আমাদের ভালোবাসার বিয়ে। ছাত্র জীবনের চকচকে প্রেম আমাদের অন্ধ করেনি। বরং করেছে স্থির এবং ধৈর্য্যশীল। জীবনের উন্মত্ত চাওয়ায় গা ভাসাইনি দুজনের কেউই। বরং শপথ নিয়েছিলাম জীবনে লাগামহীন অভাব থাকলেও ভালোবাসায় অপুর্নতার চিহ্নটুকুও রাখবোনা কখনো। বিয়ের পর যখন সে পয়লা বৈশাখে টিউশনির টাকা দিয়ে আমার জন্য শাড়ি কিনে এনেছিলো। আমি আবেগে কাঁদিনি কিংবা মোহিত প্রেমিকার মতো বিস্মিতও হইনি। শুধু তার পুরোনো পাঞ্জাবীর ছেঁড়া বোতাম সেলাই করতে করতে অভিমানের কন্ঠে বলেছিলাম, “নিজের জন্য কিচ্ছু কিনলেনা? এটা ছাড়া তো আর পাঞ্জাবীও নেই?” হেসে বলেছিলো, ” এই যে তোমার হাসিমুখ,ওটাই আমার আভরন।” তার তিন বছর পর যখন আমি পাঁচ মাসের অন্তঃস্বত্তা। মায়ের বাসায় যাবো। ওর জন্য রান্না বান্না করে ঘরদোর গুছালাম। একসাথে বসে দুপুরের খাবার খেলাম। যাবার আগে বললাম, “মন খারাপ করোনা, যাচ্ছি একজন, এক জোড়া হয়ে ফিরবো।”
ও চুপ করে রইলো। মুখে কথা নেই। গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, শেষবার তাকালাম। মুখটা আড়াল করতে চাইছে বার বার। যেনো সেই ভেজা চোখের সাক্ষী না হই। পারেনি সেদিন। আমি দেখেছি। ভীড় রাস্তায় আটাশ বছরের এক যুবক হাতের উল্টো পাশে বার বার চোখ মুছছে। আর আমি? ছুটে চলা গাড়িতে ঠোঁট কামড়ে পাগলের মত কাঁদছি। কি যে ফেলে রেখে যাচ্ছি তা তো এ পৃথিবীর কারো বোঝার সাধ্য নেই। সাথে থাকা ছোট বোন তাকে ফোনে কল দিলো, ” আপুর কান্না তো থামছেনা, ওকে শান্ত করুন, ভাইয়া।” ও গম্ভীর গলায় বললো, ” মাছ মাত্র দুই পিস কেনো রাখছো, আরো বেশি করে রাখবানা? জানো, আমি আজকে সব ভাত খেয়ে ফেলছি।” আমি ওড়নায় চোখ মুছে বললাম, ” একটা ডিম ভেজে নিও। লবন আর চিনি গুলিয়ে ফেলো না কিন্তু আবার।” এবার দুজনের চোখে জল শুকিয়ে হলদেটে রোদ ঝলমল করছে। খিল খিল করে হাসছি দুজন। ছোট বোন অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, “তোরা এত ছেলেমানুষ কেনো বলতো আপু !”
যেদিন কন্যার মা হলাম। অপারেশান থিয়েটার থেকে বেডে দেয়া হলো। জ্ঞ্যান ফেরার সাথে সাথেই আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো। মেয়েকে নিয়ে সবাই আনন্দ উচ্ছাস করতে ব্যাস্ত। কেউ বলছে দেখতে বাবার মত হয়েছে। কেউ বলছে নাহ্ নাকটা মায়ের মতো। দেখো, গায়ের রংটা কিন্তু বাবার। আরে, চুল চোখ সব অবকল মায়ের মতো। সুখানুভূতির সে দীর্ঘ আলোচনায় ইতি টানছেনা কেউই। চোখ খুলে দেখি পাশে সদ্য বাবা হওয়া ভদ্রলোকটি আমার মাথার কাছে বসে আছে। মুখটা ভার। চোখে তীব্র উতকন্ঠা। কপালে হাত ছুঁইয়ে বললো,”কষ্ট হচ্ছে, দাঁড়াও আমি দেখছি”। সাথে সাথেই অক্সিজেনের ব্যাবস্থা করলো। অপারেশান এর ধকলের জেরে আবার গভীর ঘুম নেমে এলো আমার চোখে।
মাঝরাতে জেগে দেখি সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসে নেট সার্ফিং করছে। কন্যার জন্য অর্থবহ নাম খুঁজে যাচ্ছে। বাকিরা যে যার মতো ঘুমোচ্ছে। ইশারায় কাছে ডাকলাম। বললাম, ” বাচ্চাকে দেখেছো?”
জানালো দেখেছে। বললাম, ” কোলে নিয়েছো?” নরম স্বরে বললো, “তোমার আগে কিভাবে নেই? তুমি তো ওর মা” আমি সেদিন ও কাঁদিনি। কন্যাকে কোলে নিয়ে বললো, ” আমি একটা নাম ভেবেছি, তুমি রাখবে?” বললাম, “রাখবো” ও নাম রাখলো, “রুফাইদাহ্” আমি বললাম, ” সাথে মাহনূর জুড়ে দাও।” আমাদের কন্যা রুফাইদাহ্ মাহনূরকে কোলে নিয়ে আমার হাত ধরে হাসতে হাসতে বললো, “আলহামদুলিল্লাহ” মাত্র এক মাস আগে বাবাকে হারালাম। উদ্ভ্রান্তের মতো কাঁদছি। নেই নেই কেউ নেই আর আঁকড়ে ধরার মতো। মাথার ওপরের ছায়াদানকারী মহীরুহ নেই আর। কন্যার বাবা শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে শুধু বললো, “কেউ নেই বলছো কেনো? আমি তো আছি” যেদিন বাবা মারা গেলো জুতো ছাড়াই এক কাপড়ে দৌড়ে গেলো হাসপাতালে। বাবার নিথর দেহটা নিয়ে বাসায় ফিরে এসে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছে। বাবাকে নিজ হাতে শেষ গোসল করিয়েছে।
কবরে শুইয়েছে। মৃত্যুর আগে শেষবার আমার বাবা শুধু একটা নামই উচ্চারন করেছিলেন। তার বড় মেয়ে জামাইয়ের নাম। এক বুক আক্ষেপ নিয়ে, অশ্রুসিক্ত চোখে সে বার বার জিজ্ঞেস করে, ” বাবা কি বলতে চেয়েছিলো আমাকে? জরুরী কিছু? আর তো জানা হবেনা কোনোদিন” আমি উত্তর দিতে পারিনা। চোখে নোনা জলের ঢেউ নিষেধের নির্দেশ মানেনা। জায়নামাযে দাঁড়িয়ে আমাকে স্বান্তনা দিয়ে সে বলে,” তুমি কাঁদলে বাবারও কষ্ট হয়, আমারো কষ্ট হয়, বোঝোনা কেনো?” আমি বুঝি, তাইতো আর কাঁদিনা। দুজন পাশাপাশি সালাতে দাড়াই। রুকু করি। সেজদায় যাই। স্রষ্টার দরবারে দু’হাত তুলে মোনাজাত ধরি। আমি জানি আমাদের দুজনের দুআ ই এক। এই জীবনের সঙ্গীকে যে জান্নাতেও পাশে চাই।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা