পৃথিবীতে কিছু কিছু অনুভুতি আছে যে অনুভূতি গুলো সহজে কাউকে বলা যায় না । প্রেম-ভালবাসার অনুভুতির গুলো মনে হয় সে রকম কিছুই । আসলে এই অনুভূতি টুকু যে প্রেমে পড়েনি , সে বাদে আর কেউই বুঝবে না ।
“ভালবাসা” – শব্দটাতো ছোটই, কিন্তু বিষয়টি কি তেমনই সহজ এবং ছোট ! ভালবাসা ভিন্ন কিছু –অনেক বড় ও বিশাল কিছু। হয়তো ভালবাসা কখনো ভীষণ ঝড়ের মুখোমুখি একা দাঁড়িয়ে থাকা । হয়তো ভালবাসা কখনো কারো জন্য খামোখাই কষ্ট পাওয়া নাকি অন্য কিছু ? এতো বুঝিয়ে বলার বা লেখার মত কিছু নয়; এতো বোঝানোর বিষয় নয়। ভালোবাসাটা বোধহয় সব সময় একজনেরই আলাদা ব্যপার । একজনই ভালোবাসার নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে । দু’জনের মিলিত জীবনের পক্ষে ভালোবাসার মূল্য তেমন কিছু বেশি নয় । সেখানে কৃতজ্ঞতা, দায়িত্ববোধ এগুলোরই মূল্য বেশি।
জীবনের কতজনের প্রেম দেখলাম , শুনলাম । আজকে সামুর ব্লগারদের জন্য নিজের চোখে দেখা এই কয়েকটি কাহিনি লিখলাম । ২০০২-০৩ সালের কথা । তখন ক্লাস সিক্স কি সেভেন পড়তাম । আমার খালাতো ভাই ( উনাকে আমরা শুভ দাদা নামেই ডাকতাম ) তখন কলেজে পড়তেন । আমাদের বাসা থেকে খালার বাসা খুব কাছাকাছি ছিলো । তাই তিনি প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন ।
বয়সে তিনি আমাদের চেয়ে অনেক বড় হলেও আমাদের ভাই বোনের সাথে উনার খুবই ক্লোজ সম্পর্ক ছিলো । তো উনি নিজেই আমাদের একদিন জানালেন যে , উনি নাকি উনার কলেজের এর ক্লাস মেট এর সাথে প্রেম করছেন । প্রথম প্রথম আমরা বিশ্বাস করি নি । তখন কার সময়ে প্রেমিক প্রেমিকাদের মাঝে চিঠির আদান প্রদান হত । তিনি প্রায়ই চিঠির শেষ অংশে তার প্রেমিকার নাম দেখাতেন ।
এভাবে বেশ কিছু দিন চললো । একদিন শুনলাম শুভ দাদা একসাথে অনেক গুলো ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন । খালা-খালু দাদা কে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন ।পরে যা শুনলাম তার সারমর্ম হল এই যে , উনার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে । সে শোক কাটাতেই তিনি ঘুমের ঔষুধ খেয়েছিলেন । বিয়ে হওয়াটা হয়ত সমস্যা ছিলো না । আসল সমস্যাটা ছিলো , আমার দাদা ছিলেন হিন্দু আর উনার প্রেমিকা ছিলো মুসলিম । স্বাভাবিক ভাবেই এই অসম প্রেম আমার খালা-খালু মেনে নেন নি । কিছু দিন পরে উনার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেলো । শুভ দাদা সে শোক কাটানোর জন্য ড্রাগ এর নেশা ধরলেন । খালা খালু দাদাকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দিলেন । কিছুদিন পরে সেখান থেকে সুস্থ হয়ে ফিরলেন । এরপর দাদার সাথে উনার প্রাক্তন প্রেমিকার যোগাযোগও হয়েছিলো , কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে ।
তখন সবে মাত্র এস এস সি পরিক্ষা দিয়েছি । পরীক্ষার পরের তিন মাস পুরোই ফ্রি । তাই এলাকার এক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হলাম । তো সেখানকার ইন্সট্রাক্টটর ছিলেন তপু ভাই । তিনি আমাদের বাসার সামনে একটা মেসে থাকতেন । তিনি তার পরিবার ছেড়ে কেন মেসে থাকতেন সে প্রস্নের উত্তর কিছু দিন পরে জানতে পারলাম । তপু ভাই আগে হিন্দু ছিলেন । উনার এলাকার এক মুসলিম মেয়ের সাথে উনার প্রেম হয় । সে মেয়ে শর্ত দিলো , তিনি যদি মুসলিম হতে পারেন তাহলেই তপু ভাই কে তিনি বিয়ে করবেন ।
একদিকে ছিলো বাপ-দাদাদের ধর্ম অন্যদিকে ভালোবাসা । তপু ভাই দ্বিতীয় পথটাকেই বেছে নিলেন । প্রেমিকার কথামত তপু ভাই মুসলিম হলেন । কিন্তু ধর্মান্তরিত হওয়াটা তপুভাইয়ের পরিবার মেনে নিলো না । উনাকে বাসা থেকে বের করে দেয়া হলো । এই ছিলো তপু ভাইয়ের মেসে থাকার কাহিনী । যার জন্য তিনি নিজের ধর্ম ছাড়লেন , নিজের পরিবার থেকে দূরে চলে আসলেন , সেই মেয়েটির পরে অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যায় । পুরো কাহিনি শুনে উনার জন্য অনেক খারাপ লেগেছিলো । হয়ত কিছু মানুষের ভাগ্যটাই খারাপ থাকে , হয়ত ভালোবাসার অঙ্ক কেউ কেউ মিলাতে পারে না ।
এই গল্পটা আমার কলেজ জীবনের দুই ক্লাসমেট অরুপ আর শ্যামার । আমি , মান্না , অরুপ , শাহিন আমরা এই চার জন ছিলাম কলেজের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু । তো অরুপের সাথে শ্যামার প্রথম দেখা হয় আহমেদ স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে গিয়ে। তখনো আমাদের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দেয় নি । আহমেদ স্যার ছাড়াও লিটন স্যার এর কাছেও তারা দুই জন একই ব্যাচ এ পড়তো । সেখান থেকে শ্যামার প্রতি অরূপের ভাললাগা শুরু । অবশ্য এ ক্ষেত্রে অরুপের দোষ দেয়া যাবে না । শ্যামা দেখতেও সেই লেভেলের রূপ সৌন্দর্য ছিলো । গায়ের রঙ যেমন ছিলো ফর্সা তেমনি ছিলো লম্বা আর দেখতেও ছিলো সুন্দরি । ক্লাসের অধিকাংশ ছেলেই শ্যামার প্রতি ক্রাশড ছিলো ।
যাই হোক , এসএসসির রেজাল্টের পর আমরা কলেজে ভর্তি হলাম । শ্যামা কিন্তু তখন ও জানত না যে , অরুপ শ্যামা কে পছন্দ করে । ক্লাস শুরু হওয়ার পরে মেয়েরা যে দিকে বসত অরুপ ঠিক সে দিকের বেঞ্ছের একেবারে শেষ প্রান্তে বসত । যাতে ঘাড় ঘুরালেই যেন সে শ্যামা কে দেখতে পায় । আর কলেজ ছুটি হলেই শ্যামার পিছু নিত । প্রেম ভালবাসার ক্ষেত্রে মেয়েদের সিক্সথ সেন্স খুবই প্রবল হয় । অরুপ মুখ ফুটে তার ভালো লাগার কথা না বললেও শ্যামা ঠিক বুঝে গেলো ।
এভাবেই দেখতে দেখতে দুই বছর চলে গেলো । অরুপ শ্যামাকে মনের কথা বলতে পারলো না । আমরা এইচএসসি পরিক্ষা দিলাম । পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো । আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেল এর সবাই পাস করলাম । কিন্তু অরুপ ফেল করলো । অরুপ যে শ্যামা কে পছন্দ করে , সেটা ইতিমধ্যে ক্লাসের সবাই জেনে গেছে । অরুপ পরের বার পরিক্ষা দিলো । আবারও ফেল করলো । শ্যামা তত দিনে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর ফরেস্ট্রী তে ভর্তি হয়ে গেছে ।
যাই হোক , ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় কলেজ ছাড়ার পর অরুপের সাথে দেখা হয়েছে অনেক বার । তাকে প্রায়ই শ্যামার কথা ঘুরে ফিরে জিজ্ঞাস করতাম । আমি বলতাম , “তুই অকে কেন প্রপোজ করলিনা । হয়ত বা সে রাজিও হত ।” সে বলল , “আমি কলেজে থাকার সময়ই তাকে প্রপোজ করেছিলাম । (যদিও তখন পর্যন্ত আমি জানতাম যে , অরুপ শ্যামা কে সেই রকম কিছু কখনো বলে নাই ) সে দিন অনেক বৃষ্টি হচ্ছিলো । মান্না , শাহিন ( আমার কলেজের অন্য দুই বন্ধু ) সেদিন অরুপকে অনেক জোড়াজুড়ি করলো যে , যে প্রপোজ করলে আজকেই করতে হবে । অরুপ শ্যামার বাসার সামনে দাড়ালো । যখন শ্যামা তার বাসায় ঢুকছিল , তখন অরুপ শ্যামার নাম ধরে ডাক দিলো । অরুপের ডাক শুনে শ্যামার তার সামনে আসলো ।
সে অরুপকে বলল ,”কি ব্যাপার !! তুমি বৃষ্টিতে ভিজছো কেন ?” তারপর অরুপ শ্যামাকে প্রপোজ করলো । মেয়েটা অরুপকে কিছু না বলেই সেদিন চলে গেলো । ব্যস , এত টুকুই ছিলো কাহিনি । আজও অরুপ সারা বছর ধরে একটা দিনের জন্য অপেক্ষা করে । কারন বছরের অই একটা দিনেই শ্যামা পুজা দেখতে মন্দিরে আসে এবং সেই দিনেই শ্যামাকে সে কাছ থেকে দেখতে পায় । এটা আমার দেখা জীবনের সব চেয়ে অদ্ভুত প্রেমের কাহিনি । এ গল্পটা আমার আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইমনের । মেয়েরা যে ছলনাময়ী হয় , সেটা ইমনের কাহিনিটা না জানলে হয়ত জানতামই না ।
অরুপ , মান্না , শাহিন এর মত সেও আমার কলেজেরই বন্ধু । তো প্রথম এইচএসসি পাসের প্রথম বছর সে অনেক গুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষা দেয় ।কিন্তু প্রথম বার কোথাও সুযোগ পেলো না । পরের বছর আবার ট্রাই করলো । তো পলির সাথে তার প্রথম দেখা হয় খুব সম্ভত যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা দিতে গিয়ে । প্রথমবার দেখায় তাদের মধ্যে অল্প সল্প কথা , পরে মোবাইল নাম্বার বিনিময় । এভাবেই তাদের সম্পর্কের সুচনা হলো । এরপর কয়েকটা দিন কাটল । ইমন ততদিনে কোথাও সুযোগ না পেয়ে ঢাকার এক কলেজে ভর্তি হলো আর পলি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো ।
দুই জনের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছিলো আর দুই জনেই ঢাকায় থাকায় মাঝে মাঝে দেখাও হচ্ছিলো । অবশ্য শুরুতে তারা দুই জনের মধ্যে শুধু বন্ধুত্তের সম্পর্কই ছিলো । তাছাড়া , ইমনের সাথে দেখা হওয়ার আগে থেকেই পলির সাথে অন্য একটা ছেলের রিলেশন ছিলো । যেহেতু প্রথম প্রথম তাদের মাঝে বন্ধুত্তের সম্পর্ক ছিলো , তাই ইমন পলির রিলেশন এর ব্যাপারে আগেই থেকেই জানত ।
তো কিছুদিন পর , পলির সাথে তার বয়ফ্রেন্ডের সম্পর্কে ফাটল ধরে । পলির বন্ধু হিসেবে ইমন অনেক চেস্টা করে সে রিলেশন টিকিয়ে রাখতে ।কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে ব্রেক-আপই হয় । ব্রেক-আপের পরে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মানসিক অবস্থা খুব একটা ভালো থাকে না । ততদিনে ইমন পলির অনেক কাছের একজন বন্ধু । সে পলিকে সে সময়টায় অনেক মেন্টাল সাপোর্ট দিলো । এভাবে ধীরে ধীরে তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়লো । তো একদিন পলি ইমন কে বলল , আমরা যেহেতু একে অপরকে এত দিন চিনি আর আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া অনেক ভালো । তাই আমরা দুই জন রিলেশনে যেতেই পারি ।
সাধারণত দেখা যায় ছেলেরাই মেয়েদেরকে প্রপোজ করে । কিন্তু যখন কোন মেয়ে কোন ছেলেকে প্রপোজ করে , তখন অই ছেলেটার পক্ষে সেই মেয়েকে ফিরিয়ে দেয়াটা অনেক কঠিন হয় । তাছাড়া এক নাগাড়ে কোনো মেয়ের সাথে অনেক দিন ধরে যোগাযোগ থাকলে , সেই মেয়ের প্রতি দুর্বল হওয়াটাই স্বাভাবিক । আমার বন্ধু ইমনের ক্ষেত্রে তাই ঘটলো । তাঁরা দুই জন একে অপরের প্রেমে পড়লো । ইমনের কিছু দিন খুব ভালোই কাটল । তারা চুটিয়ে প্রেম করা শুরু করলো । রাত জেগে কথা বলা , জন্মদিনে একে অপরকে গিফট দেয়া , ডেটিং এ যাওয়া । আজকালকার প্রেম বলতে যা বোঝায় ,ঠিক সে রকমেরই প্রেম ।
তো পলির অন্য এক বন্ধু এবার পলিকে কান পড়া দিতে লাগলো । ছেলেটা পড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে , আর তুই পড়িস পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে । তোর ফ্যামিলি স্ট্যাটাস এর সাথে এই ছেলের স্ট্যাটাস মিলে না । এই রকম আর অনেক কিছু বলে পলির কান ভারি করতে লাগলো । এভাবেই তাদের ভালবাসায় ফাটল ধরা শুরু হলো । বেচারা ইমন রিলেশন ধরে রাখার অনেক চেস্টা করলো , কিন্তু কোন লাভ হলো না ।কিছু দিন পরে তাদের মধ্যে ব্রেক আপ হলো ।
আগেই বলেছিলাম ব্রেক আপ পরবর্তী সময়ে প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য খুবই কঠিন একটা সময় । প্রাক্তন প্রেমিকার কথা ভুলার জন্য প্রেমিক মদ গাঁজার নেশা ধরে । আমার বন্ধু ইমনের ঠিক সেরকমই কিছু হয়েছিলো । যাই হোক , ইমন কিছুদিন পর সে অবস্থা থেকে কামব্যাক করে । পরে ইমন চেয়েছিলো পলির উপরে প্রতিশোধ নেয়ার , কিন্তু আমি মানা করলাম ।
তাকে বললাম ,” সে যাওয়ার সে চলে গেছে , তার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয় । তাহলে তার কথা এমনি ভুলে যাবি ।” তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে ইমনের সাথে ব্রেক আপ হওয়ার পর সেই প্রাক্তন প্রেমিকা পলি আবার আরেক জনের প্রেমে পড়েছিলো ।