বৃষ্টিময় দিনরজনীতে আনন্দ আর বেদনা দুটি অনুভূতিই মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। নিরবিচ্ছিন্ন বর্ষনের পরে প্রকৃতি যেন তার স্পন্দন ফিরে পায়। বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে প্রকৃতি হয়ে ওঠে কোমল আর প্রানবন্ত। বিস্তর নীলিমার বুক জুড়ে সর্বক্ষণ অন্তহীনভাবে চলাচল করে ঘনকালো মেঘের এক বিশৃঙ্খল আলোড়ন। এমন বৃষ্টিস্নাত দিনযামিনীতে কোন কাজেই মন বসে না। আমার মন তো শুধুই বৃষ্টি তে ভিজে, বৃষ্টিবিলাস করতে চাই। বর্ষার প্রত্যাবর্তনে তৃষ্ণিত ধরিত্রী যেমন করে শীতল হয়ে যায়, আমার অন্তরাত্মাও তেমন ঠান্ডা আর সতেজতায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। বর্ষাময় দিনরাত্রি আমার কাছে অত্যধিক প্রকৃষ্ট একটা দিবসরজনী।
নদীনালা,খালবিল, মাঠঘাট পথপ্রান্তর সবকিছু অগাধ জলরাশিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আজও তেমন একটা দিনই। প্রভাতের সূচনা হতে না হতেই,অন্তরিক্ষ আলোকশূন্যতা করে তুমুল বৃষ্টি নেমেছে ধরনীর তরে। বিশাল নক্ষত্রলোক জুড়ে কৃষ্ণবর্ন নীরধরের অবাধ্য বিচরণ। চারিদিকে বিদঘুটে তম্রিসার অগাধ আলোড়ন। যতদূর দৃষ্টিদর্শিত হয় কেবল সজল-কাজল মেঘের আনাগোনা। অভিন্সা না থাকা সত্ত্বেও ভার্সিটিতে গমন করলাম। ভার্সিটি থেকে ফেরার মাঝ পথে ঝুমঝাম করে তুমুল বর্ষন শুরু হলো। সেই বৃষ্টি নুপুর-নিক্বণ অবিরল ধারায় ঝরছে। সবকিছু ভুলে আপন প্রকৃতিকে প্রানভরে অবলোকন করার প্রত্যাশায় এক অদ্ভুত প্রসন্নতার আবিষ্টতায় আচ্ছন্ন করলাম নিজেকে।
গভীর চিত্তে অনুভব করছি প্রকৃতির এই ঝুমবৃষ্টিকে। আমার হৃদয় অজানা অস্থিরতায় ক্রমশই উতলা হয়ে উঠছে। অন্যমনস্ক হয়েই নিরবিচ্ছিন্ন সুরেই গায়ছিলাম বৃষ্টিভেজা এক গান। মনের গহীনে নানা রকম অত্যুদ্ভুত ভাবনা চিন্তা অন্তহীন ধারায় ঢেউ খেলে যাচ্ছে। সেই অনুভুতির নির্দিষ্ট কোন রূপ নেই রেখা নেই, নেই কোন স্পষ্ট নাম। রিমঝিম রিমঝিম বৃষ্টি একটানা হয়েই চলছে। রাস্তায় কোন জনমানব- মানবীর চিহ্ন মাত্র নেই। অকস্মাৎ প্রকট শব্দের বজ্রপাতে আমি চমকে উঠলাম। তখনই নিজেকে কারো বুকের মাঝখানে আবিষ্কার করলাম! অনতিদীর্ঘ মূহুর্ত পর অচেনা সেই আগন্তুকের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই আমি আৎকে উঠলাম। ভয় আর আতঙ্কে আমার সর্বাঙ্গ শিউরে উঠলো। নিবদ্ধ আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রাগমিশ্রিত কন্ঠে বললো,
—আজও নিরাদ্ধা! তোমাকে আর কতোবার করে বলবো তুমি বৃষ্টিতে ভিজবা না। তবুও তুমি আমার কথা একদমই শোনো না। নিবদ্ধর কথা শুনে আমি আস্তে ধীরে বললাম,
—আমি বৃষ্টিতে ভিজতে চাই নি। অচিরাৎ বৃষ্টি নামলে আমিই বা কি করবো?
—তুমি কি করবে মানেটা কি হুম? বাসায় না গিয়ে উনি এমন নিস্তব্ধ নির্জন রাস্তায় বৃষ্টি বিলাস করে চলেছে! চলো বাসায় চলো।
—না এখন যাব না। নিবদ্ধ ভ্রুযুগল ঈষৎ কুঞ্চীত করে বিস্ময় নিয়ে বললো,
—এখন যাবে না তো কখন যাবে? আমি অনুনয়ের সুরে বললাম,
—আর একটু বৃষ্টিতে ভিজি না। নিবদ্ধ তেমনই কড়া কন্ঠে বললো,
—না একদম না। বেশি বৃষ্টিতে ভিজলে তোমার শরীর খারাপ করবে তো।
—না একটু ভিজলে কিছুই হবে না।
—নিরাদ্ধা একদম বাচ্চামি করবে না।
—বাচ্চামি করছি না আসুন আমিও বৃষ্টিতে ভিজি আর আপনিও।
কথাটা বলেই আমি নিবদ্ধর হাতটা ধরে চলে আসলাম রাস্তার মাঝখানে। নিবদ্ধ অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এখন অবশ্য তাকে দেখে আমার অনু পরিমান ভয় করছে না। আমি জানি সে এখন কিছুই বলবে না। কারন বৃষ্টিতে ভিজতে তাঁরও বেশ ভালো লাগে।
আকস্মিকভাবে বৃষ্টি আরো জোরে ঝরতে শুরু করলো। আমি দুহাত উঁচু করে বৃষ্টির জল ধরছি। আর নিবদ্ধ নিষ্পলক দৃষ্টিতে অবলোকন করছে আমাকে শুধু আমাকেই। তার আঁখিতে আঁখি মেলালেই আমি শুধু আমার প্রতি তার অনবদ্য ভালোবাসাই দেখতে পাই। সহসা আমার চিত্তপটে একটা দুষ্ট অভিলাষ এলো। মনের গহীনে সেই তত্ত্ব কথাটাই বার বার আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, তার ভালোবাসার স্পর্শ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাতে। সেই অভিপ্রায় সফল করার দূর্বার আরাধ্যে নামতেই হবে। বৃষ্টির এই আবেশ ছড়ানো মুহূর্তটিকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেটা ভাবনাতে আসছে অজস্র বার। আজ এটায় হবে তার ভালোবাসা পাওয়ার সামান্য সম্বল। অতর্কিতভাবেই আমি নিজের গায়ে থাকা ওড়নাটা ফেলে দিলাম। নিবদ্ধ তৎক্ষনাৎ ওড়নাটা তুলে আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বজ্রকন্ঠে বললো —নিরাদ্ধা পাগল হয়ে গেছ নাকি! কি করছো এসব। আমি তেমনই সাবলীল ভাবে বললাম,
—কেন কি ভুল করলাম, যা করেছি একদম ঠিকই করছি আমি।
—ওই ফাজলামি করো আমার সাথে। একচড়ে তোমার গাল লাল করে দেব বেয়াদব।
—গাল লাল করবেন তো করেন না। তবে চড় দিয়ে নয় চুমু দিয়ে।
আমার কথাটা শ্রবন করা মাত্রই নিবন্ধ আমার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকালো। যদিও আমি প্রচুর ভয় পাচ্ছি তার ওমন রক্ত বর্ণ চোখ দেখে। তবুও মনে সাহস সঞ্চারণ করে নিবদ্ধর অতিশয় কাছে গিয়ে খানিকটা উঁচু হয়ে তার কপোলে নিরবিচ্ছিন্ন চিত্তে চুমু দিলাম। নিবদ্ধ কিঞ্চিৎ পরিমাণ অবাক হলো আমার কার্যক্রমে। তবু্ও আমি থামলাম না গভীর ভাবে চুমু দিলাম নিবদ্ধর অধরে। অচিরাৎ নিবদ্ধ চিৎকার করে বললো,
—স্টপ নিরাদ্ধা। তোমার সাহস কি করে হয় এমনটা করার?
—কেন আমি কি ছুঁতে পারিনা আপনাকে? একটু কি পারি না চুমু খেতে।
—তোমাকে না বলেছি বিয়ের আগে এসব করবা না।
তবুও ছোঁয়া ছুঁয়ি করাই হলো তোমার প্রধান কাজ! কি করোনি আমার সাথে? আমার শরীরটা দেখলেই তুমি লেগে পড়ো তোমার ভালোবাসা নামক অত্যাচারে। কামড়ে খামচে কি সুখ পাও তুমি বলো তো আমায়? আর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করেই আমি নিবদ্ধকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে চলে এলাম অনেকটা দূরে। সাথে সাথেই নিবদ্ধও হাজির হলো আমার শিয়রে। সে এসেই আমাকে শক্ত করে আবদ্ধ করলো তার বক্ষপৃষ্টের মাঝখানে। ক্ষনকাল মৌনাম্বলন করেই সহসা নিবদ্ধ স্নিগ্ধ কন্ঠে বললো
—আচ্ছা নিরাদ্ধা বলো তো আমাকে জ্বালিয়ে তুমি কি শান্তি পাও। আমার তো ওই একটায় ভুল তোমাকে অতিমাত্রায় অপ্রতিমভাবে ভালোবাসা। আমার দূর্বলতা শুধুই তুমি। আর সেটা নিয়েই ক্ষমতা দেখাও তুমি।
—যান আর দেখাবো না। আর ভালোবাসতে হবে না আমাকে। নিবদ্ধ আমাকে আরও শক্তকরে জড়িয়ে ধরে আবেশ মাখানো কন্ঠে বললো,
—তুমি বললেও যে আমি এটা পারবো না। আমি যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমার ভালোবাসা ভালো থাকা সব, সবটাই যে তোমাকে ঘিরেই। ভালোথাকার জন্য।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা