ফিরে আসা

ফিরে আসা

হয়তো সে আজও আমার পথ চেয়ে বসে আছে। কিন্তু আমি এতে কি করবো? এতে তো আমার কোনও দোষ ছিল না! সব দোষটা তোমার। তুমিই যদি তোমার মাথার দিব্যি না দিয়ে আমায় আজ এখানে পাঠাতে তাহলে তো দুজনকে এতটা কষ্ট পেতে হতো না!

সেই পাঁচ বছর আগে তুমি বিদায় জানিয়ে পাঠিয়ে দিলে আমায় একলা এ জগতে। এই বিদেশের মাটিতে আমি তোমায় ছাড়া বড়োই একলা হয়েছে পড়েছিলাম। খুব কষ্ট হতো! তুমি চেয়েছিলে বিজ্ঞানী রূপে আমি প্রতিষ্ঠিত হই, অনেক শিরোপা লাভ করি। তোমার এই ইচ্ছাগুলোর দাম দিতে তোমায় ছেড়ে পাঁচটা বছর একা-একা কাটিয়ে দিলাম। পরিবার, আত্মীয়স্বজন আর তুমি; হ্যাঁ, তোমায় ছাড়া বড়ো একা লাগতো। তুমি এতটাই পর করে দিয়েছিলে আমায়। যখন ফোন করতাম ফোন ধরতে কিন্তু আমার গলার স্বর শুনেই কেটে দিতে। আমি কি এই কয় বছরে এতটাই খারাপ হয়েছে গেছি? আজ পাঁচটা বছরের কষ্টের পর শুধু তোমার জন্য আজ আমি প্রতিষ্ঠিত। বিদেশের মাটিতে অনেক শিরোপা লাভ করেছি। আজ পাঁচটা বছর পর আমি ফিরে আসছি। তুমি চিনতে পারবে তো? আমার পথ চেয়ে বসে থাকবে তো আজও! তোমাকে টেলিগ্রামে জানিয়েছি আমার ফিরে আসার কথাটি, তুমি তা পেয়েছ? জানতো আমি আজ ফিরছি, তোমার স্বপ্ন গুলো পূরণ করে।

প্রিয়া তোমার মনে আছে ওই স্মৃতি গুলো! সেই পাঁচ বছর আগে তোমার গানের সুর আজও আমার কানে বাজে! তুমিও নিশ্চয়ই খুব বড়ো কিছু করেছো সংগীতে। হয়তো তুমিও আজ সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পী। এখন হাওড়া-শিয়ালদা গামী ট্রেনে বসেছি। আর কয়েক ঘণ্টায় পৌঁছে যাবো তোমার কাছে। পৌঁছেই তোমাকে খুব বকাবকি করবো। এই পাঁচ বছরে একটি বারও কথা বলোনি। তোমার গলার স্বর টুকুও শুনিনি। প্রথম এক বছরে ফোনটা তবু ধরতে কিন্তু তার পর থেকে আজ অবধি তোমায় ফোন করলেই সুইচ অফ। জানিনা কি এমন হয়েছে। রোজ রাতে তোমার স্মৃতি গুলো ভেবে আমার দুঃখ টাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। আজ কতদিন পর তোমার ওই স্নিগ্ধ হাসিটা দেখতে পাবো। আজও কি তুমি আগের মতো আছো, না কি তোমার মধ্য বদল এসেছে? যতই পরিবর্তন আসুক আমি জানি আমার প্রিয়া আমায় ঠিক চিনতে পারবে। তাইতো আজ আমি এতটা খুশি, যেই খুশিটা গত পাঁচ বছরে পাইনি। মনে-মনে অভিমানও আছে খুব। ভাবছি তোমার উপর রাগ দেখাবো, কিন্তু তোমার দুটি চোখের দিকে তাকালেই আমার সব রাগ যে গলে জল হয়ে যায়।

বিশাল একটা হুইসল দিয়ে ট্রেনটা স্টেশনে এসে থামল। আমি জিনিস পত্তর গুছিয়ে নিয়ে ট্রেন থেকে নামলাম। আমার দুই বন্ধু রমেন আর সৌরভ এসেছিলো। ওদের প্রথমে খেয়াল করিনি, সানগ্লাসটা খুলতেই দেখি “সৌগত”-আমার নাম ধরে ডাকছে, তারপর তাঁদের দিকে এগিয়ে গেলাম। “কেমন আছিস, বিদেশে গিয়ে তো ভুলেই গেছিস”

“আরে না না তোদের ভুলতে গেলে অতীত ভুলতে হয়, আর সেটা তো পারবো না! তোদের ভুলিনি, বল কেমন আছিস তোরা? আর ‘প্রিয়া’, ও কেমন আছে? ভালো আছে তো?” ওরা কথাটা এড়িয়ে গেল।

“এতদিন পর বাড়ি ফিরছিস, বাড়ি চল তাড়াতাড়ি; কাকিমা অপেক্ষা করছে। বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিবি চল, অনেক ধকল হয়েছে আসতে।”

“না আমি প্রিয়াদের বাড়ি যাবো। আগে ওর সাথে দেখা করবো।”

রমেন বলল, “প্রিয়া এতে খুশি হবে তো? আরও বকাবকি করবে তোকে। আগে তুই বাড়ি চল, অনেক সময় পাবি দেখা করার।”

আমি বাড়ি গেলাম, স্নান করে দুপুরের খাওয়া শেষ করলাম। ফোন করবো না, বাড়ি গিয়েই দেখা করবো। মা-বাবার কাছে প্রিয়ার কথা জানতে চাইলে তারা এড়িয়ে গেল। শুধু বলল, “প্রিয়া গানে অনেক নাম করেছে।” কিন্তু প্রিয়া কেমন আছে কেউ বলল না।

বিকেলে প্রিয়ার বাড়ি গেলাম। তার মা দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই বললাম “প্রিয়া কেমন আছে, ভালো আছে তো?”

কাকিমা আমার চোখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। কাকিমার এমন চাহনি দেখে আমার মনটা উদাস হয়ে গেলো। ভাবলাম, প্রিয়ার কি বিয়ে হয়ে গেছে? সে কি এখন আর এখানে থাকেনা? আমি কাকিমার কাছে আবেদনের শুরে বললাম, “কাকিমা আপনি চুপ করে থাকবেন না, একটি বার বলুন প্রিয়া কেমন আছে? সে ভালো আছে তো?”

কাকিমার চোখে জল, উনি আমায় ঘরে নিয়ে বসালেন। বললাম, “কি হয়েছে?” উনি কাঁদাতে থাকলেন। আমি অবাক হয়েছে থাকলাম শোনার প্রতীক্ষায়। তারপর কাকিমা করুন স্বর- এ বললেন, “প্রিয়াকে ভুলে যাও। তুমি ভালো কাউকে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসার করো। প্রিয়াকে ভুলে যাও!”

“না কাকিমা না! প্রিয়াকে না পাই সেটা মেনে নিতে পারবো, কিন্তু ভোলার কথা বলবেন না, ভুলতে পারবো না।” কাকিমার হাতটা ধরে বললাম, “একটি বার বলুন, কি হয়েছে?”

কাকিমা উঠে দাঁড়ালেন বললেন, “তুমি বিদেশে যাওয়ার এক বছর পর সে একটা ক্যাসেট কোম্পানিতে গানের সুযোগ পায়। একটি গানও বেরোয় তার। প্রথম যাত্রা খুব ভালো ছিল, প্রথম গানেই তার নাম হয়েছিল। তারপর সবই আমাদের ভাগ্যের দোষ। একদিন একটা অনুষ্ঠানে ডাক পড়ল গান গাওয়ার। সেখান থেকে রাতে ফেরার পথে গাড়ি এক্সিডেন্ট করলো।”

“কী? কী বলছেন?”

“হ্যাঁ বাবা! তাতে তার একটা পা বাদ যায়। তার গানের ভবিষ্যৎ তো শেষ হয়েই গেল আর তার সাথে জীবনটাও। বিদেশ থেকে যখন তোমার ফোন আসতো তখন ফোন ধরলেও কিছু বলতে পারতো না। ফোন আসলেই সে কাঁদত। তাই শেষে ফোন সুইচ অফ করে দিয়েছিলো। এখন সারাদিন সে একা-একা ঘরে বসে থাকে, ঠিক-ঠাক খাওয়া-দাওয়াও করে না।”

“কাকিমা, আমি যে ওকে ভোলার জন্য ভালোবাসিনি। ও যদি সেই সময় জোড় করে বিদেশে না পাঠাতো আজ আমি এই অবস্থায় আসতে পারতাম না। আর আজ ওর একটা পা নেই বলে আমার ভালোবাসা থাকবে না! এটা হতে পারে না। আমি আগেও ওকে যতটা ভালবাসতাম এখনো ততটাই ভালোবাসি।”

“তা বলে তুমি ওকে নিয়ে সমস্যায় পড়ো, এটা আমরা চাই না। তুমি ওকে নিয়ে সমাজে চলতে পারবে না। তোমার বাড়িতেও কেউ ওকে মেনে নেবে না।”

“আমি প্রিয়াকে ভালোবাসি কাকিমা। ভালোবাসার জন্য একটা মনের দরকার । ও যে রকম আমি সেই ভাবেই ওকে ভালবাসবো সারাটা জীবন। আমি কী প্রিয়ার সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি?”

“ওই একা ঘরে দরজা-জানলা বন্ধ করে থাকে সারাদিন। মনে অনেক কষ্ট বুঝতে পারি, কিন্তু কিছু করতে পারি না। দেখো একটু বোঝাতে পারো কি-না। ওকে তো আর যাই হোক বাঁচাতে হবে!”

“প্রিয়া! প্রিয়া! আমি ফিরে এসেছি প্রিয়া। দেখো, পাঁচটা বছর পর তোমার সৌগত তোমার কাছে ফিরে এসেছে।”

“চলে যাও তুমি, পাঁচ বছর পর আমি আর তোমার সেই প্রিয়া নই। তুমি চোলে যাও। আমাকে একলা থাকতে দাও।”

“না, আমি ফিরে যেতে আসিনি। আমি যে তোমায় ভালবেসেছি।”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত