আমার বিয়ের এক সপ্তাহ পর আমি যেদিন প্রথম ছাদে গেলাম ভিঁজা কাপড় নাড়তে সেদিন আমার সাথে সিমা ভাবির সাথে পরিচয় হল।সিমা ভাবি পাশের বিল্ডিং এর দোতলায় থাকেন।চার মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলেন তিনি।নিয়ম করে ছাদে আসেন রোদ পোহাতে, ভিটামিন ডি এর ঘাটতি পূরণ করেন ছাদে একা একা বসে থেকে।আমাকে পেয়ে খুব আগ্রহ নিয়েই ডেকে কথা বলছিলেন সেদিন।আমারও তার সাথে কথা বলতে খুব ভাল লাগছিল।কেমন জানি মায়া লাগানো চোখ তার।
মিষ্টি একটা হাসি লেগেই থাকে তার মুখে।কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম এর আগে তার আরও তিনটা বাচ্চা নষ্ট হয়েছে।চার মাস পাঁচ মাস হওয়ার পর পরই বাচ্চা গুলো আর বেঁচে থাকতে পারে না পেটের মধ্যেই মারা যায়।আর তাই এটা তার চার নম্বর প্রেগন্যান্সি হওয়ার পরও একটাও বাচ্চার মুখ দেখতে পারেন নাই। এতটা কঠিন একটা কথা ওনি কেমন জানি হাসতে হাসতেই বলে দিলেন।ওনার কথাতে আমার অনেক কষ্ট লাগছিল কিন্তু ওনি অবলীলায় গল্প করে করে সব কয়টা বাচ্চা কিভাবে কি হল তার বর্ননা দিয়ে গেলেন।হঠাৎ করেই কেমন জানি একটু স্থির হয়ে গিয়ে আমার হাতদুটো ধপ করে ধরে বলে উঠলেন
– বোন একটা কথা বলি, তুমি রাখবা? ওনার কথাতে আমি একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এভাবে হটাৎ করে কি হল।তাই নিজেকে একটু শান্ত করে নিয়ে বলেছিলাম
– কি কথা ভাবী?
– এখনই একটা বাচ্চা নিয়ে নাও।বিবাহিত জীবন ভোগ করে পরে ধীরে সুস্থে বাচ্চা নেওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে বিয়ের পরপরই একটা বাচ্চা নিয়ে নাও।একটা হওয়ার পর না হয় আরেকটা দেরিতে নিও।একটা বাচ্চা নিয়া ঘুরাফেরা করা যায়।বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানো যায়।একটা বাচ্চা কোন ঝামেলা না। নিয়ে নাও, প্লিজ আমার কথাটা শুনো।
ওনার কথাতে আমি অবাক না হয়ে আর পারলাম না।এইটা কোন কথা হল? আর ওনি কেনইবা এভাবে চিন্তা করছেন? ভিতরে প্রশ্নটা আটকে না রেখে সরাসরি জানতে চাইলাম, বললাম
– কিন্তু কেন? বিয়ের পর পর একটা বাচ্চা কেন নিতে বলছেন ভাবী?
– বাচ্চা হল একটা মেয়ের জন্য তার শশুর বাড়িতে টিকে থাকার টিকেট।তোমার যদি একটা বাচ্চা হয়,তাহলে এই ফ্যামেলিতে তোমার থাকা পাকাপোক্ত হবে।আর যদি না হয় তবে যেকোন সময় তুমি আউট আর তোমার জায়গায় নতুন কোন বাচ্চা পয়দার মেশিন ইন।বলেই ভাবী জোড়ে জোড়ে হাসতে লাগলেন।ভাবী হাসছেন ঠিকই কিন্তু তার চোখ মুখ বলছে অন্য কথা।আমার কেমন জানি খুব ভয় লাগতে লাগল তখন ভাবীকে দেখে।এরই মধ্যে নিচ থেকে ডাক পেলাম “জেসমিন” “জেসমিন” করে আমার শাশুড়ী ডাকছেন।আমি ভাবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে চলে এলাম। নিজের রুমে বসে ভাবতে লাগলাম ভাবীর কথা গুলো।সত্যি সত্যিই কি একটা বাচ্চা একটা মেয়ের জন্য তার শশুর বাড়িতে টিকে থাকার জন্য টিকিট হিসাবে কাজ করে? ভাবতে ভাবতে বুকের ভিতরে কেমন জানি একটা চাপ বোধ করতে লাগলাম।নতুন এক অশান্তিকে মনে হয় মনের মধ্যে জায়গা করে দিলাম।আমার জা বা আমার শাশুড়িকেও কিছু বললাম না।রাতে ঘুমানোর আগে আমার হাজবেন্ডকে প্রশ্ন না করে পারছিলাম না।তাই বললাম
– একটা কথা বলি?
– হুমম বল।
– একটা বাচ্চা কি একটা মেয়ের জন্য তার শশুর বাড়িতে টিকে থাকার জন্য টিকিট হিসাবে কাজ করে?
– হটাৎ এই প্রশ্ন?
– উত্তরটা বলো না।
– কিসব আজেবাজে কথা বলছ? কোথা থেকে এইসব প্রশ্ন পাও?
– পাশের বাসার ভাবী বলছে আমাকে।
– কোন ভাবী? আরে এই পাশের বাসার ভাবীদের কি কোন কাজ কাম নাই শুধু শুধু ভেজাল লাগানো কথা বলে? বাদ দাও এইসব কথা।এগুলো নিয়ে মাথা নষ্ট করো না। বলে আমাকে থামিয়ে দিলেন আমার হাসবেন্ড। আমিও মনে মনে ঠিক করলাম আর এইটা নিয়ে মাথা ঘামাব না।
এরপর কেটে গেল আরও বেশ কিছু সময় বিয়ের পর নতুন জীবন বেশ ভালোই আনন্দের সাথে কেটে যেতে লাগল।আমার হাজবেন্ড মনে হয় আমার জাকে কিছু একটা বলেছিল যার কারনে আমাকে এরপর আর ছাদে যেতে দিতেন না আমার জা ।আমার কাপড় চোপড় তিনিই ছাদে নিয়ে যেতেন।আমি বাসায় তখন অন্য কাজ করতাম। একদিন আমি আমার রুমের জানালা থেকে দেখলাম নিচে সিমা ভাবী দাঁড়িয়ে আছেন।মনে হয় কোথাও যাচ্ছেন, গেইটে দাঁড়িয়ে সি এন জির অপেক্ষা করছিলেন।খুব ইচ্ছে করছিল ডেকে ভাবীর সাথে কথা বলি কিন্তু এইটা খুবই অশোভন দেখায় বলে আর কথা বলা হল না।এরপর আমি আমার বাবার বাড়ি চলে আসি কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে। নিজের বাড়িতেই এখন আমাকে বেড়াতে আসতে হয়, ভাবতেই খুব মজা লাগে।নতুন জামাই নিয়ে বাবার বাড়ি বেড়ানোর মজাই আলাদা,সবাই খুব আদর যত্ন করে কোন কাজ কর্ম করতে দেয়না।নিজের ভাবসাবই একেবারে আলাদা।বেড়ানো শেষ করে আবার শশুর বাড়িতে ফিরে আসলাম।আমি আসার পরপরই আবার আমার জা গেলেন তার বাবার বাড়িতে বেড়াতে।
এখন বাসার সকল কাজের দায়িত্ব আমার উপর চলে আসল।কিন্তু আমার শাশুড়ি আমাকে ভয় পেতে না করলেন।তিনি নিজেও আমাকে বাসার কাজ কর্মে অনেক সাহায্য করবেন বলে আশ্বাস দিলেন।আমি কিছুটা সাহস নিয়ে প্রথম দিন বেশ ভাল মতই চালিয়ে নিলাম।পরেরদিন রান্না শেষ করে গোসল করে কাপড় নিয়ে আমাকেই ছাদে যাওয়া লাগল কাপড় রোদে দেওয়ার জন্য। ছাদে উঠেই কেনো জানি চোখটা পাশের ছাদের দিকে গেল।আর তখনই চোখটা সিমা ভাবীর দিকে আটকে গেল।ভাবীর দিকে ঠিক না ভাবীর পেটের দিকে।কেনজানি আমার হাত থেকে বালতিটা নিচে পড়ে গেল।বালতি পড়ার শব্দে ভাবী আমার দিকে তাকিয়েই জোরে ডাক দিয়ে ছুটে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়ালেন।আমি নিজেকে সামলিয়ে ভাবীর দিকে এগিয়ে গেলাম।কি বলব বুঝতে পারছিলাম না।ভাবীই বললেন
– কেমন আছো বোন? অনেকদিন তোমার কোন দেখা নাই।
– জি ভাল আছি, আমি কিছুদিনের জন্য বাবার বাড়ি গিয়েছিলাম, তাই হয়ত দেখেন নাই।আপনি কেমন আছেন ভাবী?প্রশ্নটা করেই থমকে গেলাম।
– এইতো চলে যাচ্ছে জীবন। এই বাচ্চাটাও আমাকে ফাঁকি দিল, আমার কোলটা মনে হয় ওদের পছন্দ না।আমাকে মা ডাকতে চায় না কেউ। তাই আর আমার কাছে কেউ আসে না।আর কেউ কোনদিন আসবেও না।বলে হাসতে লাগলেন।বলতো আমার এখন কি হবে? আমাকে মা ডাকতে মন চায়না তাতেতো কোন সমস্যা নাই, কিন্তু আমার হাজবেন্ডকেতো বাবা ডাকা দরকার ছিল।তাইনা বলোতো?বাচ্চাগুলো আমাকে পছন্দ করে না তাই বলেকি ওরা ওর বাবাকে শাস্তি দিতে পারে?আমার শাশুড়ী বেচারি দাদী ডাকটা শুনতে পারছেন না আমার জন্য। বলোতো কতটা বিভৎস ঘটনা। বলেই আবার হাসতে লাগলেন।আমি মনে হয় বরফ হয়ে গেলাম।একটু নড়তেও পারছিলাম না।শুধু ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে বললাম
– ভাবী কি বলছেন এইসব? বাচ্চাগুলো কেন আপনাকে পছন্দ করবেনা? নিশ্চয়ই কোথাও কোন সমস্যা আছে, একটু ডাক্তার দেখান।নিশ্চয়ই ভালে কোন ট্রিটমেন্ট আছে এর জন্য।
– ট্রিটমেন্ট? সেতো এতবছর ধরেই চলে আসছে।কতকত চেষ্টাইতো চলল কিন্তু কোন লাভ হল না।আর কোন লাভই হবে না।এইবার সব আশাই শেষ।ইউটেরাসটাই ফেলে দিতে হয়েছে।আমি শেষ,একেবারে খতম।বুঝছ,আর কোন আশাই নাই। এক আমার জন্য আমার হাজবেন্ড আমার শাশুড়ী সবার স্বপ্নই ভেস্তে গেছে বলেই জোরে জোরে হাসতে হাসতে ছাদে বসে পরলেন।ঠিক ওই সময়ই আমার শাশুড়ী আমার দেরি দেখে আমার খোঁজে ছাদে উঠে আসলেন।আমাকে ভাবীর সাথে কথা বলতে দেখে একটু রেগে গিয়ে বললেন
– জেসমিন,টেবিলে খাবার দিতে হবেনা? এখানে দাঁড়িয়ে গল্প করলে চলবে?যাও তুমি নিচে যাও আমি কাপড় নাড়তেছি।বলে আমাকে আর দাঁড়াতে দিলেন না।জলদি করে ছাদ থেকে নামিয়ে দিলেন। আমি ঠিক মত ভাবিকে বাই ও বলতে পারলাম না।নিচে নেমে এসে মনটাকে কোন ভাবেই স্থির করতে পারছিলাম না। কেন জানি আমার চোখ দুটো দিয়ে ধরধর করে পানি ঝরতে লাগল। ভাবীর কথাগুলো আর কাউকেই বলতে পারলাম না।আমার শাশুড়ী নিচে নেমে আমাকে পরিস্কার করে জানিয়ে দিলেন,আমি যেন আর কখনও সিমা ভাবীর সাথে কোন কথা না বলি।
কিন্তু কেন তা বললেন না।আমি চেয়ে ছিলাম আমার শাশুড়ী মাকে জিজ্ঞেস করতে কেন বলব না? কিন্তু তার আদেশের ধরনটাই এমন যে আমার মুখটা তালাবদ্ধ হয়ে গেল।আমি ভিতরে ভিতরে খুব কষ্ট পেতে লাগলাম ভাবীকে নিয়ে। মনটা খুব আনচান করত তার সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু নিজের ঘরের শান্তির কথা চিন্তা করে আর বলা হয়ে উঠে না। দুদিন পর রাতে আমার হাজবেন্ডের বাসায় আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল।আমি আর আমার শাশুড়ী বসে আছি তার জন্য। যখন সে বাসায় ফিরল তখন তার মুড দেখে বুঝতে পারলাম কিছু একটা ঘটেছে,কিন্তু নিজ থেকে আর জিজ্ঞেস করলাম না।এই কয়মাসের সংসারে এইটা বুঝতে পারছি যে, সে সারাদিন কি কি ঘটে তার সারাংশ আমাকে ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলে।কিন্তু আমার শাশুড়ী প্রশ্ন করে বসলেন
– কি হয়েছেরে বাবা? মনটা এত খারাপ করে রেখেছিস কেন? আর এতটা দেরিইবা কেন করলি বাসায় ফিরতে?
– আর বলোনা মা, আমিতো আসছি ঠিক সময়তেই।কিন্তু বাড়ির গেইটেই আসতে পারছিলাম না।নিচে মানুষের ভীর,আর এর সাথে পুলিশতা কন্ট্রোল করার অযুহাতে গেইট বন্ধ করে রেখেছিল।
– মানুষের ভীর,পুলিশ মানে? কি হইছে?
– ওই নিচে লাশ রাখা,
পাশের বাড়ির দোতালার কোন মহিলা ঘুমের ঔষধ খেয়ে সুইসাইড করেছে।এইসব কেইসে পুলিশতো আসবেই।মহিলার হাজবেন্ডকে এখন জিজ্ঞেসাবাদ করছে।বিরাট ঝামেলা।কথা গুলো কানে পৌঁছাতেই আমি কেন জানি আর সহ্য করতে পারলাম না।আমার মাথাটা ঘুরে গেল আর চোখগুলো হটাৎ ঝাপসা হয়ে গেল আমি মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম আর কিছু বলতে পারলাম না। যখন জ্ঞান ফিরল তখন চেয়ে দেখি আমার হাজবেন্ড আমার মাথার কাছে বসে আছে।আর আমার শাশুড়ী বাতাস করছেন মুখে যদিও মাথার উপরে একটা সিলিং ফ্যান ঘুরছিল।দুজনই একসাথে জিজ্ঞেস করলেন
– কি হয়েছে তোমার? শরীরটা খারাপ লাগছে?আমার শাশুড়ী আবার বললেন তার ছেলেকে
– কালকেই একজন গাইনি ডাক্তার দেখায় নিয়ে আয়।মনে হয় ভাল কোন খবর আছে। যাক ভালোই হল অন্তর ওর মায়ের সাথে নানা বাড়ি যাওয়াতে বাসাটা খা খা করছিল। ভাল কোন খবরে আবার আমার মনটা শান্তি পাবে বলে ওনি উঠে চলে গেলেন।আমার হাজবেন্ড কোন রকম উচ্চ বাচ্যই করলেন না।কারন ও জানে যে আমার তখন পিরিয়ড চলছে।আমি একটু উঠে বসতেই। সে বলা শুরু করল
– কি হল জেসমিন? তুমি নিশ্চয়ই ওই মহিলার সুইসাইডের কথা শুনে মুর্ছে গেলা? কেন সব বিষয় নিজের মনের মধ্যে নাও? এই রকম এক্সিডেন্ট আমাদের চারপাশে হরহামেশাই ঘটে,এরই মধ্যে আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হয়।একটু মনটাকে শক্ত কর।এগুলোকে গায়ে মেখোনা।
– এটাকি সত্যি সত্যিই সুইসাইড নাকি এক প্রকার মার্ডার?
– চুপ, একদম চুপ! কোন রকম উলোট পালোট কথা আমি শুনতে চাই না। এইটা যাই হোক তা পুলিশ দেখবে।তুমি একদম এইসব নিয়ে কথা বলবেনা।আমি সত্যি সত্যিই আর কোন কথা বলতে পারলামনা।চুপ হয়ে গেলাম শুধু তখন কার জন্য না সবসময়ের জন্যই।
এরপর কেটে গেল আরও বেশ কিছুমাস এই ভাবেই।আমার জা আমার সাথে বেশ ভাল বন্ধুর মতই আচরণ করেন।শাশুড়ী সেই ঘটনাতে যে আশা করেছিলেন তা ভেঙে যাওয়ায় প্রথম এক দুইদিন থম ধরে ছিলেন তার পর আবার আগের মতই ভালোই আচরন করা শুরু করলেন।মাঝে মাঝে ছাদে গেলে সিমা ভাবীর কথা খুব মনে পড়ে।একটা সময় সেই মনে পড়াটা কমে যেতে লাগল।হটাৎ একদিন দেখি নতুন একজন এই ছাদে বসে আছেন পরে আমার শাশুড়ীর কাছে শুনলাম সিমা ভাবীর জায়গায় নতুন একজন এসেছেন।পুরুষ মানুষ যত দ্রুত জীবন সঙ্গী বদলে ফেলতে পারে তত দ্রুতকি নিজের কাপড় বদলাতে পারে কিনা সন্দেহ? নিজের পুরুষটাকেও কেন জানি একটু একটু সন্দেহ হতে লাগল।এই মানুষটাও কি এতটা দ্রুত তার জায়গায় অন্য কাউকে আনতে পারবে? এই সব ভাবতে ভাবতে যখন মশগুল ঠিক তখনই আমার শাশুড়ী মা বলে বসলেন
– জেসমিন,তোমাদের বিয়েরতো দুই বছর হতে চলল,এখন একটা নাতি নাতনির মুখ দেখাও।অন্তরের একজন খেলার সাথীওতো দরকার। হটাৎ করেই আমার ভিতরটা একটু কেঁপে উঠল। আমি তখন তাকে কোন উত্তর দিলাম না। শুধু মাথা নিচু করে নিজের রুমে চলে এলাম।রাতে আমার হাজবেন্ড বাসায় আসার পর আমি কিছু বলার আগেই আমার শাশুড়ী কথা তুললেন
– বাবা অনেক দিনতো অপেক্ষা করলাম।এইবার একটা নাতি নাতনির মুখ দেখতে চাই।তুমি কি বলিস?
– আমি কি বলব?আল্লাহকে বল,বাচ্চা দেওয়ার মালিক তিনি।তিনি চাইলে পাইবা। বলে খাবার শেষ করে উঠে রুমে চলে গেল।আমি টেবিল গুছিয়ে রেখে নিজের রুমে চলে এলাম।রুমে এসে ভয় পেয়ে গেলাম আমার হাজবেন্ডকে দেখে, ও কেমন জানি স্থির হয়ে বসে আছে মনে হল কিছু একটা নিয়ে গভীর চিন্তায় আছে।আমি কাছে গিয়ে তার পাশে বসে তাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললাম
– কি হল তোমার? এমন থম ধরে বসে আছো কেন?
– জেসমিন,তোমাকে এতদিন বলিনাই।আমার মনে হয় আমাদেরকে একটু ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার। গত একবছর যাবৎ আমরা একটা বাচ্চার জন্য চেষ্টা করছি কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না।আজ মা এমন ভাবে বললেন যে আমি কোন উত্তর করতে পারছিলাম না। কথাটা শোনার পর আমার সারা পৃথিবীটা মনে হল জোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নাড়া দিল।অজানা এক ভয়ে আমার ভিতরটা কেঁপে উঠল।কি বলে এইসব? গত একবছর ধরে বাচ্চার জন্য চেষ্টা করছে কিন্তু আমি বাচ্চা কনসিভ করতে পারছিনা।কিন্তু কেন? প্রোবলেম কি? আমি সাথে সাথেই বললাম
– আমাকে কিছু জানাও নাই কেন?চল কালকেই ডাক্তারের কাছে যাই।আমার কেমন জানি ভয় হচ্ছে, আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
– আগেই এত ভয় পেওনা।আগে ডাক্তারের কাছে যাই, পরে জানা যাবে সমস্যাটা কি? এখন ঘুমাও আর বাসায় কাউকেই এখন কিছু বলার দরকার নাই। যা বলার তা আমি বলব।তুমি কোন কথা বলবানা।
আমি চুপ হয়ে গেলাম,শুধু আল্লাহকে বলতে লাগলাম শুধু তার কাছে একটা বাচ্চা চাইতে লাগলাম।
এরপর শুরু হল আমার আর আমার হাজবেন্ডের যুদ্ধ। আজ এই ডাক্তার,তো কালকে ওই ডাক্তার।আজকে এই পরীক্ষা তো কালকে ওই পরীক্ষা। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একেবারে ক্লান্ত হয়ে পরলাম।প্রথম প্রথম চেপে রাখতে পারলেও পরে বাসার সবাই ঘটনা জেনে গেল।আমার শাশুড়ীর কান্নাকাটিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠল।আত্মীয় স্বজনরা এসে নানান প্রশ্ন করা শুরু করলেন। সমস্যা কার সমস্যা কার বলে পরিবেশ গরম করে ফেললেন।আমার হাজবেন্ড বেশ মনমরা হয়ে বললেন সমস্যাটা তার।এক মুহূর্তেই সবার গলা নেমে গেল।পিনপতন নিরবতা ছেয়ে গেল বাসায়।আমার শাশুড়ী এই কয়দিন দাদী হতে পারছে না বলে আমাকে বার বার কথা শুনাতে শুনাতে কান পঁচিয়ে ফেলছিলেন তিনিই মনে হয় বেশি শান্ত হয়ে গেলেন।এর পর থেকে শুরু হল একে একে আমাকে স্বান্তনা দেওয়ার পালা।নতুন উপদ্রব শুরু হল আমাদের বাসা থেকে আমার জন্য।
মা ভাই ভাবীরা এসে এসে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য তাগাদা দেওয়া শুরু করলেন।আমার ছোট মামাতো শুনলাম আমার জন্য পাত্রও রেডি করে ফেলেছেন বিয়ে দেওয়ার জন্য। আমার হাজবেন্ড শুধু বললেন,তুমি আর যাই কর।আর কোন বিয়ে করোনা।আমার সাথে থাকতে চাইলে থাক না থাকতে ইচ্ছে করলে চলে যাও।কিন্তু আমার জায়গাটা কাউকে দিও না।আমি কেমন জানি একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে যেতে লাগলাম।বেশ কিছু ঘটনার জোড়াতালি দিয়ে পুরো ঘটনা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম।কিন্তু কোন কিছুই বুঝতে পারলাম না।আমি আমার মা ভাইদের ফিরিয়ে দিলাম।এখানেই থেকে গেলাম।আমার শাশুড়ী তাতে বেশ খুশি হলেন।আমার প্রতি তার আচরন খুবই ভাল, আমার এখানে থাকতে কোন সমস্যাই নাই।
কয়েকদিন পর ছাদে গিয়ে দেখলাম সিমা ভাবীর রিপ্লেস মেন্ট একটা ছোট বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছেন।আর তার পাশে বাচ্চার বাবা বসে আছেন।আমাকে দেখে মনে হয় একটু লজ্জাই পেলেন।আমি আর ছাদে দাঁড়ালাম না সাথে সাথে নিচে নেমে এলাম।সিড়িতে বসে বসে ভাবলাম সিমা ভাবী মনে হয় এই দৃশ্য দেখার ভয়েই পরপারে চলে গিয়েছিলেন জলদি করে। নিজের অজান্তেই আমার হাজবেন্ডের জন্য আমার মনটা কষ্টে ভরে গেল। ওই মানুষটা না জানি কি কষ্ট বুকটা চেপে আছে,ভাবতেই খুব কান্না পেল আমার। বেশ কিছুদিন পর আমার জায়ের বাচ্চা হওয়ার জন্য আবার একটা হাসপাতালে গেলাম। ভাবি লেবার রুমে আর আমরা বাইরে বসে আছি।এমন সময় একজন নার্স এগিয়ে এসে আমাকে দেখে হেসে বললেন
– কেমন আছেন আপা?
– জি ভাল। আমি ঠিক কোথায় ওনাকে দেখেছি তা মনে করতে চাইছিলাম।তখন নার্সটাই আমার হাত ধরে আবার বললেন
– এখানে কেন?
– জি আমার জায়ের বাচ্চা হবে, লেবার রুমে আছেন।
– ও আচ্ছা খুব ভাল, খুব ভাল। আমিতো ভাবলাম অন্য কিছু।
– না ভাই অন্য কিছু না।আমারতো আর বাচ্চা হবেনা কোনদিন।আমি নার্সটাকে চিনতে পেরে কথাগুলো বললাম।ওনি তখন একটু কাছে এসে মুখটা আমার কানের কাছে এনে বললেন
– হাজবেন্ড নতুন কোন বিয়ে করতে চায়নাই এখনও? বাচ্চা চাই, বাচ্চা চাই করেনা? আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম বললাম
– মানে?
– যেদিন রিপোর্ট গুলো নিয়ে গেল সেদিনই আমরা বলছি আর কয়দিন পরেই আরেকটা বিয়ে করবে বাচ্চার অজুহাতে। এমনই হয়।এতবছর ধরে দেখে আসছিতো? দেখতে দেখতে এখন পরবর্তী স্টেপ মুখস্থ হয়ে গেছে।সাবধানে থাইকেন আপা।পুরুষ মানুষ বলে কথা।কথাটা বলতে বলতে নার্স লেবার রুমে চলে গেলেন।
ওনিতো চলে গেলেন সাথে আমার জানটাও মনে হয় নিয়ে গেলেন।কি বলে গেলেন তা বুঝার চেষ্টা করতে লাগলাম।কোন ঠিক ঠিকানা খুঁজে পেলামনা কোথা থেকে চিন্তা করব? কি চিন্তা করব?সমস্যা যদি তারই হয় তাহলে সে কেন আবার বাচ্চা বাচ্চা করে পাগল হতে পারে? রিপোর্টে কি ছিল যে তারা তখনই ঠিক করেছিল যে আমার হাজবেন্ড আবার বিয়ে করবে? আর কিছু ভাবতেই পারছিলাম না।আমার শাশুড়ী কে বলে আমি বাসায় চলে আসলাম।আমার মাথাটা শুধু ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে।বাসায় এসে কিছুক্ষণ শুয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে লাগলাম কি হচ্ছে এগুলো।আমি আসলে ঠিক মত কোন কিছু চিন্তা করতে পারলাম না। উঠে গিয়ে আলমারি খুলে রিপোর্ট গুলো বের করে একটা একটা করে চেক করতে লাগলাম।এর কোথায় কি আছে? রাত বারোটায় আমার হাজবেন্ড বাসায় ফিরল।রুমে ঢুকে দেখে রুমের লাইট বন্ধ। লাইটটা অন করে ও এক দৌড়ে আমার কাছে আসল
– একি করেছ তুমি? জেসমিন তুমি এইসব কাগজ কেন নামাইছ?
– তুমি এতবড় মিথ্যা কথাটা কেন বলেছ?তুমিকি আমাকে করুনা করছ?
– কিসব বলছ তুমি জেসমিন? তুমি যখন জানলা দোষ আমার তখন তুমি না গিয়ে কি আমাকে করুনা করেছিলে?
– তুমি মিথ্যা কেন বলেছ?
– তোমাকে হারানোর ভয়ে?
আমাদের সমাজ একটা ছেলের দোষ যত সহজে হজম করে ততটা মেয়েদের দোষকে হজম করতে পারেনা।এরা মেয়েদের দোষ নিয়ে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে যে সেখানে সুখ থাকতে পারেনা। আমি সুখ চাই, তোমাকে চাই।এই নিয়ে আর কোন কথা বলোনা।জীবনের জন্য এই সব তুমি ভুলে যাও। আর কোনদিন আমরা এই সব নিয়ে কথা বলবনা। বলে আমাকে টেনে নিয়ে তার বুকে চেপে রাখলেন।কিন্তু আমি কেন জানি এর মাঝে কোন তাল, লয়,সুর মিলাতে পারলাম না।
দুইদিন পর নতুন বাবু নিয়ে সবাই বাসায় ফিরলেন। আমার হাজবেন্ড নতুন বাবুকে কোলে নিয়ে একা একা খেলা করছিল আমার এই দৃশ্য চোখে পরতেই মনে হতে লাগল আমি কোন না কোন ভাবে তাকে ঠকাচ্ছি। একটা বাচ্চার বাবা হওয়ার অধিকার তার আছে কিন্তু আমি তাকে সেই সুখ থেকে বঞ্চিত করছি।নিজের ভিতরেই নিজে ভেঙেচুড়ে শেষ হয়ে যেতে লাগলাম।তার সাথে একটা ভয় চেপে ধরল আমাকে আর সেটা হল কতদিন ও এই সত্যকে চেপে রাখতে পারবে? যখন সবাই আসল জানতে পারবে, তখন কি হবে?সবাই মিলে যদি জোর করে ওকে বিয়ে করিয়ে দেয়,তখন কি ছাদে দেখা দৃশ্যটা আবার আমাকেই দেখতে হবে? আমি কি তখন তা সহ্য করতে পারব? এমন সব চিন্তায় আমার দিন কাল অসহ্য হতে শুরু করল।ঘুমাতেও পারিনা। চোখ বন্ধ করলেই দেখি সত্য সবার কাছে প্রকাশ পেয়ে গেছে।সবাই মিলে আমাকে তিরস্কার করছে আমি সত্য জেনেও নিজের স্বার্থে চুপ করে আছি।সবাই আমার হাজবেন্ডকে চাপাচাপি করছে বিয়ের জন্য। আমার হাজবেন্ড এই সব চাপাচাপি সহ্য করতে না পেরে সুইসাইড করতে যাচ্ছে, আর তখনই ধরমর করে বিছানায় উঠে বসি।আর শুতে পারিনা।এভাবে চলতে চলতে আমি কেমন জানি অসুস্থ হয়ে পরছিলাম।কি করব? তাই ভাবতে লাগলাম।
একদিন হুট করে মনে হল আমি বেঁচে থাকলে আমার হাজবেন্ড আর নতুন করে সামনে আগাতে পারবে না।নতুন করে বিয়ে করবে না।কি করব তবেকি সিমা ভাবীর মত আমিও সুইসাইড করব? চলে যাব তাকে মুক্তি দিয়ে?পরক্ষণেই নিজের জীবনের জন্য খুব মায়া হতে লাগল।আমার হাজবেন্ডকে মুক্ত করার জন্য আমাকে কেন সুইসাইড করতে হবে।অন্যকোন পথ অবশ্যই আছে।ভাবতে লাগলাম কি করব? বাবার বাড়ি ফিরে গেলে আমাকে আবার আমার হাজবেন্ডের নতুন সংসার দেখতে হবে।এটা আমার জন্য সহ্য করা কখনোই সম্ভব না।আর আমার দোষ নিয়ে যখন আমি আমার বাবার বাড়ি ফিরে যাব তখন তাদের আমার প্রতি আচরনের আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে।তখন আবার আমার সাথে সাথে আমার মায়েরও কষ্ট বাড়বে।তাই ঠিক করলাম যে আর যাই করি ওখানে আর ফিরে যাবনা।
ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম নিজের জীবনকে শেষ করে দিয়ে নয় নিজের জীবনকে নিজেরমত করে ভোগ করে এই সমস্যার সমাধান করব।বেশ কিছুদিন চুপচাপ নিজেই নিজের ব্যবস্থা করতে লাগলাম।এর জন্য আমার সব গহনাগুলো কাজে লাগালাম সাথে আমার হাজবেন্ডের ও বেশ কিছু টাকায় হাত দিতে হল।প্রায় দুই মাস কেটে গেল প্রসেসিং করতে করতে।শেষ পর্যন্ত সফল হলাম। হুমম আজ আমি এখন বাংলাদেশ বিমানে চড়ে উড়াল দিলাম আমার নতুন ঠিকানায়।এই খবর জানার পর অনেকেই বলবে নিশ্চয়ই নতুন কাউকে নিয়ে পালিয়েছি।কিছুদিন বেশ কিছু কানা ঘুষা চলবে,চলুক।তবুওতো আমার জীবনটা বেঁচে গেল! আমি বাচঁব,থাকনা আমার কিছু অক্ষমতা। তারপরও আমি বাঁচব।আমার জীবনকে নতুন করে সাজাব।অক্ষমতা ঢাকার জন্য জীবন কে শেষ করতে হবে কেন? আমি তাই নিজের জীবন নিয়ে পালালাম এমন এক ঠিকানায় যেখানে আমাকে কেউ চিনবে না।আমিও কাউকে চিনব না।
কোন রকন দ্বিধা ছাড়াই শান্তিতে শ্বাস নিতে পারব! প্রথম দিকে আমার মায়ের অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে, পরে সয়ে যাবে।কিন্তু এখানে থাকলে মায়ের চোখের সামনে ধুকে ধুকে কষ্ট পাওয়া দেখলে মা প্রতিদিনই কষ্ট পাবে।তার চেয়ে দুরে চলে যাওয়াই ভাল।যেখানে সিমা ভাবী শেষ করেছে আমি না হয় সেখান থেকেই আবার নতুন করে শুরু করব জীবন। শুধু একটা চিরকুট ছেড়ে গেলাম পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল পুরুষটার জন্য “যদি সত্যি সত্যিই ভালোবেসে থাকো, তাহলে কোন দিন খোঁজ করোনা।তুমি মুক্ত।আবার বিয়ে কর।সন্তানের বাবা হওয়া তোমার অধিকার।আমি সত্য গোপন করে শ্বাস নিতে পারছিলাম না।আমি সত্যি সত্যিই তোমার যোগ্য না,তোমার মত মনোবল আমার নাই।পার যদি ক্ষমা করে দিও।”জেসমিন।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা