এই মাত্র সিগারেট এবং গাঁজা নিয়ে এসে আমার সামনে বসে থাকা রাহাতের হাতে দিয়ে বললাম,
–এগুলা খাওয়াটা এবার ছেড়ে দেওয়া যায় না? একজীবন তো এই ছাইপাঁশ খেয়েই কাটিয়ে দিলি। এবার অন্তত জীবনকে নিয়ে চিন্তা কর,স্যাটেল হ।
রাহাত আমার ছোটবেলার বন্ধু।যদিও আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিলো সে। ছেলেটা আগে খুব ভালো ছিলো, এখন যে খারাপ তা নয়। কিন্তু অনেকটা বিগড়ে গেছে।এখন প্রায় আমার বাসায় এসে বলে ওকে সিগারেট আর গাঁজার ব্যবস্থা করে দিতে। আমি প্রথম প্রথম আপত্তি করতাম, কারণ কেউ এসব নিতে দেখলেও তো আমায় খারাপ ভাববে। আর রাহাতের জন্যও যে এসব খুব ভালো কিছু তা নয়। ও এমন এক মানুষ যে তার সব কিছুই আমার সাথে শেয়ার করে। কান্না, হাসি সবটা।তাই আপত্তি করলে অকপটে কাঁদতো আমার সামনে। আমার রুমমেট রাইম এসব দেখে ভীষণ ঝামেলা করতো আমার সাথে।কিন্তু মেয়েটা আমাকে খুব ভালোবাসতো। তাছাড়া ও এটাও জানতো যে,রাহাত নামের ছেলেটিকে আমি খুব বেশি ভালোবাসি।কিন্তু প্রকাশ করিনা রাহাতের সামনে। রাহাত এখন অবশ্য কম আসে,কিন্তু আসে। ছাইপাঁশ যে গিলতেই হবে তাকে। সিগারেট টানতে টানতেই বললো,
–সেমিস্টার ফাইনাল দিলাম।আমার চোখের নিচে যেমন কালো দাগ পড়েছে ঠিক তেমনি জীবনেও লাল কালির দাগ পড়ে গেছে।খারাপ আসলো রেজাল্ট। আজ সকালে বাবা গিটারটা ভেঙে ফেলেছে রে।মা’কে রোজ আমার বেকারত্ব নিয়ে কথা শুনতে হয় বাবার কাছে। আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। আমার মনে হয়,জীবনটা এখানেই শেষ।
— এতটা ভেঙে পড়েছিস কেন! জীবন এখানে শেষ মানে? কি সব বলছিস? ধৈর্য ধর। আমি আছি তোর পাশে সবসময়। সিগারেটে আরেক টান দিয়ে ও বললো,
–কি করবো আমি মিনি? আমি আলমারির গোপন ড্রয়ার থেকে আমার জীবনের সব সঞ্চয় বের করে নিলাম।ছোটবেলা থেকেই টাকা জমানোটা আমার কাছে ভালোই লাগতো।অনেকবছর যাবৎ টিউশন করছি।টিউশনের বেশিরভাগ টাকাও জমাই আমি।ছোট ছোট সঞ্চয়গুলো একত্রিত করে, পেলাম প্রায় লাখখানেক টাকা,কিছুদিন আগে জন্মদিনে বাবার দেওয়া গলার চেইন এবং আমার গড়ানো দুই জোড়া সোনার কানের দুল ও একটি আংটি। এক জোড়া দুল আমার কানেই ছিলো। এগুলো রাহাতের সামনে রাখলাম এবং কানে লাগানো দুলজোড়া খুলতে যাবো তখনি রাহাত আমার হাত ধরে বললো,
–এসব কি মিনি! তুই এগুলো কেন বের করছিস? মৃদু হেসে রাহাতকে বললাম,
–এগুলো নিয়ে যা। দেখ কিছু করা যায় কিনা।
–আশ্চর্য! তোর থেকে কেন এগুলো নিবো আমি?
–ধরে নে এটা তোর প্রাপ্তি বা পুঁজি। সুদ চাই না,পরবর্তীতে আসলটা ফিরিয়ে দিলেই হবে।দেখ রাহাত, আমি চাইনা তুই ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে যাস এমনটা।তোকে এমন বিগড়ে যেতে দেখে আমার নিজেরই খারাপ লাগছে,তাহলে আঙ্কেলের কি দোষ বল?
শোন রে বোকা,সময় আছে এখনও।জীবন নিয়ে পজিটিভ ভাব,কিছু একটা কর।তারপর বিয়ে কর। কথাটা বলে খিলখিল করে হেসে রাহাতের কাঁধ সমান এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে নেড়ে দিলাম। উপরের কথাগুলো আমার ভার্সিটি লাইফের ছিলো।এখন অবশ্য আমার পড়াশোনা শেষ,জব করছি। আর রাফসান্ অর্থাৎ বোনের রেখে যাওয়া ছোট্ট ছেলেটার দেখভাল করছি। রাহাত ঐ সময় দেশের বাইরে চলে যায়।ওর সাথে আমার আর যোগাযোগ হয় না। আজ যখন রাফসানকে নিয়ে ওর স্কুল থেকে ফিরছিলাম তখনি হঠাৎ রাহাতকে দেখলাম।কি সুন্দর দেখতে হয়েছে সে! ভীষণ পারিপাটি লাগছে। কে বলবে, এই ছেলেটার একটা সময় কাঁধ সমান চুল, বুক সমান দাড়ি,ঠোঁট কালো,চোখের নিচে কালো দাগ, সিগারেট ও গাঁজার নেশা ছিলো! আমি রিকশা থামিয়ে রাহাতের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।ও তখন পর্যন্ত ভীষণ ব্যস্ত হয়ে একটা লোকের সাথে কথা বলছিলো। আমায় হয়তো এখনো দেখতেই পাইনি। লোকটার সাথে কথা শেষ হওয়ার পর আমি ওর পেছনে থেকে বললাম,
–রাহাত ? সে মাথা ঘুরিয়ে আমায় কিছুক্ষণ আপাদমস্তক দেখে বললো,
–মিনি! এতদিন পর তোর সাথে দেখা! কেমন আছিস, কি করছিস?
–এই তো। মৃদু হেসে বললাম,কি আর করবো!তোর কথা বল।এত পরিবর্তন! যাক,ভালোই লাগছে তোকে দেখে। আমার বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছিলাম,আসিস নাই কেন রে?
–এত ব্যস্ত ছিলাম বন্ধু,যে সময় বের করতে পারিনি রে।খুবই দুঃখিত মিনি।আর পরিবর্তন! রাহাত খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো,সে তো রাইমার জন্য হয়েছে।মেয়েটা আমার জীবনে এসে সবটা বদলে দিলো রে। রাইমা হচ্ছে আমার ভার্সিটি লাইফের সেই রুমমেট।
–ওহ্। তাহলে তোরা ভালোই আছিস বল? বিয়ে কবে করেছিস? রাহাত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
–বছরখানেক হবে।তা তোর বর কি করে ?এটা তোর ছেলে?
–ও রাফসান। ভালোই আছি আমরা।দোয়া করিস। খানিকক্ষণ বাদে আমি রাহাতকে বললাম,
–আচ্ছা যাই রে। রাহাত আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
–তোর জিনিসগুলো নিবিনা? আমি মৃদু হেসে বললাম,
–নাহ্। আসল তো ছেড়ে দিয়েছি, সুদ নিয়ে আর কি হবে? রাহাত আমার চোখে চোখ রেখে বললো,
–মিনি,তুই কাঁদছিস!
–এমা না না। ওর আড়ালে টুপ করে এক ফোঁটা চোখের পানি মাটিতে পড়ে গেলো।অথচ রাহাত টেরই পেলো না। আমি হাত বাড়িয়ে দিতেই রাফসান বললো,
–খালামণি,এই আঙ্কেলটা কে? রাফসানের মুখে খালামণি ডাক শুনে রাহাত অবাক হয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলো,
–কিরে মিনি? ও তোর ছেলে না? রাফসান পটাপট বলতে লাগলো,
–আঙ্কেল তুমি তো খুব বোকা! এটা আমার খালামণি।আমার মা তো মরে গেছে।
–মিনি এসব কি বলছে বাচ্চাটা? তুই কি তাহলে বিয়ে করিস নি? আমি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাফসানের মধ্যমাঙ্গুলি ধরে রাহাতকে বললাম,
–সেদিন কোনো একটা কারণে আমার বিয়েটা ভেঙে যায়। তারপর আর বিয়ে করিনি। কথাটা বলেই চলে আসলাম রাহাতের সামনে থেকে।আমি চাই ও সবসময় ভালো থাকুক।আর কখনো আমার দুর্বলতা সম্পর্কে না জানুক। পরেরদিন সকাল দশটা নাগাদ রাহাত এবং রাইমা এসে আমার বাড়িতে উপস্থিত।আমি ভীষণ অবাক হয়ে ওদের দেখছি। রাহাত সোফায় বসতে বসতে বললো,
— শোন মিনি, আজ নাস্তা কিন্তু সিগারেট বা গাঁজা খাবো না।মিষ্টির আয়োজন কর।
–মানে ?
— দেখ, সেদিন আমি তোর কথা মতো তোর সব সঞ্চয় নিয়েছি। আজ থেকে তুই আমার, একান্তই আমার, সঞ্চয় হবি?
–রাইমা কি বলছে এসব ও?
–আমি অনেক আগেই রাহাতকে তোর বিষয়ে সবটা বলেছি। মানে তুই যে ওকে ভালোবাসিস এটা। তোর সাথে মাঝখানে আমার বা রাহাতের আর যোগাযোগ হয়নি।শুনেছি তারই মাঝে তোর বিয়ে হয়েছে।তারপর আর কখনো রাহাত তোর সামনে আসবে ভাবেনি। শাড়ির এলোমেলো কুঁচিগুলো পায়ের উপর দিতে দিতেই রাইমা আরো বললো,
–আমি তো নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত।আমার বর ব্যবসায়ের কাজে গতকাল দেশের বাইরে গেছে।সবকিছু সামাল দিয়ে এখন একটু ফ্রী অাছি।
–তোর বর মানে?
–হ্যাঁ,আমার বর, মৃদুল।আরে যার সাথে ভার্সিটি লাইফে আমার রিলেশন ছিলো।তুই তো চিনিস। আমি রাইমার কথা শুনে রাহাতের দিকে তাকাতেই রাহাত ইশারায় কানে ধরে গতকালের মিথ্যা বলার জন্য স্যরি বলে নিলো। তারপর বললো,
–মিনি,বিয়ে করবি আমায়? আমি সেদিনের মত খিলখিল করে হেসে ওর হাতে হাত রেখে বললাম,
–হতচ্ছাড়া, অনেক অপেক্ষা করিয়েছিস আমায়।আর ছাড়ছি না তোকে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা