অর্চিতার হাতের আঙ্গুল গুলো বেশ লম্বা লম্বা। তাতে আবার কায়দা করে নেইল পলিশ লাগানো।
ওর ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকে আটকে পড়া ডানহিলের কাঠিটার দিকে আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।
মেয়েটা বহুত কায়দা করে কাঠিটার উপযুক্ত ব্যবহার করার চেষ্টা করছে।
আমি অপেক্ষা করছি কখন সে খকখক করে কাশা শুরু করবে।
জীবনে প্রথমবার ধোঁয়া টানার অভিজ্ঞতা মোটামুটি সবারই এক রকম হয়।
আমাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটা একটুও না কেশে পুরো সিগারেটটা শেষ করে ফেললো।
তার চোখে মুখে ‘দেখসিস আমি কি বস’ টাইপ অভিব্যাক্তি! আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম। এই মেয়ে উপরের লেভেলের মিচকা শয়তান।
সে সিগারেটের ধোঁয়াতে মুখ ভরেছে তারপর মুখ থেকে ভুসভুস করে ধোঁয়া ছেড়েছে। ধোঁয়া না গিললে কাশবে কোত্থেকে!
আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি আমি বাজীতে হেরে গিয়েছি।
২০০টাকা খরচ করে ডানহিলের একটা গোটা প্যাকেট কেনাটা পুরোপুরি লস প্রজেক্ট হয়ে গিয়েছে।
তবুও নিজেকে জেতানোর উদ্দেশ্যে আমি গলাকে যতটুকু সম্ভব ভারী করে বললাম,
দ্যাখ তুই কিন্তু শর্ত মানিসনি। বাজীর একটা টাকাও পাবিনা। সিগারেটের ধোঁয়া না গিললে ওইটাকে সিগারেট খাওয়া বলেনা।
তুই দূরে গিয়ে উলটা হয়ে ঝুলে থাক। জীবনে কোনদিন আমার সাথে পেরেছিস বাজীতে?
আর কোনদিন মেয়ে বলে আন্ডারস্টিমেট করবি? বল করবি?
এই মেয়ের সাথে আসলে কথা বলাটা ঠিক না।
মানুষজন বেয়াড়া হলে তাকে চড় থাপ্পড় দিয়ে ঠিক করে দেয়া যায়,
কিন্তু যে মানুষ বেয়াড়া হবার উপর পিএইচডি ডিগ্রী করে ফেলেছে তাকে সিধা করার কোন উপায় বুদ্ধি আমার জানা নেই।
কখনো জানার সম্ভাবনাও নেই। কিন্তু এই অসম্ভব বেয়ারা মেয়েটাকেই আমার অসম্ভব ভালো লাগে।
অর্চিতা যেমন ঠিক তেমন করেই ওকে আমার ভালো লাগে। অর্চিতা, একটু পাগলাটে, বাউন্ডুলে, কিছুটা বাঁধন ছাড়া একজন।
ও আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসির অধিকারিণী ,
যেই হাসিতে হুমায়ুন আজাদের উক্তির মতো মাংস পেশীর কৃতিত্ব নেই,
আছে সুন্দর একটা মনের অবদান।অর্চিতা আমার মায়ের পরে পৃথিবীর একমাত্র মেয়ে যাকে আমি ভালোবাসি।
ভালোবাসার পুরো ব্যাপারটিই ভীষণ রকম খেয়ালি।
আপনি কারো বাহ্যিক প্লাস্টিক সৌন্দর্য কিংবা মাস শেষে পকেট কতটা ভারী হয় কিংবা শহরে কয়টা বহুতল বাড়ী আছে,
কয় বিঘা জমি আছে কিংবা কত শত ডিগ্রী আছে তা দেখে কাউকে ভালোবাসতে পারবেন না।
আপনি যখন কাউকে ভালোবাসবেন তখন কোন কারণ ছাড়াই ভালোবাসবেন, ভালোবাসতে কারণ লাগে না, কোন যুক্তি লাগেনা।
এই ভারী ভারী কথা গুলো অর্চিতা বিশ্বাস করতো একেবারে মনের ভেতর থেকে।
যার বিশ্বাসের বুনিয়াদ এতো পোক্ত, এতো অন্যরকম তাকে ভালো না বেসে, তার প্রেমে না পড়ে কি কোন উপায় আছে?
তাই আমিও অর্চিতার প্রেমে পড়ে গেলাম, একদম ঘাড়মোড় ভেঙ্গে পড়া যাকে বলে।
কিন্তু কাউকে ভালোবাসলেই ভালো লাগলেই তাকে এই কথা জানাতে হবে সেই নীতিতে আমি বিশ্বাসী ছিলাম না।
আমার মনে হতো আমি আমার অনুভূতিগুলো জানিয়ে দিলেই বুঝি অর্চিতার উচ্ছলতাটুকু হারিয়ে যাবে,
বুঝি ও আর আমার সামনে সহজ হতে পারবেনা…
চোখের সামনে একটা হেসে খেলে বেড়ানো চটপটে আর দুরন্ত ঘাস ফড়িং মেয়েকে তাই কখনো বলিনি কি উত্তাল ঝড় নিয়ে ঘুরি বুকের ভেতর,
বলিনি পাজরে পাঁজরে ঝড়ের আঘাত লেগে আছে, হারিয়ে ফেলার একটা হাহাকারে ভরা ভয় আছে।
সেই ভয় সত্যি করে দিয়ে একদিন অর্চিতা হারিয়ে গেলো সেটা অবশ্য অনেক পরের গল্প।
আমাদের দুজনের একসাথে থাকার গল্প গুলো সুন্দর ছিলো। ছিলো বলাটা ঠিক হচ্ছেনা, গল্প গুলো সুন্দর আছে।
স্মৃতি তো কখনো বদলে যায়না, আমাদের সাথে থাকার গল্প গল্প স্মৃতি গুলো তাই সুন্দর আর জীবন্ত হয়েই আছে, আমার কাছে।
অর্চিতার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ক্লাস ফাইভে। ও ছিলো একটা গার্লস স্কুলে।আমরা একই কোচিং এ ভর্তি হয়েছিলাম।
ছেলেবেলার ইঁচড়ে পাকা আমি, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটে ভয়াবহ অবিশ্বাসী আমি সেদিন কোচিং এ বসেই কোচিং এর গুষ্টি উদ্ধার করছিলাম,
ভাবছিলাম সামনের দিন থেকে আর এই মরার জায়গায় আসছিনা অন্তত। একাডেমিক পড়ালেখা আমার কোনদিনই ভালো লাগেনি।
তার উপর এইসব কোচিং টোচিং আমার একদমই ভালো লাগতোনা।
হ্যাংলা পাতলা মেয়েটা যখন ক্লাস রুমে এসে ঢুকলো লাস্ট বেঞ্চির আমি তাকে এক দৃষ্টিতে স্ক্যান করা শুরু করলাম।
মেয়েটার সাথে আরো কেউ একজন ছিলো, দুজনে নিজেদের কানে মুখে কি একটা বললো আর হিহি করে হেসে উঠলো…
সেই হাসিতেই সর্বনাশের ঘন্টা গিয়েছিলো বেজে। ছোটখাটো চশমা পড়া শ্যমলা একটা মুখ,
চিবুকের কাছটায় একটু কাটা আর হাসলে দুই গালের গভীর টোল। প্রেমে পড়ার জন্যে ওই বয়সে এতোটুকুই যথেষ্ট ছিলো।
কোচিং ছেড়ে দেবার চিন্তা ভাবনা ছেড়ে দিয়ে বরং প্রতিদিন আগে আগে যাওয়া শুরু করলাম।
আড় চোখে মেয়েটাকে দেখি, ক্লাসে ওকে ইম্প্রেস করার উদ্দেশ্যে বিদ্যা ফলাই। এক ফাঁকে জেনে নিলাম তার নাম।
সবাই অর্চিতাকে ছোট করে অর্চি ডাকতো। ছোট খাটো মেয়ের জন্য ছোট্ট একটা নাম।
কিন্তু আমি মনে মনে ওর অন্য একটা নাম দিয়েছিলাম।
হৃদয়ের কাছাকাছি বসবাস করা প্রিয় মানুষের জন্য মায়া মায়া একটা নাম, প্রিয়তা। কিন্তু এদিকে দূর্ঘটন ঘটেছিলো অন্য জায়গায়।
যাকে ইম্প্রেস করার জন্য এতো পড়াশোনা করতাম নিজের অজান্তেই তার শত্রু হয়ে গিয়েছিলাম,
বেশিরভাগ ভালো ছাত্রের একটা সমস্যা থাকে তার থেকে কেউ বেশি জানবে বা পারবে এটা সে মেনে নিতে পারেনা।
অর্চিতা, আচ্ছা ওকে বরং প্রিয়তা বলেই ডাকি, সেও মেনে নিতে পারলোনা।
একদিন দুম করে আমি আবিষ্কার করলাম আমি মেয়েটার শত্রু হয়ে গিয়েছি।
পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কড়া লুক দেয়, ছোট খাটো ঘটনায় ঝগড়া বাঁধায়, আমি জানিনা কেন মজা পেয়ে গেলাম।
তক্কে তক্কে থাকতাম ঝগড়া করার জন্য। রেগে গেলে প্রিয়তার নাকের কিনারা লাল হয়ে যায়। আমার খুবই আনন্দ লাগতে থাকে।
কিন্তু একদিন প্রিয়তা কোচিং ছেড়ে দিলো।
প্রথম প্রথম অপেক্ষা করতাম তারপর একদিন যখন বুঝে গেলাম ও আসবেনা, দেবদাসের মিনি সন্সকরন হয়ে গেলাম।
ওই বয়সে দাঁড়ি গোফ তো উঠেনি, মদ খেয়ে টাল হওয়াও স্মভব ছিলোনা। আমি সেটাই করলাম যেটা সম্ভব ছিলো।
পড়াশোনা মোটামুটি ভাবে ছেড়ে দিলাম… কোনমতে পাশ করে টেনে টুনে এস এস সি পরযযন্ত এগুলাম।
কাজের মধ্যে কাজ ছিলো এলাকার বিশিষ্ট প্রেমিক পুরুষ হয়ে যাওয়া।
কয়দিন দোতালার মলিকে ভালো লাগতো কয়েকদিন পাশের ফ্ল্যাটের কলিকে। এরমধ্যেই একদিন রেজাল্ট দিয়ে দিলো!
রেজালতের পর হতভম্ভ হয়ে আবষ্কার করলাম এ+ পেয়ে গিয়েছি। তারপর শহরের সেরা কলেজের একটাতে ভর্তি।
অর্চিতার সাথে আবার দেখা হলো লাইব্রেরীতে বই কিনতে গিয়ে। নিজেই আগ বাড়িয়ে কথা বলেছিলাম সেদিন।
তারপর আমার অস্থায়ী নিবাস অর্চিতার কলেজ চত্বর হয়ে গেলো!
প্রতিদিনের দেখা, একটু হাত নাড়া, একটু হাসি এসবের ফাঁকেঅর্চিতা কখন যে আমার বন্ধু হয়ে গেলো!
ধীরে ধীরে আমি ওকে জানলাম, বুঝলাম এবং আবার প্রেমে পড়লাম!
অর্চিতার সাধারণতার মাঝে যে অসাধারণ মানুষটা বাস করতো তার পরিচয় পেয়ে আমি খুশী ছিলাম।
আমরা ঘুরে বেড়াতাম, কলেজ শেষে আমি চলে যেতাম ওর কলেজের সামনে,
নামী কলেজের ভারী ব্যাগের ভারে নুএ পড়া ছোট্ট অর্চিতার ব্যাগ টানা শুরু করেছিলাম যেদিন সেদিন ওর কি হাসি…
আমি দেখতাম আর ভাবতাম কবি হয়ে গেলে আর খারাপ কি… এবং ভাবতে ভাবতেই জীবনের প্রথম কবিতা লিখে ফেললাম।
বালিকা আমার কবিতার পঙক্তি হবি তুই?
তোকে লিখবো আঁকবো অনেক যত্নে…
ইরেজারে ঘষবোনা কলম দিয়ে কাটবোনা
শুধু নিউরণে করবি বসবাস…
বালিকা আমার দিনান্তের স্মৃতি হবি তুই?
তোকে সাজাবো গুছাবো অনেক যত্নে …
ধুলো জমবে না তোর ছায়াতেও
হবি আমার দীর্ঘশ্বাস…
বলাইবাহুল্য কন্যার আমার এই প্যানপ্যানানি টাইপ কবিতা ভালো লাগেনাই।
সে মানুষ ছোট খাট হতে পারে কিন্তু তার যাবতীয় ভারী লেখাপত্র পছন্দ। সে আমার মুখের উপর ফ্যা ফ্যা করে হেসে দিলো।
একটা মেয়ে যাকে আপনি পছন্দ করেন তার হাসি মাঝে মাঝে গায়ে জ্বলুনি ধরিয়ে দিতে পারে এটা আমি সেই মুহুর্তে আবিষ্কার করেছিলাম।
যাই হোক অর্চিতাকে আর আমার কোনদিন বলা হলোনা কবিতা লেখার পেছনের কারণ কিংবা উদ্দেশ্যসে ছিলো।
একদিন বিকেলে খুব আড্ডার মাঝে ও নিজের মনকে আমার সামনে মেলে দিয়েছিলো, যেন খোলা বই।
আর আমি সুযোগ পেয়ে টুক করে ওকে পড়ে ফেললাম। জানলাম ওর ইচ্ছার কথা, স্বপ্নের কথা। ওর পরিবারের মানুষ গুলোর কথা।
অর্চিতার একটা বড় ভাই ছিলো, রাশভারী গম্ভীর টাইপ বড় ভাই। ওদের চার ভাই বোনের সংসারে ও ছিলো মেঝো।
ওদের বাবা হুট করে যখন চলে যায় ওর ভাই পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। পড়াশোনা করেছেন করিয়েছেন।
ওদের মা মানুষটা ভীষণ রকমের আধুনিক মনের অধিকারী, ছোট জমজ দুটো ভাই বোন,
বাইরে থেকে আপাদমস্তক সুখি পরিবার ভেতরে কিছু দুঃখ তো আছেই কিন্তু ওগুলো বড় নিজস্ব, ও কাউকে তার ভাগ দিতে চায়না।
আরো জানলাম নির্মলেন্দু গুণের কবিতা অর্চিতা খুব ভালোবাসে, সাদা তারার মত বেলি ফুলের ঘ্রাণ অর্চিতার খুব প্রিয়,
শীত গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা সব ঋতুতে অর্চিতার আইসক্রিম চাইই চাই। অর্চিতার নিজস্ব কিছু মতবাদ ছিলো।
পড়ালেখা শুধু একটা চাকরীর জন্য করাটাকে ও মেনে নিতে পারতোনা ঘৃণা করতো। ওর কথা জানার জন্য পড়ছি চাকরীর জন্য না।
ওর দুনিয়াটা পুতুল খেলার সংসারে সীমাবদ্ধ ছিলোনা… ও বড় হতে চাইতো… আকাশের সমান বড়।
আর আমি ফাঁকতালে লাইফ পার্টনার সম্পর্কে ওর মতামত জানতে চেয়ে জানলাম ওর বাঁধনহারা মানুষ পছন্দ।
শিক্ষিত পড়ুয়া ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একটু যত্নশীল কাউকে ওর দরকার হবে ভবিষ্যতে…
মনে মনে কতশত বার যে আউড়ে গিয়েছি শব্দ গুলো সেদিন। কলেজের দুর্দান্ত দিন গুলো চোখের সামনে দিয়ে উড়ে উড়ে গেলো…
উচ্ছ্বল অর্চিতা যেদিন পাথর হয়ে গেলো সেদিনটা আমার বেশ মনে আছে। ও আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিলো
একটু বাসায় আসতে পারবি?
ওর গলা শূন্য শুন্য লাগলো। যতদ্রুত সম্ভব ওর বাসায় গিয়েছিলাম।
বাসার সামনে বড় জটলা আর কান্নার আওয়াজে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম, সাদা চাদরে মোড়ানো অর্চিতার বড় ভাই।
ছিনতাইকারীর ছুরিতে অর্চিতার ভাইএর সাথে ওদের পরিবার ও সেদিন এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিলো।
তারপর থেকে অর্চিতা কে আর কখনো হাসতে দেখিনি।
তারপরের ঘটনা গুলো ঘটলো খুব বেশি দ্রুত গতিতে। কলেজ লাইফটা শেষ হয়ে গেলো…
ভার্সিটি লাইফ, পড়াশোনার পাশাপাশি এইবার প্রথম আমরা সত্যিকারের বড় হতে শুরু করলাম।
বলা ভালো আমি বড় হতে শুরু করলাম। অর্চিতা তো কবেই বড় হয়ে গিয়েছিলো… আগের মতো তো একেবারেই ছিলো না।
যেই ভয় আমি সবচেয়ে বেশি পেতাম সেটাই ঘটে বসলো। অর্চিতার ভেতরটা আমূল বদলে গেলো।
যেদিন ওর বিয়ের কার্ডটা হাতে পেলাম সেদিন আমি ভেতরে ভেতরে কেমন একলা হয়ে গেলাম।
ঘাস ফড়িং থেকে বদলে যাওয়া পাথরের ভাস্কর্য মেয়েটাকে বলা হলোনা,
তার জন্য আমি charles Bukowskiএর কিছু কথা আলাদা করে রেখেছিলাম-
“ I loved you like a man loves a woman he never touches, only writes to, keeps little photographs of.”
বলা হলো না নির্মলেন্দু গুনের শুধু তোমার জন্য কবিতার প্রতিটা শব্দকে কত যত্নে আগলে রেখেছিলাম,
বলা হয়নি আমার ছোট এক চিলতে বারান্দার পুরোটা জুড়ে এখন শুধু সাদা বেলিফুলের গুল্ম।
কিছু বলা হয়নি।শুধু একদিন দেখা করে বলেছিলাম,
কেন প্রিয়তা কেন??
উত্তরে ও খুব ঠান্ডা কন্ঠে জানিয়ে দিলো এই শহরে বেঁচে থাকা কতটা কঠিন হয়ে পড়েছিলো ওদের জন্য।
মাথার উপর কোন অভিভাবকের ছায়া নেই, উঠতে বসতে শুনতে হতো সবার কত শত মন্তব্য।
ওর মা আর ওর চারপাশের সমাজ ওকে জানিয়ে দিয়েছিলো ঘরে ওর মত বয়েসী একটা মেয়ে থাকার বিড়ম্বনা কতখানি।
শকুন আর শিয়ালদের ওত পেতে থাকার গল্প। অর্চিতার মা শেষের দিকে নাকি রাতে ঘুমোতেন না।
তারপর একদিন এক বিশিষ্ট ধনী ভদ্রলোক অর্চিতাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
অর্চিতাদের পুরো পরিবারের দায়িত্ব তিনি নিতে রাজি হয়েছেন,
সেই সময় এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাওয়া ছাড়া একটা মেয়ে আর কিইবা করতে পারতো… আমার অর্চিতার উপর খুব রাগ হলো।
ও কেন নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করলোনা কেন হাল ছেড়ে দিলো…আরো হাজারটা কেন।
এখন বুঝি অর্চিতা , আমার প্রিয়তা ভেঙ্গে পড়েছিলো। একটা কাঁচের আয়নার মত ভেঙ্গে পড়েছিলো মেয়েটা।
ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো কি আর জোড়া লাগে… লাগেনা। আর আমিইবা কি করেছি ওর জন্য? কীইবা করতে পারতাম।
মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে কি করতে পারতাম আমি? তাই চেয়ে চেয়ে দেখলাম প্রিয়তার চলে যাওয়া।
যাওয়ার সময় ওর চোখে কোন অভিমান ছিলোনা বরং নির্লিপ্তিতা ছিলো। একবার ভেবেছিলাম ও কে যেয়ে বলবো
“বলতে এলাম ভালোবাসি…”
পরক্ষণেই মনে হলো এবেলা বরং ওসব থাক।
ওই কথাটা বলার জন্য কোন যুক্তি তো ছিলোই না আর সময়, সেওফুরিয়েছিলো অনেক আগেই…
প্রিয়তার ধনী পতিদেবের শহরে বেশ কয়েকটা বাড়ি ছিলো, ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যবসা ছিলো,
অঢেল সম্পদ ছিলো শুধু ছিলোনা অর্চিতাকে বোঝার মত মন।
ওনার অবশ্য জীবন সঙ্গীর চেয়ে একজন শয্যা সঙ্গীর প্রয়োজন ছিলো বেশি। অর্চিতাকে তার প্রয়োজন হতো শুধু রাতের বেলায়।
একটা মেয়ের জন্য ব্যাপারটা ভয়ঙ্করতম লজ্জার।
অর্চিতার ছোট শরীর তখন কেমন ঘৃণায় কুঁকড়ে যেতো তা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে চাইনা।
বিয়ের পর অর্চিতা একলা থেকে একলাতর হয়ে গিয়েছিলো। কাকে বলবে সে এসব কথা?
মা কে বলতে পারতোনা, ভাইবোন গুলো ছোট ছোট আর আমি তার সো কল্ড বেস্ট ফ্রেন্ড সে তো অন্য গ্রহের বাসিন্দাই হয়ে গিয়েছিলাম।
ওসব কথার তাই ঠাঁই ওর একটা ছোট ডায়রীর পাতায়। ওসব অনেক পরে আমার হাতে এসেছিলো।
একসময় ও ভার্সিটি আসা ছেড়ে দিলো, যোগাযোগ ও ছেড়ে দিলো।
অর্চিতার উপর কি একটা অজানা অভিমান খুব কাজ করতো তখন আমার, আমিও তাই যোগাযোগ করিনি।
তারপর তো দেশ ছাড়লাম। নিজেকেব্যস্ত হয়ে গেলাম আমি, অনেক ব্যস্ত।
পাঁচবছর পরের এক বিকেলে গরম কফির মগে চুমুক দিতে দিতে আমার দেশের কথা মনে পড়লো, অর্চিতার কথা মনে পড়লো।
আমি ভাবতে বসলাম ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো নিয়ে আর আবিষ্কার করলাম কত বড় হিপোক্র্যাট আমি!
আমি বুঝতে পারলাম অনুশোচনা করার জন্যওআমি কত দেরি করে ফেলেছি। আমি কত বড় ভুল করে ফেলেছি।
আমি সে সময়ে, অর্চিতার সেই ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের সময় গুলোতে ওকে ছেড়ে চলে এসেছি। আমি কতটা ভিতু কতটা কাপুরুষ।
প্রতিটা মুহুর্তে নিজের দহন দেখতে লাগলাম তারপর। আয়নায় নিজেকে দেখতে ইচ্ছে হতোনা।
যেদিকে তাকাই যেন প্রিয়তা হাসছে, অবজ্ঞার হাসি। চোখ বন্ধ করলে দেখি চোখে মুখে তাচ্ছিল্য নিয়ে প্রিয়তা তাকিয়ে আছে।
আমার বেঁচে থাকাটা অসহ্যকর হয়ে গেলো। সব ছেড়েছুড়ে দেশে চলে আসলাম। মনে হচ্ছিলো ক্ষমা চাইতে হবে।
আমি আসলে প্রিয়তার কিছু হতে পারিনি। না বন্ধু না স্বজন না প্রিয়জন।
কঠিন বিপদের সময় যে হাত ছেড়ে দেয় সে আর যাইহোক বন্ধু তো হতে পারেনা।
আমি ওর সাথে যতদিন ছিলাম ততদিন তো শুধু নিজেকে নিয়ে নিজের জীবন নিয়েই ভেবেছি। অবশেষে আমার বোধদয় হলো।
আমি বুঝলাম ক্ষমা চাইতে হবে। দেশে ফিরলাম হুট করে। কে জানতো দেশে আমার জন্য অপেক্ষা করছে অনেক বড় চমক!
দেশে ফিরে জানতে পারলাম একটা ভয়ঙ্কর কিন্তু রুঢ় সত্য। আমার দুনিয়া ফাঁকা হয়ে গিয়েছিলো।
প্রায়শ্চিত্য করার এতোটুকু সুযোগ কি আমি পাবোনা? আমি জানতে পেরেছিলাম অর্চিতা দূরে চলে গিয়েছে, অনেক দূরে।
অনেক খানি একা থাকার অভিমান নিয়ে একা একাই অর্চিতা না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে ,আরো এক বছর আগে।
ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছিলো ওর। ওর পাষন্ড পতি সেই মেয়েকে অর্চিতার নানীর কোলে ফেলে গিয়েছে।
শুনেছি সে নিজে বিয়েও করেছে আরেকটা। অর্চিতার পরিবারের দেখভাল করা তো দূরের কথা কখনো খোঁজ ও নেয়নি আর।
অর্চিতার পরিবারকে খুঁজে বের করতে বেগ পেতে হয়েছিলো অনেক আমার। ওর মা কে দেখে চমকে উঠেছিলাম।
অদ্ভুত সুন্দর স্নিগ্ধ সেই মহিলার চোখে মুখে কেমন বিদায়ের আকুতি। পৃথিবী তো তাকে কম আঘাত দেয়নি।
কি করে যে সবাইকে হারিয়ে বেঁচে ছিলেন। জানলাম প্রিয়তার মেয়েকে সামলানোর ক্ষমতা তার নেই।
তাই নাতনিকে এক পরিবারের কাছে দত্তক দিয়েছেন। মাঝে মাঝে যেয়ে দেখে আসেন। ওনাদের ঘর থেকে বেড়িয়ে আসলাম।
সেদিন আমি আমার গন্তব্য আর কর্তব্য দুটোই জানি।
আরিনা আমার অনেক আদরের মেয়ে। একটা ছোট ফড়িং ছানা আমার। ওকে নিয়ে দিব্যি আছি।
ওকে যেদিন এতিমখানায় প্রথম দেখি আমার মনে হয়েছিলো ছোট্ট একটা অর্চিতা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
সেই ছোট খাটো গড়ন, চিবুকের কাছটায় একটু কাটা আর দুই গালে গাঢ় টোল। ওকে আমি বুকে করে ঘরে নিয়ে এলাম।
অর্চিতার একটু স্মৃতিই নাহয় আমার কাছে থাকুক।
বৈশাখের পড়ন্ত বিকেল গুলোতে আরিনা যখন আমার বাড়ির লনে ছোট ছোট পায়ে হেঁটে বেড়ায়, তখন আমি দূর থেকে তাকে দেখি।
আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সেই মুহুর্ত গুলোতে আমার , আমার প্রিয়তাকে খুব মনে পড়ে।
আমার মনে হতে থাকে ও বুঝি আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।