বরযাত্রী নতুন বউ নিয়ে চলে গেছে। বাসাটায় এমন নিস্তবদ্ধতা নেমে এসেছে যেন মনে হচ্ছে বাসাটা ঘুমিয়ে পরেছে। খালু গোসল করছেন আর গান গাইছেন। বইরে কুকুরগুলো ফেলে দেয়া হাড় নিয়ে মারামারি করছে। বাসার সামনে চেয়ারে বসে ফোন চাপছি। খালি গায়ে ঠান্ডা বাতাস আর ঝিঁঝি পোকার একটানা ডাকে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। মাঝে মাঝে তারা ভর্তি আকাশের দিকে তাকাচ্ছি।
রাত যতো গভীর হচ্ছে চারিদিক ততোই নিরব হচ্ছে। আকাশে চাঁদ না থাকায় অন্ধকার আরো গাঢ় হচ্ছে। হুট করেই মনে হলো পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মাথা ঘুরিয়ে দেখি বুলু কাক্কু দাঁড়িয়ে আছেন। লোকটা কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারিনি। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলাম তাই। অন্যমনস্ক থাকার কারন অনেকদিন পেছনে ঘুরার পরে পছন্দের মেয়েটা মেসেজের রিপ্লাই করেছে। শুধু মেসেজের রিপ্লাই করেছে তা নয়। বেশ কিছু কথা হয়েছে। মনে হচ্ছে প্রেমটা বুঝি হবে, তবে সময় লাগবে। বসে বসে তার মেসেজের অপেক্ষা করছি। সারাদিন বিয়ে বাড়ির কাজে এতোটাই ব্যাস্ত ছিলাম যে তার সাথে তেমন কথা বলতে পারিনি। বুলু কাক্কুর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কাক্কু বসলে বাসা থেকে একটা চেয়ার নিয়ে আসেন।’
‘তোমার কাছে সিগারেট আছে?’
‘না কাক্কু সিগারেট তো শেষ।’
‘টাকা আছে?’
‘কতো?’
বুলু কাক্কু কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, ‘দশ টাকা দিবা?’ কথাটা কানে না বলে স্বাভাবিক ভাবেই বলতে পারতেন। কেননা আমাদের কথা শুনার মতো এখানে কেউ নেই। মানিব্যাগ চেক করে দেখলাম একটা একশত টাকার নোট। কাক্কুকে বললাম, ‘কাক্কু খুচরা টাকা তো নাই।’
‘দোকানে গেলে পাওয়া যাবে?’
‘এতো রাতে দোকান খোলা নাই তো।’
‘আছে। টাকাটা দাও খুচরা করে এনে দিচ্ছি।’
মানিব্যাগে এই একশত টাকার নোটটা ছাড়া আর কোন নোট নেই। কাল বাসা যেতে হবে। গাড়ি ভাড়া লাগবে পঞ্চাশ টাকা। নোটটা তাকে দিলে বাকি টাকা ফেরত পাবো কি না কে জানে। ফেরত না পেলে মুশকিলে পরে যাবো। কাক্কুকে বললাম, ‘চলেন আমিও যাই।’ দুচোখে ঘুম নেই। এককাপ চায়ের সাথে সিগারেট পেলে মন্দ হয়না। খালাতো ভাই আলফাজ বাসা থেকে বের হয়ে বলল, ‘চল চা খেয়ে আসি।’ আলফাজের চোখ লাল। একটু আগে ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদছিলো। বোনের সামনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইটা বোন চলে যাবার পরে একা একা কেঁদেছে। বোনদের ভালোবাসাটাই অন্যরকম। সকাল থেকে কাজ করছিলাম। বোন ডেকে বলল, ‘ভাইয়া তোর হেয়ার ব্যান লাগবে? চুলগুলোর জন্য কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে তোর।’
এতো মানুষ কিন্তু কেউ বিষয়টা খেয়াল করেনি। বোন ঠিকই খেয়াল করেছে। বোন অন্যের ঘরে চলে যাবার পরে এই ছোট ছোট বিষয়গুলো কেন যেন বারবার মনে পরে। সেই বোনের জন্য দুচোখ ভেজানো খুব স্বাভাবিক বিষয়। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। শার্টটা কাঁধে নিয়ে দোকানের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। আল আমিন ঘর থেকে বের হয়ে বলল, ‘ভাইয়া দাঁড়া আমিও যাবো।’ বুলু কাক্কু পেছন পেছন আসছিলেন দেখে আলফাজ বলল, ‘কাক্কু তুমি কই যাও?’ ‘যাই তোদের সাথে ঘুরে আসি।’ ‘তোমার যেতে হবেনা। তুমি ঘুমাও।’ আলফাজের কথা শুনে কাক্কু আমার দিকে তাকালেন। আলফাজকে বললাম, ‘কাক্কু আসুক সাথে।’ কাক্কু হাসলেন। আল আমিনকে এই গরমে ফুল শার্ট পরতে দেখে বললাম, ‘কিরে তোর গরম লাগেনা? আমি তো গরমে গেঞ্জিটাই শরীরে রাখতে পারছিনা।’
আলফাজ বলল, ‘ফুল শার্ট কি এমনি পরছে। ছ্যাঁকা খেয়ে হাত কাটছে। হাতের দাগ লুকানোর জন্য ফুল শার্ট পরে।’
বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে হাত কাটছে। সিগারেট ফুঁকছে। বিষয়টা কেমন যেন। ভালোবাসার থেকে মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। মানুষের ভালোবাসা দেখে এখন হয়তো ভালোবাসা নিজেই লজ্জা পায়। চারজন চায়ের দোকানে এসে বসলাম। ট্রাক টার্মিনালের এই চায়ের দোকান সারারাত খোলা থাকে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দুজন দুটো সিগারেট ধরালাম। আলফাজ সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে বুলু কাক্কুর দিকে এগিয়ে দিলো। আল আমিনকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম, ‘তুই ও সিগারেট খাবি?’ ‘তোমার খাওয়া হলে একটু দিয়ো।’ সিগারেটটা আল আমিনের দিকে এগিয়ে দিলাম। সিগারেটের ব্যাপারে সিনিয়র জুনিয়র নিয়ে আমি তেমন মাথা ঘামাইনা। আল আমিন বলল, ‘ভাইয়া একটা মজার জিনিস দেখবা?’
‘কি?’ আল আমিন বুলু কাক্কুকে বলল, ‘কাক্কু আলিফ বানান করো তো।’ বুলু কাক্কু একটু নড়েচড়ে বসলেন। আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, ‘আলিফ বানান তো। দাঁড়া করছি। qup… noi… rahdbj… jagaga… কাক্কু অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করলেন। ইংরেজি প্রতিটা বর্ণ অনেকবার বলার পরে বললেন, ‘খুব কঠিন বানান রে। দাঁড়া পারবো, একটু সময় লাগবে।’
‘কাক্কু আমার নামটাকে তো ধর্ষণ করে ছেড়ে দিলেন। থাক চেষ্টা করতে হবেনা আপনি নিজের নাম বানান করেন।’
‘btw…brs…bqn…trs…’
‘থাক কাক্কু এতো কষ্ট করতে হবেনা আপনি চা খান।’
‘আচ্ছা।’ কাক্কু আচ্ছা বলেই চায়ে মনোযোগ দিলেন। আল আমিন বলল, ‘ভাইয়া এবার মজা দেখ। কাক্কু বেলি বানান করো তো।’
কাক্কু আবারো নড়েচড়ে বসে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, ‘Bely’ এবার অবাক হলাম। যেই লোকটা নিজের নাম বানান করতে পারেনা সে বেলি বানান করলো কিভাবে। তাও কোন প্রকার চিন্তা ভাবনা না করে। আল আমিনকে বললাম, ‘কাকির নাম কি বেলি ছিলো? আল আমিন হাসলো। পাগলের ভালোবাসা দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। সেই কবেই বেলি কাকিকে হারিয়ে কাক্কু পাগল হয়েছিলেন কিন্তু বেলি কাকির কথা ঠিক মনে রেখেছেন। দোকানে একজন বয়ষ্ক লোক ঢুকেছেন। ঠান্ডা সিঙ্গারা নিয়ে দুভাগ করলেন। এক টুকরা মুখে দিলেন অন্য টুকরা কাগজে মুড়িয়ে নিলেন। দোকানদার ঠাট্টা করে বলল, ‘চাচা আপনার মতো কাস্টমার দিয়ে কি চলবে? মানুষ একটা খায় একটা নিয়ে যায়। আপনি অর্ধেক খান অর্ধেক নিয়ে যান।’ দোকানদারের কথায় চাচা হেসে বললেন, ‘অতো টাকা নাই। চা দে।’
‘এতো রাইতে চা খাইলে ঘুম হবে?’
‘ঘুম হয়না বলেই তো চা খাইতে আসছি।’
আমি চা শেষ করে আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়েছি। বুলু কাক্কু হুট করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি আমাকে ভালোবাসো?’ কাক্কুর এমন প্রশ্নে কিছুটা থতমত খেয়ে গেছি। আমাকে চুপ থাকতে দেখে কাক্কু বেঞ্চের উপর পা তুলে বসে বললেন, ‘ভালোবাসোনা তাইনা? পাবনা থেকে আসার পর থেকে কেউ ভালোবাসেনা। পাবনা গেছিলা কখনো?’
‘না কাক্কু।’
‘বললা না তো আমাকে ভালোবাসো?’
‘ভালো না বাসার কারন তো দেখিনা কাক্কু। কেন ভালোবাসবোনা।’
কাক্কু মনে হয় আমার কথায় খুশি হলেন। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর এলোমেলো কথা বলতে শুরু করলেন। নানান কথা বলছেন। কোন কথার সাথে কোন কথার মিল নেই। এক কথায় পাগলের প্রলাপ যাকে বলে।
কাক্কুর কথায় আমার মনোযোগ নেই। মেয়েটা মেসেজ দিয়েছে, ‘কি করছেন।’ মেসেজ দিয়েই অফলাইন চলে গেছে। আমি তার অনলাইনে আসার অপেক্ষা করেছি। আলফাজ আমাকে হাতের ইশারায় সামনের দিকে তাকাতে বলল। চাচা পান নিয়ে দু’ভাগ করলেন। অর্ধেক মুখে দিলেন অর্ধেক কাগজে ভাঁজ করে নিলেন। হয়তো তিনি পরে খাবেন। আলফাজ চাচার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ফুপা সিগারেট খেলেও কি ফুপুর জন্য অর্ধেক নিয়ে যান?’ আলফাজের কথায় চাচা হাসলেন। উত্তর না দিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে গেলেন। আলফাজকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমি তো ভাবছি চাচা পরে খাবে সেজন্য অর্ধেক করে রাখছে।’
আমার প্রশ্নের জবাব দিলো দোকানদার ছেলেটা, ‘যতোদিন ধরে দোকান করতেছি বুড়াকে কখনো পুরোটাই একা খাইতে দেখিনি। নাস্তা, পান যেটাই হোক অর্ধেক খাবে অর্ধেক বুড়ির জন্য নিয়ে যাবে।’ আমি অবাক হয়ে চাচার দিকে তাকালাম। বয়স ষাটের বেশি হবে। কিন্তু স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসাটা এখনো বৃদ্ধ হয়ে যায়নি। চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটছি। বুলু কাক্কু কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, ‘টাকা দিবানা? দিতে তো চাইছিলা।’ মানিব্যাগ থেকে দশ টাকা বের করে দিলাম। ছোট বেলা থেকে এই লোকটাকে দেখে আসছি। তার আবদার ওই দশ টাকাই। খুব বেশি হলে মাঝে মাঝে চা সিগারেটের আবদার করেন। কাক্কুকে বললাম, ‘কাক্কু বেলি কাকির কথা এখনো মনে আছে?’ কাক্কু হাসলেন। বললাম, ‘কাকির সাথে দেখা হয় আপনার?’
‘হ্যাঁ দেখা হয়। দেখা হয় তো।’
‘দেখা হলে কাকি কিছু বলেনা?’
‘নাহ্ কথা বলেনা তো। বলেনা।
আমার দিকে দেখেই না। আমাকে তো হিসাবেই ধরেনা।’ আলফাজ বলল, ‘বেলি কাকির দুইটা মেয়ে আছে। কাক্কুকে দেখলে সালাম দেয়।’ আলফাজের কথা শুনে কাক্কুকে একটু মজা করেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কাক্কু বেলি কাকির মেয়েরা আপনাকে কি বলে ডাকে। আব্বা/বাবা বলে?’ ‘ধূর কি বলো। বাবা বলবে কেন? মামা বলে। বাবা বলে ওর বাবাকে। আচ্ছা তোমরা তো পড়ালেখা করছো। আমি পড়ালেখা করে এখন প্রফেসার হতে পারবোনা?’ ‘প্রফেসার হয়ে কাকিকে বিয়ে করবেন?’ কাক্কু কথার জবাব দিলেন না। আলফাজের কাছে গিয়ে বললেন, ‘প্রফেসারের থেকে মাটি কাটার কাজ ভালো কি বলিস।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে কালকে একটা কোদাল দিবো মাটি কাটিও।’
‘আচ্ছা।’
কাক্কু হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশে বসে পরলেন। কাক্কুকে ডেকে বললাম, ‘কাক্কু বাড়ি যাবেন না?’
‘না।’ আলফাজ বলল, ‘থাক কাক্কু পরে আসবে চল।’
বাসা থেকে তিনটা চেয়ার বের করে বাইরে বসলাম। মেয়েটা আবারো অনলাইন এসে মেসেজের রিপ্লাই করেছে। কেন যেন মেয়েটাকে মেসেজ করতে ইচ্ছে করছেনা। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছি আমি কি কখনো বুলু কাক্কুর মতো মেয়েটাকে ভালোবাসতে পারবো? মনে হয় পারবোনা। এক জীবনে একজনকেই ভালোবাসা সত্যি খুব কঠিন। সবাই সেটা পারেনা। ভালোবাসা নিয়ে বড় বড় কথা বলা মানুষগুলোও বারবার প্রেমে পরে। সত্যিকারের প্রেমিক তো বুলু কাক্কুর মতো মানুষেরা।
এক জীবনে একজনকেই ভালোবেসেছেন। একজনকে ভালোবেসে পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। ভালোবাসতে জানে সেই বুড়ো চাচা। বয়স যার ভালোবাসায় ভাগ বসাতে পারেনি। আমি নিশ্চই মেয়েটাকে এদের মতো ভালোবাসতে পারবোনা। মেয়েটাকে ব্লক দিয়ে ফোনটা পকেটে রেখে দিলাম। যতোদিন না বুলু কাক্কুর মতো কাউকে ভালোবাসতে পারবো ততোদিন নাহয় ভালোবাসি শব্দ উচ্চারণ করবোনা। বুলু কাক্কু বাসায় ফিরেছেন। ঘরে শুয়ে শুয়ে গান গাচ্ছেন। গানের গলা তেমন ভালো না। তবে এই মাঝরাতে শুনতে খারাপ লাগছেনা।।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা