আজ আমার পঁচিশতম জন্মদিন আর সৌরভের চতুর্থতম মৃত্যুদিন। পঁচিশটি সাদা গোলাপ ও চারটি লাল গোলাপ নিয়ে দাড়িয়ে আছি সৌরভের কবরের পাশে। মনে করছি সেই ফেলে আসা দিনগুলো কথা।
কলেজের প্রথমদিন গেটে ঢুকতেই চোখ পরেছিল সৌরভের ওপর। যেমন সুন্দর দেখতে, তেমন স্মার্ট, সুন্দর দুইটি চোখ, আর সব থেকে ওর চুলের স্টাইল, সব মিলিয়ে ভালোই লেগেছিল ছেলেটিকে। ক্লাস করার সময় জানতে পারলাম সৌরভ আমাদের ডিপার্টমেন্টেই পড়ে। সৌরভের প্রতি আমার আগ্রহটা যেন আরো একটু বেরে গেল। কলেজের প্রায় সবার সাথেই আমার একটা ভালো বন্ধুত্বপুর্ন সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে শুধু তার সাথেই এখনো কোনো কথা হয়নি। একদিন আমার সব থেকে কাছের বান্ধবী রশ্মির সাথে গেলাম ছেলেটির সাথে পরিচিত হতে। ওহ, আমিতো বলতেই ভুলে গেছি, আমি নীরা আর রশ্মি আমার চাচাতো বোন আবার সব থেকে কাছের বান্ধবীও আমরা একসাথেই পড়াশোনা করি।
নীরা: কেমন আছেন?
সৌরভ : এইতো ভালোই আছি। আপনি কেমন আছেন?
নীরা: আমিও ভালো। তা লেখা পড়া কেমন চলছে? আপনি তো আমাদের ডিপার্টমেন্টেই পড়েন তাই ভাবলাম একটু পরিচিত হওয়া যাক।
সৌরভ : হুম আমিও তাই ভাবছিলাম কলেজের সবার সাথেই কমবেশি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে শুধু আপনার সাথেই কথা হয়নাই।
রশ্মি : আর আমি! আমার সাথে বুঝি খুব কথা বলেছেন। [রশ্মির এমন কথা শুনে তিনজনি হেসে উঠি।]
নীরা: আচ্ছা আজ তাহলে আসি। ভালো থাকবেন।
সৌরভ: ok bye
কিরে নীরা তুই কি সৌরভকে প্রথম দেখেই প্রেমে পরে গেলি নাকি? আমায় যে কথা বলার সুযোগি দিলিনা সব নিজেই বললি। রশ্মির কথা শুনে কেন যানি অবাক হলাম না। মনে হলো সত্যি হয়তো আমি প্রেমেই পরেছি। ছেলেটিকে দুর থেকে যতেটা ভালো লেগেছিল কাছে থেকে হাজার গুন ভালো লেগেছে। ওর কথা বলা, ওর চাহনি, হাসি সবকিছু যেন আমার মন ছুয়ে গেছে যাকে বলে love at fast side. এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিন আমি কলেজে গিয়ে সৌরভকে দেখতাম, ওর আশেপাশে থাকার চেষ্টা করতাম, ওর সাথে কথা বলার জন্য সুযোগ খুজতাম, প্রায় সময়টা ওকে নিয়ে ভাবতাম। হঠাৎ একদিন ক্লাস শেষে রশ্মি বলল, নীরা তোকে একটা কথা কিছুদিন ধরেই বলবো বলবো ভাবছি কিন্তু বলা হচ্ছেনা।
আচ্ছা সত্যি করে বলতো তুই কি সৌরভ কে পছন্দ করিস? তুই কি ওকে ভালোবাসিস? আমি শুধু ছোট্ট করে হুম বলে রশ্মিকে ফেলেই চলে এসেছিলাম। ব্যস এতেই যে কাজ হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি। পরের দিন আমার ২১ তম জন্মদিন। রাত তখন ঠিক ১২ টা, হঠাৎ করেই ফোনের ম্যাসেজ রিংটোন বেজে উঠতেই দেখলাম একটা অচেনা নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে। Happy Birthday my sweet heart. কাল কলেজের ক্লাস রুম এ দেখা হবে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। আজগুবি এমন ম্যাসেজ দেখে চমকে গেলাম। কে হঠাৎ এমন ম্যাসেজ করতে পারে? ভাবলাম একবার কল করে দেখি আবার ভাবলাম এতো রাতে কল করাটা বোধহয় ঠিক হবেনা তাই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়েছি বুঝতেই পারিনি। সকালে ঘুম ভাঙ্গল রশ্মির ডাকে।
রশ্মি : happy birthday nira…
আমি: হুম।(ঘুম জরানো কন্ঠে)
রশ্মি : কিরে ওঠ কতো বেলা হয়েছে কলেজ যাবিনা?
হঠাৎ করেই মাথায় এলো কাল রাতের ম্যাসেজটা। তারাহুরো করে উঠে ফ্রেস হয়ে কোনোমতে খাবারটা শেষ করে ছুটলাম কলেজের দিকে। যেতে যেতে রশ্মিকে কাল রাতের ঘটনা সব খুলে বললাম। রশ্মি হ্যা না কিছুই বললনা শুধু বলল চল দেখি কে? অবশেষে পৌছালাম কলেজে ছুটে গেলাম ক্লাস রুমের দিকে সাথে রশ্মিও ছিল। কিরে রশ্মি আজ কি কলেজ ছুটি নাকি কাউকেই তো দেখছিনা আর রুমটাও এতো অন্ধকার দেখে তো মনে হচ্ছে কেউ আমাদের সাথে মজা করেছে। চল এখানে থেকে কাজ নেই, তাই আমি আর রশ্মি যেই রুম থেকে বের হবো ঠিক সেই সময় রুমের সব আলো জলে উঠে আমি তো চমকে যাই! পেছনে তাকিয়ে দেখি একটা ছেলে তার এক হাতে ২১ টি সাদা গোলাপ ও একটি লাল গোলাপ আর অন্য হাতে একটা কার্ড তার মুখ বরাবর তাই প্রথমে মুখটি দেখতে পাইনি। কার্ডটাতে অনেক বড় বড় করে লেখা happy birthday my sweet heart. ঠিক কাল রাতের ম্যাসেজটির মতো। তাই আর বুঝতে বাকি রইলোনা এই তবে সেই। বুকের ভেতরটা কেমন যানি তোলপার হতে শুরু করেছে। অবশেষে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কে আপনি? এইসব কেনো করছেন? অধির আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছি ছেলেটির দিকে।
ধিরে ধিরে ছেলেটি তার মুখের সামনে থেকে কার্ডটি সরাতেই আমি যেন আকাশ থেকে পরলাম! একি! এতো সৌরভ! যাকে নিয়ে আমি আমির স্বপ্ন দিয়ে সাজিয়েছি। প্রতিনিয়তো যাকে আমি চেয়ে এসেছি। যাকে ঘিরেই আমার নিশ্চুপ ভালোবাসা গড়ে উঠেছে। সে কিনা আমার জন্মদিনে আমায় এতোবড় একটা উপহার দিলো। কিন্তু সে জানলো কি করে? মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে রশ্মির দিকে তাকাতেই দেখি রশ্মি মিটমিট করে হাসছে। আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা যে এসব রশ্মিরি কাজ। সেদিন যখন আমি রশ্মিকে ফেলে চলে গিয়েছিলাম রশ্মি তখন আমার উত্তরটা নিয়ে সৌরভের কাছে যায়, তাকে আমার সম্পর্কে সবটা খুলে বলে। আর তাকে বুঝায় আমি তাকে কতোটা ভালোবাসি। সৌরভও সবটা বুঝতে পারে আর বলে সেও নাকি আমায় পছন্দ করে কিন্তু কখনো বলতে পারেনি।
রশ্মি তাকে জানায় পরশু আমার জন্মদিন আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে তারা এমন একটা প্ল্যান করে। সবটা যখন যানতে পারলাম আমি রশ্মিকে জরিয়ে ধরে কান্না করে দেই। আজ তুই আমার জীবনের সবথেকে বড় উপহারটা আমায় দিয়েছিস রশ্মি। আমি কোনোদিন তোর এই উপহারের কথা ভুলবোনা। আচ্ছা তোকে ভুলতে হবেনা এবার ছাড় আমায়। সৌরভ তোকে কিছু বলতে চায় সেইটাতো শোন। আমি রশ্মিকে ছেড়ে সোজা দাড়িয়ে আছি হঠাৎ দেখি সৌরভ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমার সামনে এসে হাটু গেড়ে বসে ২১ টি সাদা গোলাপ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল Happy Birthday Nira. তোমার ২১তম জন্মদিন এই সাদা গোলাপের মতো পবিত্র হোক। আর অবশিষ্ট একটি লাল গোলাপ দিয়ে সে আমায় প্রপোজ করে। I Love You nira. তুমি কি আমার চলার সাথী হবে? থাকবে চিরটা কাল আমার সাথে? আমি কোন কিছু না ভেবেই হ্যা বলে দেই।
রশ্মি: তাহলে তো হয়েই গেল সব, আমার কাজ শেষ আমি এখন আসি।
কেন যানি রশ্মিকে আটকাতে গিয়েও আটকাতে পারিনি মনে হচ্ছিলো যেন আজকের দিনটা শুধু আমার আর সৌরভের।
ভালোবাসার মানুষটিকে এতোটা কাছ থেকে পাব তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। সৌরভ আমার হাতটি ধরে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল নীরা আজ থেকে আমাদের নতুন চলার পথ শুরু। চলোনা আজকের দিনটি আমরা নিজেদের মতো করে উপভোগ করি। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম সৌরভের কথাগুলা। ওর কনো আবদারেই বাধা দিতে পারিনি। কলেজ থেকে বের হয়ে দুজন একটা রিক্সা নেই আর তাতে আমি আর সৌরভ পাশাপাশি বসে আমি সৌরভের কাধে মাথা রেখেছি আর সৌরভ আমার হাতটি শক্ত করে ধরে বলল আজ আমি তোমায় আমার শহর ঘুরাবো যার প্রতিটা স্পর্শে রয়েছো তুমি। আমি শুধু চুপচাপ তার কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই কথা থেকে যেন একটা গাড়ি এসে ধাক্কা দেয় আমাদের রিক্সাকে। ছুটে যায় আমার হাত সৌরভের হাত থেকে। ছিটকে পরি দুজন দুদিক। আমি মাথায় আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারাই। তার পর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা অবস্থায় পাই। চেয়ে দেখি পাশে বাবা মা রশ্মি সবাই আছে, কিন্তু সৌরভ সে কোথায়? আমি ব্যকুল হয়ে রশ্মিকে জিজ্ঞেস করি সৌরভের কথা।
রশ্মি কোন কথা না বলে অঝরে কান্না করে যাচ্ছে। আমার ভিতরটাও কেমন যানি ভাঙ্গচুর হয়ে আসছে মনে হচ্ছে কেউ একজন মনের মাঝে বার বার সজোরে আঘাত করছে। আমি কোনো কিছু না ভেবেই হাসপাতালের বেড থেকে নেমে দৌরে সৌরভের কাছে যেতে চাই কিন্তু ততোক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। মিশে গেছে আমার ভালোবাসা মাটির সাথে। মুছে গেছে পৃথিবী থেকে আমার ভালোবাসার স্মৃতি। এখন আমি একা। পার করে এসেছি জীবনের ফেলে আসা ৪ টি বছর তোমাকে ছাড়াই। এসব ভাবতে ভাবতে ভিতরটা কেমন যানি ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে। আস্থির হয়ে আসছে বুকের মাঝে। হঠাৎ অনুভব করলাম কারো হাতের স্পর্শ। ফিরে এলাম ৪ বছর আগের সেই অন্ধকার দিনগুলো থেকে। তাকিয়ে দেখি রশ্মি। নীরা! আর কতক্ষণ থাকবি এখানে? যাবিনা? সন্ধে যে নেমে এলো…….