হায় আল্লাহ্! ট্রেন চলে এসেছে। রিক্সায় বসেই মেহেদী় দেখতে পেল ট্রেনটা স্টেশনে। একটু পরই ট্রেনটা ছেড়ে যাবে। মেহেদী তাড়াতাড়ি রিক্সা ভাড়া দিয়ে দৌড়ে ট্রেনে
উঠলো। ওর অবস্থা দেখে মনে হয় যেন কত জরুরী কাজে ব্যস্ত ছিল তাই ট্রেন ধরতে লেট করেছে। কিন্ত তার জরুরী কাজটা যে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া তা
হয়তোবাইরের সবারই অজানা। সারাদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়াই তার প্রধান কাজ। নানা রকম দুষ্টুমি কাজ আর কথা বার্তায় সবাইকে মাতিয়ে রাখে সে।
ডিপ্লোমাতে ৩য় সেমিস্টারে পড়েও তার দুষ্টুমি এখনও কমে নি। ক্যাম্পাসে সবাই ওকে “বান্দর” নামে চেনে। বান্দর নামেই বেশ খ্যাতিকুড়িয়েছে সে। টিচাররা পর্যন্ত তার
বাদরামির হাত থেকে রক্ষা পায় না। পড়ালেখার ধারে কাছে নাই সে। কোনমতে পরীক্ষায় পাশ করে গেলেই হল। আর পরীক্ষার হল এ হেল্পলাইন তো আছেই। সবাই
জানে মেহেদীকে পরীক্ষায় হেল্প না করলে উপায় নেই। কোন না কোন দিক দিয়ে সে সবাইকে ব্ল্যাকমেইল করে রাখে। তাই বাধ্য হয়ে ওকে পরীক্ষায় হেল্প করতেই হয়।
এভাবেই কেটে যায় বান্দর উপাধী প্রাপ্ত এই ছাত্রের পরীক্ষা গুলো। ট্রেনটা চলতে শুরু করেছে। ভাগ্য ভাল যে টিকিটটা আগে থেকেই কাটা ছিল। জানালার কাছের
সিটটা পেয়েছে ও। ভালই হল প্রকৃতি দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে। এখন ট্রেনে একা একা কোন বাদরামী করা যাবে না তাই প্রকৃতি দেখাই ভাল। মেহেদী ট্রেনে করে তার
নানু বাড়ি যাচ্ছে। কিছুদিন আগে ওর মা নানু বাড়ি গেছে। তাই মা কে আনতে যাচ্ছে সে। হেডফোনটা লাগিয়ে একমনে গান শুনে যাচ্ছে মেহেদী। হঠাৎ তার চোখ
পড়লো দু সিট সামনে বসা মেয়েটির দিকে। মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে ওর। কিন্ত মনে করতে পারছে না মেয়েটি কে। হঠাৎ মনে পড়লো মেয়েটির সাথে একদিন
ক্যাম্পাসে ওর ধাক্কা লেগেছিল। এরপর মেয়েটির অনেক ঝাড়িহজম করতে হয়েছিল ওকে। পরে বন্ধুদের কাছে জানতে পারলো মেয়েটির নাম মিম। ফার্স্ট সেমিস্টারে
পড়ে। মেয়েটিওট্রেনে করে কোথায় যাচ্ছে মেহেদীর খুব জানতে ইচ্ছে করছে। হয়তো কোন আত্মীয়ের এখানে যাচ্ছে। মেয়েটাদেখতে খারাপ না। দুপুরের কড়া রোদ
একদম মিম এর মুখেএসে পড়ছে। খুবই অসহ্য অবস্থা। উড়না টা দিয়ে মাথাটাকে রোদ থেকে রক্ষা করে মিম। একটা লাল জামা পড়েছে সে। মাথায় উড়নাটা দেওয়াতে
একদম নতুন বউ এর মত লাগছে মেয়েটাকে। মেহেদী় মুগ্ধ হয়ে দেখছে সেই নতুন বউ এর মত মুখ খানি। বাতাসে চুল গুলো বার বার উড়ে এসে মিম এর মুখে এসে
পড়ছে। মেহেদীর খুব ইচ্ছে করছে আলতো করে মিম এর চুলগুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিতে। কিন্ত সব ইচ্ছেই তো আর পূরন হয় না। মেহেদীর অপূর্ন ইচ্ছা
গুলোর মধ্যে এটি একটি। মেহেদী় বুঝতে পারে না কেন এমন লাগছে ওর। কোন মায়ার জালে আটকে যাচ্ছে না তো সে! অবাধ্য চোখ গুলো শুধু মিম এর মুখ খানি
দেখতে চাচ্ছে। নানু বাড়ি গিয়েও রাতে শুধু মিম এর কথাই মনে পড়ছে ওর। মনের ভিতরে কিছু একটা হচ্ছে তা আর মেহেদীর বুঝতে বাকি রইলো না। চুন্নী মেয়েটা
মেহেদীর ঘুমটাও চুড়ি করে ফেলেছে। একদমই ঘুম আসছে না ওর। দিন যেতে থাকে আর মেহেদী় বুঝতে পারে সে মিম এরপ্রেমে পড়ে গেছে। আচ্ছামতই পড়েছে।
সেখান থেকে আর উঠার উপায় নেই। দুষ্টু ছেলেরাও যে কাউকে ভালবাসতে পারে বুঝে গেল সে। তারা শুধু সারাদিন দুষ্টুমি নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও কাউকে গভীরভাবে ভাল
বাসতেও পারে। ক্যাম্পাসে গিয়েই মিমকে বলতে হবে মনের কথা। কিছুদিন পর মেহেদী ক্যাম্পাসে গেল। ওর চোখ জোড়া শুধু একজন মানবীকেই খুঁজছে। অবশেষে
দেখা মিললো সেই মানবীর। কিন্ত মেহেদী আজ সব সাহস হারিয়ে ফেলেছে। পূর্বে অনেক দুঃসাহসিক কাজের জন্য খ্যাতি থাকা সত্বেও আজ সে মিম কে ভালবাসার
কথাটা বলতে পারছে না। সারাদিন মিমকে আড়ালে থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে সে। কিন্ত কিছু বলতে পারেনি। পরদিন মেহেদী় ঠিক করলো মিম কে গিয়ে সরাসরি
বলবে মনের কথা। মিম বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো। মেহেদী এসে মিম কে ডাক দেয়। : মিম তোমার সাথে একটা কথা ছিল। একটু এদিকে আসবে? — না।
আপনার যা বলার এখানেই বলেন। : প্লিজ আসো না। মাত্র দুমিনিট। –আচ্ছা চলেন। হ্যাঁ বলেন কি বলবেন : আসলে মিম…. ইয়ে…. মানে…. –আপনি কি তোতলা?
এমন করতেছেন কেন? কি বলবেন তাড়াতাড়ি বলেন। : আ..মি তোমাকে ভা..ভা..ভালবাসি। বিয়ে করতে চাই তোমাকে… — কি??!!! আপনার সাহস তো কম না।
আপনাকে! যাকে সবাই বান্দর ডাকে সে আমাকে বিয়ে করতে চায়! সারাদিন ভন্ডের মত ঘুড়ে বেড়ান। পড়ালেখা নাই। আপনার লজ্জা করে না আমাকে এসব বলতে!!
: দেখো আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। আমি ভাল হয়ে যাব তোমার জন্য। — এসব ভন্ডামি আমার জানা আছে। আর আমার বাবা যার সাথে আমাকে বিয়ে দিবে
আমি তাকে বিয়ে করবো। আমার বাবা নিশ্চই আপনার মত বান্দরের সাথে আমার বিয়ে দিবেন না। দেখেন আপনি কখনও আমার সামনে আসবেন না। পারলে যোগ্য
হয়ে আমার বাবার সামনে দাড়ান।
এত অপমানের পর মেহেদী কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেল। ক্যাম্পাসের পুকুর পাড়টায় বসে শুধু ভাবছে মিমতো ঠিকই বলেছে আমার মত ছেলের সাথে কেনই
বা কোন বাবাতার মেয়ে কে বিয়ে দিবে। এই পর্যন্ত কি করতে পেরেছে সে..! সারাদিন পর বাসায় গেল না মেহেদী়। বাসার কেউ ওর কোন খোঁজ পাচ্ছে না। মোবাইল টাও
অফ।
ছয় বছরপর…মিম এর আড়াই বছরের পিচ্চি মেয়েটা সুন্দর লাল জামা পড়ে এসে তার বাবা কে বলছে- ~বাবা, বাবা তলো,তালাতালি যাই। আমি তো লেডি হয়ে গেছি। মা
ও লেডি। (বাবা, বাবা চলো, তাড়াতাড়ি যাই। আমি তো রেডী হয়ে গেছি। মা ও রেডী) আধো আধো কথা বলতে শিখেছে মেয়েটা। অনেক দুষ্টু হয়েছে। হয়তো বাবার কাছ
থেকে পেয়েছে দুষ্টুমি গুন টা। মিম এসে এক ঝাড়ি দিয়ে বলল- –এই মেহেদী়!!! তুমি এখনও রেডী হওনি?? আমরা তো রেডী। পরে কিন্ত ট্রেন মিস হয়ে যাবে। : এইতো
আর দুমিনিট। আজ মেহেদী় কোন দুষ্টুমি বা আড্ডাবাজির জন্য লেট করছে না। অফিসের জরুরী কাজটা শেষ করার জন্য একটু লেট হচ্ছে।
ছয় বছর আগে মিম এর সেই অপমানের পর নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে মেহেদী়। পড়ালেখায় মনোযোগ দেয়। বান্দর উপাধী বর্জন করে ভদ্র উপাধী কুড়িয়ে নেয়।
পড়ালেখা শেষ করে ভাল চাকরী পায়। ভালবাসার জন্য দেবদাস না হয়ে অবশেষে যোগ্য পাত্রের বেশে মিম এর বাবার সামনে দাড়ায়। পারিবারিক ভাবেই বিয়েটা হয়
ওদের। মেহেদীর এতটা পরিবর্তনের পর মিম আর অমত করেনি। মেহেদী নিজের এতটা পরিবর্তন আনতে পেরেছিল শুধু ‘ভালবাসার জন্য। মিম কে সে অনেক বেশীই
ভালবেসেছিলো। সত্যিকার ভালবাসা আসলেই মানুষের জীবনকে পাল্টে দিতে পারে।
আজ ওর সংসার হয়েছে। অনেক দায়িত্ববান হয়েছ।ফুটফুটেএকটা মেয়ে হয়েছে ওদের। ওরা তিনজন আজ মেহেদীর নানুবাড়ি যাচ্ছে ট্রেনে করে। আজ মেহেদী মিম
এর মুখের উপর থেকে উড়ে আসা চুল গুলো সড়িয়ে দিবে। ছয় বছর আগের সেই ইচ্ছাটি পূরন করবে..