একই বেঞ্চের দুই প্রান্তে দুইজন চুপচাপ বসে আছে। মনে হচ্ছে এখানে ওরা নিরবতা পালন করতেই এসেছে। কিছুক্ষণ পরে নুপুর বলে উঠলো,
– আচ্ছা সজল, তুই কি আমায় সত্যিই ভালোবাসিস?
— হুম, ক্যানো তাতে কোনো সন্দেহ আছে তোর?
— আছেই তো, আমি দেখা করার কথা বললে কোনদিন তুই সময় মতো এসেছিশ বলতো, কমপক্ষে আধা ঘন্টা দেরি হবেই হবে তোর, কিন্তু কেন ?
— হা,হা,হা” এই কথা?
— হাসছিশ না, মিথ্যুক, ভন্ড, পাজি!
–হুম, মিথ্যুক, ভন্ড আর পাজি হলেও, প্রত্যেকবারই ঠিক সময় এসে আড়ালে দাড়িয়ে, ঐ সময়টুকু তোকে দুচোখ ভরে দেখি।
— ক্যানো, লুকিয়ে দেখতে হবে ক্যানো?
— লুকিয়ে লুকিয়ে যখন দেখি তুই আমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছিশ, তখন মনে হয় আমি কতো ভাগ্যবান, আমার পথ চেয়েও কেউ বসে থাকে, মনে হয় জীবন আমার ধন্য, তোর ভালোবাসা পেয়ে।
— হইছে হইছে, এবার থাম।
— বিশ্বাস কর নুপুর, ধীরে ধীরে আমি তোর প্রেমের নেশায় এতটাই আসক্ত হয়ে গেছি যে, তোকে হারালে হয়তো পাগল হয়ে জাবো, নয়তো পৃথিবী ছেড়ে চলে জাবো।
— এবার তুই থামবি সজল, একটা কথা জেনে রাখ, তোকে হারালে আমি নিজেই পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে জাবো। এবার দুজনেই এগিয়ে এসে একেবারে গায়ে গায়ে মিশে বসলো। নুপুর সপিং ব্যাগ থেকে একটা সার্ট বের করে সজলের হাতে দিয়ে বললো,
– দ্যাখ তো, তোর পছন্দ হয় কিনা। সজল বললো,
– সোন, এভাবে তুই আর আমাকে ছোটো করিসনা প্লিজ, তোকে কোনোকিছু দেবার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই আমার, তাই তোর কাছ থেকে কিছু নিতে ভিশন খারাপ লাগে আমার। নুপুর বললো,
– আমি জানি তো, টিউশনি করে জা পাও, তাতে নিজের খরচাই হয়না। সজল বললো,
– তবুও তুই ক্যানো টাকা খরচা করে আমাকে এ সব দিস।
— এগুলো আমি তোকে দেইনা, এগুলো দিয়ে আমি আমার স্বপ্নটাকে সাজাই, আর তোকে ঘিরেই আমার সেই শপ্নের পৃথিবী।
— আর তুইজে আমার পৃথিবীতে সুর্য, তোকে ছাড়া আমার জীবনটাও যে মূল্যহীন, সেটা কে বলবে।
— ক্যানো, তুই নিজের মুখেই বলবি, তোর মুখে ঐ কথাগুলো সুনতে আমার খুবই ভালোলাগে। এভাবেই দিন যায়, দুজনার ভালোবাসা অতল গভীরতার সিমাও ছাড়িয়ে যায়। প্রায় দুবছর পরে, একদিন আবারও দুজন পার্কে দেখা করতে আসে। নুপুরের মুখে দুঃখ, কষ্ট, বিষণ্ণতা, আর হতাশার ছায়া স্পষ্ট। মাথা নিচু করে বসে আছে নুপুর। সজল আলতো করে নুপুরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– কিরে কি হয়েছে তোর, শরীর খারাপ ?। নুপুর মাথা তুলে সজলের দিকে তাকালো, দুচোখে জল টলমল করছে, ভাঙা ভাঙা গলায় সজলের হাত সক্ত করে ধরে নুপুর বললো,
– এখন থেকে আমার সপ্নটা মনে হয় আমার আর সাজিয়ে রাখার সৌভাগ্য নেই রে, তুই আমায় কথা দে, আমার সপ্নটা তুই সুন্দর ভাবে এই পৃথিবীতে বাচিয়ে রাখবি!।
এই বলে উঠে দাড়িয়ে, সজলের কপালে একটা চুমু দিয়ে কাদতে কাদতে চলে গেল নুপুর। সজল কিছুই বুঝতে পারলোনা, হঠাৎ নুপুরের মুখে এই কথা সুনে যেন বাকশক্তি হারিয়ে নির্বাক সজল। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছেনা, তবে নুপুরের চোখে জল দেখে, নিজের চোখের জল আর আটকে রাখতে পারলোনা সজল। পরে খোজ নিয়ে জানতে পারে, নুপুরের দুটো কিডনি-ই নষ্ট হয়ে গেছে, এখন সে হাসপাতালে। এদিকে আজ অনেকদিন ধরে হাসপাতালের বেডে শুয়ে ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর পথে এগিয়ে জাচ্ছে নুপুর। বেচে থাকতে হলে অন্তত একটা কিডনি প্রয়োজন। অনেক চেষ্টা করেও নুপুরের আত্মীয় স্বজন একটা কিডনির ব্যাবস্থা করতে পারেনি। নুপুর বিছানায় সুয়ে সুয়ে সজলের কথাই ভাবছে,- আজ এতদিন হয়ে গ্যালো, সজলে একটি বারের জন্যও আমাকে দেখতে এলোনা, এই কি আমার প্রতি ওর ভালোবাসা, নাকি স্বপ্নটা সুধু আমিই দেখতাম, ওর কোনো ইচ্ছেই ছিলনা।
এসব ভেবে ভেবে নুপুরে ফুপিয়ে কাদতে কাদতে নিজের বুকের ভেতর দুঃখের নদীতে কষ্টের বন্যা বইয়ে দিলো। ভাগ্য ভালো বিধায় কয়েকদিনের মধ্যেই একটা কিডনি পাওয়া গেল। অপারেশন হলো, নুপুর এখন সুস্থ প্রায়। কিন্তু সজলের কোনো খবর নেই। সজলের প্রতি নুপুরে ভালোবাসা এতদিনে ঘৃণা আর অভিমানে পরিণত হয়েছে। কয়েকদিন বাদে নুপুর সেই পার্কে আসলো, যেখানে সজল আর নুপুর দেখা করতো। আশ্চর্যের বিষয়, ওরা যে বেঞ্চে বসে কথা বলতো, সেই বেঞ্চের কাছে আসতেই নুপুর দেখলো, সজল বসে আছে, হয়তো কারো অপেক্ষায়। নুপুর সজলের সামনে এসে দাড়ালো। নুপুরকে দেখে সজল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো নুপুরের দিকে। নুপুর বললো,- কি, খুব অবাক হয়ে জাচ্ছো তাইনা, আমি এখনও বেচে আছি তাই দেখে!
— আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি নুপুর !
— চুপ করো, তোমার মতো বেইমান বিশ্বাসঘাতকের মুখে ভালোবাসি সব্দটা শোভা পায়না। তুমি আমাকে ভুল বুঝনা বলে সজল নুপুরের হাত ধরতেই, নুপুর সজলের গালে একটা থাপ্পর মেরে বললো,
– কোন অধিকারে তুমি আমার হাত ধরো?। সজলের চোখের জল উপছে পড়তে চাইছে। হাত দিয়ে চোখের জল মুছলো সজল। নিজেকে সামলে নিয়ে সজল বললো,
– তোমার সেই সুখের স্বপ্নটা এখন তোমার কাছে খুব বিরক্তিকর তাইনা?। প্রচণ্ড কাশি শুরু হলো সজলের। পেটে হাত দিয়ে কাশতে কাশতে নুয়ে পড়লো সজল। কোমরের দিকের সার্টের কিছু অংশ রক্তে লাল হয়ে গেল। নুপুর ধরতে চাইলে সজল বললো,
– আমি ঠিক আছি, আমাকে ধরলে তোমার হাতে এই বেইমান বিশ্বাসঘাতকের রক্ত লাগতে পারে। সজলের এই অবস্হা দেখে নুপুরের হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো। সজলের জামা উল্টে রক্ত বের হবার কারণ খুজতে চাইল নুপুর, সজল বাধা দিলো। কিন্তু নুপুর জোর করে সজলের সার্টটা তুলে ধরতেই দেখলো, সজলের কোমরের কাছাকাছি ডান পাশে একটি অপারেশনের দাগ। নুপুর এবার জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। নুপুরের আর বুঝতে বাকি ছিলনা, যে কিডনিটার জন্য নুপুর বেচে আছে, সেটা আর কারো নয়, সজলের-ই। জ্ঞান ফিরতেই নুপুর সজলের পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে উঠলো-” আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও সজল, আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি, অনেক বড়ো অন্যায় করেছি”। নুপুরকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে সজল বললো,
– অপারেশনের পড়ে ঘা সুকানোর জন্যে ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দিয়েছিলো, টাকা ছিলনা তাই খেতে পারিনি, তবে এই যন্ত্রণা আমার কাছে মধুর, এই যন্ত্রণার কারণেই আমার ভালোবাসা বেচে আছে, আর তুমিই তো বলেছিলে আমি তোমার শপ্নে, তাই তুমি বেচে না থাকলে তোমার স্বপ্নটা বেচে থাকবে কার চোখ।