ইদানীং জায়গাটা খুব ভালো লাগতে শুরু করেছে আমার। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে রোজ কিছু সময় দাড়াই এখানে। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই হারানো
অতীতে। খুব বেশিক্ষন একা দাঁড়ানো যায়না। লোকে কি না কি ভাববে। তাই একজন বন্ধুকে জুটিয়েছি। বছর সাতেক হবে। কথা! সে যেন ফুলঝুরি। সারাক্ষন কিছু না
কিছু বলতেই থাকে। নামটাও যেন মিলিয়ে রাখা হয়েছিল ওর। কথা! ভারী মিষ্টি নাম। খুব পছন্দের নামটা আমার। কারন আমাদের ইচ্ছা ছিল আমাদের মেয়ের নাম
রাখবো কথামুনি। কিন্তু ভাগ্যটা বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষনা করেছিল। না। কেউ পারেনা ভাগ্যের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হতে। আমিও পারিনি। হারিয়েছি তাকে! কিন্তু কোথায়
আছে ও? কেমন আছে? গোলাকার পৃথিবীতে যদি হঠাৎ কখনও দেখা হয়ে জানতে চায় কেমন আছো? আজ তুমি আমায় বিয়ে করবে চলো! কি উত্তর দিবো সেদিন?
কথা বলতে পারবো তো! নাকি মাথা নিচু করে মাটির পানে তাকিয়ে থাকব আর ভাববো যদি মাটি টা ফাক হয়ে যেত আমার জন্য। চিরদিনের জন্য লুকিয়ে পড়তাম সেখানে!
– ওমন করে কি ভাবছো?
– আ! না মানে কিছুনা। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছিলাম কিছু সময়ের জন্য। অতীত পিছনে লেগে থাকলে মাঝে মাঝেই এরকম পরিস্থিতির শিকার হতে হয়।নতুন কিছু নয়। গত নয় বছর হল এটাই হয়ে আসছে আমার সাথে। জানিনা আর কতদিন!
– মিথ্যা বলো কেন? তুমি মোটেই আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে না। কি ভাবছো বলো।
– একটা পরীর কথা। ঠিক তোমার মতো দেখতে ছিল। তার কথাই ভাবছিলাম। তোমার মতোই মিষ্টি করে কথা বলতো। আর খুব হাসতো। ওর হাসি,,,
– থামো। শুধু শুধু কেউ কোন কাজ করেনা। আমি যে তোমার গল্প শুনবো তার জন্য আমি কি পাবো?
– চকলেট এনেছি। তুমি যেটা পছন্দ কর।
– দাও তবে।
– এই নাও।
কাধে সবসময়ই একটা ব্যাগ ঝুলানো থাকে আমার। এটা বিরক্ত লাগতো আগে। কিন্তু বর্ষার অনুরোধেই ব্যাগটা কাধে রাখতাম। এখন আর বর্ষা জেদ করেনা কাধে ব্যাগ
রাখার জন্য। তবুও রাখি। সব স্মৃতী ই যে শুধু কাদায় এমনটা নয়। কিছু স্মৃতী হয়ে থাকে ভালবাসার সাক্ষী। হয়ে থাকে ভালবাসার সেই মুহুর্তগুলো মনে করিয়ে দেওয়ার প্রধান হাতিয়ার!
– তোমার এই ব্যাগটা তো অনেক পুরনো। নতুন ব্যাগ কিনতে পারো না?
– নতুন ব্যাগ আমার ভালো লাগে না।
– কেন?
– ও তুমি বুঝবে না।
– কেউ ভালবেসে দিয়েছিল বুঝি?
কি বলব ভেবে পাচ্ছিনা। উত্তরগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে না। আসার পথ তো বন্ধ করে দিয়েছি আমি নিজেই! নিজ হাতে গলা টিপে হত্যা করেছি আমার ভালবাসাকে।
– কি হল বলছনা যে?কথা না বললে আমার কিন্তু খুব রাগ হয়!
– আ! হ্যা। ভালবেসেই দিয়েছিল একজন।
কথার আচার আচরনগুলো আমার খুব চেনা মনে হয়। বর্ষার মতো একেবারে। খুব চঞ্চল ছিল বর্ষা। আমি একটু কম কথা বলা পছন্দ করতাম। কিন্তু বর্ষা তার উল্টো। কোথায় জানি পরেছিলাম,
“মানুষ তার নিজ আচরনের বিপরীত বৈশিষ্ট সম্পন্ন মানুষের প্রেমে পড়ে”
আমরাই ছিলাম তার জীবন্ত প্রমান। ও কথা বলতো আর আমি চুপচাপ শুনতাম। মাঝে মাঝে হুম হ্যা বলতাম। এটা যেন ওকে আরও রাগিয়ে দিত। কারন ও চাইতো
আমি বেশি কথা বলি ঠিক ওর মতো করে। মেয়েটা খুব শাসন করত আমায়। ওর ভয়ে সিগারেট খেতে পারতাম না। অথচ এখন? রোজ সিগারেট খাই। তাকেই ভুলে
থাকার জন্য। কষ্টগুলোকে নিকোটিনের ধোয়ায় পুড়িয়ে বাষ্প করে দিতে চাই। চেষ্টাটা ব্যর্থ হয়। নয়ত এই নয় বছর পরেও এত জমাট বাধা কষ্ট নিয়ে বেচে থাকতে হতো
না আমাকে!
– আচ্ছা তোমার মনে কি খুব কষ্ট?
– তুমি একথা কেন বলছো?
– তোমার চোখ দেখে তাই মনে হল।
– অহহ। খুব বুদ্ধিমতী তুমি।
আমার মন খারাপ থাকলে কি করে যেন বর্ষা সবকিছু বুঝে যেত। মন ভালো করার চেষ্টা করত। সবকিছু ঘিরে আমিই ছিলাম তার পৃথিবী। আর সেই আমি তাকে! না
প্রতারনাও করিনি আমি। হয়ত করেছি। সেটা পরিস্থিতি আর তার ভালোর কথা চিন্তা করেই। তবুও কি বর্ষা আমায় ভুল বুঝবে? যদি কখনো দেখা হয় আমার সাথে
আমাকে কি একটা সুযোগ দেবে বর্ষা তাকে বোঝানোর? দেবে নিশ্চয়! ও কি জানতো না কেন আমি শীতে কাপতে কাপতে ছাদে বসে ওর সাথে মুঠোফোনে কথা
বলতাম! কেন আমি ঠান্ডায় বসে জমতে জমতে হিমশীতল বাতাস উপভোগ করে তার সাথে ফেসবুকে মেতে থাকতাম! জানতো তো বর্ষা!
– একদম পাম দিবা না। আম্মু বলে যে আমি নাকি তার মতোই গাধী হয়েছি!
– হা হা হা। আমি কি পাম্পার মেশিন নাকি যে তোমাকে পাম দিবো হুম?
আবার মনে পড়ে গেল বর্ষার কথা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে ছিল তার শাসন আর বারন। তাকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখতাম। রাগাতাম,ঝগড়া করতাম আবার
ভালওবাসতাম অনেক। আমি কিছু করলেই ও অনেক প্রশংসা করত। তাই ওকে ক্ষেপানোর জন্য পাম্পার মেশিন বলে ডাকতাম। খুব রেগে যেতো ও। অনেক কস্টে ওর
রাগ ভাঙতাম। এসবই এখন কেবল স্মৃতি। নয় বছরের পুরনো। তবু মনে হয় খুব কাছের।
– আচ্ছা তুমি যেন কি বলছিলে?কোন পরী?
– হ্যা। আমার স্বপ্নের পরী। খুব ভালবাসতো আমায়। আমিও ভালবাসতাম ওকে। অনেক ভালবাসতাম। কিন্তু বাস্তবটা ছিল অন্যরকম। ওর বাবা ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল।
প্রেম-ভালবাসার সম্পুর্ন পরিপন্থী। আমাকে দেখা করতে বলে বর্ষার সুখের কথা বলে জুড়ে দিয়েছিল একগাদা শর্ত। ভুলেই হয়ত ভুল সিদ্ধান্তটা নিতে বাধ্য হয়েছিলাম।
নিরবে সরে এসেছিলাম বর্ষার জীবন থেকে। হত্যা করেছিলাম আমার ভালবাসাকে। যেগুলোই এখন জমে শক্ত পাথরে পরিণত হয়েছে। কস্টের পাথর। বর্ষা হয়ত আজ
ভাবে আমি স্বার্থপর। বেইমান। কিন্তু সত্যিটাতো এটাই যে আমি ওর সাথে কোন বেইমানি করিনি। আমি নিস্বাঃর্থভাবে ভালবেসেছিলাম বর্ষাকে। তাইতো দীর্ঘ নয় বছর
ধরে কষ্ট গুলোকে লালন করে চলেছি নিজের মনের অন্তরালে। বাইরের পরিবেশটাকে বুঝতে দিইনি কখনো।
ক্ষীনকন্ঠে কি যেন কানে ভেসে আসছিল। ভালো করে শুনতে চেষ্টা করলাম। হ্যা।কথাকে ডাকছে। নিশ্চয় কথার মা-ই হবে। ডাকতে ডাকতে খুব কাছাকাছি চলে
আসলেন উনি। পিছন ফিরে তাকিয়ে চোখের ওপর চোখ পড়ল। চোখ থেকে মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে ফেললাম। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। দীর্ঘ নয় বছর পরেও বর্ষাকে
চিনতে এতটুকু ভুল হয়নি আমার। বর্ষাও হয়ত চিনতে পেরেছিল আমায়। শুষ্ক হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
-কেমন আছো? তবে হাসিটা ঠিক মানানসই হয়নি। ঠোটের চিপাতেই পড়ে রইল মলিন হয়ে।
– এইতো আছি একরকম। তুমি? অনেকদিন পর দেখা! বেশ শুকিয়ে গেছো মনে হচ্ছে?
– হবে হয়ত। কেউ আর ঠিক সময়ে খেতে জোর করেনা।সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে এখন।যেমন সাজিয়ে রেখে গিয়েছিলে তার সাথে আমার কোনও মিল খুজে পাবে না হয়ত!
– পাচ্ছিতো। অনেক মিল খুজে পাচ্ছি। এই যে ব্যাগটা কাধে রেখে দিয়েছো। দারুন লাগছে। (কাদছে)
– ইচ্ছা করছিল আরেকবার জ্বালায় ওকে। কিন্তু না । যেটা অতীত সেটা অতীতেই থাক। খুব পাকা পাকা কথা বলতে পারে তোমার মেয়ে।
– হুম। আমার মতোই হয়ত।
– ক্ষমা করা যায়না আমাকে?
– অপরাধটা ঠিক কতটুকু? জানিনা। তবে এটা সত্য হয়ত চিরকাল ঘৃনাই করে যেতাম তোমায় যদি বাবা সত্যটা না বলতেন কখনো।
– তুমি জানো সবকিছু?
– হুম। শেষ মুহুর্তে সত্যটা বলে গেছে বাবা।
– (নিরব।)
– চুপ করে থাকলে কিন্তু আমার রাগ হয় খুব!
– অনেক পুরনো কথা! দীর্ঘস্বাস বেরিয়ে যায় ভিতর থেকে।
– নিজেকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছো? আরেকবার নতুন করে শুরু করনা সবকিছু প্লিজ!
– আর তুমি?
– কথাকে ঘিরেই আমার সবকিছু। যত স্বপ্ন এখন ওকে ঘিরে। সত্যটা জানার পর খুব রাগ হয়েছিল বাবার ওপর। কথাই আমার সব। আর নিজেকে কষ্ট দিয়ো না। প্লিজজ?
– হুম। আসছি আজ। ভালো থেকো। আর কথা? আমি কিন্তু কালও অপেক্ষা করব তোমার জন্য। এখানে!
– ঠিক আছে। চকলেট নিয়ে আসবে কিন্তু?
– মাথা নাড়ালাম। হাটতে শুরু করলাম পিছন ফিরে। কথা কি যেন বলছিল ওর মাকে! আম্মু জানো, ওই লোকটার মনে না অনেক কষ্ট। বর্ষার ফুঁপিয়ে কাদার কান্নার
আওয়াজ আমার কানে এসে বারি দিতে লাগল। পিছন ফিরে তাকাতে ইচ্ছা করছিল বারবার। কিন্তু তাকালাম না। কেবল মনে হতে লাগলো কি করে শুরু করবো নতুন
জীবন বর্ষা? ভালবাসা নেই যে আর আমার জীবনে। আমার সবটুকু ভালবাসাই ছিল শুধু তোমার জন্য!!
:
…………………………………… সমাপ্ত………………………………..