কালো পরী

কালো পরী
বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে,কুচকুচে কালো একটা মেয়ের সাথে।যাকে দেখলেই আমার গা ঘিন ঘিন করতো।
মেয়েটার নাম, ‘পরী।আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় প্রচলিত একটা কথা আছে,’শাল নাই কুত্তার আবার বাঘা নাম।যেই না চেহারা আবার নাম রাখছে পরী।যাজ্ঞে,এভাবে বলা বোধহয় ঠিক হয়নি। একটা মানুষকে কখনোই কোন প্রাণীর সাথে তুলনা করা যায় না।কারণ,মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব।’ পরীর এই পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ নাই।বাবা জন্মের আগেই মারা গেছে।আর মা, জন্মের নয় মাস পর জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।মানুষ হয়েছে আমার ফুফুর কাছে।পরীর মায়ের নাম ছিলো,আলেয়া খাতুন।আমার ফুফুর বাড়িতে ছোটা কাজ করতো।ধান সিদ্ধ করা, সুখানো,ঝেড়ে দেওয়া, থালাবাসন ধোঁয়া, ঘর পরিষ্কার করা এইসব করতো।’
পরীর মা আলেয়া খাতুনের জন্ম হয় খুবই নিম্নবিত্ত পরিবারে।বাবা দিনমজুরের কাজ করতো।রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করে যা পেতো তাই দিয়ে সংসার চলতো।এতটাই করুণ ছিলো যে,একদিন কাজ না করলে উপোস থাকতে হতো।’ মেয়ে বড় হবার সাথে সাথে দিনমজুর বাবা রমিজ মিয়ার মাথায় বাজ পরে।বয়স হয়েছে শরীরে শক্তি সামর্থ্য তেমন একটা নাই।একদিন কাজ করলে তো অন্যদিন বসে থাকতে হয়।সংসার চালাতেই খুব কষ্ট হচ্ছে তাঁর।তার মাঝে মেয়ে বড় হয়ে গেছে,বিয়ে সাদি দিতে হবে।অনেক খরচার ব্যাপার।তাছাড়া আজকাল তো আর যৌতুক ছাড়া বিয়ে হয় না।কী করবেন তিনি?চিন্তায় তার ঘুম আসে না।’
আলেয়ার বিয়ে হয়,পাশের গ্রামের ভ্যান চালক সবুজের সাথে।বাবা-মা,ভাই-বোনদের ছেড়ে আসার কারণে আলেয়ার মনে দুঃখের ঝড় উঠে।আবার স্বামী সংসার পেয়ে মনে সুখের জোয়ার উঠে।সুখ-দুঃখ সব মিলিয়ে আলেয়ার বিবাহিত জীবন বেশ ভালোই চলছিলো।কিন্তু,বিষাদে বলি সে ঘনঘটা বেশ।মানব জীবনে সুখ কখনো চিরস্থায়ী হয় না।বহু প্রতিক্ষার পর সুখ আসে আবার অল্প সময় বিচরণ করার পরই চলে যায়।’ বিয়ের সাড়ে সাত মাসের মাথায় আলেয়ার স্বামী ভয়ানক সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায়।তখন সে দুই মাসের (পোয়াতি)অন্তঃসত্ত্বা।এমন সময় স্বামীর অকাল মৃত্যুতে তাঁর জীবনে ভিবিশিকাময় অন্ধ্যকার নেমে আসে।নিভু নিভু জ্বলা এক মোমবাতির মত।হটাৎ ধমকা হাওয়াই নিভে যেতে পারে কিংবা গলে নির্শেষ হয়ে যেতে পারে।’
আলেয়া ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলো না কী করবে সে।বাবার বাড়িতে ফিরে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।তাছাড়া এখানেও এমন কেউ নেই যে,তাকে দু’বেলা দুমুঠো আহার করাবে।অবশেষে জীবিকার তাগিদে পেঠে সন্তান নিয়েই জীবন সংগ্রামে নেমে পরে।পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ছোটা কাজ করতে শুরু করে।তবে সেটা বেশিদিন কুলিয়ে উঠতে পারেনি।ইতিমধ্যে তাঁর প্রেগনেন্সির সাত মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে।এমন অবস্থায় কাজ করবে তো দূরের কথা,দু’কদম হাটতেও তাঁর ভীষণ কষ্ট হয়।’
আমার ফুফু আবার খুব কোমল হৃদয়ের মানুষ।অসহায় মানুষের কষ্ট দেখে একদম সহ্য করতে পারেন না।আলেয়ার এমন করুণ অবস্থা দেখে তাঁর হৃদয় হু হু করে কেঁদে উঠে।নিজের ইচ্ছাতেই আলেয়াকে দেখাশুনার দ্বায়িত্ব কাঁদে তুলে নেন।’ ফুফা মারা যাবার পর ফুফুকে আমরা অনেক জোরাজুরি করেও আবার বিয়ে করতে রাজি করাতে পারিনি।তাঁর কথা মতে,মেয়েদের বিয়ে নাকি একটাই।গো ধরে বসে,একাকী জীবন পার করতে পারবে।যাজ্ঞে,আলেয়াকে পেয়ে ফুফুর ও একজন সঙ্গী হলো।আর আলেয়াও আশ্রয়স্থল খুঁজে পেলো।
আলেয়ার মেয়ে সন্তান হয়েছে তবে,দেখতে একটু কালো।তাতে কী মায়ের কাছে কালো মেয়েরাও পরীই হয়।তাই আলেয়া শখ করে নাম রাখে, পরী।কালো পরী।যাতে কেউ কালো বললে সাথে পরী শব্দটা যোগ করতে হয়।’
আলেয়া মারা যাবার পর পরীকে ফুফুর কাছেই রেখে দেন।নয় মাসের শিশু কোথায় রেখে আসবে?তাছাড়া ফুফুর ও কোন সন্তান নেই।তাই পরীকে নিজের মেয়ের মতই আদর যত্ন ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করেছে।মেট্রিক পর্যন্ত পড়াশোনাও করিয়েছে।’ ফুফু এখন মৃত্যু শয্যায়।বাবাকে ডেকে বলে,’তিনি তাঁর সব সহায় সম্পত্তি পরীর নামে লিখে দিতে চান।আর পরীকে বিয়ে দিয়ে শান্তিতে মরতে চান।আমার বাবা মনে মনে চিন্তা করে এটাই সুযোগ, হাত ছাড়া করা যাবে না।আসলে আমার বাবা ফুফুর সম্পত্তিটা হাত ছাড়া করতে চাচ্ছিলেন না।তাই পরীর সাথে আমার বিয়ের কথা পাকা করে ফেলে।’
পরিবারের চাপে পরীকে বিয়ে করলেও,মন থেকে মেনে নিতে পারিনি।এক বিছানায় ঘুমালেও ওর দিকে তাকাতে ইচ্ছে হতো না আমার।সবসময় মনে হতো আমার পাশে একটা ছায়ামূর্তি শুয়ে আছে।যার প্রতি মানুষের কোন ইন্টারেস্ট জাগে না।’ ওকে বিয়ে করে আমার বাড়ি থেকে বের হওয়া দায় হয়ে পড়েছে।বন্ধু-বান্ধবরা আমায় দেখলেই বলে,’কী করে আলম?টাকার লোভে শেষ পর্যন্ত একটা কুৎসিত কালো মেয়েকে গাড়ে ঝুলিয়ে নিলি।ওদের ধাড়ালো কথা গুলো শুনে আমার খুব খারাপ লাগতো।আবার প্রচন্ড রাগও হতো।সব রাগ এসে ঝাড়তাম পরীর উপর।মাঝে মধ্যে অকারণে গায়েও হাত তুলতাম।ও সবকিছু মুখ বুঝে সহ্য করে নেয়।কিচ্ছু বলে নাহ।কোন প্রতিবাদ করে না।হয়তো ধরে নিয়েছে কালো মেয়েদের ভাগ্যে এটাই থাকে।’
পরীর শুধু গায়ের রংটা ছাড়া অন্যসব কিছুতেই ভালো।স্বভাব, চরিত্র, আচার,ব্যাবহার খুব ভালো।বাড়ির সব কাজ ও একাই করে।সবার প্রতি খুব খেয়াল রাখে।অল্প কয়দিনে সবার মন জয় করে নিয়েছে শুধু আমি ছাড়া।অবশ্য আমি প্রতি খুব কেয়ারফুল।যখন যেটা প্রয়োজন বলার সাথে সাথে হাজির।কোন অভিযোগ রাখতে দেয় না।বলতে গেলে আমার মন জয় করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।কিন্তু আমি এসবে পাত্তা দেই না।কখনো কোনদিন জিঙ্গেস করিনি ওর কিচ্ছু লাগবে কি-না, কিংবা নিজের ইচ্ছেও কোনদিন পঁচিশ টাকা দামের একডজন চুড়ি কিনে এনে দেইনি।
আমার উপর ওর শত অভিযোগ থাকলেও মুখ ফুটে বলার সাহস পায়নি।’ মাঝে মধ্যে লক্ষ করতাম, মেয়েটা ভোর রাতে বিছানা ছেড়ে উঠে যায়।তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে।নামাজ মোনাজাতে ওর ফুঁফিয়ে কান্নার আওয়াজ শোনা যেতো।অস্পষ্ট স্বরে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতো।কথা গুলো শুনতে না পেলেও, বুঝতে অসুবিধে হতো না আমার। শুনেছি,কোন বান্দা-বান্দী যদি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে দুফোটা অশ্রু বের করে দেয় তাহলে সে চোখের পানি কখনো বিপলে যায় না।হয়তো এটাই তাঁর ফল।’
হটাৎ করে আমার মনটা কেমন নরম হয়ে যায়।মনের মধ্যে ধারণা আসে,আমি যেটা করছি একদমই ভুল।গায়ের রং দিয়ে মানুষ বিবেচনা করা যায় না।কারণ,আল্লাহর সৃষ্টি সবই সুন্দর আর মানুষ তো সৃষ্টির সেরা জীব।’ আমার মধ্যে অনুশোচনা আসে।বাহ্যিক সৌন্দর্যের মোহে পরে প্রকৃত সুন্দর মনের একটা মানুষকে এতদিন কষ্ট দিয়েছি।’ মনের মধ্যে থাকা অনুশোচনাটা ধীরে ধীরে পরীর প্রতি ভালোবাসার জন্ম দেয়।নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছি কালো পরীটাকে।কথা দিচ্ছি কোনদিন কোন কষ্টের আঁচ লাগতে দিবো না তাঁর গায়ে।’
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত