মুখে মাস্ক,চোখে চশমা,স্পেশাল ইউনিফর্মে কেবিনে বসে আছেন ডঃ নির্ঝর চক্রবর্তী ।চোখে একরাশ ঘুম,দেহে বিগত কয়েকদিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ক্লান্তি,আবার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে মাথা ব্যথাটাও অসহ্য ভাবে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।আরাম করে ঘুমিয়ে যে শরীরের ক্লান্তি দূর করবে তার জো নেই। আসলে সময় কই? চারদিকে কোভিড-19 এর উৎপাত।এই ছোঁয়াচে মহামারির ঔষধ বিজ্ঞানের জ্ঞানে এখনও কুলোচ্ছেনা।দেশ তথা পৃথিবীর বিপদের সময়।হাজার হাজার মানুষকে যমের দুয়ারে ঠেলে দিচ্ছে এই কোরোনা , বিশেষত ভাইরাসটা মোটেই করুণা করছেনা শিশু ও বয়স্কদের।ভারতের অবস্থাও করুন।বিশেষত মেট্রোপলিটন সিটি গুলোতে। যেমন এই মুম্বাইয়ের নামকরা হাসপাতালে কয়েকশো কোরোনা রোগি।নতুন এই মহামারীর রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন ডাক্তাররা ।নাওযা়,খাওয়া,বাড়ি ছেড়ে তাদের হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। চিকিৎসা করছে 24 ঘন্টা। তাদের মধ্যে একজন ডঃ নির্ঝরও।16 দিন ধরে তার বাড়ির ত্রিসীমানাও দেখা হয়নি আর তিনদিন ধরে নাওয়া খাওয়া কিছুই হয়নি ঠিক মত।বিশ্রামের কথা আর নাই বা বলা হলো। তাছাড়া এই পরিস্থিতিতে বিশ্রাম নেবেই বা কি করে!!
নাঃ মাথা ব্যথাটা বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। এক কাপ ব্ল্যাক কফি খেতে হবে ।টেলিফোন থেকে কল করলো স্টাফকে। রিং হচ্ছে,ওপাশ থেকে কেউ তুলছেনা। সম্ভবত ফোনের কাছে কেউ নেই ।মেজাজটা আরো খারাপ হয়ে গেল নির্ঝরের।একেই ক্লান্তিতে মেজাজটা খিটখিটে হয়ে আছে,তার উপর এই ইউনিফর্ম। বিরক্তিকর পরিবেশ। স্টাফ রুমের উদ্দেশ্যে বেরোলো।কেবিনের ডোর খুলে বেরানোর সাথে সাথেই বুকের সাথে সজোরে কারো ধাক্কা লাগল আর সাথে সাথে নির্ঝরের দুর্বল হয়ে আসা ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে পরলো।প্রচন্ড রাগে চেঁচানোর আগে সামনে তাকাতেই সে ঝটকা খেলো,সাথে সাথে মাথাব্যথা ঘুম, ক্লান্তি সব উড়ে গেল। সামনে নাকে হাত দিয়ে ভ্রু কূঁচকে চোখবন্ধ করে এক সুন্দরী যুবতী দাড়িয়ে আছে।পরনে ব্ল্যাক জিন্স ও রেড টি শার্ট। তাতেই মেয়েটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। নাকে হয়তো মেয়েটার বেশি লাগতো না ,কিন্তু কোন কারনে মাস্ক খোলার দরুন নাকে ব্যথা টা একটু বেশিই পেয়েছে সে নির্ঝর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কেবিনে আবার ঢুকতে গেলে মেয়েটা বলে ওঠে,
“এক্সকিউজ্মি ডক্টর!”
“ইয়েস! হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?” মেয়েটা হিন্দিতে জবাব দেয়,
“একচুয়ালি ডক্টর, আমাকে 14 দিন আইসলেশনে থাকতে বলা হয়েছে ।আমার কোরোনা টেস্টও করানো হয়নি। আমি এখন বাড়ি যেতে পারছিনা কিছু সমস্যা রয়েছে। বাইরের ওয়ার্ডে সবাই ব্যস্ত আছে তাই আমাকে ডক্টর নির্ঝরের কাছে যেতে বলা হয়েছে।”
” ইয়োর নেম মিস্ ?”
“তৃষ্ণা দত্ত”
“বাঃ বাঙালি !!মাই গুডনেস ।অনেকদিন পর বাঙালির দেখা পেলাম। ভেতরে আসুন ।আমিই ডক্টর নির্ঝর চক্রবর্তী।”
ঘণ্টাখানেক পর নির্ঝর নিজের কেবিনে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে ।হাতে ব্ল্যাক কফি ।কফি থেকে ওটা বাষ্প পাক খেতে খেতে কুণ্ডলীকৃত হয়ে যেন তৃষ্ণার মুখমন্ডলের প্রতিকৃতি তৈরি করে নির্ঝরের চোখে ধরা দিচ্ছে ।তৃষ্ণা মেয়েটা বাঙালি ,মুম্বায়েই বড় হয়ে উঠেছে ।বিশেষ কাজের দরুন লন্ডনে গিয়েছিল, আজই ফিরেছে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হসপিটালে চলে এসেছে ।সে চায়না তার জন্য তার পরিবারের ক্ষতি হোক ।তার পরিবার নাকি অনেক বড় ।তাই সে হাসপাতালেই আইসোলেশনে থাকতে চায় ।হাসপাতালের আইসোলেশন বিভাগে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছে নির্ঝর।সাথে তার ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে নিয়েছে । তৃষ্ণা মেয়েটা বেশ মিশুক ও খোলামেলা স্বভাবের। ব্যবহারটাও বেশ ।অন্যরকম টান অনুভূত হচ্ছে নির্ঝরের ।বাংলার বাইরে হিন্দিভাষীদের মধ্যে বাঙালি মানে যেন নিজেরই পরিবারের সদস্য।
নাঃ মেয়েটার ব্যাপারে অত ভাবা ঠিক হচ্ছেনা। নির্ঝরের তো আবার বিয়েও ফিক্সড। এতদিনে বিয়েটা হয়েও যেত। কিন্তু কোরোনা মহাশয় বিয়েটাকে লাথি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ভারতে নিজের ঘাঁটি বসিয়ে রাজত্ব করছে ।যার দরুন বিয়ের ডেটটা ছয় মাস পেছোতে হয়েছে ।যা নিয়ে নির্ঝর দারুন বিরক্ত।বিয়ে উপলক্ষে কিছু দিন ছুটিও পেয়েছিল নির্ঝর ।কিন্তু কাজের কাজতো কিছু হল না ।উপর থেকে এখন টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স কাজ করতে হচ্ছে। বিয়েটা না হওয়ায় প্রচণ্ড চটে ছিল নির্ঝর। কথাটা মাথাতে আসলেই এতদিন মেজাজ চড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে বিয়েটা হয়নি তো বেশ হয়েছে। কিন্তু এমনটা মনে হওয়ার কারণ বুঝতে পারছে না নির্ঝর।
সারাদিন বেশ ফুরফুরে মেজাজে চিকিৎসা করেছে নির্ঝর।রাত আটটার দিকে তৃষ্ণার কাছে যায় সে।
” কেমন আছেন মিস্ !!খাওয়া-দাওয়া হলো?”
“এই তো কিছুক্ষণ আগেই হলো। অন্যান্য রোগীদের অবস্থা কেমন ?”
“ঠিক বলা যাচ্ছে না।”
এভাবেই বেশ কিছুক্ষন কথা বলে কাটায় তারা ।দুজনেই দুজনের নিজেদের ব্যাপারে একে অপরকে জানাচ্ছে। তৃষ্ণার ফ্যামিলিটা আসলে শুধু বড়ো না, বিশাল বড়ো। অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে সে।অনাথ আশ্রমের মালিক দম্পতি তৃষ্ণাকে লালন পালন করেছে । দম্পতিটিও বাঙালি ।বারো বছর বয়সে মা-বাবা মারা গেলে দম্পতিটি তাকে এডপ্ট করে ও দুই বছর পর একটা অনাথ আশ্রম খুলে।আশ্রমের সব বাচ্চারাই তার আপন।সে চায় না তার জন্য তাদেরও কোনো রোগে আক্রান্ত হতে হোক।নির্ঝরের বেশ লাগে মেয়েটিকে।আপন মনে হয় ।
দুইদিন পর আজ রিপোর্ট হাতে বসে আছে নির্ঝর ।রিপোর্টটা যতবার দেখছে তার মনখারাপটা দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।তৃষ্ণার কোরোনা পজিটিভ এসেছে ।সে বুঝতে পারছে না কিভাবে তাকে জানাবে ।খুব মন খারাপ হচ্ছে মেয়েটার জন্য।তৃষ্ণাকে জানাতেই সে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।নির্ঝর সান্তনা দিতে গেলে তৃষ্ণা তাকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে।নির্ঝর বুঝতে পারছেনা কী বলে সান্ত্বনা দেবে তাকে ।তার কান্নাতে নির্ঝরেরও হৃৎপিণ্ড চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। হয়তো তারও চোখ থেকে দুই ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু কেন ?এত এত রোগী তো আছে এই হাসপাতালে, শুধু এই মেয়েটার জন্য কেন তার হৃদপিণ্ড চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে?? এর কোন জবাব নেই নির্ঝরের কাছে।
আজ 13 দিন হল তৃষ্ণা হাসপাতালে। প্রথম প্রথম খুব জ্বর শ্বাসকষ্ট হলেও এখন তৃষ্ণার অবস্থা আগের থেকে কিছুটা ভালো ।এই 13 দিনে তাদের মাঝেও একটা মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।রিপোর্ট বেরোনোর পর থেকে তৃষ্ণা খুব কাঁদত।নির্ঝর তার কাছে গেলেই দেখতে পেত তার চোখদুটো ভেজা ।এই কদিনে নির্ঝর তৃষ্ণাকে অনেকটা সামলেছে। চারদিকে ব্যস্ততার মাঝেও তৃষ্ণার কাছে যাওয়ার সময় খুঁজে নেয় নির্ঝর।তার সাথে বসে খানিকটা গল্পও করে নেয়।তৃষ্ণাকে না দেখে তার দিন শেষ হয়না। তেমনি তৃষ্ণাও যত রাত হোক না কেন নির্ঝরের জন্য অপেক্ষা করে। অদ্ভুত টান সৃষ্টি হয়েছে দুজনের মধ্যে ।নতুন এক ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে তাদের মাঝে ।যতই ব্যস্ততায় দিন কাটুক না কেন দিন শেষে দেখা হওয়ার অপেক্ষার ধৈর্য ও আছে তাদের মধ্যে। একটা ভাইরাস কখোনই ভালোবাসাকে আটকাতে পারেনা। রাত এগারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। নির্ঝর তৃষ্ণার পাশে বেডে বসে আছে।
“মিস্ ভিতু কাঁদুনে ,কেঁদে কেটে চোখের কি অবস্থা করেছো তা কি জানো?”
” আমি মোটেও ভীতু নয়,না কাঁদুনে”
“ওহ্ আচ্ছা তাই !!রোজ রোজ বুঝি দেবদাস সিনেমা দেখো আর কাঁদো তাইনা!মিস্ ভীতু কাঁদুনে তৃষ্ণা ”
“বলছিনা আমি মোটেও ভিতু নয় ,কাঁদুনেওনয়।এই কোভিড-19আমার কিছু করতে পারবে না।আই নো ,মাই ইমিউনিটি সিস্টেম ইজ্ ভেরি মাচ স্ট্রং।”ঠোট ফুঁলিয়ে বলে তৃষ্ণা।
তৃষ্ণার কথায় মুচকি হেসে নির্ঝর তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফোনটা হাতে নিয়ে এক নম্বর ডায়াল করে।এত এত জন যদি দেশে আরোগ্য হতে পারে তবে তৃষ্ণ কেন নয়?স্ক্রিনে বাংলায় ‘মা’ শব্দটা ভেসেওঠে। চারবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ্ড হয়।নির্ঝর কলটা লাউডস্পিকার করে দেয়। ওপাশ থেকে ঘুম জড়ানো কন্ঠে ভদ্রমহিলার আওয়াজ শোনা যায়,
“নির!কেমন আছিস বাবা? খাওয়া-দাওয়া ভালো করে করছিস তো?”
” আমি ভালোই আছি মা ।তোমাকে একটা কথা বলার জন্য কল করেছি ।”
“কি বলবি বল ;সব ঠিক আছে তো ?”
“ছন্দাকে আমি বিয়ে করছি না মা। তুমি যেমন করে হোক ব্যাপারটা সামলে নাও। ওদের বলে দিও আমি ছন্দার যোগ্য নয়। খুব চেনা পরিচিত এক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গেছি আমি ।হাসপাতালে একটা মিস্টি পরী তার জাদুবলে আমার মনে ভালোবাসা নামক এক ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটিয়ে ফেলেছে। ভাইরাসটার সংক্রমণ এখন আমার পুরো দেহেও হয়ে গেছে ।এর ঔষধ সে নিজে।তাই তাকে ছাড়া আমার বাঁচা সম্ভব নয়।আর ছন্দার বাবাকে আমি নিজে বুঝিয়ে বলব।সেদিন ছন্দা আমায় কল করেছিল,কান্না করছিল মেয়েটা।সেও নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসে,তার বাবার চাপে পরে বিয়েটা করতে রাজি হয়েছিল ।অবশ্য এতে আমারই সুবিধে হয়েছে ।আর হ্যাঁ,সোজা তোমার বৌমাকে নিয়েই বাড়ি ফিরবো।চিন্তা করো না।” মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নির্ঝর ফোন কেটে দেয় । তৃষ্ণা বেশ বুঝতে পারছে নির্ঝরের এসব পাগলাটে কথায় ভদ্রমহিলার ঘুম এতোক্ষণে উড়ে গেছে ।ফোন কেটে দুষ্টুমি ভরা হাসি নিয়ে নির্ঝর তৃষ্ণার দিকে তাকায় ।তৃষ্ণাও তার বদলে নির্ঝরকে উপহার দেয় মিস্টি একটা হাসি ।।