কিছু কেনাকাটা করে অর্থিকে নিয়ে শপিংমল থেকে বের হলো অজান্তা। রাস্তার ওপরপ্রান্তে যেতেই, অকস্মাৎ কোন এক অজ্ঞাত আগন্তুক বললো,
— অজান্তা শোন। সেই পুরুষ কন্ঠস্বরটি শ্রবন মাত্রই অজান্তা নিজ মনেই বললো,
— এই কন্ঠস্বরটা যে আমার চিরচেনা সেই মানুষটার! তাহলে কি সেই ডাকছে আমায়? মুহূর্তও বিলম্বিত না করে তৎক্ষণাৎ অজান্তা পিছু ফিরে তাকালো। অনাবিলকে দেখে অজান্তা প্রসন্ন হাসি মাখা মুখে বললো,
— আরে অনাবিল ভাই আপনি, কতোদিন পর দেখা! আমি তো ভাবতেই পারিনি আবারও আপনার সাথে আমার দেখা হবে! অজান্তার কথা শুনে অনাবিল মৃদু হেসে রহস্যময় কন্ঠে বললো,
— ওহ তার মানে তুমি ভাবতে আমার কথা! যাক খুব বেশি খুশি হলাম এটা জেনে, যে এতো ব্যস্ততার মধ্যেও তুমি আমাকে নিয়ে ভাবার সময় পেতে। অনাবিলের কথা শুনে অজান্তা অভিমানী সুরে বললো,
— এটা কেমন কথা অনাবিল ভাই? চেনা-পরিচিত মানুষকে কি কখনো চিরন্তনী ভাবে ভোলা যায়? অনতিদীর্ঘ এই জীবনের পথে, কোন না কোন মুহূর্তে চিত্তপটে স্পষ্টভাবে মনে পড়ে চিরচেনা খুব কাছের সেই মানুষটাকে।
— হুম আমি তোমার সাথে একমত। বাট কিছু কিছু সময় দেখা যায়, সময়ের বিবর্তনে অতি কাছের মানুষটির কথাও হৃদয়ের পাতা থেকে স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলান্তে হারিয়ে যায়!
— আচ্ছা বাদ দেন এসব কথা। তো এখন বলেন, আপনি এতোদিন কোথায় ছিলেন? আপনার দেখা তো পাওয়ায় যায় না, আপনি তো এখন অমাবস্যার চাঁদের মতো! অজান্তার কথা শুনে অনাবিল স্মিত হেসে বললো,
— আমার দেখা পাবে কি করে? আমি তো আজ চার বছর যাবৎ দেশের বাইরে ছিলাম। এক সপ্তাহ হলো এখানে এসেছি, আর কাকতালীয় ভাবে তোমার সাথে দেখাও হয়ে গেল!
— তো আবারও কি চলে যাবেন ওখানে?
— হুম সিঙ্গাপুরেই জীবনের বাকিটা সময় অতিবাহিত করবো। দেশে আসার কোন ইচ্ছেই ছিল না আমার। তবুও ছোট ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে আসতে হলো।
সহসা অজান্তা উৎকন্ঠা মেশানো কন্ঠে বললো,
— আপনি বিয়ে করেছেন অনাবিল ভাই?
— উঁহুম।
— কেন? অচিরাৎ অনাবিল রহস্যময় কন্ঠে বললো,
— যাকে চেয়েছিলাম তাঁকেই তো পাওয়া হলো না, তাই আর অন্য কাউকে জড়াতে চাইনা আমার সাথে।
অনাবিলের এমন একটা অবান্তর কথা শুনে অজান্তা ঔৎসুক্য দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললো,
— কেন তাঁকে পেলেন না? অনাবিল ম্লান হেসে বললো,
— সে যে আমার ভালোবাসাটা কখনোই অনুভব করতে পারলো না! আমার ভালোবাসাটা সেই মানবী কখনও উপলব্ধিও করলো না। আর আমিও তাঁর সামনে গিয়ে কখনোই কোনভাবেই বলতে পারলাম না, ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে। অনাবিলের কথা শুনে অজান্তা অধীর কন্ঠে বললো,
— বলেন কি অনাবিল ভাই! এতো সুদর্শনীয় পুরুষকে দেখেও সেই মেয়েটি আপনার সামনে এসে বললো না,
অনাবিল খুব ভালোবাসি তোমায়! কেমন মেয়ে সে?
— এতো কিছু জানি না। তবে সেই মেয়েটি ছিলো, আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ রমণীদের মধ্যে একজন!
— কেন এখন আর নেই বুঝি?
— হুম এখনো আছে, আর সারাটা জীবনই থাকবে।
— কে সেই ভাগ্যবতী রমণী?
— উঁহুম। তোমাকে বলা যাবে না।
— ওহ।
কথা বলতে বলতে অজান্তা হঠাৎ তাঁর মেয়ের দিকে তাকাতেই দেখলো, অর্থি বার বার তাকাচ্ছে অনাবিলের দিকে। অজান্তা তাঁর মেয়ের এই চোখের চাহনিটা বোঝে। অর্থি যখন কারো কোলে যেতে চায় ঠিক তখনই সে এমন ছটফট করে। অজান্তা তখন ক্ষীণ স্বরে বললো,
— অর্থি না আপনার কোলে যেতে চায়ছে। যদি কোন সমস্যা না থাকে, তাহলে ওকে একটু কোলে নিন না অনাবিল ভাই।
— না না কোন প্রবলেম নেই। অর্থিকে দাও আমার কাছে। অনাবিল অর্থিকে কোলে নিতেই অর্থি অনাবিলের মুখে চুমু খেয়ে অস্পষ্ট ভাবে টেনে টেনে বললো,
— আব্বু আব্বু!
অর্থির এমন কথা শুনে অজান্তা অনাবিল দুজনেই স্তম্ভিত বাকরুদ্ধ। সহসা অজান্তা অর্থির গালে হাত দিয়ে কোমল কন্ঠে বললো,
— না সোনা উনি তোমার আব্বু নয়, আঙ্কেল। অজান্তার বলা সেই কথাটা শুনে অর্থি আবারও বললো,
— না এটা আমার আব্বু। কথাটা বলে অর্থি অনাবিলের দিকে তাকিয়ে বললো,
— তুমি আমার আব্বু না? অর্থির কথা শুনে অনাবিল আধো হেসে বললো,
— না অর্থি আমি তোমার আব্বু না, তোমার আঙ্কেল। অনাবিলের কথা শুনে অর্থি রেগে গিয়ে অনাবিলকে মারতে মারতে বললো,
— না তুমিই আমার আব্বু। বলো তুমি আমার আব্বু? উপায়ন্তর হয়ে অনাবিল অগত্যা মৃদুস্বরে বললো,
— হুম সোনা আমিই তো তোমার আব্বু, এবার হ্যাপি তো? অর্থি তখন একগাল হেসে অনাবিলের বুকে মাথা রেখে চুপ করে রইলো। অনাবিল তখন অজান্তার দিকে তাকিয়ে বললো,
— অর্থি কি ওর বাবাকে চেনে না? সহসা অজান্তা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
— চেনে তবে, ওর বাবা ওকে একদম সময় দেয় না। সব সময় বিজনেসের কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকে। মাঝরাতে বাড়িতে আসে, রাতদিন চব্বিশটা ঘন্টাই সে অশ্রান্ত ভাবে টাকার পিছনে ঘোরে! আমি তাঁকে কতবার করে বলেছি,
— এতো টাকা-পয়সা দিয়ে হবেটা কি? তোমার যা আছে তাইতো যথেষ্ট। তবু্ও তাঁর সেই একই কথা,
— আরো বড় বিজনেস আমি গড়ে তুলতে চাই, এই শহরের বুকে। সুপ্রতিষ্ঠিত-সুপ্রসিদ্ধ বিশিষ্ট বিজনেস ম্যান হিসাবে, আমি পরিচয়-পরিচিতি পেতে চাই। অজান্তা কিয়ৎক্ষণ থেমে আবারও অধীর কন্ঠে বললো,
— তাঁর এতো ব্যাতি-ব্যস্ততার মাঝে, আমাদেরকে সময় দেওয়ার মতো সময়টাই বা তাঁর হাতে কই! মেয়েটা কতদিন তাঁর বাবার কোলে যেতে চেয়েছে, তবে সে সেই দিকে লক্ষ্য না করে গভীর ধ্যানে নিবিষ্ট হয়ে তাঁর বিজনেসের সব কাজ করেছে। অর্থি কতোবার যে আব্বু আব্বু বলে ওর বাবাকে ডেকেছে, কিন্তু অর্থির সেই ডাকে কোন প্রকার সাড়াশব্দও দেয়নি ওর সো কলড বাবা। সময় যেতে যেতে অর্থিরও কোন টান নেই ওর বাবার প্রতি! ওর বাবা অবসর সময়ে হাজার বার ডাকলে, কোলে নিতে চাইলেও অর্থি কোনমতেই যেতে চায় না ওর বাবার কোলে। অজান্তা চাপা এক হতাশার অনুশোচনার তীব্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— সত্যি কথা বলতে, সুখ-শান্তি একটা আপেক্ষিক বিষয়! শুধু টাকা-পয়সা বিলাসিতা-বিলাসবহুল জীবন যাপন করে, প্রকৃত সুখের মুহূর্ত উপভোগ করা যায় না! সুখ তো একটা অন্যরকম অদ্ভুত রকমের অদৃশ্য বস্তু, যা কারুকার্য খচিত বিরাট, বিস্ময়কর স্বর্ণের অট্টালিকাতে থেকেও পাওয়া যায় না! আবার কুঁড়েঘরে থেকেও অবারিত অফুরন্ত সুখ সুখের অনুভূতি অনুভব করা যায়। কথা থামিয়ে অজান্তা অনাবিলের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
— অর্থিকে আমার কাছে দিন, বাসায় যেতে হবে। অনেক দেরি হয়ে গেল! অনাবিল অর্থিকে অজান্তার কোলে দিতে গিয়ে দেখলো, অর্থি পরম তৃপ্তিতে অনাবিলের গলা জড়িয়ে ধরে সুখকর দিবানিদ্রায় মগ্ন হয়ে আছে। হঠাৎই অর্থির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অনাবিলের অর্থি প্রতি কেমন এক অদ্ভুত আবেশ মাখানো মায়ার গভীর টান অনুভব করছিলো! অভিন্সা না থাকা সত্ত্বেও অনাবিল অর্থিকে অজান্তার কোলে তুলে দিলো। অর্থিকে কোলে নিয়ে অজান্তা সামনের প্রান্তে হাঁটা শুরু করলো। অচিরেই অনাবিলের বুক চিরে চাপা এক দীর্ঘতার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো! অনাবিল বিষাদ পূর্ণ কন্ঠে বললো,
— ভাগ্য সহায় হলে অর্থি তো আজ সত্যি সত্যিই আমার মেয়ে হতে পারতো। জানো অজান্তা হৃদয়ের অন্তরালে লুকিয়ে রেখেছিলাম তোমায়, তাইতো তুমি কখনও উপলব্ধি করতে পারলে না কতটা ভালোবাসি তোমাকে।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা