বাড়িতে ঢুকার অনুমতি না পেয়ে গেইটের সামনে এভাবে পায়চারি করতে দেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা ইসমাইল সাহেব তার স্ত্রী শায়লাকে বলতে লাগলেন,
– তোমাকে বললাম, মেয়ের চিকিৎসা করাতে। আর তুমি বললে বিয়ের থেকে বড় চিকিৎসা নেই! দিলাম বিয়ে। এখন দেখো, তোমার মেয়ে আমার জামাইটাকেও পাগল বানিয়ে ফেলল! শায়লা বেগমও মুচকি হেসে বললেল,
– সব দোষ তোমার, মেয়েকে তো ভয়ে কিছুই বলো না! ভীতুর ডিম একটা!
– আমি না হয় ভীতুর ডিম, তুমি তো সাহসের গোডাউন। যাও না, গিয়ে জামাইকে ডেকে পাঠাও! আমি ডাকলে তো তোমার মেয়ে আবার আমাকেই না ঘর থেকে বের করে দেয়। পরে দেখা যাবে জামাই-শ্বশুর একসাথে রাস্তায় ঘুরঘুর করছে! কি সাংঘাতিক দৃশ্য! তারপর শ্বাশুড়ি দারোয়ানকে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠালেন। দরজা খুলে আমাকে দেখতেই ইভা বলে উঠল,
– বাবা, ওকে চলে যেতে বল! আমি আর ওর ঘর করছিনা! বলেই সে তার রুমের দিকে আর আমি কয়েদির মত দাঁড়িয়ে রইলাম শ্বশুরের সামনে। উপায়ন্তর না দেখে শ্বশুরই বলে উঠলেন,
– তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না দেখছি! তোমার শ্বাশুড়িকে কিভাবে হ্যান্ডেল করি একটু দেখে তো শিখতে পারো! এখানে ভেবলাকান্তের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে রুমে যাও! গিয়ে মেয়ের রাগ ভাঙাও! আমিও বাধ্য জামাইয়ের মত শ্বশুরের আদেশ পালন করতে ইভার রুমের ভেতর ঢুকি! আমাকে দেখেই ইভা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
– জানি, তুমি রাগ করে আছো! আমিও কিছুক্ষণ আগে ঠিক এভাবেই তোমার উপর রাগ করেছিলাম! সামান্য ঝগড়া তো সব স্বামী-স্ত্রীর মাঝেই হয়, তাই বলে এভাবে বাসা ছেড়ে চলে আসে কেউ? ভেবেছিলাম তোমার মুখই আর দেখব না। গরমের সাথে রাগটাও ক্রমাগত বাড়তেই লাগল। ফ্রিজ খুলে পানির বোতল বের করতেই দেখি রাতের খাবারে ফ্রিজ ভর্তি। বুঝতে দেরি লাগলো না, রাগ করে বাসা ছাড়ার আগেও তুমি আমাকে নিয়ে ভেবেছ, রান্না করে রেখে গেছ যেন আমাকে না খেয়ে থাকতে হয়!
রাগটা অনেকটাই নাই হয়ে গেল। ফ্রিজটা বন্ধ করে মন হালকা করতে টিভির সামনে গিয়ে বসলাম, টিভি অন করতেই Sony TV তে The Kapil Sharma Show হচ্ছে দেখলাম! কিছুক্ষণ পরপর শো এর অডিয়েন্স, হোস্ট, জাজ হোহো করে হাসছে কিন্তু আমার হাসি পাচ্ছে না, আজকের রাতটা যে একটু ব্যতিক্রম। অন্যসব দিনগুলোতে আমরা একসাথে শো-টা দেখলেও আজ যে তুমি পাশে নেই। ভাবতেই হৃদয়টা খাঁখাঁ করে উঠলো, চোখ ভার হতে শুরু করলো!
টিভি অফ করে রুমে চলে গেলাম ঘুমাতে! বিছানায় শুতে গিয়ে চোখ পড়ে গেল পাশের বালিশে! আমার ইভার বালিশে! যেই বালিশে মাথা রেখে তুমি ঘুমাতে! এপাশ থেকে ওপাশ করছি কিন্তু তোমাকে ভুলতে পারছি না! যতই ভাবছি তোমাকে নিয়ে ভাবব না, ততই আরো তোমার চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে! নাহ! ঘুম আজ আর আসবে না, বিছানা ছেড়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করতেই ঘড়ি ঢং ঢং করে উঠলো, তাকিয়ে বুঝতে পারলাম ঘড়িটা জানান দিচ্ছে এখন ঠিক ৯ টা, মানে আমাদের এখন খাওয়ার সময় কিন্তু ঘড়ি তো জানে না তুমি পাশে নেই! ভাবতে লাগলাম, ‘আচ্ছা তুমি কি আমাকে ছাড়াই খেয়ে ফেলেছ? নাকি এখনো আমার জন্য অপেক্ষা করছ? বিয়ের পর একদিনও তো আমাকে ছাড়া তুমি খেতে বসনি!’
কেমন যেন সব অসহ্য লাগছে। বুঝতে পারলাম তোমাকে ছাড়া এক মুহুর্ত একা থাকা আমার সম্ভব না। কিভাবে থাকব? বাসার প্রতিটা ইঞ্চি, প্রতিটা কোণে, দেয়াল ঘেষা প্রতিটা আসবাবপত্রে যে তোমার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়!
কথাগুলো বলতে বলতে আমি কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম, তাই তো ইভার ছলছল চোখ আমার চোখ ছুঁয়ে যায় নি। কিন্তু হঠাৎ যখন সে জড়িয়ে ধরলো আর আমার পরনের শার্টটা ভিজতে লাগল তখন বুঝলাম পাগলীটা কান্না করছে!
– তাহলে আমাকে থামালে না কেন? আমি চলে আসতে চাইলে তুমি আসতে দিবে?
– ভুল হয়ে গেছে! আর সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি হয়ে গেল যে আমি কিছু বলতে যাবো তখনই পেছন থেকে শ্বাশুড়ি বলে উঠলো,
– কি? মিমাংসা তাহলে হলো! হয়ে গেলে খেতে এসো তোমরা! আমরা অপেক্ষা করছি! পিছন থেকে শ্বাশুড়ির গলার শুনেই ইভা নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,
– না মা! আমরা খাবো না, বাসায় রান্না করে এসেছি! বলেই ইভা রেডি হতে শুরু করলো! তৈরি হতেও বেশিক্ষণ লাগে নি। বাসা থেকে আসার সময় স্যুটকেসে ভরে কাপড় এনেছে মাত্র এক স্যুট জামা!
– এ কি! মাত্র এক স্যুট জামা?
– এটাও তো এনেছি বেশি, ভাবলাম তোমার রাগ একদিন টিকবে।
এখন তো দেখছি এটা না আনলেও চলতো! বলেই মুচকি হাসতে লাগল। বুঝতে পারলাম আজকে ঝগড়া করার জন্য শিক্ষার দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েই এসেছে। আমি এবার ইভার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে পিছনে নিতেই দেখলাম শ্বশুর, শ্বাশুড়িও আমার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। তিনজনই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি!
– কি হলো? তোমরা এমনভাবে তাকিয়ে আছো যেন কোন ভূত দেখছ! আর তুমি দাঁড়িয়ে আছো যে? রাত বেশি হয়ে গেলে তো আবার গাড়ি পাবো না! নীরবতা ভেঙে ইসমাইল সাহেব তার স্ত্রীকে বলে উঠলেন,
– ইভার মা, তোমাকে আমি কি বলছিলাম? আমাদের মেয়েটা আসলেই পাগল, দরকার ছিল পাগলা গারদে পাঠানোর আর আমরা পাঠালাম শ্বশুরবাড়ি! (শ্বশুর)
– আমি মোটেও পাগল না, আমি আমার স্বামীর বাড়ি ফিরে যাচ্ছি এতে পাগলামিটা কোথায়?
কারো মুখে আর কোন কথা শুনতে না পেয়ে অগত্যা ম্যাডামের এক স্যুট জামা আর হাওয়া ভর্তি স্যুটকেস তুলে বের হলাম। কিছুক্ষণ পর আবারো বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইসমাইল সাহেব তার স্ত্রীকে আবার বলতে লাগলেন,
– ওদের দুইজনের যে কি হবে! একসাথে থাকলে যেটাকে মনে হয় ঝগড়া, একটু দূরে এলেই দেখি সবটাতেই ভালোবাসা!
– মনে হয় না ওরা আর পাল্টাবে!
– তাহলে আর কি প্রস্তুতি নাও। দুইদিন পর আবার নতুন কি নাটক নিয়ে হাজির হয় কে জানে! একদম হয়েছে তোমার মত, যেমন ঝগড়াটে মা তেমনই হয়েছে তার মেয়ে!
– কি বললা? আমি ঝগড়াটে? আজ বন্ধ!
– বন্ধ মানে? কি বন্ধ?
– তোমার রাতের খাবার বন্ধ!
– আরে লক্ষ্মীটি, আমি তো মজা করে বললাম। এই শুনো না…
বলতে বলতে ইসমাইল সাহেব শায়লা বেগমের পিছু নিলেন আর এদিকে আমি আর ইভা এক হুডের নিচে। দশটা বাজলেই এই রাস্তায় তেমন কোন গাড়ি পাওয়া যায় না! তাই রিক্সাতেই উঠতে হয়েছে। সত্যি বলতে খারাপ লাগছে না! শহর তার চিরচেনা রূপ বদলে ফেলেছে। রাস্তায় নেই কোন ব্যস্ততা, নেই কোন কোলাহল! দূরদূরান্তে যতদূর চোখ যায় শুধু শূন্যতা আর রাতের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু ল্যাম্পপোস্ট আর সেগুলোর আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা কুকুর! মাঝেমধ্যে দুই একটা খোলা দোকান শুধু দেখা যাচ্ছে। রিক্সার ঝাঁকুনিতে ইভার হাতটা আমার হাতকে আরো জোরে আঁকড়ে ধরে। আমিও অভয়ের ছোঁয়ায় তার মাথাটা কাঁধে এলিয়ে দেই। তারপর আলতো করে মাথায় হাত বুলাতে থাকি। ইভা পরম নিশ্চিন্তমনে চোখ বন্ধ করে। অন্যরকম লাগছে এই চেনা শহরের অচেনা মুহূর্তগুলো। যদি শেষ না হতো এই রাতটা! কিন্তু রিক্সা চলার গতি দেখে তা হবে বলে মনে হচ্ছে না! তাই বললাম, ‘মামা আস্তে যান, আমাদের কোনো তাড়া নেই!’
এবার রিক্সা আস্তে চলতে লাগল। পরক্ষণে ইভার দিকে চোখ পরতেই দেখি আবারো ইভার মুচকি মুচকি হাসছে।
আসলেই মুচকি হাসতে পারা মেয়েগুলো প্রচন্ডরকম লোভী হয়! ভালোবাসা-লোভী। শুধু ভালোবাসলেই চলবে না, তাদের দায়িত্ব নিয়ে সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে হবে। তাদেরকে তাদের মত করেই বুঝতে হবে, বারংবার মুগ্ধ করতে হবে, তাদের মতামতকে সম্মান জানাতে হবে! প্রতিমুহূর্তে এটা বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করে যেতে হবে যে, আপনার ভালোবাসা তার জন্য কিঞ্চিৎ পরিমাণেও বদলায় নি। আর এই ভালোবাসায় একটুখানি কমতি হলেই হাজারটা অভিযোগ। হয়ে উঠে সুন্দরী থেকে ভয়ংকর। ভালোবাসার ক্ষেত্রে যে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না তারা। ভালোবাসার ক্ষেত্রে তারা যেমন ছাড় দেয় না, তেমনি একটুতেই হালও ছেড়ে দেয় না, বরং আরো জোরে আঁকড়ে ধরে! যেমনটা এখন আমাকে ইভা ধরে রেখেছে! প্রচন্ড ভয়ংকর এই হাসি। তবুও ভাবতে অবাক লাগে ইভার এই হাসির প্রেমেই আমি পরেছিলাম!
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা