মেয়েটির গালে বসন্তের দাগে ভরপুর ছিলো, আয়নার সামনে দাঁড়াতেই ঘেন্না লাগতো নিজের প্রতি। নিরুপায় হয়ে যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হতো, তখন পাড়ার ছেলে মেয়েরা বলতো বসন্ত আপু যাচ্ছে; তখন কষ্ট হতো ভীষণ কষ্ট।
মেয়েটির বয়স যখন সাতাশ অথচ বিয়ে হচ্ছে না, তখন পাড়ায় নতুন প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে। তখন বসন্ত আপু নয়, বসন্ত বুড়ি বলে আক্ষা করা হয়েছে।
দিন শেষে চারপাশ যখন অন্ধকার তখন ঘরের দ্বারে কপাট দিয়ে অশ্রুবিসর্জন করা ছিলো মেয়েটির নিত্যক্রিয়া।
মধ্যরাতে যখন সারাদিনের অবহেলা গুলো মনে পড়তো তখন ঝার্নার মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়তো। একদিন সকালে মেয়েটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বসন্তের দাগ গুলোতে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলো, এই জন্যই এতো অবহেলা? হঠাৎ মেয়েটির ভাবি এসে বললো হয়েছে হয়েছে, আর মুখ দেখতে হবে না, কেউ কুড়িয়েও নেয় না। কেন এমন আপদ আমাদের ঘাড়ে? মেয়েটি জবাব দেয় না নিঃশব্দে কেঁদে যায়। তারপর যখন বয়সটা ত্রিশের কাঁটায় এসে পড়ে, তখন ভাবি বলে জনমটা বোধ হয় এখানেই যাবে। দু’পায়সার চাকরী করে তোমার ভাই, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে পারছিনা এর ওপর তোমাকে অন্ন গেলাতে হয়। মেয়েটি মাথা নিচু করে থাকে, যেন এ জীবনে সে ব্যর্থ। একদিন মেয়েটির ভাই তাকে ডেকে পাঠায়। মেয়েটি বসে আছে খেজুরের পাতা দিয়ে বানানো পাটিতে।
—মেয়েটির ভাই আমিনুল বললো বোন আর কত পারা যায় বলতো? দেখতে দেখতে ত্রিশটা বছর পেরিয়ে গেলো। আমিও আর পারছি না, দিন শেষে তোর ভাবির উৎপাত আর ভালোলাগেনা।
—মেয়েটির ভাবি আয়শা বলে আমি আর পারছি না, এটা না বলে বলো বাড়ি থেকে বিদায় হতে।
—পাশের ঘরের লোকজন শোরগোল শুনে আমিনুলের ঘরে আসলো।
তারপর অনিলাকে বললো একজন মানুষ বেশী মানে অনেক খরচ বাপু, কয় পয়সা ইনকাম তোমার ভাইয়ের?
—অনিলা জবাব দেয় না জাস্ট মাথা নিচু করে থাকে।
—আয়শা বেগম বললো এবার তোমার পথ তুমি খুঁজে নেও, তা না হলে স্রেফ কথা এ বাড়িতে হয় আমি থাকবো নয়তো তুমি।
অনিলা নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কোথায় থাকবে কি খাবে এসব অনিলার ভাবনায় নেই, অনিলা ভাবছে কি নিয়ে সে বেঁচে থাকবে? কেন এই জীবন? তারপর বাঁচার সুবাদে অনিলা নেমে পড়ে পাথর ভাঙার কাজে, দিনশেষে খাওয়া-দাওয়া মিটে যায় সেই টাকায়। এভাবে অনিলা লক্ষ্যহীন ভাবে বাঁচতে থাকে। তার জীবনে শুধু একটাই প্রাপ্তি জাস্ট প্রাণটা ধরে রাখা। একদিন অনিলা অসুস্থ শরীর নিয়ে পাথর কাটতে আসলো, এছাড়া কোন উপায় যে ছিলো না। সেদিন দুপুরে যখন কড়া রোদ ছড়ায় তখন অনিলার শরীর ভেঙে আসছে ক্লান্তিতে। ক্লান্তির প্রতিফল ঘটে যায়, হঠাৎ অনিলা জ্ঞান হারায়। অনিলার করুণ দুর্গতি দেখে, শফিক এগিয়ে আসে। শফিকও এখানে পাথর কাটে। শফিক তাঁর ছোট্র কুঁড়েঘরে অনিলাকে নিয়ে আসে। শফিক ভাবলো আজ আর কাজে যাওয়া যাবে না। তারপর শফিক করাতিয়া নদীর শীতল জল এনে অনিলার বসন্তের দাগে ভরা মুখে মারে।
—অনিলা জেগে উঠে বলে এখানে আনলেন কেন?
—শফিক বললো এছাড়া অন্য কিছু করার ছিলো না, তাছাড়া আমি আপনার বাসাও চিনি না।
—অনিলা বললো আমার বাসা নেই। একটা ভাড়া বাসায় থাকি আমি একা।
এভাবে শফিকও অনিলার কথা হতে থাকে। শফিক অনিলার সব কিছু শুনে অনিলার ওপর ভীষণ মায়া পড়ে। অনিলা একদিন পাথর কাটতে আসেনি, সেদিন শফিক পায়চারী করতে থাকে, ছটফট করতে থাকে, শফিকের কাজে মন বসছে না। শফিক ভাবলো এটা কি? ছটফটের নাম কি? এটাই কি ভালোবাসা? শফিক সাহস করে একদিন বলে দিলো ভালোবাসি। অনিলা বললো এটা হয় না। শফিক বললো কেন হয় না?
অনিলা বললো আমার দিকে তাকিয়ে দেখেছো কখনো? শফিক বললো প্রয়োজন নেই, কারন ভালোবাসা চোখের দৃষ্টি দিয়ে হয় না, মনের দৃষ্টি লাগে। অনিলা জবাব দেয় না। তারপর শফিক অনিলার হাত ধরে বলে থাকতে দেবে আমায় সারাটা জীবন? অনিলা মাথা নিচু করে থাকে। শফিক অনিলার মাথা তুলে বসন্তের দাগের উপর চুমো খেয়ে বুঝিয়ে দেয় ভালোবাসা জিনিসটা সবার জন্য আসেনি। সবশেষে শরৎচন্দ্রের কথাটাই সত্য হয়ে গেলো। কপালের যেখান টায় বসন্তের দাগ ছিল, সবাই চোখ ফিরিয়ে নিত ঘেন্নায়। সেখান টায় চুমু খেয়ে বুঝিয়ে দিতে হয়, ভালোবাসা জিনিস টা সবার জন্য আসেনি।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা