পূর্ণতায় ভালোবাসা

পূর্ণতায় ভালোবাসা
অর্কের হাত ধরে বাবার সামনে নিজের ভালোবাসার কথা শিকার করতে আমার মোটেও শরীর কাপেনি ভয়ও লাগেনি। বরং বাবা যখন বললো,এই ছাগল নিয়ে দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে,এ কলঙ্কিত চেহেরাটা আমি আর দেখতে চাইনা। তখন আমি অর্কের হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।পিছনে ফিরেও দেখলাম না বাবা কি করছে না করছে। তারপর অর্কের সাথে চলে এলাম ঢাকায়।অর্কের তখনো চাকরি হয়নি। মাষ্টার্সটা শেষ করে একের পর এক ইন্টারভিউ দিয়েই চলছে কিন্তু কোথাও চাকরি হচ্ছে না।অর্ক তাই ওর সাথে ঘর ছাড়ার আগে একবার আমাকে বলেছিল,নীরা,তোমাকে আমার সাথে গেলে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হবে,তুমি বরং আঙ্কেলের পছন্দ করা ছেলেটাকে বিয়ে করে নাও।ওর অবস্থান তো বেশ ভালো, তোমাকে অনেক সুখে রাখবে।
অর্কের কথায় আমি অপমানে ডুকরে কেঁদেছিলাম।এমন করবো কেন?অর্থের সুখের লোভে আমি এই অসহায় মানুষ টাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাবো?এই নিষ্ঠুর চিন্তা আমি করতে পারেনি।ভালোবাসার শুরুতে তো কথা দিয়েছিলাম, সুখে-দুঃখে দু’জনে সমান অংশীদার হবো।তাহলে আজ শুধু টাকার জন্য আমি ওঁকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে শুধু নিজেই সুখের নৌকায় চড়ব কেন?আমি অর্কের হাত ধরে বললাম,ছেড়ে যাব বলেতো এই হাত ধরেনি, ঝড়-ঝঞ্ঝা একসাথে সামলে উঠে একসাথে হাসবো বলেই তো ভালোবেসেছি। অর্ক তখন বাচ্চাদের মতো করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমি সত্যি কোন ভুল মানুষকে ভালোবাসিনি।।তুমি শুধু আমার পাশে থেকে আমাকে অনুপ্রেরণা দিও,প্লিজ।বাকিটা আমি নিজেই সামলে নিব। সে ঘটনার পাঁচ বছর পার হয়ে গেলো।
অর্কের মতো অনাথ একটা ছেলের হাত ধরে সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।তখন অর্কের ছিলোনা থাকার মতো একটা বাড়ি,ছিলোনা কোন পয়সাকড়ি। ঢাকায় এসে বস্তুির মতো একটা স্যাতস্যাত বাসায় উঠেছিলাম।যে ঘরটা ছিলো একদম নোংরা বসবাসের জন্য অযোগ্য।অর্কের চাকরি না হওয়া পর্যন্ত আমরা সে ঘরে ছিলাম।অর্কের টিউশন করে চাকরির পড়াশোনা সম্ভব হয়নি বলে আমাকেও দুটো টিউশন করিয়ে এক বছর পর্যন্ত সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়েছিলো।তখনো বাড়ির সাথে আমার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।মাঝেমধ্যে আমি যোগাযোগ করতে চাইলেও বাবা গালাগাল করতেন বলে লাস্ট তিন বছর আর কোন ফোন করেনি।
তবে সেদিন দুপুরে নামাজ পড়ে শুয়েছিলাম।আমাদের বিয়ের পঁাচ বছর পূর্ণ হলো। বাবা-মায়ের কথা আজকাল খুব মনে পড়ে।ওনাদের দেখতে ইচ্ছে করে।ওনাদের কথা ভাবলে চোখে জল আসে।অর্ক আমার চোখের জল সহ্য করতে পারেনা বলে চুপিসারে কেঁদে যায়।এখন আমার ভালোবাসা আছে,টাকা আছে সরকারের দেওয়া গাড়ি আছে।অর্ক পুলিশ অফিসার হয়েছে।আমি যা যা চেয়েছিলাম অর্কের সবই হলো।কিন্তু আমার সুখ দেখে কেউ খুশি হয়ে হাসবে এমন কোন লোক থেকেও নেই।
ঠিক তখনই ডোরবেল টা বেজে উঠলো।চোখের জল মুছে দরজা খুলতে বেশ অবাক হলাম,এরকম অবেলায় অর্ক কখনো আসেনা কিন্তু আজ এসেছে বলে একটু ভয়ও পেলাম। আমাকে অবাক হতে দেখে অর্ক কেমন হলো সারপ্রাইজ বলে সরে দাড়াতে বাবা-মা দু’জন কে দেখতে পেলাম। বাবা-মা আমার ঘরে ডুকতে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো এতো খুশি হয়েছিলাম যে,বাবা-মায়ের সামনে অর্ককে জড়িয়ে ধরে খুশিতে কেঁদে দিয়েছিলাম। আমার ঘাড়ে টপ করে একফোঁটা জল পড়তে বুঝলাম অর্কও কাঁদছে।বললাম, কি করে রাজি করালে,বাবার তো যে রাগ, তুমি বললে আর বাবা চলে আসলো এমন না।
–কিডন্যাপ করেছি।,অর্ক বলল। সত্যি করে বলো অর্ক।
–বারে,পাঁচ বছর ধরে যে মেয়েটা আমার জন্য নিজের কষ্টগুলো লুকিয়ে সব ছেড়ে আমার ঘরে পড়ে রয়েছে,তার মুখে হাসি ফুটাতে তার প্রিয় জিনিসগুলো আমি যেভাবি পারি ফিরিয়ে আনতে পারবোনা ভাবলে কি করে?
বাবা খাঁকারি দিতে অর্ক কে ছেড়ে বাবার কাছে ছুটে গেলাম।এই মানুষটার মন ভালো করা স্নেহময়ী স্পর্শটা কতোদিন মিস করেছি আমি।পালিয়ে আসার পূর্বে প্রতিদিন আমার চুলে যার হাতের স্পর্শ না পেলে ঘুম আসতো না,আমার সেই ঘুম পাড়িয়ে দেয়া বাবা।বাবা এবার আমাকে তাড়িয়ে দিলেন না,বুকে টেনে নিয়ে ডুকরে কেঁদে দিলেন। বললেন, অভিমান আমার হয় না বুঝি?
আমি কি করে বাবার কাছে ক্ষমা চাইবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আসলে,গত পাঁচ বছরে এমন খুশি আমি আর কোন সময় হত পারেনি। আমাদের পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী তে অর্ক আমাকে সেরা উপহার টা দিলেন। বাবা-মা ছিলো আমাদের বিয়ের প্রধান অতিথি। এর আগের বিবাহ বার্ষিকীগুলোতে অর্কের প্রতি আমার ভালোবাসা থাকলেও ছিলোনা নিজের মনের কোন সুখ।বাবা-মাকে কষ্ট দিয়ে নিজের ভালোবাসা কে জিতিয়েছি বলে মনেমনে অপরাধবোধ কাজ করতো সবসময়।সংসারে মন বসতো না তেমন। বাবা-মা আসাতে এই প্রথম আমি ভালোবাসা, আনন্দ এবং সুখী সংসারের পূর্ণতা নিয়ে বিবাহ বার্ষিকীর কেক কাটলাম। বাবা-মায়ের পায়ে পড়ে ক্ষমা চেয়ে দুয়া করতে বলে নতুনভাবে সংসার শুরু করলাম।
সেদিন খাওয়া-ধাওয়া শেষে রাতের বেলা বাবা-মা চলে যাওয়ার আগে বাবা আমাকে অর্কের তাদের এখানে নিয়ে আসার রহস্য সম্পর্কে বললেন, ভুল মানুষকে পছন্দ করিসনি মা।যে তোর মুখে হাসি ফুটাতে এতো বড় অফিসার হওয়ার পরেও সামান্য একজন মানুষের পায়ে পড়ে তোর অপরাধের জন্য কেঁদেকুটে বাবার পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে পারে সে আসলে সত্যি তোকে ভালোবাসে।তুই ওকে দেখে রাখিস।দোয়া করি যেন তোরা সুখী হোস।বাবার কথায় অর্কের জন্য আমার সেদিন আরো বেশি খারাপ লেগেছিল। ওনারা বিদায় নিতে ছুটে এলাম অর্কের কাছে।
জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে জিজ্ঞেস করলাম, বাবার পায়ে পড়ে কেঁদে কুটে নিজের সম্মান বিসর্জন দিয়ে ওদের এখানে কে নিয়ে আসতে বলেছিল বল?
উত্তর এলো,নীরা,তুমি আমার জন্য নিজের সবটুকু বিসর্জন দিয়ে কোথায় পড়ে রয়েছ,আমি কষ্ট পাব বলে একদিনও বাবা-মায়ের কথা মুখে আনলেনা। আমি না দেখার মতো করে নিরবে কেঁদে গেলে রোজ।তুমি কি ভুলে গিয়েছিলে?যেদিন তোমার হাত ধরেছিলাম,ওয়াদা করেছিলাম সুখে-দুঃখে দু’জনে সমান অংশীদার হবো।ত্যাগ করলেও দুজন সমান করবো।তুমি তো তোমার সারাজীবন ত্যাগ করে দিলে আমার জন্য,আমি না হয় তোমার কষ্টগুলো কাঁধে নিয়ে নিজের সামান্যটা বিসর্জন দিলাম।
আর বড়দের কাছে নিজের অপরাধের জন্য পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে কি দোষ বা লজ্জার বলো? ওরা ক্ষমা করেছে বলেতো আমি আমার পাঁচ বছর আগের নীরা কে ফিরে পেয়েছি। আগে তোমার মুখের হাসিটার দিকে তাকালে মনে হতো তুমি সুখী নেই নীরা,এখন থেকে আমাকে আর তোমার মুখের হাসিতে আর সন্দেহ নিয়ে তাকাতে হবেনা।যখন দেখবো সত্যিকারের একটা হাসিমুখ দেখবো।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত