“সাবধানে বাসায় যাও। বাসায় গিয়েই আমাকে কল দিবা ঠিক আছে। ওরনা সামলে বসবা। যাওয়ার পথে কোনো দরকার হলেই আমাকে কল দিবা ঠিক আছে।”
“ঠিক আছে। এত টেনশন কর না তো। সাবধানে বাসায় যাও। গিয়ে খেয়ে নিবা কেমন।”
“তুমি একা একা বাসায় যাবে আর আমি টেনশন করব না তা কি করে হয় বল। আমি যাই না তোমার সাথে। তোমাকে বাসায় পৌছে দিয়েই চলে আসব। কেউ দেখবে না।”
“না গো আসতে হবে না। বাসায় যাও তুমি স্নেহা বাসায় একা আছে। আমি যেতে পারব তো।”
“আচ্ছা ঠিক আছে যাও তাহলে। গিয়ে কল দিও। অপেক্ষায় থাকব আমি।”
“ঠিক আছে যাচ্ছি। একি শার্টের কলার উঠাচ্ছো কেনো।”
“ইয়ে আমার ভালো লাগে আর কি।” নওরিন শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলল,
“একদম এমন করবে না আর। বাজে লাগে এমন করলে বুঝেছো? এই নাও আমি ঠিক করে দিলাম। আমি যাওয়ার পর শার্টের কলার উঠাবা না কিন্তু বলে দিলাম।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
“আমার বাস চলে এসেছে নিহান আমি যাই। “
“উহহ কতবার বলেছি যাই বলতে নেই বল আসি।”
“তুমিও না নিহান। আচ্ছা আসি। ঠিক আছে এখন?”
” একদম ঠিক আছে। যাও, সাবধানে যেও।”
“ঠিক আছে।”
নওরিন কথাটা বলেই বাসে উঠে গেল। নিহান নওরিনকে বসিয়ে দিয়ে বাস যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ বাসের দিকে তাকিয়ে রইল। বাসায় বোন একা না থাকলে নওরিনকে একা যেতে হত না। নওরিনের বাস ভিড়ে মিলিয়ে যেতেই নিহান দ্রুত পায়ে বাসায়পৌছায় গিয়ে দেখে বোন দুপুরের রান্না শেষ করে টিভি দেখছে। ভাইকে দেখতেই এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত এনে ভাইকে দিল। নিহান সোফায় বসে শরবতটা খেয়ে নওরিনকে কল দিল। আকবার রিং হতেই নওরিন কল রিসিভ করে ফেললো।
“হ্যালো, বাসায় পৌছে গেছ?”
“বাব্বা ফোন হাতেই ছিল মনে হচ্ছে।”
“তুমি কল করবে জানতাম তো তাই ফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম।”
“ইশশশ তাই না।”
“জি তাই। এখন বলো পৌছে গিয়েছ কিনা।”
“হ্যা এই মাত্রই পৌছলাম।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন যাও গোসল করে খেয়ে নাও। ততক্ষণে আমি পৌছে যাব।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।” নিহান ফোন রেখে গোসল করতে গেল। গোসল শেষে এসে বোনকে খাইয়ে দিচ্ছিল,
“ভাইয়া নওরিন আপুকে আজ তুমি বাসায় দিয়ে আসলে না কেন?”
“তুই যে বাসায় একা ছিলি বোন। তোকে এভাবে রেখে কি যাওয়া যায় বল। তোর নওরিন আপুও বলল তোর কাছে থাকতে।”
“ওহ আচ্ছা তাই না!”
“হ্যা তাই।”
“ভাইয়া তুমি আপুকে বিয়ে করবে কবে?”
“তোমার আপুর পড়াশোনা শেষ হবে এই বছর, আমরা আগামী বছর বিয়ে করব। “
“ইয়েয়ে কি মজা।”
“হ্যা অনেক মজা এখন খেয়ে নাও।”
নিহান নয়নাকে খাইয়ে দিয়ে নিজে খেয়ে নিল। খেয়ে অপেক্ষা করতে থাকল আর বিড়বিড় করতে থাকে নওরিনের কলের এতক্ষণে তো ওর পৌছে যাওয়ার কথা তবে এখনো কল এল না কেনো?
“ভাইয়া তুমি কল দাও তাহলেই তো হয়।”
“ঠিক বলেছিস। এই কি রে তুই আমার কথা শুনতে পেয়েছিস কি করে।”
“এত জোরে বিড়বিড় করলে তো শুনতে পাবই।”
“আচ্ছা হয়েছে হয়েছে।”
নিহান নওরিনকে কল দিল রিং হচ্ছে, হতে হতে একসময় কল কেটে গেল কিন্তু নওরিন কল রিসিভ করল না। নিহান আবার কল দেয় কিন্তু এবারও কেউ ধরল না। এভাবে দিতে দিতে ৩০ বারের উপরে কল দিয়েছে নিহান কিন্তু নওরিন কল ধরেনি। নিহানের এবার ভিষণ চিন্তা হতে থাকে। ঘরের মধ্যেই পায়চারি করতে থাকে নিহান। কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। নওরিন কি বাসায় পৌছালো, নাকি না। নওরিনের বাসার কারো নাম্বারও নিহানের কাছে নেই।
নয়না ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে ভাইকে বুঝানোর চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু নিহান কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না। সন্ধা হয়ে গেছে এখনো নওরিনের কোনো কল নেই। নিহান নওরিনের পরিচিত সব বন্ধু বান্ধুবির কাছে নওরিনের কথা জিজ্ঞেস করে ফেলেছে কিন্তু এখনো কোনো খবর পায় নি। নিহানের চিন্তা হচ্ছে খুব। একে ওকে জিজ্ঞেস করতে করতেই রাত ১১ টা বেজে গেছে। নিহানের মাথা কাজ করছে না এখন। নয়না নিহানকে ধরে বসে আছে। ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে নয়নাও কাদছে আর প্রার্থনা করছে যেনো কোনো একটা খবর আসে। সকাল ৮ঃ২৫ । সারা রাত নিহানের চোখে ঘুম আসে নি। ওর পাশেই বসে নির্ঘুম রাত্রি পার করেছে নয়না। এখনো ভাইয়ের পাশেই বসে আছে। আজ স্কুলে যায় নি নয়না। ভাইকে রেখে একা যাওয়া যায় নাকি!এমন সময় নিহানের ফোন বেজে উঠলো। নওরিনের বেস্ট ফ্রেন্ড রোদেলা কল দিয়েছে। প্রায় সাথে সাথে ফোন রিসিভ করে ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“হ্যা হ্যা রোদেলা বল কোনো খবর পেলে?”
“হ্যা ভাইয়া ওর ভাই মাত্রই ফোন করে বলল।”
“কি বলেছে তাড়াতাড়ি বল। নওরিন কোথায় ও কেমন আছে?”
“আসলে ভাইয়া”
“উফফ, হেয়ালি করছ কেন রোদেলা? বল না নওরিন কোথায় ও কেমন আছে?”
“আপনি ওর বাড়ির কাছে চলে আসেন এখনই, সব বুঝতে পারবেন।”
“কিন্তু তুমি বল কি হয়েছে ওর।”
“ভাইয়া আপনি চলে আসেন।”
“কিন্তু রোদেলা হ্যালো হ্যালো রোদেলা রোদেলা কল কেটে দিয়েছে। নয়না ছলছল নয়নে নিহানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
“ভাইয়া কি হয়েছে? আপু কেমন আছে।”
“জানি না বোন, রোদেলা বলল এখনই নওরিনের বাসায় যেতে। আমি বের হই কেমন।”
“আমিও যাব। আমাকে রেখে যেও না আমার অনেক চিন্তা হবে।”
“ঠিক আছে চল।” দুই ভাইবোন উস্কখুস্ক অবস্থা নিয়েই বেরিয়ে পড়ল। লক্ষ্য একটাই নওরিনের বাড়ি।
নওরিনের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেল অনেক ভিড়। ভিড় ঠেলে ভিতরে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ল খাটিয়ার উপর সাদা কাপড়ে মোড়া মুখ ঢাকা এক লাশ। নিহান কি করবে বুঝতে পারছিল না। এ লাশ কার তাও বুঝতে পারছিল না। কাউকেই সে চিনে না কাকে কি জিজ্ঞেস করবে। এমন সময় উপর থেকে রোদেলা নিহানকে দেখতে পেয়ে নিচে আসে। “রোদেলা এসব কি? নওরিন কোথায়? আর কে মারা গেছেন, নওরিনের পরিবারের কেউ?” নিহানকে দেখে রোদেলার চোখের বাধ যেনো ভেংগে গিয়েছে। রোদেলা ভেবে পাচ্ছে না যে কীভাবে বলবে নিহান কে যে নওরিন আর নেই। নিহান কীভাবে নিতে পারবে। নিহান যে নওরিনকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। “আহা রোদেলা কি হয়েছেটা কি তোমার। বল না নওরিন কোথায়। ওকে একবার দেখতে চাই। ওর কোনো খবর পাচ্ছি না ভালো লাগছে না একদমই।প্লিজ ওকে একবার ডেকে দাও। আমাকে দেখলে ওর ও ভালো লাগবে। “
রোদেলা নিহানের হাত ধরে নিহানকে খাটিয়ার সামনে নিয়ে আসে। নিহানের বুক জোরে জোরে ধড়ফড় করতে থাকে। রোদেলা ধীরে ধীরে লাশের মুখ থেকে সাদা কাপড় সরায়। নিহান দেখতে পায় নওরিন শুয়ে আছে। নওরিনের ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেধে আছে। মুখের বিভিন্ন জায়গায় কেটে গেছে। অত সুন্দর নওরিনের গাল গুলো কেটে কেটে বিভৎস হয়ে গেছে। গলার চেইন পেচানোর দাগ। নাক থেকে রক্ত পড়ে তা জমাট বেধে কালো হয়ে গিয়েছে। এই কি সেই ৪ বছর আগের দেখা নওরিন? এই কি গত কালকের দেখা নওরিন যাকে নিহান বাসে তুলে দিয়ে এল। হ্যা এই তো সে। তার এমন অবস্থা হল কি করে। নিহান নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বার বার নিজের চোখ কচলিয়ে কচলিয়ে দেখছে নওরিনকে। নয়না নওরিনকে ধরে কাদছে। নিহান পাথর হয়ে গিয়েছে। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে রোদেলার দিকে তাকায় নিহান।
“গতকাল বাসায় আসার সময় কয়েকজন ওকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করে। ওর ভাই ওকে খুজে বাসায় ফিরার পথেদেখতে পায় কয়েকজন ওকে রাস্তার পাশের ঝোপে ফেলে দিয়ে গাড়ি করে চলে গেলেন। প্রথমে ওর ভাই বুঝতে না পারলেও সামনে গিয়ে দেখে এটা নওরিন।” নিহান থমকে গেছে। এক নজরে তাকিয়ে আছে নওরিনের মায়াবী মুখটার দিকে। কতই না কষ্ট পেতে হয়েছে ওকে। কত করে বলেছিল নিহান যে ওকে দিয়ে যাক। নিহান দিয়ে গেলে কি আর এমনটা হতে দিত নিহান। হঠাৎ নিহান নওরিনের হাত বুকে ধরে হাউমাউ করে কেদে উঠে আর নওরিনকে উঠতে বলে।
“নওরিন উঠ। উঠ নওরিন। এভাবে চলে যেতে পার না তুমি। দেখ একবার আমাকে। একটাবার দেখ নওরিন। নওরিন আমাকে একা রেখে এভাবে স্বার্থপরের মত চলে যেতে পার না তুমি। এই নওরিন এই। আমার সাথে কথা বলতেসো না কেন আমার সাথে। কথা বল নওরিন কথা বল।” নিহানের গগনবিদারী চিৎকারে পুরো বাড়ি থমকে গেছে এত ভালো ও কেউ কাউকে বাসতে পারে। নওরিনকে কবর দিয়ে আসা হল নিহান কবরের পাশ থেকে আসতে চায় নি নওরিনের ভাই নিহানকে জোর করে নিয়ে এসেছে। নিহানের কথা সে অল্প অল্প জানতো। এখন ঠিক ভাবে জানতে পেরেছে। বোন বেচে থাকলে এই ছেলের জন্য না কখনোই করতে পারত না। নিহান একদম চুপ হয়ে গেছে। কোনো কথা বলছে না কেবল চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। নিহান এখনো মানতে পারছে না যে নওরিন আর নেই।
এভাবে তার ভালোবাসা অসমাপ্ত রয়ে গেল। নয়না আসে ভাইয়ের কাছে এসে ভাইকে বুঝি বাড়ি নিয়ে যায়। নওরিনের মৃত্যুর ২২ বছর হয়ে গেছে। নওরিনের অপরাধীরা আজ কারাগারে বন্দি। কেস নিহানই লড়েছিল এবং জয়লাভ ও করেছে। নিহান আজও নওরিনকেই নিজের সব ভাবে। নওরিনের স্মৃতি নিয়ে সে এতগুলো বছর পাড় করেছে। এত বছরে এমন একদিন যায় নি যেদিন নিহান নওরিনের কাছে যায় নি। এখন সে তৈরি হচ্ছে নওরিনের কাছে যাওয়ার জন্য। আজ তাদের সম্পর্কের ২৬ বছর হল। মেরুন রংয়ের শার্ট পরে হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ নিয়ে সে চলেছে নওরিনের কাছে একসাথে এই দিনটা কাটানোর জন্য।
“নয়না এই নয়না।”
“আসছি।”
“আমি এখন যাই। তুই ১ ঘন্টা পর কেক এর ডেলিভারি নিয়ে চলে আসিস কেমন। মা ও মা”
“চেচাতে হবে না আব্বাজান আমার রান্না প্রায় শেষ তোরা আসার আগেই আমি সব রেডি করে রাখব।” নিহান বেরিয়ে গেলো। লক্ষ্য আজকেও একটাই নওরিন। নওরিনের সাথে দেখা করে পথশিশুদের নিয়ে নওরিনের কবরাস্থানের পাশে বসে কেক কাটবে তারপর তাদের বাসায় নিয়ে গিয়ে বিরিয়ানি খাওয়াবে। নওরিন যতদিন ছিল ও এটাই করেছে। তাই নিহান আজও এটা করেই চলেছে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা