ভালোবাসি তোমাকে

ভালোবাসি তোমাকে

আমি রানা,
আজ আট মাস এগারো দিন পর খোলা আকাশ দেখছি, কিছু দিন আগেও ভেবেছিলাম আমি হয়তো আর কোনো দিন খোলা আকাশ দেখতে পারবো না। ভাবতাম আমার হয়তো সারাটা জীবন চার দেয়ালের মধ্যেই কেটে যাবে। বন্দি জীবন থেকে তো মুক্তি পেয়েছি কিন্তু এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারিনি। হুহিল চেয়ার টাই এখন আমার নিত্য সঙ্গী। কে জানে হয়তো বাকিটা জীবন আমাকে এভাবেই কাটিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আমি তো এমন ছিলাম না, আর কখনো এমন তা হতেও চাইনি।

এইতো তিন বছর আগের কথা, কত আনন্দ ছিল আমার জীবনে। পড়াশোনা, নাচ, গান, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, অনেক ভালো ভাবেই কাটছিলো আমার দিন গুলো। আমি হলাম আমার আব্বা আম্মার এক মাত্র সন্তান। আব্বার ছোট খাটো একটা ব্যবসা আছে তাই ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব একটা ভাবতে হয়নি আমাকে। সময় গুলো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েই কাটিয়ে দিতাম। আমার জীবনের বলার মতো গল্পটা শুরু হয় সেদিন থেকে যেদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটা মেয়ে কে দেখে আমার চোখ আটকে যায়। ক্যাম্পাসে এত সুন্দরীদের ভিড়ে সে হয়তো কিছুইনা, কিন্তু তার চোখে মুখে যে মায়া তা আমাকে চোখ ফেরাতে দিচ্ছেনা। মিষ্টি একটা হাসি তার চোখে মুখে লেগেই আছে, চোখের ভাষা একদম স্পষ্ট, মনে হচ্ছে আমি পড়তে পারছি। হাসলে গালে টোল পড়ছে, বাতাসে খোলা চুল ভাসছে। সব মিলিয়ে তার রূপের ঝলক আমাকে অন্ধ করে দিচ্ছে! আমার মনে তার একটা স্পষ্ট ছবি আঁকা হয়ে গেছে।

মেয়েটাকে দেখতে দেখতে কখন যে দাঁড়িয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি, আমার হাতে একটা হেচ্কা টান অনুভব করতেই আঁতকে উঠলাম, মনে হচ্ছিলো এতোখ স্বপ্ন দেখছিলাম, এখনই ভাঙ্গলো। বুঝলাম এটা মুহিদের কাজ ছিল, ভীষণ রাগ হলো ওর ওপর, কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না। ওরা আমাকে এতক্ষন কিযেন বলছিলো যার কিচি আমি শুনিনি। তাই এসব নাভাবে মেয়েটাকে দেখার জন্য আবারো ফিরে তাকালাম কিন্তু সেখানে আর কাউকেই দেখতে পেলাম না। আসেপাসেও মেয়েটার চিহ্ন মাত্র নেই, একটু অবাক হলাম এতো তাড়াতাড়ি কোথায় চলে গেলো মেয়েটা? তখন সত্যি সত্যি রাগ হচ্ছিলো মুহিদের ওপর, ও আমার মনোযোগ নাভাঙ্গলে তো আর কিছুক্ষন মেয়েটাকে দেখতে পেতাম!

সেদিন সারাক্ষন শুধু ওই মেয়েটার মুখটাই আমার চোখের সামনে ভেসে ছিল, যেদিকে তাকাই শুধু তাকেই দেখতে পাচ্ছিলাম। কোনো কিছু তেই মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। সারা ক্যাম্পাস মেয়েটাকে অনেক খোজাখোজি করলাম কিন্তু কোথাও পেলাম না। বিষয় তা মুহিদ আর রিতু বুঝতে পেরে জিজ্ঞাস করলো “কি হয়েছে রে তোর? এত কি এত খোজাখোজি করছিস এদিক ওদিক?” আমি এড়িয়ে গেলাম, কিন্তু বেশিক্ষন থাকতে পারলামনা, ওরা জোর করতে সবটা বলে দিলাম। সবটা শোনা পর রিতু হা হা করে হাসতে লাগলো, আমার অনেক রাগ হলো, মুহিদ হাত দিয়ে ইশারা করে থামতে বললো, আমি ওখান থেকে চলে আসলাম।

ছয় দিন পর দ্বিতীয় বার মেয়েটার দেখা পেলাম। আমার চোখ আনন্দে নাচতে লাগলো। এইবার আর সময় নষ্ট করলাম না, মেয়েটা গভীর মনোযোগ দিয়ে কি একটা বই পড়ছিলো, আমি যে তার পাশে আসে বসেছি সেদিকে তার কোনো খেয়ালি নেই! মনোযোগ ভাঙ্গতেই তার চোখে মৃদু ভয় আর ঠোঁট নড়ছিলো সে আমাকে কিছু একটা বলছিলো কিন্তু আমার কানে কেন শব্দই আসছিলো না। আমার ওপর বিরক্ত হয়ে সে উঠে দাঁড়ালো তখন আমি হঠাৎ করেই তার হাতটা ধোরে ফেলি। মেয়েটা হাত ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করেও পারলোনা। আমি তার নাম জিজ্ঞাস করলাম কিন্তু ততো ক্ষনে ভয়ে তার চোখে পানি চলে আসছে, মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আমি সরি বলে হাতটা ছেড়ে দিলাম। পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলাম তখন মেয়েটা ঘার নেড়ে বাধা বাধা গোলায় বললো ঠিকআছে কি জানতে চান এখন বলুন? আমি বললাম না কিছু না। আমার নাম নেহা বলেই মেয়েটা চলে গেলো। সেদিন সারা রাত ভাবা পর বুঝতে পারলাম আমি খুব ভালোভাবেই নেহা নামের ওই মেয়েটার প্রেমে পড়েগেছি।

পরের দিন মুহিদ আর রিতুকে সব টা খুলে বললাম তখন ওরা বেপারটা সিরিয়াসলি নিলো। আর কোনো কিছু নাভাবে সরাসরি ভালোবাসি বলে দেয়ার জন্য পরামর্শ দিলো রিতু। আমারো তাই মনে হয়, ঠিক করলাম সময় নষ্ট নাকরে এইবার দেখাহলে ভালোবাসি টা বলেই দিবো। কিন্তু কিছুতেই তার দেখা পাচ্ছিলাম না, এভাবেই আরো দুদিন কেটে গেলো। আমার অস্থিরতা বেড়েই চলেছে, জানিনা কেনো এই মেয়েটার জন্য আমি এতো পাগল হোচ্ছি? আমি যেনো একটা ঘোরের মধ্যে আছি, নেহা ছাড়া যেন আমার পৃথিবী অন্ধকার! কেনো আমাকে এতো পাগলামিতে পেয়েছে? আর কেনোইবা নেহাকে আমি এতো ভালোবাসি?

এইসব নিয়েই বসে বসে ভাবছিলাম, হঠাৎ আমার সামনে নেহাকে আবিষ্কার করলাম, দেখে মনে হচ্ছে নেহাও আমাকে কিছু বলতেই এসেছে। তবে আজ কিন্তু ওকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে! আমি দাঁড়িয়ে গেলাম আর অনেকটা সহজ ভাবেই তার সাথে কথা বলতে থাকলাম। আমাদের অনেক কথাই হলো, নেহার সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনে গেলাম। নেহা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন, শুধু মাত্র পড়াশোনা করার জন্য ঢাকায় এসেছে, পরিবারের সবাই গ্রামের বাড়িতেই থাকে, এখানে নেহা তার ফুফুর বাসায় থাকে। আরো অনেক কথাই হলো কিন্তু ভালোবাসিটাই বলা হলোনা। নেহার ফোন নাম্বারটা চেওয় পাইনি তাই আমার নাম্বারটাই দিলাম। বুঝতে পারলাম নেহার আমার প্রতি ভালো লাগা নাথাকলেও কোনো বিরক্তি নেই!

যতই সময় যাচ্ছিলো ততোই নেহার জন্য আমার মনের জায়গাটা আরো বড়ো হচ্ছিলো! নেহাকে নিয়ে ভাবতে আমার ভালো লাগে, একবার ভাবতে শুরু করলে সময় গুলো যে কখন চলে যায় কিছুই বুঝতে পারিনা। ভেবেছিলাম নেহা আমাকে কল দিবে কিন্তু কোনো কল আসলোনা। পরের দিন সারা ক্যাম্পাস খুঁজেও নেহার দেখা পেলাম না। ততো দিনে আমি নেহাকে ভীষণ ভাবে মিস করা শুরু করলাম! তাকে একদিন নাদেখা টা আমার জন্য অনেক বড়ো কষ্টের কারণ হয়ে গেলো! আমার কিছুতেই মনোযোগ আসছিলোনা, পড়াশোনা খাওয়া, ঘুম, কিছুই ভালো লাগছেনা শুধু নেহাকে একটু দেখতে ইচ্ছা করছে। দুই দিন পর নেহার ফোন আসলো, ওর কন্ঠে হ্যালো শুনেই সস্থির নিঃস্বাস ফেল্লাম! মনটা শান্ত হয়ে গেলো, এতোটাই ভালো লাগছিলো যে নেহার বাকি কথা গুলো ভালো শুনতেই পেলামনা। তবে এতোটুকো বুঝতে পারলাম যে ওর কোনো একটা প্রব্লেম হয়েছিল যার কারণে সে এই দুই দিন কল দিতে পারেনি। কি প্রব্লেম হচ্ছিলো তা আর জানতে চাইলাম না, আমার জন্য খুশির খবর এটাই যে আমাদের কাল আবার দেখা হোচ্ছে।

নেহাকে আজ একটু চিন্তিত মনে হলো, তবে আগের মতোই বেশ সুন্দর লাগছিলো! জিজ্ঞাস করায় বললো তেমন কিছুই হয়নি, সামনের সপ্তাহে কিছু দিনের জন্য গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। তবে বেপারটা যে এর থেকেও জটিল কিছু তা আমি ঠিকই বুঝতে পারলাম, কিন্তু সেদিকে পাত্তা নাদিয়ে বললাম যে কয়দিন আছো প্রতিদিন আমার সাথে দেখা করতে হবে? অবাক হলাম! নেহাও তাই চায়। এই সাত দিনে আমি নেহার অনেক কাছের মানুষ হয়ে গেলাম, আমাদের ভালোলাগা মন্দলাগা নিয়ে অনেক কথার আদান প্রদান করলাম। বুঝতে পারলাম নেহার মনে আমাকে নিয়ে কিছু একটা চলছে কিন্তু বলতে পারছে না। কাল নেহা গ্রামের বাড়ি চলে যাবে, বাসে ওঠার আগে আমার সাথে দেখা করতে চাইলো, আমি নাকরিনি।

মনে মনে ঠিক করলাম কাল ভালোবাসিটা বলেই দেবো। আমার হাতে লাল গোলাপ দেখে নেহা জিজ্ঞাস করলো এটা কেনো? আমি গোলাপ টা নেহার হাতে দিয়ে বললাম তোমার জন্য! আমাকে চুপ থাকতে দেখে বললো আর কিছু বলবেনা? আমি তো চলে যাচ্ছি, তুমি অনেক ভালো থেকো, নিজের যত্ন নিয়ো, আমি নেহাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম “ভালোবাসি তোমাকে” নেহা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিছু বলতে পারছে না শুধু ওর চোখের কোন দুফোটা পানি দেখতে পেলাম। আমি কোনো উত্তর চাইনি, শুধু বললাম সাবধানে যেয়ো আর খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।

আজ এগারো দিন হলো নেহার সাথে কোনো যোগাযোগ হয়না, ওর ফোন বন্ধ! নানান দুশ্চিন্তায় আমি রীতিমতো মানুষিক রোগী হয়ে গেছি। বারো দিন পর নেহার ফোন পেয়ে বুঝতে পারলাম সেদিন ওর চোখে পানি কেনো এসেছিলো, নেহার বাবা নেহার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে, আর সেই কারণেই নেহাকে গ্রামের বাড়ি ডেকেছিলো, কিন্তু ততো দিনে নেহা আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে! নেহা আমাকে ভালোবাসে এটা শুনে যতটা নাহ ভালো লাগছে তার থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছে! কারণ কয়েক দিনের মধ্যেই নেহার বিয়ে! আমি নেহাকে আর কোনো দিনও আপন করে পাবনা এটা ভাবতেই চোখে পানি চলে আসছে! কি করবো কিছুই বুঝতে পারলাম না। দুদিন পর আবার নেহার কল আসলো, নেহা আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না, সেও অনেক কষ্ট পাচ্ছিলো! আমি নেহাকে পালিয়ে আস্তে বললাম কি তা সম্ভবনা জানালো।

আমি নেহাকে পাওয়ার একটা শেষ চেষ্টা করবো এই ভেবে বেগ গুছিয়ে রওনা হলাম নেহার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে। ভালো লাগছিলো এইভাবে যে অনেক দিন পর আমি আবার নেহার দেখা পাবো! মনে মনে অনেক পরিকল্পনা সাজাচ্ছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারিনি আর একটু পরেই আমার জীবনের সব রং মুছেযেতে চলেছে! কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামনে থেকে আসা একটা ট্রাক আমাদের বাস কে ধাক্কা দেয়। আমার মাথায় আর পায়ে অনেক জোর আঘাত অনুভব করি তারপর আর কিছু মনে নেই! যখন জ্ঞান ফিরলো জানতে পারলাম আমার পা দুইটা ভীষণ বাজে ভাবে ভেঙ্গে গেছে, আমি হয়তো আর কোনো দিন উঠে দাঁড়াতে পারবোনা। মাথার আঘাত টাও জটিল ছিল। নেহার কথা মনে পড়তেই চোখে পানি চলে আসলো! এই অবস্থায় তার সামনে যাওয়ার কথা ভাবতেও সাহস হলোনা! আমি তার সুন্দর জীবন নষ্ট করতে চাইনা, তাই ফোন বন্ধ করে কষ্ট গুলো নিজের মধ্যে চাপা দিয়ে এই চার দেয়ালের মধ্যেই দিন কাটাতে থাকলাম!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত