রিক্সা ডাইকা দেই।আপনি চইলা যান।সন্ধ্যে হইতেছে।না! আমি রিক্সা ডাইকা দিলে উনি যাইবেন না।উনারে নাকি কোন গর্দভ নাকি নিতে আসবে।
আমি খানিকটা হতভম্ব হলাম।আমাকে গর্দভ বলেছে? আমি সিউর হওয়ার জন্যে বললাম,
:গর্দভ? গর্দভ বলেছে কেন?
:আমি কি জানি।উনিই বলেছেন।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে পুস্পের সামনে এলাম।আমাকে দেখেই কেবল একবার তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। তারপর উঠে দাঁড়াল। এমন একটা ভাব করল যেন সে কোন এক যুদ্ধ্যে জয় হয়েছে।তবে আমার দিকে তাকাচ্ছে না।মুখটা বেশ শক্ত করে আছে। রেগে আছে বোধ হয়। রিক্সায় উঠার পর ও আমার সাথে একটা কথাও বলল না।আমার দিকে একবার তাকালোও না।গালল আর নাক ফুলিয়ে দিব্যি কঠোর হয়ে বসে আছে।ওর চুপ থাকা দেখে আমি বললাম,
:আচ্ছা তুই ওই কাউন্টারের ছেলেটাকে বলেছিস তোকে একটা গর্দভ নিতে আসবে। ওই গর্দভটা কি আমাকেই বোঝায়। ও কথা বলে না।চুপ করে থাকে।এমন ভাবে আসপাশ দেখছে যেন এখানে নতুন এসেছে।একেবারে নিখুঁত ভাবে দেখছে। আমার কথা শুনছেই না।বা আমি যে ওর পাশে বসে আছি সেটা ও জানেও না।রেগে আছে বোধ হয়। আমার খারাপ লাগে।দোষটা আমারই। তাই সরি আমাকেই বলতে হবে।আমি আস্তে করে বললাম,
:সরি! ওর মাঝে কোন পরিবর্তন এল না।সেই আগের মতই আছে।আমি আবার বললাম,
:আসলে কাল রাতে একটু বেশিই আড্ডা দিয়েছিলাম। রাতে ঠিক ভাবে ঘুমাতে পারি নি।তাই দুপুরের দিকে শুয়েছিলাম। তারপরই ঘুম চলে আসে।সরি রে! উঁহু! কোন পরিবর্তন নেই ওর মাঝে।আমিও আর কিছু বললাম না।চুপ করে থাকলাম।রাগটা একটু বেশিই করে ফেলেছে। পুস্প রিক্সা থেকে নামে ভাড়া দেওয়ার জন্যে পার্স খুলল।আমি বললাম,
:থাক না।আমিই দিয়ে দিব। পুস্প আমার কথা শুনল না।আমি নেমে ওকে এগিয়ে দিয়ে আসতে চাইলাম।আমাকে নামতে দেখে বলল,
:প্রয়োজন নেই তোর আসার।তুই চলে যা।আর আজ থেকে আমার সাথে কথা বলবি না।তোর সাথে কোন কথা বলতে চাই না আমি।তোর মত কেয়ারলেস বন্ধু আমার চাই না।আজ থেকে তুই আর আমি ভিন্ন। আমি পুরো থ হয়ে গেলাম।বুকের বাঁ পাশটা খানিকটা মুছড়ে উঠল। বলে কি ও।নিজেকে সামলে বললাম,
:আরে আমি তো সরি ও চলে গিয়েছে।একেবারে চলে গিয়েছে।ওর সাথে আর কথা হয় নি।আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন এখানে এসে স্থগিত হয়ে ভেঙ্গে যায়।আমি এর পরেও বেশ কয়েকবার সরি বলেছি।ও এড়িয়ে যায়। কথা বলে না।ফ্রেন্ডদের আড্ডায় আমি থাকলে ও থাকে না।চলে যায়।অন্যকোথাও গিয়ে বসে। সর্বোপরি আমায় সম্পূর্ণ ভাবে এড়িয়ে চলে ও।আর বাকি গুলো তো তোমার সামনেই ঘটা। পাশ থেকে নিরু বলে উঠল,
:পুস্প আপুর এতটা বাড়াবাড়ি করা ঠিক হয় নি।মানুষ তো ভুল করতেই পারে।তার জন্যে এতটা বাড়াবাড়ি মোটেও কাম্য নয়।আঙ্গুলের নখ বড় হলে নখ কাটতে হয়।সম্পূর্ণ আঙ্গুল না।ভুল বুঝাবুঝি হলে সুধরে নিতে হয়।এরজন্যে সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলা উচিৎ নয়। নিরু আমাদের বাসায় নতুন এসেছে।আমার জুনিয়র। নতুন হওয়ায় একা একা আসতে ভয় পাচ্ছিল নাকি।তাই আন্টি আমায় ধরিয়ে দিলেন। বড় মানুষ। মায়ের সমতুল্য! তাই ফেলতে পারি নি। মেয়েটাও মোটামুটি ভালো মিশুক আছে।আমার কোন ছোট বোনও নেই। তাই ওকে বোন বানিয়ে নিলাম।ওকেই এতক্ষন পুস্পের সাথে আমার বন্ধুত্ব বেঙ্গে যাওয়ার কাহিনীটা বললাম।আমার বন্ধুরা এক জায়গায় আড্ডা দেয় আর আমি একা একা বলে ও একা থাকার কারণ জানতে চাইল।তাই কারনটা বললাম। নিরুর কথা শুনে আমি মেকি হাসি দিলাম। বললাম,
:হয়েছে! এত পাকা পাকা কথা বলতে হবে না।চল! বাড়ি যাই।
:চলে যাবা?
:ভালো লাগছে না।
:ওকে।তাহলে চল। গল্প করতে করতে যাই।
আমি আর নিরু উঠে দাঁড়ালাম।আমি দাঁড়াতেই চোখ গেল পুস্পদের আড্ডার দিকে। ও আড় চোখ আমায় দেখল একবার।আমাদের চোখাচোখি হয়।খুব দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয় ও।তারপর আমি।চলে আসি নিড়ে। পুস্পের সাথে আমার বন্ধুত্ব আর হয়ে উঠে নি।বরং অনেক অবহেলা পেয়েছি আমি।ওর প্রচন্ড অবহেলায় কষ্ট পাওয়া অনুভুতিটা জানিয়ে দেয় যে মেয়েটাকে আমি ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি। আশ্চর্য! একটু টেরও পাই নি আমি।এখন মনে হয় যে ওর জন্যে সব করতে পারব। ওর জন্যে আজ বন্ধুদের আড্ডায় আমি নেই।তাই আড্ডায় আজ হোহোহো করে কেউ হেসে উঠে না।মজার মজার জোক্স বলার মত আমি ছেলেটা আর নেই। ক্লাসের সময় এক কোনে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকি।যাতে পুস্প না দেখে।আড়াল করি নিজেকে। ক্লাসে আজ আর হইহুল্লড় করি না।দুষ্টামি করি না আজ অনেক দিন।কারো কাছ থেকে প্রচন্ড অবহেলা পেয়েছে ভিশন কষ্টে আছি আমি।দিনরাত পার হয় কেবল পুস্প নামক অদ্ভুত মেয়েটার জন্যে।
আমি এটা ভাবতেও পারি নি যে ওকে আমি ভালোবাসব বা এত ভালোবাসি।উঁহু! আপনি জানেন না।ভালোবাসা বলেকয়ে আসে না।হুট করেই এসে পড়ে।তবুও আপনি জানেন না আমি তাকে প্রচন্ডরকমের ভালোবাসেন।আপনি তখন জানেন যখন ভালোবাসার মানুষটা থাকে না আর।তাকে আপনি অনেক মিস করতে থাকেন।তার কথা ভাবতে থাকেন কেবল।এই ভাবতে থাকাটা হল ভালোবাসা।তার শুন্যতায় কষ্ট পাওয়াটা হল ভালোবাসা।ভালোবাসা ধরা যায় না।ছোঁয়াও না।কেবল অনুভব করা যায়।তার প্রতি আপনার এই অনুভুতিটাই ভালোবাসা।।তার না থাকার প্রতিটি মুহুর্ত আপনাকে জানিয়ে দিবে আপনি তাকে কতটা ভালোবাসেন।ঠিক এমনটা আমার সাথেই হয়েছে।আমার এখন প্রতিটি মূহুর্ত জানান দেয় আমি মেয়েটাকে কতটা ভালোবাসি। এই ভালোবাসা প্রকাশ করে তার থেকে ঘৃণা পাওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই। তাকে যে একটু দেখতেই পাই এই অনেক।
:ভাইয়া! একটা কথা বলব? সবুজ ঘাসের উপর বসে বসে খানিকটা কবিদের ভাব নিয়ে পুস্পের কথা ভাবতেছিলাম।ঠিক তখনই নিরু বসতে বসতে কথাটা বলল।আমি আবারো মেকি হাসলাম।বললা,
:বল!
:পুস্প আপুকে খুব ভালোবাস তাই না। আমার মনে কেবল পুস্পের কথাই ছিল।তাই অকপটে সত্য কথাটা বেরিয়ে গেল যেটা আমি খুব যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছিলাম। বললাম,
:হুম! খুব এতটুকু বলতেই মনে পড়ল এটা বলাটা ঠিক না।আমি যেটা লুকাতে চাচ্ছি সেটা আমি বোকার মত বলে বেড়াচ্ছি। এটা মোটেও ঠিক না।আমি আবারো মেকি হাসি দিয়ে বললাম,
:নাহ।দুষ্টামি করেছিলাম।যে আমাকে সহ্যই করতে পারে না তাকে আমি ভালোবাসব কেন? কি সব গাধার মত প্রশ্ন করিস না। এড়িয়ে যাই।মুখ ফিরাই অন্য দিকে। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার।আর পারছি না মিথ্যা বলতে।কষ্ট হয় অনেক। চোখে জল জমে। বের করি না।ভেতরে রেখে দুমড়ে মুছড়ে মরি আমি।অনেকটা সময় কোন কথা হয় না।আমি আবার নিরুর দিকে ফিরি মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি চোখ ফিরিয়ে নেই। ও বললে,
:আরিফ ভাইয়া! তুমি মিথ্যা বল?
:কই না তো! আমি মিথ্যা বলব কেন?
মিথ্যা বলি না বলে আরো একটা মিথ্যা বলি আমি।এত পাপের ভার কিভাবে যে নিব? নিরু উঠে দাঁড়ায়।আমার বুকটা ধক করে উঠে। ও পুস্পের কাছে যাচ্ছে না তো।আমি ওর চোখের দিকে তাকাই।আমি মারাত্মক ভাবে ভয় পাই।নিরুর চোখ বলছে ও পুস্পের কাছে যাবে।আমি নিরুর হাত ধরে ফেলি।ভেজা কন্ঠে বলি,
:প্লিজ বোন।কাউকে বলিস না! পুস্পকে তো নাই। প্লিজ। এই বলে ওকে বসিয়ে দেই।ও বলে,
:এভাবে আর কত ভাইয়া?
:যাই হোক।আমি ওর চোখে আমার জন্যে ঘৃণা কখনোও সহ্য করতে পারব না।কোন মতেই না।
:কিভাবে যে পার!
:সময় শিখিয়ে দেয় সব। অনেকটা সময় চুপচাপ কাটে আমাদের।খানিকটা সংকোচ নিয়ে নিরু বলে,
:ভাইয়া! একটা কথা বলব?
:হুম বল।
:তার আগে বল তুমি আমায় হেল্প করবে। আমি ওর মাথায় হাত দিয়ে বললাম,
:পাগলি! বল কি করতে হবে!
:আসলে ভাইয়া আমার একজনকে খুব ভালো লাগে। এই বলে ও খানিকটা লজ্জা পায়।আমি মৃদু হাসি।বলি,
:কে সেই রাজপুত্র?
:ওই যে তোমার বন্ধু! তাসফি! তাসফিকে আমার খুব ভালো লাগে।
:কিহহ! তুমি এই হাবলাটার প্রেমে পড়লে কিভাবে?
:এই ভাইয়া! ওকে একদম হাবলা বলবা না।হাবলা হলে এত সুন্দর গল্প লিখতে পারে কেউ?
:হা! কচু লিখে।কি না কি ছাইপাঁশ লিখে।জঘন্য! তুমি আবার তার প্রেমে পড়লা।
:ভাইয়া! তুমি কি তার সত্যি কারের বন্ধু? নাকি শত্রু।জানো ও ওর গল্পে, প্রতিটা পোষ্টে তোমার নাম এবং তোমাদের কথা,প্রায় সবার কথাই বলে। আর সেই তুমি কি না…
:হেহে! ওর এসব ছাইপাঁশ আমার পড়া আছে।কি না কি লিখে।ধুরর।খামখা টাইম নষ্ট করা আরকি।
:সে যাই হোক।হেল্প করাব?
:তুমি বলছ! না করে পারি?
:ওকে।ধন্যবাদ ভাইয়া।
যাই।দেখি হাবলাটারে পটাইতে পারি কি না।যাই হোক, ওর পিছু ছাড়া যাবে না।আমাকে ভালোবাসাতেই হবে।এত বড় সাহস! আমার প্রপোজাল রিজেক্ট করে সে! ওর ভাব আমি ছুটাবো। আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম,
:প্রপোজ করে ফেলেছিস?
:হুম।
:আমি জানতাম।
প্রপোজ একচেপ্ট করবে না।ও এমনি। আচ্ছা।যা! দেখ পারিস কি না।না পারলে তো আমি আছিই।(অবশ্যই তাসফি আর নিরুকে নিয়ে গল্প আসবে।) নিরু চলে যায়।আমিও চলে আসি।ভালো লাগে না কোন কিছুতেই। বিকেলে শুয়েছিলাম। ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি নিরু ফোন দিয়েছে।ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে হস্তদন্ত হয়ে নিরু বলল,
:ভাইয়া! খুব জলদি সেন্ট্রাল হাসপাতালে চলে আস।পুস্প আপু সেই কখন জ্ঞান হারিয়েছে এখনো জ্ঞান ফিরে নি।
আমি কয়েক মুহুর্তের জন্যে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। কোন রকমে বলি,
:কি হয়েছে ওর? কিভাবে হল?
:ডাক্তার বলেছে দূর্বলতার কারনে হয়েছে।উনার রুমমেট বলেছেন উনি নাকি আজ দুইদিন কিচ্ছু মুখে নেন নি।
:আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আসছি। ঠিক তখনই নিরু জোরাল কন্ঠে বলল,
:এই ভাইয়া শুন।আপুর জ্ঞান ফিরেছে মাত্র।তুমি জলদি আস।
আমি ফোন কেটে খুব দ্রুত হাসপাতালের দিকে যেতে থাকলাম।বুকের বাঁ’পাশটার ব্যাথা বেড়েছে।চিন্তায় ভাবনা শক্তি যেন লোপ পেয়ে যাচ্ছে। আমার প্রতি পদে যেন অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে। আমি দরজা ঠেলে রুমে ঢুকলাম।আমাকে দেখতেই পুস্প উঠে বসতে চাইল।আমি কাছে গিয়ে বললাম,
:আরে করছিস কি! উঠিস না।শুয়ে থাক। ও আমার কথা শুনল না।আমার দিকে তাকালো না।নিজে উঠে আধশোয়া হয়ে বসতে চাইচে। আমার কি করা উচিত ভেবে পেলাম না।পরমূহুর্তে ভাবলাম চলে যাই।ও হয়ত বিরক্ত হচ্ছে।বা আমার সাথে কথা বলতে চাইছে না।তাই চলে যাওয়ার জন্যে পাঁ বাড়ালাম।ঠিক তখনই ও বলল,
:খুব জেদ তোর না? এত অভিমান তোর? আর সেই তুই কি না আমায় বলেছিস আমি জেদি!অভিমানি!
আমি ওর দিকে তাকাই। প্রথম বারের মত ওর চোখে চোখ রাখি।ও নিজেও একভাবে তাকিয়ে আছে। আশ্চর্য! অদ্ভুত শান্তি এতে।আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।আমার চোখে জল জমছে।দেখে ফেলতে পারে ও।তাই সরিয়ে নিলাম। বললাম,
:এখন কেমন আছিস!
:সেদিন থেকে আজ তুই আসার আগ পর্যন্ত আমি একদমই ভালো ছিলাম না।এখন মোটামুটি ভালো আছি।
:বুঝলাম না।
:আমি জানি তুই বুঝবি না।আমি মরে গেলেও তুই বুঝবি না।
:ছি ছি! মরে যাওয়ার কথা বলিস না।কষ্ট হয়!
:আমার কষ্ট হয় না।আমারো তো কষ্ট হয়।আমি সহ্য করতে পারি না এত কষ্ট। তুই বিশ্বাস কর! আমি সহ্য করতে পারি না মোটেও।
পুস্পের গাল বেয়ে চোখের জল পড়ে। সাথে কিছু কষ্ট ঝরে।আমার চোখেও জল জমে।প্রথম বারের মত গড়িয়ে পড়ে কিছু জল।আমি বলি,
:তুই কষ্ট পাস কেন?
:তুই ভালো নেই তাই।
:আমি ভালো নেই কে বলেছে?
:তোর চোখ। আমি কিছু সময় চুপ করে থেকে বলি,
:তাহলে কষ্ট দিস কেন?
:ভুলে ।
ভুলে কষ্ট দিয়ে তার মাসুল দিচ্ছি এই হাসপাতালে বসে। বিশ্বাস কর আমি এতদিন ভালো ছিলাম না।তোকে কষ্ট দিয়ে আমি মোটেও ভালো ছিলাম না।আমার প্রতিটি মূহুর্ত কেটেছে তোকে ভেবে।জানিস নিরবে অনেক কেঁদেছি। তবুও কষ্ট কমে না।কষ্ট বাড়ে কেবল।বিশ্বাস কর এই কয়েদিনে ভালো মত খেতেও পারি নি।খাওয়া গলা দিয়ে নামে না।তোর সাথে ভার্সিটিতে কঠোর ব্যবহার করলেও ভিতরে ভিতরে মরেছি কেবল।যেন তোকে হারিয়ে ফেলছি।হারিয়ে ফেলার ভয়ে কষ্ট পেয়েছি দিনরাত। আমার বুকের ধপ ধপ শব্দটা খানিকটা বেড়ে যায়।বহু কষ্টে বলি,
:ভালোবাসিস? পুস্প আমার দিকে গোল গোল চোখে তাকায়।তার চোখে আমার জন্যে প্রচন্ড ভালোবাসা দেখি আমি।পুস্প কি তাই দেখে আমার চোখে?ও বলে,
:তুই মনে হয় বাসিস না! আমি চুপ করে থাকি।কথা বলি না।এই প্রথম প্রচন্ড আনন্দে আমার চোখে জল আসে।আমি পুস্পের দিকে তাকিয়ে থাকি।ও আবার বলে,
:জানিস! আমি যাকে ভালোবাসি সে কখনো আমার হাত পর্যন্ত ধরে নি।আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নি।অথচ সেদিন জুনিয়র একটা মেয়ের হাত ধরেছে ও।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। মানুষটা এত খারাপ যে ভালোবাসে আমায় আর হাত ধরে অন্যকারো। আমি এবার ভীষন অবাক হই।বলি,
:নিরুর কথা বলছিস? পুস্প মুখ ঘুরিয়ে নেয়।অনেদিকে তাকায়।তার এই তাকানো জানান দেয় আমার পাশে কোন মেয়েকে সে মেনে নিতে পারে না।কষ্ট হয় তার।আমি বলি,
:আরে ও আমার ছোট বোনের মত।…
:জানি আমি।
:কে বলেছে?
:ওই যে নিরু! নিরু বাইরে ছিল। জানাল দিয়ে ওকে দেখিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল পুস্প।
:ও বলে দিয়েছে সব!
:আমি জেনে নিয়েছি।ও বলে নি। এই বলে পুস্প কিছু সময় চুপ করে থাকে।তারপর চেঁচিয়ে বলে,
:এখনো কি বসে থাকবি নাকি কাছে এসে হাত ধরবি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিবি না? গর্দভ!
আমি মৃদু হাসি।এগিয়ে যাই কাছে।ওর হাত ধরতে যাব ঠিক তার আগেই ও আমার বুকে ঝাপটে পড়ে।তারপর খানিকটা কান্না করে।ভেজা কন্ঠে বলে,
:বিশ্বাস কর এতটা শান্তি আমি কোনদিন পাই নি।তোর মাঝে কি আছে এত ! এত শান্তি কেন এখানে?
আমার চোখে জল জমে।আনন্দের জল।ভালোবাসার মানুষটিকে পাওয়ার আনন্দ। পুস্পের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলি,
:এখানে ভালোবাসা আছে।পবিত্র ভালোবাসা।কোন বেড়াজাল নেই।নেই কৃত্তিমতা।তাই এত শান্তি।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত