ছুটতে-ছুটতে শিয়ালদা স্টেশনের প্লাটফর্মের ঢুকতেই ডিসপ্লে বোর্ডে একবার তাকিয়ে ভাগীরথী এক্সপ্রেসের প্লাটফর্ম নম্বর দেখে ও হাত ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আরও ছুটতে লাগলো রিয়াজ। রাতের মধ্যে বহরমপুরে নিজের বাড়িতে ভালোভাবে পৌঁছে এই ট্রেনটা খুব ভালো ভরসা। রিজার্ভেশন করাই ছিল। দু’মিনিটের মধ্যে ছুটে D2 কামড়ায় উঠতেই ট্রেন হুইসল দিয়ে উঠলো। সর্পিল গতিতে হেলতে-দুলতে চলতে শুরু করেছে ট্রেন। এতটা পথ ল্যাপটপ ও ফাইল ভর্তি একটা লাগেজ ব্যাক-প্যাক কাঁধে নিয়ে দৌড়ে এসে রিয়াজ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। গেটের মুখে বেসনে ফ্রেশ হয়ে একটু জল খেয়ে নিয়ে নিজের সিটের উদ্দেশ্যে চলল। সব সিটগুলি ভর্তি। দূর থেকে নিজের সিটের দিকে চোখ যেতেই রিয়াজ দেখল এক ভদ্রমহিলা বসে আছে।
“এক্সকিউজ মি! জানালার ধারের সিটটা আমার,” রিয়াজ বলে উঠলো।
“ও ইয়েস!” এই বলে রুহি ঘুরে তাকাতেই একরাশ বিস্ময় নিয়ে চমকে উঠলো।
হতভম্ব রিয়াজও। অন্য সময় রিজার্ভেশন ট্রেনে ওঠার আগে স্টেশনে রাখা নামের লিস্ট চেক করে নেয় বরাবরের ইন্ট্রোভার্ট রিয়াজ। চেনা জানার ভিড় থেকে নিজেকে লুকাতে এরকম প্রায়ই করে সে। তবে এবার সময়ের অপ্রতুলতার কারণে সেই লিস্ট দেখা হয়ে ওঠেনি। নিয়তি তার জন্য এত বড় বিস্ময় লুকিয়ে রেখেছিল সে কল্পনায়ও ভাবেনি। রুহি দ্রুত সিট ছেড়ে দিতে চাইলে রিয়াজ বলে উঠলো, “ওখানে বস।” তিনজনের এই সিটে জানালার ধারে রিয়াজের ও মেঝের সিটটি রুহির ছিল। তিন নম্বরের সিটে যথারীতি একজন বসে আছে। রিয়াজ কি করবে ভেবে উঠতে পারছিল না। রুহি বলে উঠল, “দাঁড়িয়ে কেন? এখানে বস?” চারিদিকে তাকিয়ে নিয়ে রিয়াজ বলল, “হ্যাঁ, এই বসি।”
“কেমন আছো?” জানালার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলল রুহি।
“যতটুকু দেখছ, তার থেকেও আছি বেশি ভালো,” দুটো বিস্কুট মুখে দিয়ে জল খেতে-খেতে বলল রিয়াজ, “বিস্কুট নেবে?”
“ভুলে গেছো হয়তো যে, আমি ক্রিম বিস্কুট খাই না।” রহি হাসল। ট্রেনের দুলুনি আর আওয়াজের মাঝেও দুজনের মধ্যে এক অদ্ভুত নীরবতা কাজ করছে। দু’জনেই ভাবছে অন্যজন কী ভাবছে। নীরবতা ভেঙে রিয়াজ বলল, “কলকাতায় কি কাজে এসেছিলে?” “হেড অফিসে একটু কাজে এসেছিলাম। তুমি আজ বাড়ি ফিরছ নাকি?” হেড অফিসে কাজ – কথাটা শুনে রিয়াজ একটু বিস্মিত হলেও কথাটিকে গুরুত্ব না দিয়ে উত্তর দিল, “বাড়ি! আমার আর বাড়ি! ওই বহরমপুর যাচ্ছি একটি অফিসিয়াল মিটিংয়ে। কাল সকালে এটেন্ড করে সন্ধ্যায় হাজার-দুয়ারি এক্সপ্রেসে ফিরে আসব।”
আবার ট্রেনের কামরার সব রকম শব্দকে ছাপিয়ে এক অদ্ভুত পিনপতন নীরবতা তৈরি হয়েছে এই দুই সিটের মধ্যে। পাঁচ বছর আগের কথা তখন এই নীরবতা ছিল না। কলকাতায় এক সরকারি দপ্তরে চাকরির সুবাদে রিয়াজ তার নতুন বউ, রুহিকে নিয়ে প্লেট ভাড়া করে থাকতো। উইক-এন্ডে বা দু-এক দিনের ছুটিতে এভাবেই এই ট্রেনের রিজার্ভেশনে যেত দেশ বাড়ি মুর্শিদাবাদে। সদ্য গ্র্যাজুয়েট রুহিকে দেখে রিয়াজের দিদির পছন্দ হয়ে যায়। রিয়াজ তখন কলকাতায়। একদিন হঠাৎ রিয়াজকে ডেকে দুই পরিবার মিলে তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়। তারপর থেকে অফিসের কাজে কলকাতায় থাকা শুরু।
বেশ ইন্ট্রোভার্ট ছিল রিয়াজ। অন্যদিকে রুহি এক্সোভার্ট না হলেও বেশ বক-বক করত। পরিবারের অনেক দিক সামলাতে-সামলাতে রুহি ক্লান্ত হয়ে পড়তো এবং এই নিয়ে অনেক চোট-পাট করতো। কিছুদিন বাদে দেখা গেল চুপচাপ থাকা রিয়াজের উপর আপন কর্তৃত্ব ফলানোর একটা ব্যর্থ চেষ্টা রুহিকে হতাশায় ফেলে দেয়। রিয়াজ ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের প্রমোশনের জন্য। এত সবের মধ্যেও রুহিকে সে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু প্রতিদিনের মানসিক কষ্ট সামলাতে না পেরে রুহি একদিন নিজের বাড়ির লোককে সব কথা বলেই ফেলে। রিয়াজ নিজেও বুঝতে পারে না, তার করনিয় কি?
সে নিজেকে কাজের সাথে আরও ব্যস্ত করে তোলে দিন দিন। দুই বাড়ির আত্মীয়-স্বজনরা রিয়াজের এই মনোভাবে আস্তে-আস্তে দূরে সরে যায়। রিয়াজ এগুলো নিয়ে কখনো যে ভাবে না, তা নয়। কিন্তু বুঝতে পারে না, সে কি ভুল করেছে? একাকীত্ব কাটাতে রুহি চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার কথা ভাবে, কিন্তু ঠিক হয়ে ওঠেনা। রিয়াজ দিন-দিন এতটাই চুপ মেরে যাচ্ছিলো যে, শেষ-মেষ রুহি ক্লান্ত হয়ে আত্মীয়-স্বজনের কথায় ডিভোর্স চিঠি পাঠায় উকিল মারফত। এক বছরের মাথায় সম্পর্কের শেষ সুতোতে কাঁচি চালিয়ে দু’জনে নিজেদের মতো আলাদা হয়ে যায়, তারপর আর কোনও খোঁজই নেয় নি কেউ কোনদিন।
আজ রিয়াজ ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। রুহি এখন বহরমপুরে সূর্য গ্রুপ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার শাখায় কর্মরত। কিন্তু কেউ কারোর খবর তো জানেনা সেই চলে যাওয়া চার বছর পর আজকে আবার হঠাৎ দেখা। দীর্ঘ চার ঘণ্টার রাস্তা বিষাদময় গভীর নীরবতার সাথে দু-একটা কথোপকথনে পার হয়ে যেতে থাকে। নামার কিছু আগে রিয়াজ মৃদু স্বরে বলতে থাকে, মুহূর্তেরা আজ হয়ে ওঠে মরীচিকা শূন্যতায় পূর্ণ হল আমার দিনন্তিকা, কল্পনার পাখি উড়ে গেলে সন্ধ্যা হয়, তপ্ত দুপুরে বৃষ্টিরও নাকি কান্না পায়, আবেগের সংলাপ গুলো বাঁধা থাকে দুই দাঁড়ি আর সেমিকোলনের ফাঁকে। আকাশে দেখে ঘন মেঘ, হলাম চাতক নামবেই বৃষ্টি, সেই আশায় দিন কাটুক।” রহি নীরবে ব্যাগ গোছাতে-গোছাতে বলে ওঠে,
ঝগড়া-সুখের কাব্য সাথে, জীবন চলুক নিজ ছন্দে
টুকরো-টুকরো মুহূর্ত কিছু না হয় কাটুক আনন্দে।”
ট্রেন থামলে পিছন না ফিরে রুহি চলে গেলে রিয়াজ কিছুক্ষণ বসে রইল প্ল্যাটফর্মের চেয়ারে। তারপর নিজের বাড়ির দিকে ফিরতে লাগল। পরদিন সকাল দশটায় বেশ পরিপাটি করে সেজে নিয়ে রুহি তার অফিসে রোজকার মতই পৌঁছল। রুহি সেখানকার সেকেন্ড ইন-চিফ। ম্যানেজমেন্টের টেণ্ডার নিয়ে লেনদেন সংক্রান্ত কাজের মাঝে প্রচুর ব্ল্যাক টাকার আদান-প্রদান রুহির নজরে আসে। বরাবরের স্বাধীনচেতা ও সততার পথে চলা রুহি এসব মেনে নিতে না পেরে, চাকরি যায় যাক, কিন্তু এর একটা হেস্তনেস্ত করবেই বলে মাস অনেক আগে সূর্য গ্রুপের হেড অফিসে এই নিয়ে কমপ্লেন করেছিল অ্যানোনিমাস ইমেইল মারফত। সাথে, সিসি করেছিল ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টকেও। কোম্পানি থেকে এই জন্য আগের দিন রুহির ব্রাঞ্চ-হেডকে ডেকে পাঠানো হয়। ব্রাঞ্চ-হেড নিজে না এসে, তার পরিবর্তে রহিকে পাঠিয়েছিল হেড-অফিসে।
মিটিং চলাকালীন হঠাৎ রিসেপশন থেকে ফোন এলো যে, একজন সরকারি অফিসার স্থানীয় থানার এস-আইকে নিয়ে অফিস দরজা বন্ধ করে রেইডের ওয়ারেন্ট দেখাচ্ছে। হন্তদন্ত হয়ে রিসেপশনে ছুটে এসে রুহি হতভম্ব চোখে দেখে ব্রাঞ্চ-হেড কাঁপা-কাঁপা হাতে সমস্ত ফাইল নিয়ে দু’জন লোকের সামনে বসে বিগত দশটি টেন্ডারের ফাইল দেখাচ্ছে। তাদের কোম্পানির কলকাতার অফিসের অডিটরও সেখানে উপস্থিত। বাকি লোক দু’টির মধ্যে একজন রিয়াজ। এখন রুহি কি করবে ভেবে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ব্রাঞ্চ-হেডের পাশে দাঁড়ালো। মনে- মনে এটাই তো চেয়েছিল সে; ব্রাঞ্চ -হেডের সাসপেনশন হবে আর তার প্রমোশন! কিন্তু ভাবেনি নিয়তি রিয়াজকেই তার ভাগ্য-দূত করে পাঠাবে। রিয়াজের সততার প্রতি বিশ্বাসে রুহি নিশ্চিন্ত হলেও, মনে-মনে ভয় পায়।
চার বছর আগের চেনা পারফিউমের গন্ধের টানে ও তার টেবিলের সামনে নতুন একজনের আগমনে রিয়াজ মুখ তুলে তাকিয়ে বিস্ময় একটুক্ষণ স্থির হয়ে যায়, তারপর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে আবার কাজে লেগে পড়ে। সম্পূর্ণ অচেনার ভানে কেটে যায় চার-পাঁচ ঘণ্টা। প্রচুর অসঙ্গতি পেয়ে ব্রাঞ্চ-হেডের নামে কমপ্লেন করা হয়। কাজ শেষে রিয়াজ আর অপেক্ষা করেনি, বিকেল পাঁচটার হাজার-দুয়ারি এক্সপ্রেসে ফিরে আসে কলকাতায়। শুধু অফিস থেকে ফিরে যাওয়ার সময় একবার ঘুরে তাকিয়ে ছিল রুহির দিকে।
দু’দিন বাদে এক সকালে রিয়াজ খবরের কাগজের শিরোনাম দেখল, এক অজানা ই-মেইলের জেরে হওয়া তল্লাশিতে সূর্য গ্রুপের বহরমপুর শাখার ব্রাঞ্চ-হেড সাসপেন্ড , এই নতুন দায়িত্বে রুহি। ভালোবাসার মানুষটির জন্য অজান্তে হলেও এই কাজটি করতে পেরে মন থেকে খুশি হল রিয়াজ। সে মনে-মনে বলে উঠে, “নিয়তি তুমি যে বড্ড নিষ্ঠুর, নিয়েছ আপনারে এত কাছে পাঠিয়েও ফিরালে আমায় একা করে।” অন্যদিকে সুদূর বহরমপুরে কোন এক বারান্দায় বসে কফির কাপে চুমুক দিতে-দিতে রুহি মনে-মনে কেঁদে বলে ওঠে, “অযাচিত এই প্রাপ্তি হল শেষে ভালোবাসার উপহার, আমারও যে মন কাঁদে তোমায় আবার কাছে পাওয়ার।”