– কাব্য আর কথা একটি কফিশপে মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে। কথা’র পরনে কাচা হলুদ রঙের জর্জেট গাউন। মেয়েটাকে দেখতে বেশ লাগছে। কিন্তু তাতে কাব্যের কোন ইন্টারেস্ট নেই। কারন সে অন্য এক মেয়েকে ভালোবাসে,আর সে ব্যপারে কথা বলতেই কাব্য কথা’কে কফিশপে ডেকেছে। কাব্যের বাবা নিযে পছন্দ করে কথার সঙ্গে কাব্যের বিয়ে ঠিক করেছে। কিন্তু কাব্যের বুঝে আসছেনা যে বাবা তাকে এতো ভালোবাসে সে কেন আজ তার মতের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে। কাব্য এ বিয়ে কিছুতেই করতে পারবেনা। তাই যা করার আজই করতে হবে। কাব্য একটি চেয়ার টেনে টেবিলের সামনে বসল। তারপর কথা’কে লক্ষ্য করে বলল আপনিও বসুন। কথা বসতেই ওয়েটার এসে কফি দিয়ে গেল। কাব্য কফিতে চুমুক দিয়ে বলল আপনি খুব সুন্দরী। কথা ধন্যবাদ জানাতে মুচকি হাসল।
-কাব্য আবারো বলতে শুরু করলো, আপনাকে দেখলে যে কোন ছেলেরই ভালো লাগবে। আপনার লাইফ স্টাইল, আপনার চয়েজ সবই নাকি মার্জিত বাবা বলেছে। আর আপনাকে দেখেও সেটাই মনে হচ্ছে। খুবই ভদ্র আর সাবলীল মেয়ে। বাট আপনাকে আমার পছন্দ নয়।
কথা’র এতক্ষণ কাব্যের মন্তব্য শুনে ভালোই লাগছিলো। কিন্তু শেষ কথাটা শুনে হঠাৎ কথা চমকে উঠল! লোকটা বলছে কি? কাব্য কথা’র কিছু বলার অপেক্ষা না করেই আবারো বলতে শুরু করল,আচ্ছা! আপনি এমন কেনো? যাকে বিয়ে করছেন তার ব্যপারে কিছু জানার কি প্রয়োজন মনে করেননি? যাকে লাইফ পার্টনার করতে যাচ্ছেন,তাকে অন্তত একবারতো যাচাই করুন? সে লোকটা কেমন? সে আপনাকে পছন্দ করে কি’না? তার কোন রিলেশন আছে কিনা। আজকালের যুগে এসব যাচাই না করে কেউ বিয়ের পিড়িতে বসে? কথা কাব্যের কথা গুলো শুনে পুরো জমে বরফ হয়ে গেল। লোকটা তাকে বিয়ের পূর্বেই এভাবে অপমান করছে?
– কাব্য কড়া গলায় বলল কিছু বলছেননা যে? ভাবছেন আমি কেন আপনাকে দোষ দিচ্ছি? কেন আপনাকে যাচাই করিনি বা নিযের বিষয়ে বলিনি? আসলে আমার আপনাকে নিয়ে কোন ইন্টারেস্টই নেই। আর আমার বিষয়ে জানাবো বলেই তো আজ এখানে আসা। আচ্ছা, আপনার মতলব কি অন্য কিছু ছিলো? বড় লোক বাবার একমাত্র ছেলেকে দেখে ফিদা হয়ে গেছেন। কোটি টাকার সম্পত্তির মালকিন হবেন সেখানে ভালোবাসা থাকা বা না থাকায় কি আসে যায় তাইনা? আসলে আপনাদের মত মেয়েরা এসব ধান্দা….
-কাব্যের বক্তব্য শেষ না হতেই কথা হাত তুলে বাধা দিয়ে বুঝালো ব্যস এবার থামুন..
– তাই কাব্য থেমে গিয়ে বলল হ্যা বলুন আপনি কি বলবেন।
– কথা নিযের ব্যগ থেকে একটা ছোট্ট ডাইরি বের করল,
তারপর কিছু একটা লিখে সেই পাতাটা ছিড়ে কাব্যের দিকে এগিয়ে দিল। কাব্য লেখাটা না দেখেই পাতাটা ছুড়ে ফেলে দিল,আর মেজাজের সঙ্গে বলল ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সঙ্গে তাইনা? যত্তসব ফাজলামো, কি প্রবলেম আপনার কথা বলছেননা কেন আপনি? আপনি কথা বলুন বা না বলুন আমার ডিসিশন শুনে রাখুন,আমি কিছুতেই আপনাকে বিয়ে করবোনা। কথা আর সেখানে দাড়িয়ে থাকতে পারলোনা,বোবা কান্না কেঁদে দৌড়ে কফিশপের বাহিরে চলে এল। কাব্যও যখন বাহিরে বের হতে যাচ্ছিলো তখন নিচে ফেলে দেওয়া ডাইরির পাতাটা উড়ে কাব্যের জুতোর সাথে লেগে গেল। কাব্য এবার কাগজটা হাতে তুলে নিল এটা ভেবে যে মেয়েটা কিছুতো বলতে চাচ্ছিলো। যখনি কাব্য কাগজটা চোঁখের সামনে মেলে ধরল লিখাটা দেখে আৎকে উঠল!
তাতে লিখা ছিলো,আপনি আমায় ভুল বুঝবেননা, আমি একটি বোবা মেয়ে তাই আপনাকে কিছু বলতে পারছিনা। আর সেজন্য কাগজে লিখে দিলাম। তবে আপনি আমাকে এতটা অপমান নাও করতে পারতেন। আপনি বলছেন আপনি নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসেন, আদৌ কি তাই? আমার তো মনে হয়না। কারন ভালোবাসার প্রথম শর্ত হচ্ছে সম্মান করা। আপনি যাকে ভালোবাসেন সেও তো একজন মেয়ে আর তাকে যদি সম্মান করেন তাহলে অন্য মেয়েদের অসম্মান করতে পারতেননা। আর যে ব্যক্তি মেয়েদের অসম্মান করে সে কখনই ভালোবাসার যোগ্য নয়। একজন নারীকে অসম্মান করা মানে পৃথিবীর সব নারীকে অসম্মান করা। এমনকি নিযের মা’কেও। আর হ্যা,আপনি টাকা সম্পত্তি এসবের অহংকার করছেন তাইনা? জেনে রাখুন অহংকার ধ্বংসের কারন।
কাগজের লিখা গুলো পড়ে কাব্যের চোঁখ থেকে দু’ফোটা অনুতাপের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সে কফিশপ থেকে দ্রুত বের হলো কথাকে সরী বলার জন্য, কিন্তু কথা ততক্ষণে অটো ধরে সেখান থেকে চলে গেছে। কাব্য নিযের বাসায় ফিরল,অনুতাপের আগুন তার ভেরতটা পুড়িয়ে দিচ্ছে। একটা বোবা মেয়েকে সে কত কষ্ট দিয়ে ফেলল,অহেতুক কত অপমান করল। সত্যিই আমাকে মানুষের কাতারে ফেলা যায়না। ক্ষমতা, টাকা, ধন, সম্পদ এসবের মোহে্ আমি অমানুষ হয়ে গেছি। অন্ধকারের জগতে বাস করছি। আজ যদি ঐ মেয়েটার স্থানে আমি হতাম,তাহলেকি কেউ আমাকে বিয়ে করতো? আমাকেও যদি সবাই এভাবে কষ্ট দিতো তাহলে আমার কেমন লাগতো?
আজ মেয়েটি খুলে দিল আমার বেধে রাখা চোঁখ। সে বুঝতে পারলো শিফা তার ভালোবাসা নয়,ওটা শুধু মাত্রই মোহ্।
সময় কাটানোর সঙ্গী ছিলো মাত্র। কারন শিফাকে নিয়ে কাব্য এতটা ভাবেনি আজ কথাকে নিয়ে যতটা ভাবছে।
এভাবে বার বার কাব্য অনুসূচনা করতে করতে কখন যে কথাকে ভালোবেসে ফেলল সে বুঝতেও পারলোনা। তার সেই মুচকি হাসি,তার নিষ্পাপ কান্না, তার চেহারার মাধুর্য সবটাই কাব্যের মস্তিষ্কে গেঁথে বসল। এখন শুধু তাকে ঘিরেই তার ভাবনার আনাগোনা। সে ভাবল অবশ্যই কাব্য কথাকেই বিয়ে করবে তার কাছে প্রথমে ক্ষমা চাইবে, এরপর থেকে সারাজীবন তাকে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসা দিবে। পৃথিবীর একটা বোবা অসহায় মেয়ে অন্তত থাকুক না হয় আমার বুকে, পরম সুখে। কাব্য তার বাবাকে বলে দিল শিঘ্রই বিয়ের ব্যবস্থা করতে। সে এই বিয়েতে সম্পূর্ণ রাজি। কাব্যের বাবাতো অবাক! যে ছেলে এই বিয়েতে কিছুতেই রাজি ছিলোনা আজ হঠাৎ তার এত পরিবর্তন। যাইহোক খুব দ্রুতই কাব্য আর কথার বিয়ে হয়ে গেল।
পূর্ণিমাময় শুভ বাসর রাত্রীতে প্রথমে কাব্য দু’ই রাকাত শুকরিয়া আদায়ের নামাজ পড়ে নিল,তারপর আল্লাহর দরবারে তার নেক মাকসুদ নিয়ে প্রার্থণা করল। এরপর বলল ইয়া আল্লাহ! আমি জানি এটা সম্ভব নয় তবুও তুমিতো মহা মহিয়ান তাই আমার মনের কথাটা বলছি,আমি পৃথিবীতে যা কিছু পেয়েছি বা পাবো,তারমধ্যে সর্বশ্রেষ্ট নেয়ামত তুমি আর আমাদের নাবী(সাঃ) যার উম্মত হয়ে জন্ম নিতে পেরেছি, আর আমার মা। আর এসব পেয়ে আমি ভীষণ খুঁশি। এরপর যে বস্তু পেলে আমি বেশি খুঁশি হতাম তা হলো কথার মুখের কথা। কথা যদি আমার সঙ্গে কথা বলতে পারতো। তাহলে আর তোমার নিকট আমার শুকরিয়া আদায়ের ভাষা থাকতোনা। হৃদয়ের সব ভাষা তোমার শুকরিয়া আদায়ে উজাড় করে দিতাম, সেদিন এতটাই খুঁশি হতাম।
মোনাজাত শেষ করে কাব্য নিযের রুমে এল,আর দুম করে কথা’র পা ছুঁতে গেল। কথা নিযের পা সরিয়ে নিল। কাব্য বলল প্লিজ কথা আমাকে তোমার পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাওয়ার সুজোগটা দাও। আমি সত্যিই লজ্জিত আর অনুতপ্ত। তবে এটা ভেবোনা আমি তোমাকে তুমি অসহায়ের কারনে বিয়ে করেছি। সত্যি বলতে আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছি। এবার কথা বলল আর আমিও তোমাকে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি। তাইতো এত অপমান করার পরেও তোমাকেই বিয়ে করেছি। কিন্তু তাই বলে স্বামী হয়ে তুমি কিছুতেই আমার পা ধরে ক্ষমা চাইতে পারোনা। এটা কিছুতেই ঠিক নয়। কাব্যতো হতভম্ব হয়ে গেল,কথা কথা বলছে।এটা কি করে সম্ভব? কাব্য বিষ্মিত সুরে বলল, কথা! তুমি কথা বলতে পারো?
– হ্যা পারি।
– তাহলে সেদিন আমাকে ঠকিয়েছো?
– নাহ্,জাস্ট যাচাই করেছি। তুমি এটা জানার পর আমাকে বিয়ে করবে কিনা। আমাকে ভালোবসতে পারবে কিনা।
– কাব্য এবার আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছল। সে বলল সত্যিই কথা তুমি অতুলনীয়। তোমার যাচাই করার ধরণটাও অদ্ভুত। তোমার মত মেয়ে না কাউকে ঠকাবে, না কোথাও ঠকবে। হাজারো কাচের মাঝে, ঠিক সে আসল হিরেটাই খুঁজে নিবে। যদিও তুমি বোবা ছিলেনা তবুও আমি আজ অনেক বেশি খুঁশি যে তুমি কথা বলতে পারো এটা জেনে। কারন আমি তোমায় ভালোবাসি যে।
-কথা বলল আর আমিতো তোমায় ভালোবাসি ৫ বছর ৩ মাস ১০ দিন যাবত?
– কিহ্? এতদিন ধরে তুমি আমাকে ভালোবাসো? আর আমি সেটা জানতামও না? কিন্তু কিকরে?
– তুমি আমাদের নবীন বরন অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলে,আর সেদিন তুমি আমার মনটা কেড়ে নিয়েছিলে। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত মনে মনে তোমাকে একই ভাবে চেয়ে এসেছি।
আজ আল্লাহর ইচ্ছায় পেয়েও গেলাম।
– কাব্য এবার ইমোশন হয়ে কথাকে জড়িয়ে ধরে বলল আমিও তোমাকে ভালোবাসি কথা। অনেক বেশি ভালোবাসি।
– আমি জানতাম আমি জানি,তুমি আসবেই ভালোবাসবেই।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা