কালো সানগ্লাস পরা মেয়েটিকে প্রথম দেখাতেই আমার ভালো লেগে গেলো। মনে হলো এর জন্যই আমি অপেক্ষা করছি। কক্সবাজার লাবনী পয়েন্টের সী-বিচে দুটো মেয়ে পানিতে ভিজছে ও ছুটাছুটি করছে।সফেন সমুদ্রের ঢেউ মেয়ে দুটোর পায়ে এসে আছড়ে পড়ছে। প্রচন্ড বাতাসে চশমাপরা মেয়েটির খোলা ঘনকৃষ্ণ চুল পৎপৎ করে উড়ছে। অক্টোবরের শেষ। হেমন্ত শুরু। ভোরে শিশির ভেজা থাকে। সকালে গা শিরশিরানি হিমেল হাওয়া। একটা ভালো লাগার আমেজে মনটা যেনো ভরে থাকে। এখন সকাল সাড়ে দশটা বাজে। যদিও হেমন্তের সকাল, একটু একটু করে রোদের তিব্রতা বাড়ছে।
মেয়েটি উজ্জ্বল শ্যামলা, হাইট ৫’ ৭” হবে। কালো সানগ্লাসের জন্য আসল চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। পরনে মেরুন কালারের শাড়ী, সাদ ব্লাউজ। তবে দেহ সৌষ্ঠব খুব আকর্ষনীয়া ,ওয়াও যে কারো ঘুম হারাম করার জন্য যথেষ্ট। খিলখিল করে যখন হাসছে তখন জলতরঙ্গের আওয়াজের মত মিষ্টি লাগছে। রবি ঠাকুরের গান মনে এলো
আমারো পরান যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো সাথে একজন মহিলা রয়েছে। মা অথবা, ভাবি হবেন। নিরাপদ দুরত্বে শুকনো বালির উপর একজন পুরুষ কাধে অনেক গুলো লেডিজ ব্যাগ ও হাতে লেডিজ স্যান্ডেল নিয়ে কাকতাড়ুয়া ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছেন কখন রমনীদিগের জলকেলি শেষ হবে। আমি অনতিদূরে রঙ্গীন ছাতার নিচে বিচ চেয়ারে শুয়ে আছি। আমার আর পনেরো মিনিট সময় আছে। ও আমার পরিচয় দেয়া হয় নি। আমি কামরান আহমেদ। একটা এনজিওর সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। লন্ডন থেকে এমবিএ করে এসেছি। বয়স ?
নাহ থাক বয়সটা নাই বললাম। দুর্ভাগ্যবশত এখনো অকৃতদার। উচ্চতা ৫’ ৯”। গৌর বর্ন, মাথা ভর্তি ঘন কৃষ্ণ কোঁকড়া চুল, লম্বাটে মুখ, লোমশ বুক, জিম করা শরীর। দেখো কান্ড, তখন থেকেই নিজের প্রশংসাই করে যাচ্ছি। কাকতাড়ুয়া মূর্তিটিকে ভালো করে দেখতে চেষ্টা করছি। মুখটা চেনা চেনা লাগছে। কাউচ থেকে উঠে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ কাকতাড়ুয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো কামরান না ? আমি ভালো ভাবে চেয়ে দেখলাম রায়হান গফুর!! হ্যাঁ রায়হানই তো । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকনোমিক্সে মাষ্টার্স একসাথে করেছি। তারপর আমি চলে গেলাম লণ্ডন। মাঝখানে দীর্ঘদিন কোনো দেখা সাক্ষাৎ নাই। দুই বন্ধু দীর্ঘ আট বছর পর দেখা। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, হ্যাঁ তাহলে চিনতে পেরেছিস।
চিনবো না মানে ? তোর কথা কি ভোলা যায় ! ছিলি তো লেডি কিলার। ডিপার্টমেন্টের সব মেয়েরাই তো তোর চারপাশে ঘুরঘুর করতো। আমরা কি জেলাস ফিল করতাম !! বিয়ে টিয়ে করেছিস না এখনো পুষ্পে পুষ্পে বিচরণ চলছে ? ওর কথা বলার স্বভাবটাই এরকম। একটানা কথা বলতে পারে। কাউকে বলার সুযোগ দেয় না। ততক্ষণে মহিলাটি কাছে এগিয়ে এলো। রায়হান পরিচয় করিয়ে দিলো, আমার অর্ধাঙ্গিনী মানে তোর ভাবি। আমাকে দেখিয়ে বললো, আমার বন্ধু কামরান। এর কথাই তো তোমাকে বলতাম। আমাদের বিয়ের সময় ও লন্ডনে পড়াশোনা করছিল। তারপর অনতিদূরে জলকেলিরত মেয়ে দুটিকে দেখিয়ে বললো একটা আমার মেয়ে রায়হানা আর অপরটা আমার শ্যালিকা মৌটুসী। রায়হানা এই যে তোমার আংকেল। ও আমাকে সালাম দিয়ে ওর মায়ের গা ঘেঁসে দাঁড়ালো। তারপর মৌটুসির দিকি তাকিয়ে বললো, এসো পরিচয় করিয়ে দেই, কামরান, আমার ব্ন্ধু।
কামরান meet মৌটুসী, my sister in law. আমি নড করে বললাম হাই। দূর থেকে মৌটুসী যত সুন্দরী মনে হয়েছিল , কাছে দেখা মৌটুসী আরো সুন্দরী ও আকর্ষনীয়া। তাছাড়া পানিতে ওর আধা ভেজা বিস্ফারিত যৌবন দর্শনে নিজেকে দিশাহারা নাবিকের মতো লাগছিল। মনে হলো আমার ভ্যাবাচ্যাকা অবস্হা ও খুব ভালো ভাবেই সে উপভোগ করছে। মেয়েদের সম্ভবত একটা তৃতীয় নয়ন থাকে, যা দিয়ে সে পুরুষের দৃষ্টি ‘decode’ করতে পারে। কাজলকালো হরিণ হরিণ চোখে সে অপলকে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেঁসে বললো কেমন আছেন ? হাসতেই গালের গভীর টোল চোখে পড়লো। মুক্তোর মতো দন্তরাজি তার পানপাতা মুখাকৃতিতে অসাধারণ মানিয়েছে। আমি সম্মোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। চোখ ফেরাতে পারছি না। সমস্ত শরীরে অন্যরকম একটা সুখানুভূতি খেলা করছে। একেই মনে হয়, ” Love at first site” বলা হয়। রায়হান জিজ্ঞেস করলো, কোথায় উঠেছিস ?
আমিঃ হোটেল সি কক্স। তোরা ?
রায়হানঃ লাইট হাউস রিট্রিটে ।
আমিঃ ওটা আবার কোথায়?
রায়হানঃ কলাতলি হিল সাইডে ,মাদ্রাসার সামনে ? চমৎকার নতুন হোটেল। ওদের রুফ টপে একটা ফার্ষ্ট ক্লাস রেস্তোরাঁ আছে। ওখান থেকে পাহাড় ও সমুদ্র দেখা যায়। রাতে আয় একসঙ্গে খাওয়া যাবে।
আমিঃ চেষ্টা করবো।
রায়হানঃ তোর মোবাইল নম্বর বল ?
আমিঃ ০১৮১ ৭০৭ ..…., তুই এই নম্বরে রিং করে নাম্বারটা save করে রাখ।
মোবাইল নাম্বার দেয়া নেয়ার পর্ব শেষ। এবার বিদায়ের পালা। ভাবী ও মৌকটুসির দিকে তাকিয়ে বললাম এখন আসি তাহলে। ভাবি বললেন , রাতে আসবেন কিন্ত, ডিনারের দাওয়াত থাকলো। মৌটুসী হাত নেড়ে বিদায় জানালো। রায়হানাকে বললাম, আংকেল বাই । রায়হান কে বিদায় জানিয়ে হোটেল সি কক্সে ফিরতে ফিরতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেলো। রুমে ঢুকেই বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লাম। কেনো যেনো একরাশ ক্লান্তি ও অবসাদ আমাকে পেয়ে বসেছে। পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে এসেছি তিন দিন চলছে। আরো দুদিন বাকি। এর মধ্যে মৌটুসীর আবির্ভাব মনটাকে এলোমেলো ও অস্হির করে তুলেছে। ভালোই তো চলছিল বাউণ্ডুলে জীবন!!
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। ঘড়িতে দেখলাম দেড়টা বাজে। তড়িঘড়ি করে উঠে শাওয়ার নিলাম। এখন বেশ রিলাক্সড লাগছে। আয়নার সামনে চুল আঁচড়াতে গিয়ে দেখলাম মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ভাবলাম বিকেলে শেভ করলেই হবে। দুপুরে রেস্তোরাঁয় বসে একটা বিশাল রুপচাঁদা ফ্রাই ও বিভিন্ন রকমের ভর্তা দিয়ে উদর পূর্তি করলাম। রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। এখন অল্পতেই টায়ার্ড লাগে। কেনো ? জানি না । তবে ঢাকায় গিয়ে একটা থরো মেডিকেল চেক আপ করাবো ভাবছি। আজকাল হুটহাট করে ইয়ং পোলাপানরা মারা যাচ্ছে !! ঘুম ভাঙ্গলো বিকাল পাঁচটায়। স্বপ্নে মৌটুসী আসবে ভেবেছিলাম। কিন্তু আসেনি। মৌটুসীকে আবারও দেখতে ইচ্ছে করছে। রায়হানের কলের জন্য অপেক্ষা করবো ? কিন্তু ও যদি ফোন না করে। এমন সময়ে ফোন বেজে উঠলো। হ্যাঁ, রায়হানই করেছে। হ্যালো,রায়হান বল?
রায়হানঃ ছটার সময় সুগন্ধায় বার্মিজ মার্কেটে আয়। আমরা যাচ্ছি। দেখা হচ্ছে। ওকে?
বললাম, ঠিক আছে। মেঘ না চাইতেই জল। মনটা আচানক কেনো যেনো প্রফুল্ল হয়ে উঠলো ! আমি তো মনে মনে এটাই চাচ্ছিলাম। খুব যত্ন করে শেভ করলাম। ডেনিম লোশন লাগিয়ে ফুরফুরে মনে গুনগুন করতে করতে জিন্সের প্যান্টের উপর ক্যালভিন ক্লেইনের ক্রিম কালারের টিশার্ট পরে বেরিয়ে পড়লাম। ঠিক ছ’টায় সুগন্ধা পয়েন্টের মার্কেটে গেলাম। শুটকির গন্ধে ম-ম করছে পুরো জায়গাটা। সূর্যাস্ত সমাসন্ন। কিন্ত মার্কেটে আজ বেশ ভিড়। ওদের খুঁজে বের করতে দেরি হলো না মোটেই। দুর থেকে হাল্কা নীল শাড়ি পরা মৌটুসীকে অনেক ভিড়ের মধ্যে মুহূর্তেই আবিষ্কার করে ফেললাম। দূর থেকে আমাকে দেখেই মৌটুসী হাতের ইশারায় ডাক দিলো। আহা, এই ইশারা কত মধুর !!!
আমি সম্মোহিতের মতো ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। রায়হানকে বললাম, কখন আসলি? রায়হানের উত্তর, এই তো পাঁচ মিনিটের মতো হবে। ভাবিকে ছালাম দিতেই জিজ্ঞেস করলেন , ভাই কেমন আছেন ? শুটকি কিনবেন? বললাম দেখি। রায়হানা আমাকে ছালাম দিয়ে বললো আংকেল লইট্টা মাছ আর রুপচাঁদা মাছের শুটকি খুব মজার না ? আমি বললাম, হ্যাঁ খুব মজার। মৌটুসী আমার প্রায় গা ঘেঁষেই মাছটাছ দেখছে। চুলগুলো শ্যাম্পু করে ফাঁপানো। মাঝে মাঝে তা আমার গলা ও মুখ স্পর্শ করে এক অজানা শীহরন সৃষ্টি করছে। ওর পোষাক থেকে একটা সিডাক্টিভ পারফিউমের গন্ধ আমাকে মৌটুসীর পাশে পাশেই থাকতে বাধ্য করছে যেনো। গন্ধটা বুক ভরে নেবার চেষ্টা করছি। আমি শুধু ওকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। কে কি মনে করছে সেই ভাবনা বা ভয় আমার মোটেই হচ্ছে না। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম আপনার কি মাছ পছন্দ ?
মৌটুসীঃ লাক্ষা ও ছুরি শুটকি। আপনার ?
আমিঃ রুপচাঁদা ও চিংড়ি শুটকি।
মৌটুসীঃ আপনার বাসায় কে কে আছে ?
আমিঃ মা ছাড়া আর কেউ নেই।
মৌটুসীঃ কেনো বিয়ে করেন নি ?
আমিঃ দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম, না ওই কাজটা এখনো হয়ে উঠেনি।
মৌটুসীঃ এখনো সময় আছে, চেষ্টা করুন।
আমিঃ মনপছন্দ মেয়ে পাচ্ছি না যে।
মৌটুসীঃ কেমন মেয়ে পছন্দ।
আমিঃ এই ধরুন আপনার মতো মেয়ে পেলে আমি চোখ বন্ধ করে রাজি।
মৌটুসীর টোল পড়া গাল লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। পরক্ষণেই বিষন্ন মনে সে বললো, আমার চেয়ে অনেক সুন্দরী মেয়েকে পাবেন । শুধু আমার দিকে তাকালে ঠকবেন, পরে পস্তাতে হবে। অনেক মেয়েদের সহজ হতে সময় লাগে না। মৌটুসী মনে হচ্ছে সেই টাইপের। ঝিনুক,শামুক, পুতি, মালার দোকানের উদ্দেশ্যে সবাই হাটতে থাকলাম। রাস্তা থেকে নামতেই বামে ফ্রেশ ডাব নিয়ে এক ছোকরা দাঁড়িয়ে আছে। রায়হানকে বললাম, চল ডাব খাই। সবাই মিলে স্ট্র দিয়ে ডাব খেলাম। রায়হানা পানি খেয়ে ডাবটা কেটে দিতে বললো। তারপর সাদা সাদা সাঁস আঁচড়ে খেলো। বললো আংকেল খাবেন ? আমি বললাম তুমি খাও। ঝিনুক মার্কেটে ওরা অনেক সময় ধরে কেনা কাটা করলো।মনে মনে অধৈর্য হলেও মুখে হাসিহাসি ভাব নিয়ে সঙ্গে থাকতে হলো।
টুকিটাকি কেনাকাটা শেষে রায়হান বললো, চল বীচে ঘন্টা খানেক বসে যাই। বীচে যেয়ে দেখি জোয়ারের ঢেউ ফেনিয়ে ফেনিয়ে সমুদ্রর তীরের দিকে ধেয়ে আসছে। আমরা নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার ডানে রায়হান আর বামে মৌটুসি, অনিচ্ছাস্বত্বেও অনেক সময় ওর সাথে শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। ওর ভরা যৌবনের উষ্ণতায় আমি শিহরিত হয়ে উঠছি। মৌটুসীর গায়ের পারফিমের গন্ধটা আমায় যেনো নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে সফেন ঢেউরাশি পায়ের কাছে এসে আছড়ে পড়ছে। হঠাৎ একটা বড়ঢেউ প্রচন্ড বেগে ধেয়ে এসে আমাদের উপর আছড়ে পড়লো। ভারসাম্য হারিয়ে ডানে রায়হানের হাতটা শক্ত করে ধরতেই অনুভব করলাম মৌটুসী আমার বুকটা দুবাহু দিয়ে আঁকড়ে ধরে রেখেছে । আমিও তাকে মুহূর্তে বাম হাত দিয়ে জাপটে ধরলাম। আহা কি স্বর্গীয় সুখ !! আবেশে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। ভাবলাম সারাটা জীবন যদি এভাবে থাকা যেতো !!!
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা