“ক”
মেয়েটাকে কোলে রেখে স্টোভের সামনে উবু হয়ে বসে আছে মিনু। জ্বাল কমিয়ে ছোট একটা পাতিল চড়িয়েছে।
বাম হাতে মেয়েটাকে ধরে রাখতে হচ্ছে, না হলে কোল থেকে নেমে যাবে। ভীষণ ছট ফটে স্বভাবের হয়েছে মেয়েটা।
হামাগুড়ি দিতে পারে ভাল মত, ছেড়ে দিলেই সারা ঘর ময় ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। যেটাই পায়- ধরে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে।
কদিন আগে তো স্টোভ ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে স্টোভ উল্টে ফেলে দিয়েছিল। ভাগ্য ভাল যে স্টোভ নেভানো ছিল।
মিনু গিয়েছিল গোসল করতে। ঘুম পাড়িয়েই রেখে গিয়েছিল। এসে দেখে এই কান্ড করে রেখেছে মেয়ে।
কেরসিন আর কালি ঝুলির মাঝে মাড়ি বের করে হাসি দিচ্ছে তার এগারো মাসের মেয়েটা!
উঁচু বিছানা থেকে কীভাবে নেমেছে এত টুকুন মেয়ে সেটাই ভেবে পায়নি মিনু। সেই থেকে সাবধান হয়ে গেছে।
গোসল করতে গেলেও মেয়েকে কোমড়ে বড় একটা বেল্টে বেঁধে খাটের স্ট্যান্ডের সঙ্গে লাগিয়ে রেখে যায়।
তাতে ঘুম ভাঙলেও বিছানার বাহিরে যেতে পারবে না, বড় জোর বিছানার বাহিরে এসে ঝুলতে থাকবে। ঘরের সঙ্গে এটাজড্ বাথরুম হলে অসুবিধা ছিল না।
চড়ুই পাখির মত এক রুমের বাসা, সাথে কেবল রান্নাঘর, তাও ঘরের মধ্যেই একপাশে রান্নার জন্য অল্প জায়গা রাখা। আলাদা কিছু না।
টিন শেডের চালের নিচে ত্রিশটা পরিবার থাকে এখানে। বাহিরে গোসল খানা আর টয়লেট।
সিরিয়াল দিয়ে রাখতে হয়, আগে থেকে বালতি মগ বাথরুমে রেখে না এলে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
সাত সক্কাল বেলা টয়লেটের জন্যও বিশাল লাইন পড়ে থাকে। মিনুর স্বামী হামিদের আবার সকাল সকাল অফিস যেতে হয়।
তিন টয়লেটের এত লম্বা সিরিয়াল ভেঙে সামনে যাওয়ার মত সময় থাকে না হাতে। অফিসের টয়লেটই ভরসা।
সকাল বেলা উঠেই কোনো মতে মুখে কিছু একটা গুজে অফিসের জন্য কাপড় চোপড় পরে রওনা হয়ে যায়।
জামা-জুতোর কোনো ঠিক না থাকলেও ‘টাই-চাই’ অফিস হামিদের।
ভোর বেলা বাসের দরজার হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে ঝুলতে মতিঝিলের অফিসে যাওয়ার সময় ব্ল্যাক স্টেপের টাইটা পতাকার মত পত্ পত্ করে উড়তে থাকে।
টাইপিন না থাকায় আশে পাশের ঝুলন্ত মানুষগুলোর মুখে গিয়েও লাগে টাইয়ের বাড়ি।
বিরক্ত মুখে বলে ওঠে লোকজন, “ভাই নিজের গাড়ি নাই তো টাই পরছেন ক্যান? পকেটে ঢুকায় রাখেন মিয়াঁ। মানুষজনের মুখে বাড়ি খাইতেছে!”
হামিদ উত্তর দেয় না। চুপচাপ স্বভাবের মানুষ সে। মিনুর কথা অনুযায়ি “কাঁঠাল গাছ”। হাজার কথা শুনলেও উত্তর দেয় না।
পতাকার মত টাই উড়িয়েই প্রতিদিন অফিসে যায়। টাই’টা মিনু কিনে দিয়েছিল বিয়ের দ্বিতীয় দিনে। আর অন্য কোনো টাই কেনা হয়নি।
রঙ জ্বলে গেছে অনেকটাই, তাও এই এক জিনিস দিয়েই চলছে হামিদ। ভ্রুঁক্ষেপ নেই।
অফিসে গিয়ে ঢোকা মাত্র পিয়ন বাথরুমের তালা খুলে দিয়ে দাঁত বের করে একটা হাসি দেয়, “ভাইজান, বাথরুম কিলিয়ার করি ফালান।
আপনের লাইগাই তো আমার এত বিয়ান বেলা আসা।”
হামিদ কোনো কথা না বলে বাথরুমে গিয়ে ঢুকে বসে থাকে। যতক্ষণে বের হয় ততক্ষণে অফিসের সব স্টাফ চলে এসেছে।
বাথরুম থেকে হামিদকে বের হতে দেখে চাপা একটা হাসি হাসতে থাকে সবাই। অনেকেই পেছনে পেছনে নাকি তার নাম দিয়েছে “বাথরুম হামিদ”।
অফিসে তিনটা হামিদ আছে। ফাইল কার টেবিলে নিয়ে যেতে হবে পিয়ন জিজ্ঞেস করলে সবাই চাপা স্বরে বলে দেয়, “বাথরুম হামিদের কাছে পাঠাও।”
না হলে বাত হামিদ কিম্বা হাম হামিদ। সবারই পেছনে পেছনে নাম দেয়া থাকলেও মিনুর স্বামীর মত এত ফলাও নাম পায়নি কেউ।
অফিসের বড় সাহেব পর্যন্ত মাঝে মাঝে সামনা সামনি বাথরুম হামিদ ডেকে বসেন তাকে।
হামিদ শান্ত স্বভাবের মানুষ। শুনে যায় কেবল ভাবলেশহীন মুখে। উত্তর দিতে ভাল লাগে না। জগৎ সংসারে সবাই বলতে ভালবাসে, শুনতে ভালবাসে না।
হামিদের বেলায় অন্যরকম। সে শুনতে পছন্দ করে।
প্রতিদিন অফিসের হাজারটা কাজ আর কথা শুনে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পর বিছানায় পড়ে মরার মত ঘুমাতে থাকে।
গোসল খানার বিশাল লাইন সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকে দেখে হামিদ রাত দশটার পর গোসল করে। তখন ভিড় থাকে না। গোসল করে এসে খেয়েই আবার ঘুম।
বাজার যে যেতে হবে খেয়াল থাকে না। তাছাড়া রাত দশটার পর আবার বাজার কিসের?
মিনু সুজির বোয়মটা খুলে ভেতরে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দু এক চামচের মত সুজি বাকি আছে। বাসায় চিনিও শেষ হয়ে এসেছে।
ডানো দুধের বোয়মের দামও বেড়েছে। বার বার কেনা যায় না। হামিদের বেতন কম।
ঘরের বাজার সদাই আর বাসা ভাড়া দিতে দিতেই সব শেষ হয়ে আসে।
মিনুর মেয়েটা আবার সুজি দিয়ে দুধটাকে তরল ধরণের করে না দিলে ফিডার খেতে চায় না।
সুজি লাগবেই। চিনি খাওয়ার শখ আছে। হাতের তালুতে অল্প চিনি দিয়ে দিলে মুঠো করে ধরে রেখে চেটে চেটে খেতে থাকে বাচ্চাটা।
বিছানার ওপর চিত হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে হামিদ। ঘাড় বাঁকা করে শুয়েছে দেখে মৃদু নাক ডাকছে। গোসল করেনি এখনো।
ঘরে ঢুকেই মিনুকে বলেছে দশটা বাজলে ডেকে দিতে উঠে তখন গোসল করতে যাবে। অফিসের কাপড় পরেই শুয়ে পড়েছে। টাইটাও খোলেনি ঠিক মত।
মিনু স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল। কারেন্ট নেই। একপাশে হারিকেন জ্বলছে, আর স্টোভের আগুনের নীলাভ আলো। হামিদের মুখটা দেখা যাচ্ছে না ঠিক মত।
কিন্তু মানুষটা যে গরমে দর দর করে ঘামাচ্ছে বোঝা যায়। কিন্তু গরমটাকে পাত্তা না দিয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
মিনুর নাকের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে ফেলল সেটা।
আব্বা বলতো যে মেয়েদের নাকের ডগায় ঘাম জমে তারা নাকি বড় ঘরে যায়।
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটাকে নিয়ে উঠে এসে হামিদের পাশে বসল মিনু।
হাত দিয়ে হামিদের টাইটা খুলে নিতে নিতে টের পেল ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে মানুষটা। ঘরে কারেন্ট থাকলেও লাভ হতো না অবশ্য।
ফ্যান কেনা হয়নি। এরশাদ সাহেবের সামরিক সরকার খাবার দাবারের দাম কমালেও ইলেক্ট্রনিক্স জিনিস পাতির দাম আকাশে চরিয়ে রেখেছে।
ফ্যান একটা কিনবে কিনবে করেও কিনতে পারছে না হামিদ। সাইকেল একটা কিনেছিল ছয় মাস আগে, অফিসে যাওয়ার জন্য।
বাসে ঝুলে যেতে ভাল লাগে না দেখে। কিন্তু সাইকেল কেনার চার মাসের মাথায় মিলিটারি নামিয়ে দিয়েছিল এরশাদ সাহেব।
গণঅভ্যুত্থান ঠেকানোর জন্য, যেখানে যাকে পেয়েছে ধরে নিয়ে গেছে, কিম্বা টিয়ার সেল ছুঁড়ে লোক ঠেকানোর চেষ্টা করেছে।
হামিদ অফিসে যাওয়ার পথে মিলিটারি ট্রাকের সামনে পড়ে গিয়েছিল সেবার। রাস্তা থেকে লোকজন ধরে নিয়ে যাচ্ছে সন্দেহ লাগলেই।
উপায় না দেখে সাইকেলটা রাস্তার পাশে বড় ড্রেনে ফেলে দিয়ে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে দৌড় দিয়েছে হামিদ। ভেবেছিল পরে এসে সাইকেল তুলে নিয়ে যাবে।
কিন্তু ঘন্টা খানেক পর ফিরে এসে দেখে সাইকেল গায়েব। নর্দমা থেকেও সাইকেল তুলে নিয়ে যাবে কেউ ভাবতে পারেনি হামিদ।
মোটামুটি বজ্রাহত হয়ে ড্রেনের পাশে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে ছিল।
হামিদ সাধারণত কথা খুব একটা বলে না। কিন্তু সেদিন বাসায় এসে অনেক্ষণ গালাগাল করেছিল এরশাদ আর খালেদা-হাসিনাকে।
যতদিন আতিক সাহেব সেনা প্রধান হিসেবে ছিল, দেশ শান্তিতে ছিল। এরশাদও তার ওপর সব ছেড়ে রেখে চুপচাপ ছিল।
রাস্তা ঘাট বানিয়ে দেশটার একটু উন্নতি করেছে। কিন্তু নাসিম এসেই গণ্ডগোল পাকিয়েছে।
সেনা প্রধান বানানোর জন্য আর কাউকে যেন পায়নি এরশাদ সাহেব। নিজের গদিতে ইঁদুর তুলেছেন খেয়ে ফেলার জন্য।
নাসিম লোকটা এসেই সিভিল দলগুলোকে লাই দেয়া শুরু করেছে গণঅভ্যুত্থানের জন্য।
সুযোগ না দিলে কি আর বাসদের পাঁচ দল, সাত দল, শেখ সাহেবের মেয়ে আর খালেদা জিয়ায় মিলে চক্রান্ত করে?
দেশ শান্তিতে ছিল এতদিন- এখন হয়ে গেছে গরম কড়াই। লাফ মারলে আগুনে গিয়ে পড়তে হবে।
গদির বাদশাদের তো আর ঝামেলা নাই, কষ্ট তো বার মাসের মাইনে জমিয়ে সাইকেল কেনা ছাঁ-পোষা কেরানীদের,
চার মাসের মাথায় যাদের নর্দমায় সাইকেল ফেলে পালাতে হয় জান নিয়ে। না হলে ককটেলের বাড়ি খেয়ে হাত পা যাবে।
ষোল নম্বর ঘরের আনিস সাহেবের দুটো পা’ই উড়ে গেছে ককটেল না বোমে লেগে যেন। বিছানাতেই পড়ে থাকেন সারাদিন।
হামিদ দেখতে গিয়েছিল একবার, আপেল আর কমলা নিয়ে।
আনিস সাহেব শুয়ে শুয়ে হতাশ গলায় কেবল বলেছিল, “ভাই, আপেল কমলা দিয়ে আর কি করবো। পারলে দুইটা ঠ্যাং আনে দেন।
বিছানাতে হাগা মুতা করতে করতে অতিষ্ট হয়ে গেছি। সব দলগুলারে যদি বিছানেতেই শুয়ে বাথরুম করাইতে পারতাম- একটু শান্তি লাগতো।
শালারা তো হাই কমোড নিয়ে ঘোরে। বিপদ আপদ যত সব আমাদের!”
হামিদ শুঁকনো মুখে বসেছিল কেবল। আনিস সাহেবের কাটা পা’গুলোর ঘাঁ শোঁকায়নি এখনো। চাদর দিয়ে ঢাকা থাকলেও মাছি এসে ভন ভন করে।
কসাই খানার বড় বড় মাছি। আনিস সাহেব হাত পাখা দিয়ে সেগুলো উড়িয়ে দিতে দিতে বিমর্ষ মুখে বলতে থাকেন, “মাছিও পঁচা গন্ধ পায় ভাই।
সরকারের গন্ধ পায় না ক্যান বুঝি না!”
মিনুর কাছে ফিরে এসে সেদিন হামিদ চিন্তিত মুখে বলেছিল, “দেশের অবস্থা ভাল না। খারাপ কিছু একটা হয়ে যাবে। বাড়ীতে ফিরতে পারলে ভাল হতো।”
কিন্তু ফিরতে হয়নি ওদের। তার আগেই সব শান্ত হয়ে গেছে আগের মত। মিলিটারি কঠিন জিনিস। সব ঠাণ্ডা করে ফেলে।
দর দর করে ঘামতে থাকা হামিদের পাশে বসে বাড়ী ফেরার কথাটা মনে পড়তেই বিষণ্ণ হয়ে এলো মিনুর মুখটা।
কোলের মেয়েটাকে বাবার পাশে ছেড়ে দিতেই সে হামাগুড়ি দিয়ে বাবার পায়ের কাছে এসে পায়ের আঙ্গুল ধরে কামড়াতে শুরু করল।
মেয়েটার বড় অদ্ভুত স্বভাব। হামিদ কিম্বা মিনু ঘুমিয়ে পড়লেই তাদের পায়ের আঙ্গুল কামড়াবার চেষ্টা করে। প্রায় রাতেই মিনু ভয় পেয়ে জেগে যায়।
উঠে দেখে তাদের মেয়ে মহানন্দে তার পায়ের আঙ্গুল ধরে কামড় দেয়ার চেষ্টা করছে। মাত্র দুটো দাঁত হয়েছে মেয়েটার।
কামড় বসাতে পারে না ঠিক মত। মিনুর ঘুম পাতলা, হামিদের গাঢ়। হামিদ টের পায় না কিছুই। এখনো পাচ্ছে না।
একটা হাত পাখা নিয়ে জোরে জোরে হামিদকে বাতাস করতে করতে বেণুকে টেনে সরালো বাবার পা থেকে।
দু দিন পর পর অসুখ বাঁধাবে এই মেয়ে। হামিদের দিকে তাকাল মিনু। বাঁকা ভাবে শুয়েছে দেখে বালিসটা ঠিক করে দিল।
নাক ডাকাটা বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। গভীর নিঃশ্বাসের সাথে ধীরে ধীরে বুকটা ওঠা নামা করছে মানুষটার।
আধো অন্ধকারে হামিদের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে মিনু। গাছের গুঁড়ির মত হয়ে যাচ্ছে দিন দিন এই খুব চেনা মানুষটা।
ভীষণ অবাক লাগে ভাবতে, সোরওয়ার্দী উদ্যানে একুশে ফেব্রুয়ারিতে দেখা হয়েছিল এই ঘুমন্ত মানুষটার সাথে।
সেদিন কলেজ থেকে মিনুদের দলটা পথ নাটক করতে না এলে কখনই দেখা হত না তাদের।
ভর দুপুরের খাঁ খাঁ রোদ্দুরে পুরো নাটকের দলটা এসেছিল সেদিন। নাটকে এক ভাষা শহীদের ছোট বোনের ভূমিকায় অভিনয় করবে মিনু।
রেখা আপা লাল কমলা একটা শাড়ী পরিয়ে দিয়ে বিশাল একটা লাল টিপ দিয়ে দিয়েছিল তার কপালে। এত বড় টিপ যে কপালটাই অর্ধেক ঢাকা পড়ে গেছে।
বেণী করেছিল একটা। কমলা লেস দিয়ে বাঁধা। প্রথমবার নাটক করতে যাচ্ছে দেখে হাত পা জমে আসছিল ওর।
হামিদ ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র তখন, মহসীন হলে থাকে। তবে জগন্নাথেও ওর বন্ধু বান্ধব আছে, সেই সূত্রেই জগন্নাথ কলেজের পারফর্মেন্স দেখতে আসা।
চারপাশে খুব ভিড় ছিল নাটক শুরু হওয়ার আগে। একে তো কাঠ ফাটা রোদ, তার ওপর ভিড়। দম আটকে আসা অবস্থা সবার।
মিনুর মুখ শুঁকিয়ে এত টুক হয়ে গেছে তখন। টেনসন কমাতে রেখা আপা মেয়েদের গ্রুপটাকে নিয়ে আইসক্রিম খেতে এসেছিল রাস্তার এক পাশে।
হামিদ ওখানেই দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছিল। পাঁকা রোদ রাস্তার পিচ গলিয়ে দিচ্ছে।
তার মাঝেই আইসক্রিমের ভ্যানের ছাতার নিচে মাথা ঢুকিয়ে ছেলে মানুষি ভঙ্গিতে খাচ্ছিল ও।
রেখা আপাদের দলটাকে এদিকে আসতে দেখেই হামিদ আইসক্রিমটা ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে গেল অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে।
রেখা আপা কিম্বা অন্যরা হামিদকে অতটা খেয়াল না করলেও মিনু আড় চোখে তাকিয়ে দেখল —
নীল পাঞ্জাবী পরা রোগা মত ছেলেটা রাস্তায় ফেলে দেয়া আধ খাওয়া আইসক্রিমটার দিকে তৃষ্ণার্ত চোখে তাকাচ্ছে বার বার।
পিচের গরমে গলে যাচ্ছে দ্রুত আইসক্রিমটা।
রেখা আপারা যতক্ষণ দাঁড়িয়ে ওখানে আইসক্রিম খেলো, ছেলেটা চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে তার ফেলে দেয়া আইসক্রিমটার গলে যাওয়াটা দেখতে লাগল।
দৃশ্যটার মাঝে বিচিত্র একটা কষ্ট আছে।
সবাই যখন ফিরে যাচ্ছিল মিনু তখন কেন জানি খেয়ালের বসে একটা আইসক্রিম কিনে ছেলেটার পেছনে এসে দাঁরালো, “নিন। আপনারটা পড়ে গেছে না?”
অবাক হয়ে ফিরে তাকালো ছেলেটা, “আমাকে বলছেন?”
“হ্যাঁ। মেয়েদের দেখে আইসক্রিম ফেলে দেয়ার কোনো মানে আছে?” মিনু হাতের আইসক্রিমটা বাড়িয়ে দিল ছেলেটাকে।
বিব্রত মুখে দাঁড়িয়ে রইল নীল পাঞ্জাবী পরা ছেলেটা।
“কি হল? নিতে বললাম না?” অধৈর্য্য গলায় বলল মিনু।
কাঁপা হাতে আইসক্রিমটা নিল ছেলেটা। কথা খুঁজে পাচ্ছে না। আমতা আমতা করে বলল, “আপনারা নাটক করতে এসেছেন তাই না?”
কড়া রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে মিনু বিব্রত এই তরুণকে দেখে মজা পাচ্ছিল খুব। গম্ভীর মুখে মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল, “হু। আর আপনি?”
“আ-আমি মহসীন হলে থাকি। আপনাদের কলেজে আমার কয়েকজন বন্ধু আছে। ওদের সঙ্গে এসেছিলাম নাটক দেখতে। দলছুট হয়ে পড়েছি।”
“আমি নাটকে ভাষা শহীদের ছোট বোনের রোলে আছি। গেট আপটা ভাল হয়েছে না?”
ছেলেটা আইসক্রিম হাতে জড়ো সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মিনুর এ প্রশ্নে। কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না যেন।
গরমের চোটে চকোলেটের ক্রিম গলে পড়ছে ওর হাতে। খাচ্ছে না।
“কি হল? খাচ্ছে না যে?” মিনু মুখ টিপে হাসছে ছেলেটার অপ্রস্তুত ভাব দেখে।
ছেলেটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। মিনুর আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না। রোদ অনেক।
নাটকের সময় হয়ে গেছে। ছেলেটাকে ওভাবে রেখেই ঘুরে চলে আসতে লাগল।
“আপনার কপালের টিপটা খুব বেশি বড় হয়ে গেছে। মুখ দেখা যায় না। টিপের ওপরেই চোখে যাচ্ছে।”
পেছন থেকে আড়ষ্ট গলায় শোনা গেল ছেলেটার কথা।
অবাক হয়ে ফিরে তাকাল মিনু। নীল পাঞ্জাবী পরা ছেলেটা প্রচণ্ড রোদের মাঝ দিয়ে হেটে চলে যাচ্ছে।
ছোট মানুষের মত আইসক্রিম খাচ্ছে। যেন বহুদিন ধরে খায়নি কিছু।
সেদিনের নাটকে মিনু টিপ খুলে অভিনয় করেছিল। মুখ ঢেকে যাওয়া টিপ পরে লাভ কি?
হাত পাখা দিয়ে হামিদকে বাতাস করতে করতে হাত দিয়ে নাকের ঘাম মুছলো মিনু। সেদিনের পর কত ঘটনা ঘটে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হল ঘেটে অনেক কষ্টে এই ছেলেকে খুঁজে বার করতে হয়েছিল মিনুকে। তারপর অনেক কথা।
গাছের গুঁড়ির মত একটা জড় পদার্থ টাইপের মানুষকে কীভাবে যে বিয়ে করল মিনু- নিজেও জানে না।
তাদের এই বিয়ে দুই পরিবারের কেউ মেনে নিতে পারেনি। হামিদের মা কেবল মিনুর বাচ্চাটা হওয়ার সময় এখানে এসে থেকেছিলেন কিছুদিন।
এক ঘরের বাসা। স্বামী স্ত্রী আর শ্বাশুড়ি মিলে থাকা সম্ভব না। তাও থাকতে হয়েছে।
মিনুর শ্বাশুড়ি ফাহিমা পারভিন প্রায় রাতেই হামিদ ঘুমিয়ে গেলে মিনুর মাথায় হাত বুলিয়ে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতেন,
“মা’রে, বড় অভাবের সংসারে আমার ছেলেটা তোমারে আনে তুলছে। বিয়ার সময় এক আনা সোনার গহনাও দিতে পারে নাই।
আর মাই যে তোমার শ্বশুড়ের চোখ এড়াইয়া তোমারে কিছু বানায় দিমু সেই স্বামর্থ্যও আমার নাই।
আমি নিজেই গরীব ঘরের মানুষ, চালের ফুটা পাতিল দিয়া ঢাকে সংসার করছি। তোমাদের অভাবের সংসার দেখলে বুকটা পুঁড়ায় গো মা।
কিন্তু কিছু করবার না ই আমার। খালি দুয়া করতে পারি আমি।”
মিনু সেই রাত গুলোতে তার শ্বাশুড়ির হাত শক্ত করে ধরে শুয়ে থাকতো। সংসার তার পূর্বকে উত্তরের সাথে খুব নীবিড় রাত্রী কিম্বা মুহূর্ততে বেঁধে রাখে।
যেখানে কিছু সাহস, কিছু ক্ষভ আর অভাবের অতৃপ্ত ব্যাঞ্জনা প্রবাহিত হয় উত্তরের দিকে।
‘নিন্ম মধ্যবিত্ত সংসার’ ধর্মে দীক্ষিত হতে বছর বছর সময় লাগে না, চিনির বয়মের তলানী পানি ঢেলে বের করে আনার প্রথম দিনেই এই সংসারের শিক্ষা শুরু,
আর রঙ ওঠা শাড়ীর পাড় ছিঁড়ে আসা দিয়ে আট ঘাট চিনে নেয়া। তাছাড়া নারীর অভিযোজন ক্ষমতা পুরুষের চেয়ে তীব্র।
মিনু তার এক ঘরের বিচ্ছিন্ন জগতে মানিয়ে নিয়েছে বহুদিন হল। হামিদের কাছে তার কোন উচ্চাশা নেই।
এক জীবনের প্রাপ্তি আর দায়ভার বড় ভয়ংকর হিসাব। মিনু মেলানোর চেষ্টা করেনি কখনও। গত দুই ঈদে হামিদ কোন শাড়ী দিতে পারেনি মিনুকে।
তা নিয়ে মিনুর মাঝে কোনো ক্ষোভ নেই। শুধু মানুষ হওয়ার কারণে হঠাৎ হঠাৎ একটা হতাশা এসে ভর করে।
জোর করে ঠেলে সরিয়ে রাখতে পারলে ভাল হতো। তেইশ বছরের এত অল্প জীবনে সেটা ঠেলে সরাবার ক্ষমতা এখনো মিনুর জন্মেনি।
হতাশা ঠেকাতে বয়স লাগে। বয়সের দেয়াল বড় শক্ত দেয়াল।
দশটার মত বেজে গেছে। কারেন্ট আসেনি এখনো। মিনুর মেয়েটা ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে গেছে। হাত পা ওপরের দিকে তুলে পেট ফুলিয়ে ঘুমাচ্ছে।
মিনু খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো বাচ্চাটার দিকে। পেটটা বেশি ফুলে আছে মনে হচ্ছে। কৃমি হয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।
কৃমির ওষুধ খাওয়ানো উচিত নাকি হামিদকে জিজ্ঞেস করতে হবে। ফাহিমা পারভিন থাকলে তাকেই জিজ্ঞেস করা যেত।
কিন্তু ছয় সাত মাস হয়ে গেছে আসেননি তিনি। শ্বশুড় আব্বাই হয়ত আসতে দেন না। যাকে স্বীকার করা হয়নি, তাতে শেকড় বসাবার অর্থ নেই।
হামিদ নড়ে উঠল। মিনু ঘুমিয়ে এসেছিল প্রায়, হামিদ জেগে ওটায় ঘুম ঘুম ভাবটা চলে গেল।
“কয়টা বাজে মিনু?” চোখ পিটপিট করে তাকাল।
“দশটার মত।” দেয়ালে ঝোলানো চারকোনা ঘড়িটার ওপর হারিকেনের আলো পড়েছে। দশটার কাছাকাছি বাজে।
প্রতি ঘন্টায় সুন্দর মিউজিক হয় ঘড়িটায়। তারপর ঢং ঢং করে যতটা বাজে ততগুলো শব্দ। এখনো দশটার ঘন্টা বাজেনি।
“কারেন্ট আসেনি?”
“নাহ। সেই যে সন্ধ্যায় গেছে, এখনো আসার নাম নেই। ভাত দেবো?”
“উঁহু। গোসল করবো। বেণু কি ঘুমিয়ে গেছে নাকি?” উঠে বসল হামিদ। মেয়েটার ছোট ছোট হাতগুলো আলতো করে ধরে দেখছে।
সারাদিনে সময়ই পায় না মেয়েটাকে কোলে নেয়ার। ময়লা শাদা একটা হাতা কাটা গেঞ্জি আর প্যান্ট পরে আছে।
দুটোই ময়লা হয়ে গুঁটি উঠেছে। ভাল দুটো জামা কেনা দরকার বাচ্চাটার জন্য।
“ওর কৃমি হয়েছে কিনা দেখো তো? পেট এত ফোলা কেন?” মিনু ক্লান্ত গলায় বলল।
হামিদ ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে গেঞ্জিটা তুলে পেটে হাত বুলালো, “কই? ছোট মানুষ দেখে পেটটা গোল গোল লাগে। হয়নি।
তবে একবার হাসপাতালে যাওয়া দরকার তোমাদের দুজনকে নিয়েই। চেক আপ করিয়ে আনা উচিত। অনেকদিন যাই না।
গরু ছাগলের মত একটা চাকরী করি, ছুটিই থাকে না। যাবো কীভাবে। মেয়েটাকে নিয়ে যে একটু পার্ক টার্কে ঘুরতে যাবো সময় হয়ে ওঠে না।”
মেয়েটার দিকে আনমনে তাকিয়ে রইল হামিদ।
বালিশ টেনে হেলান দিল মিনু, “সুজি আর চিনি শেষ হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে ছিলে দেখে ডাক দেইনি। বেণু খায়নি এখনো।
পারলে দোকান থেকে একটু সুজি-চিনি এনে দিও। না হলে ভাত-তরকারি দিয়েই খাওয়াতে হবে আজকের রাতটা।
তোমার মেয়ে তো আবার ভাত পছন্দ করে না।”
“আগে বলতে পারো না? ঘুমিয়ে থাকলে ডাকা নিষেধ নাকি?” বিরক্ত মুখে মিনুর দিকে তাকালো হামিদ।
মেয়ে না খেয়ে ঘুমাচ্ছে শুনে রাগ লাগছে। বেণুকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে পড়ল। স্যান্ডেলে পা গলিয়ে শার্টের বোতাম লাগাতে শুরু করল।
“কোথায় যাও?” ঘুম ঘুম চোখে জিজ্ঞেস করল মিনু। এত ঘুম পাচ্ছে কেন আজ?
“সুজি আনতে।” রাগী রাগী স্বরে উত্তর দিল।
“এত রাতে মুদির দোকান খোলা পাবে?”
“তাহলে কি মেয়ে না খেয়ে ঘুমাবে?” ধমক দিয়ে উঠল হামিদ।
“আশ্চর্য! এখানে রাগার কি আছে? ওর বয়স হচ্ছে না? ভাত তরকারি খাওয়াতে হবে না নাকি?” মিনুর ঘুমটা আবার চটে গেল।
“তোমার বুঝতে হবে না। আমার মেয়ে আমি বুঝবো।
….আর স্টোভটা অযথা জ্বালিয়ে রেখেছো কেন? কেরসিন কি তোমার বাপের টাকায় আসে?”
“দেখো হামিদ, বাপ-মা তুলে কথা বলবে না। বস্তির লোকদের মত কথা তোমার কাছে আশা করি না আমি।” শীতল গলায় বলল মিনু।
কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল মিনুর দিকে হামিদ। কোনো কথা না বলে একটা খালি পাতিলে লাথি মেরে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।
মিনু হতভম্ব হয়ে বসে আছে আবছা অন্ধকারে। পাতিলটা ঠন্ ন্ ন্ আওয়াজ তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের ভেতর।
পাতিলের শব্দে বেণু জেগে উঠেছে। কান্না শুরু করেছে ধনুকের মত শরীরটা বাঁকিয়ে। মিনু শূণ্য দৃষ্টিতে মেয়ের কান্না দেখছে।
“খ”
কাছের মুদির দোকানটা বন্ধ হয়ে গেছে।। রিক্সা নিয়ে আরো আধ কিলোমিটার দূরের একটা বাজারে গিয়ে সুজি আর চিনি কিনে আনতে হল হামিদকে।
পকেটে টাকা বেশি নেই। বাকি মাস কেমন করে চলবে কে জানে। বেণুর ডানো দুধের টিন খালি হয়ে এসেছে প্রায়। আগে ত্রিশ টাকা ছিল পাউন্ড।
এখন চল্লিশ হয়ে গেছে। হাত খালি। মিনুর কাছে জমানো কিছু টাকা থাকে সব সময়। ওর কাছে হাত পাততে হবে মনে হচ্ছে।
বেণু হওয়ার আগে দু চারটা টিউশনি ছিল মিনুর। দুজনের টাকাতে চলে যেত মাস। এখন মাসের অর্ধেক যেতে না যেতেই হাতে টান পড়ে।
রিক্সায় ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা বেজে গেল। বাসায় এসে ঢোকার সময় হামিদের মনে হল গোসল খানার দিকে কেউ বমি করছে। শব্দ হচ্ছে।
টিউবওয়েল টিপছে সাথে সাথে। মেয়েরাই কেবল বমি করতে করতে টিউবওয়েল টেপে। ছেলেরা না।
কে বমি করে এত রাতে? একবার ইচ্ছে হল গিয়ে দেখে কে ওখানে। পরে আবার চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিল। কে না কে গেছে ওখানে।
ত্রিশ ফ্যামেলির ঘিঞ্জি ভাড়া বাড়ী এটা। যে কেউ যেতে পারে। কৌতুহলটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে নিজের বাসার দিকে গেল।
কিন্তু দরজাটা হাট করে খোলা। মিনুটা দরজা খোলা রেখেছে কেন? বিরক্ত হল স্ত্রীর ওপর।
কিন্তু ভেতরে ঢুকে কেবল বেণুকে বিছানায় দেখে ধাক্কার মত খেলো হামিদ।
হাতের জিনিসগুলো স্টোভের পাশে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো ধীরে ধীরে। তার মানে কি গোসল খানায় বমি করছে মিনু?
সাথে সাথে হাজারটা চিন্তা এসে ভর করলো হামিদের মাথায়। ঝট্ করে ঘুরে গোসল খানার দিকে দৌড়ে গেল।
বাহিরে মিটমিটে একটা চেরাগ জ্বালিয়ে ভেতরে ঢুকেছে মিনু। দরজা খোলা। টিউবওয়েলটা ধরে বসে আছে মুখ নিচু করে।
থেকে থেকে বমি করছে, পেটে কিছু নেই। কেবল পানি বেরুচ্ছে।
হামিদ দরজায় এসে দাঁড়ানো মাত্র ফিরে তাকাল মিনু, ঘেমে গেছে সারা মুখ। চুল ভেজা। বমি ঠেকাতে মাথায় পানি দিচ্ছিল।
হামিদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছলো, “কখন এলে?” গলা কাঁপছে মিনুর। দূর্বল হয়ে গেছে।
হামিদ এগিয়ে এসে ওর পাশে ঝুঁকে বসল, “বমি করছো কেন? শরীর খারাপ নাকি?”
“মাথা ঘোরাচ্ছে সকাল থেকে। বুঝতে পারছি না কিছু।” ক্লান্ত গলায় বলল মিনু।
হামিদ ওর দু হাত ধরে রাখল শক্ত করে। কিছু বলল না। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবতা।
“হামিদ?”
“হুঁ?”
“বেণুর কি ভাই বোন আসছে?”
“হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার তোমাকে।” শান্ত মুখে বলল হামিদ।
“আমি ঠিক আছি।” উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে পড়ে গেল মিনু।
হামিদ ধরে ফেলল ঠিক সময়ে। না হলে মাথা ফাটাতো।
“তুমি হাটতে পারবে না।” গম্ভীর কণ্ঠে বলল হামিদ।
“আমি ঠিক আছি।” আবার বলল, “একটু বসে থাকি। ঠিক হয়ে যাবো।”
হামিদ জবাব না দিয়ে মিনুকে পাঁজকালো করে তুলে নিলো। মিনু লাল হয়ে গেল সাথে সাথে।
বেণু হওয়ার আগে এ রকম হুট হাট করে যখন মাথা ঘুরে পড়ে যেত, হামিদ কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিত।
একটু আগেও পাতিলে লাথি মেরে বেরিয়ে যাওয়া মানুষটা এখন শক্ত হাতে মিনুকে বুকের সাথে ধরে রেখে ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে দেখে মিনুর চোখ ভিজে এলো।
কাঁঠাল গাছটায় এত মমতা কেন?
ফাহিমা পারভিন চিঠি পাঠিয়েছেন আজ সকালে। মিনুর আবার বাচ্চা হবে এ কথা জানিয়ে হামিদ চিঠি দিয়েছিল বাড়ীতে।
জবাব আসতে তিন দিন দেরী হয়েছে। নাতিদীর্ঘ একটা চিঠি দিয়েছেন ফাহিমা পারভিন।
“স্নেহের হামিদ ও বউমা,
তোমাদের পত্র পাইয়াছি আমি। দেশের অবস্থা ভাল না। তার উপর মিনু সন্তান সম্ভবা।
পত্রে লিখিয়াছো তার নাকি মাঝে মাঝেই বমি হয়, সাথে জ্বর।আমার বিশেষ ভাল লাগে নাই ব্যাপারটা।
তোমার আব্বার কাছে শুনিলাম পত্রিকায় লিখিয়াছে প্রতিদিন নাকি পাঁচ ছয় ঘন্টা করিয়া কারফিউ জারী হয় ঢাকা শহরে।
প্রয়োজন মত হাসপাতালে যাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় ওইখানে তোমাদের থাকা ঠিক হবে না। তোমাদের আব্বাকে আমি বুঝায়ে বলেছি।
তিনি বউমাকে নিয়া বাড়ীতে চলে আসতে বলেছেন। পত্র পাওয়া মাত্রই তোমরা বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হইবে।
ছোট বেণুকে আমার আদর ও দোয়া দিও। ভাল থাকিও এবং সাবধানে আসিবে।
তোমাদের আম্মা-
ফাহিমা পারভিন।”
চিঠিটা অফিসের ঠিকানায় এসেছে হামিদের কাছে। সকালে অফিসে গিয়েই পিয়নের কাছে পেয়েছে। রাজনৈতিক অবস্থা ভাল না।
অফিস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অনেক স্টাফই দেশের বাড়ীতে চলে গেছে। পরিস্থিতি দিন দিন ঘোলাটে হয়ে আসছে।
এরশাদ সাহেব আর বেশিদিন গদি ধরে রাখতে পারবে না। সব দলগুলো জোট হয়ে চাপ দিচ্ছে।
খুব শীঘ্রই সংসদীয় গণতন্ত্র আসতে পারে আবার দেশে। দফায় দফায় আন্দোলন কর্মসূচি চলছে। রাস্তায় আর্মি আর পুলিস নামানো হয়েছে আবার।
যেখানে যাকে পাচ্ছে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বাসা থেকে বেরুনোই বিপদ। হামিদের পকেট প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে।
বাস ভাড়া দিয়ে যে বাড়ী যাবে সে উপায়ও নেই। ঘরে অবশ্য বাড়তি রেশন কেনা ছিল। বাড়ী যদি চলেই যায় তাহলে ওগুলো নষ্ট হবে।
বেঁচে দিলে বাস ভাড়া উঠে যাওয়ার কথা। কয়দিন ধরে চাল-আটার দাম বেড়ে গেছে।
তাছাড়া তিন বছরের সংসারে মিনুকে গহনা গাটি কিছুই কিনে দিতে পারেনি হামিদ।
বহু কষ্টে অল্প কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিল অফিসের ক্যাসিয়ারের কাছে। ওভার টাইমের। সেখান থেকে দুটো সোনার বালা বানাতে দিয়েছে হামিদ।
আজকে বাসায় ফেরার পথে নিয়ে যাবে। আম্মার চিঠি পেয়ে এখন কাজের ফর্দ লম্বা হল আরো। বাসায় ফিরে গিয়ে রেশন বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে আগে।
টিকিট কিনে ফেরার পথে বালা গুলো নিয়ে আসা যাবে। অযথা অযথা পকেটে দামী জিনিস নিয়ে ঘোরার মানে হয় না।
সারাদিন হামিদের সময় কাটল ছটফট করতে করতে। বিকেল হবার আগেই ক্যাসিয়ার মতিন সাহেবের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাসায় ছুটলো।
অফিস কামাই নিয়ে ভাবনা নেই, বড় সাহেব নিজেই অফিসে আসেন না। কর্মচারী বলতে চার পাঁচজন রয়েছে কেবল। বাকিরা গায়েব। সময় হলেই উদয় হবে।
ফিরতে ফিরতে বার বার ঘড়ি দেখছে হামিদ। রেশন বেঁচে বাসের টিকেট কেটে ফেলতে হবে। রাতের বাসে উঠলে নিশ্চিন্তে বাড়ী চলে যাওয়া যাবে।
হামিদকে এত সকাল সকাল বাড়ীতে ফিরতে দেখে অবাক হল মিনু, “কি ব্যাপার? আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে?” চোখ মুখ ঢুকে গেছে মিনুর।
শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে অল্প-কদিনেই।
“আম্মা চিঠি পাঠিয়েছে। বাড়ী যেতে বলেছে তোমাকে আর বেণুকে নিয়ে। দেশের অবস্থা ভাল না। আব্বাই নাকি বলেছে।”
“সত্যি?” উজ্জ্বল মুখে তাকালো মিনু।
“হ্যাঁ। বাস ভাড়া নেই। বাড়ী যেহেতু চলেই যাবো রেশনগুলো বেঁচে দিয়ে যাই। তাহলে বাস ভাড়াটা উঠে যাবে।
তাছাড়া পড়ে থাকলে নষ্ট হবে- কবে ফিরি না ফিরি। এজন্যই আগে ভাগে এলাম। তুমি ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে ফেলো।
আমি ভ্যান নিয়ে এসেছি। চাল, আটাগুলো বেঁচে আসি।”
মিনু মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে পড়ল। বেণুকে তাড়াতাড়ি গোসল করিয়ে তৈরি করে নিতে হবে। ঘরের জিনিস পত্রও গুছিয়ে ফেলা দরকার।
এলোমেলো ফেলে রেখে যাওয়া পছন্দ না মিনুর। দূর্বল শরীর নিয়ে কাজে লেগে গেল।
হামিদ ভ্যানের ড্রাইভারকে এনে চাল আর আটার বস্তা নিয়ে চলে গেল বেচার জন্য।
মিনু বড় একটা লাল প্লাস্টিকের গামলায় বেণুকে গোসল করাতে করাতে আদর করে বলতে লাগল, “বেণু বুড়ি জানিস কোথায় যাবো আজকে?”
বেণু মাড়ি বের করে মার দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়।
“দাদু বাড়ী যাবো!” মেয়ের ফোলা ফোলা গাল গুলোতে সাবানের ফ্যানা মাখিয়ে দেয় মিনু।
— ১৯৯০ সালে হোসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের সেই সময়ের কাহিনী নিয়ে আমাদের এই গল্প।
যদিও গল্পের বাকি অংশটুকু খুব সংক্ষিপ্ত। এরশাদের ছয় ডিসেম্বর পতনের পূর্ব মুহূর্তে ঢাকা সহ দেশের নানা জায়গায় কারফিউ জারী করা হয়েছিল।
মিলিটারি ছাড়াও এখানে পুলিশদের একটা বড় ভূমিকা ছিল। ঢাকা থেকে অন্যান্য শহরের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল দীর্ঘ সময়ের জন্য।
রাজনৈতিক আলোচনা যদিও এ গল্পের মুখ্য বিষয় না, তবে গল্পের প্রেক্ষাপটে দু এক লাইন লেখা হয়েছে কেবল।
আমরা বরং আমাদের মূল কাহিনীর বাকি অংশে ফিরে যাই।
..আমাদের গল্পের নায়ক হামিদ সেদিন রেশনের চাল, আটা বিক্রি করার পর —
কাওরান বাজারের এক জুয়েলারী দোকান থেকে দুটো সোনার বালা কিনে সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরেছিল।
ততক্ষণে পুরো নগরী জুড়ে অনির্দিষ্ট কালীন কারফিউ জারী করা হয়েছে।
বাংলাদেশ টেলিভিশন সহ বেতার কেন্দ্র থেকে বার বার নিউজ বুলেটিনে এই কারফিউ জারী করার ঘোষণা শোনানো হচ্ছিল।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় হামিদ বাসের টিকেট নিয়ে যখন ফিরেছে- ঢাকা নগরী নিরেট নিস্তব্ধতায় ডুবে গেছে।
সন্ধ্যার আগেও রিক্সায় করে কারফিউ জারী করার কথা মাইকিং করা হয়েছে। হামিদ আসার সময় শুনেছে সব।
পকেটে এখন বালা দুটো ছাড়া মাত্র নব্বই টাকা আছে। আর বাসের টিকেট। টিকেটগুলো আর কাজে আসবে না এখন।
বাসই চলবে না। ফেরত দিয়ে যে টাকা তুলে আনবে সে উপায়ও নেই। সব দোকান পাট বন্ধ। ঘরে চাল আটা কিছুই নেই।
হামিদের সব কিছু কেমন যেন দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।
গেট দিয়ে ঢোকার সময় আজও বমির শব্দ শুনতে পেল হামিদ। মিনু বমি করছে।
কিন্তু এত ঘন ঘন বমি করবে কেন মেয়েটা? বেণু হওয়ার সময় তো এত করেনি। ঘরের দিকে না গিয়ে গোসল খানার দিকে এলো হামিদ।
আজ কারেন্ট আছে। বাথরুমের দরজার সামান্য ওপরে চল্লিশ ওয়াটের বাল্ভ জ্বলছে।
দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই হাত পা জমে গেল হামিদের। টিউবওয়েলটা ধরে আজও বসে আছে মিনু।
কিন্তু সামনের পুরো ফ্লোর জুড়ে রক্ত! মুখেও লেগে আছে। থেকে থেকে বমি করছে মেয়েটা, দলা দলা রক্ত বেরিয়ে আসছে…..
হামিদ ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল, “মিনু! কি হয়েছে তোমার? ব্লিডিং হচ্ছে কেন!” ছুটে গিয়ে মিনুকে জড়িয়ে ধরল।
থর থর করে কাঁপছে পালকের মত হালকা মেয়েটা। হামিদের হাতেও রক্ত লেগে যাচ্ছে ওর মুখ থেকে গড়িয়ে।
“জানি না। বিকেলে তুমি যাওয়ার পর থেকেই হঠাৎ বমি শুরু হয়েছে। গায়ে জ্বর ছিল আগে থেকেই।
কিন্তু বমি যে কেন শুরু হল……” নিস্তেজ হয়ে এসেছে গলাটা মিনুর।
হামিদ কোনো কথা না বলে মিনুকে কোলে তুলে নিলো।
“কোথায় নেবে? ঘরে?”
“হাসপাতালে।” গলার স্বর শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে হামিদ। কিন্তু উদ্বেগটা ঢাকতে পারছে না।
“বাহিরে তো রিক্সাও নেই মনে হয়।” একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল মিনু।
“লাগবে না।” হঠাৎ অদ্ভুত দৃঢ় গলায় বলে উঠল হামিদ।
মিনুকে নিয়ে বেরিয়ে এলো তারা জ্বলা আকাশের নিচে। চাঁদ নেই, মিট মিট করে অসংখ্য তারা জ্বলছে।
“বেণু তো একা থাকবে!” মিনু প্রায় কান্না আটকে বলল কথাটা।
থমকে গেল হামিদ, “ওকে বেল্ট দিয়ে বেঁধে রেখে এসেছো না?” ঘরের দরজার দিকে তাকালো একবার হামিদ। অনিশ্চিত একটা দৃষ্টি।
“না। পাশের বাসার সুফিয়া ভাবীর কাছে রেখে এসেছি। সন্ধ্যা থেকেই তো এখানে আছি।” ক্লান্ত, অবসন্ন গলায় বলল মিনু।
“তাহলে ভাবতে হবে না। তাড়াতাড়িই ফিরবো।” মিনুকে কোলে নিয়ে হাটতে লাগল হামিদ।
নিস্তব্ধ নগরীর রাস্তায় লাইট পোস্টের আলোয় দু একটা ছন্ন ছাড়া কুকুরের পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে হামিদ। মিনু এখনো বমি করছে।
আশে পাশে কোথাও কোনো রিক্সা কিম্বা বেবি টেক্সি নেই। হামিদের হাত ব্যথা করছে খুব।
কাছা কাছি হাসপাতালটা পাঁচ মাইলের মত দূরে। যেতে পারবে তো?
পকেটের বালা দুটোর কথা মনে আসছে না হামিদের।
তার মনে পড়ছে কপালে সূর্যের মত বিশাল একটা লাল টিপ দেয়া ছিপছিপে এক তরুণী আইসক্রিম হাতে ভর দুপুরে রোদের মাঝে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
দুই চোখে তীব্র মমতা তার জন্য।
মিনু শক্ত করে হামিদের বুকের কাছটায় শার্ট খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে আছে। টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে চোখ থেকে।
সে জানে এই মানুষটা তাকে কিছুতেই মরতে দেবে না।
পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ থাকে যাদের ছোঁয়া মাত্র মনে হয় এরা বাঁচিয়ে রাখার অলৌকিক শক্তি নিয়ে জন্মেছে। হামিদ তাদেরই একজন।
নিঃশব্দের কোলাহলে ছাওয়া শহরটার রাস্তায় কালো তারা জ্বলা আকাশটা কাঁচের আয়নার মত ফুটে রয়েছে।
তারা গুলোতে পা রেখে ছুটে চলেছে হামিদ মিনুকে নিয়ে। পকেটের বালা দুটো মৃদু স্বরে কথা বলছে। হামিদ কিম্বা মিনু কেউ শুনতে পাচ্ছে না সেটা।
হামিদের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানির ফোঁটা মিনুর কপালে পড়তেই মিনু চোখ মেলে তাকালো।
অবাক হয়ে দেখলো তাকে নিয়ে ছুটতে থাকা মানুষটা কাঁদছে ছোট একটা বাচ্চার মত। শত চেষ্টা করেও মুখ শক্ত করে রাখতে পারছে না।
মিনুর কপালে সূর্যের মত বড় টিপ চক চক করছে হামিদের চোখের পানিতে। মিনু আরো শক্ত করে হামিদের শার্ট খামচে ধরল।
এত মমতা একটা মানুষ বুকে ধরে কেমন করে?