বুঝবে তুমিও

বুঝবে তুমিও
আমাদের পাশের বাসার এক বড় আপুর বিয়ে হবার ছ’মাস পর তার শ্বশুরবাড়ির লোক জানতে পারলো আপু কখনো মা হতে পারবে না। এমনিতেই বিয়ের প্রথম থেকে আপুর হাজবেন্ড এই বিয়েতে রাজি ছিল না কারণ আপু দেখতে শ্যামলা বর্ণের ছিল।
আর তাছাড়াও আপু এই যুগের মডার্ন মেয়েদের মতো স্টাইলিশ ছিল না। তিনি পর্দাশীল ছিলেন। যেটা আপুর হাজবেন্ড মোটেও পছন্দ করতেন না।আপুর বাসর রাতের দিনই আপুর হাজবেন্ড আপুকে বলেছিল সে তাকে পছন্দ করে না। বাবা মায়ের ইচ্ছা পূর্ণ করতেই এই বিয়ে করেছে। সেদিন আরো বলেছিল যে ছ’মাস আপুকে তার স্ত্রী হিসেবে তাকে থাকতে হবে কিন্তু কখনো স্ত্রীর অধিকার চাইতে পারবে না। আপু হাসিমুখেই সব মেনে নিয়েছিল। আপু কোনো উত্তর না দিয়ে দু’রাকাত নামায পরে ঘুমিয়ে পরেছিল। সেদিন তার খাটেও জায়গা হয়নি। তাই সেদিন জায়নামাযেই রাত কাটিয়েছিলো। এভাবেই কাটছিলো দিন। একদিন আপুর স্বামী নেশা করে এসে আপুকে কাছে টানলো। আপুর সাথে অনেক ধস্তাধস্তির পরেও আপু নিজেকে বাচাতে পারেনি। সপে দিয়েছিল তার হাজবেন্ডের কাছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বসতেই ঝড়ের বেগে তার স্বামী তাকে চড় মারলো। আপু কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারেনি কারণ সেদিন তার স্বামী তাকে হাজারটা কথা শুনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেছিল। আপুর শশুরবাড়ির লোকও যে খুব একটা ভালো ছিল তা নয়। তারা শুধু মাত্র আপুর বাবার সম্পত্তির লোভে জোড় করে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন।ঘরের রান্না থেকে শুরু করে সকল কাজ আপুই করতো কারণ সে মেনে নিয়েছিল হয়তো এটাই তার নিয়তি। কথায় আছে, ‘ভাগ্যের লিখণ না যায় খন্ডন’।একদিন রান্না শেষে গোসল সেরে বের হতেই আপুর মাথা ঘুরে উঠলো।সেই সাথে বমিও হলো। আপু কিছু একটা আচ করতে পারলো। আপুর এক বান্ধবী ডাক্তার ছিল তাই আপু তাকে কল করে যাবতীয় সব খুলে বললে আপুর বান্ধবীও জানান আপু প্রেগন্যান্ট। কিন্তু শেষ রক্ষাটা আর হলো না কারণ আপুর স্বামী পিছন থেকে দাড়িয়ে সবটা শুনেছিলেন।
আপু পিছনে ঘুড়তেই দেখলেন সে রক্তলাল চোখে আপুর দিকে তাকিয়ে আছে।তারপর আপুকে কিছু না বলেই সে বেরিয়ে গেল। আপু ভেবেছিল হয়তো বাচ্চার কথা ভেবে আর স্বামী তাকে মেনে নেবে। কিন্তু ভাগ্য যে তার সহায় ছিল না। আপু রাতে ঘুমিয়ে পরলে কৌশলে আপুর খাবার পানির সাথে ওষুধ মিশিয়ে রাখলেন। মাঝরাতে আপু পানি খেতে উঠলে দূর্ভাগ্যবশত সেই ওষুধ মেশানো পানি খেয়ে ফেলে।কয়েকঘন্টা পর আপুর প্রচুর লেবার পেইন শুরু হয়। আপু বাথরুমে গিয়ে বুঝতে পারলো আপুর সাথে কি হয়েছে। বাথরুমের এক কোণে ডুকরে কেদে উঠলো আপু।তারপর ওযু করে তাহাজ্জুদের নামাযের মুনাজাতে মনভরে কাদলেন আপু। দোষ হয়তো তার ছিল কিন্তু নবাগত বাচ্চাটা কি দোষ করেছিল!কাদতে কাদতে সেখানেই ঘুমিয়ে পরে আপু।
কেটে গেছে বিয়ের পাচ মাস। আপুর শশুরবাড়ির লোকেরা আপুকে বাচ্চা নিয়ে প্রায়ই কথা শুনাতো। একদিন আপু এসব সহ্য করতে না পেরে তাদের বলে দিলো যে আপু কখনো মা হতে পারবে না। সেদিনই তার শশুরবাড়ির লোকেরা আপুর বাবাকে খবর দিয়ে নিয়ে এসে মেয়েকে তাদের সাথে পাঠিয়ে দিলেন।আপুর বাবা মা ও সেদিন কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনি কারণ কারণ তাদের মেয়ের অক্ষমতা। তাদের মেয়ে বন্ধা না হলে হয়তো এসব হতো না। সেদিনের পর থেকে আপু অপেক্ষা করতো,যদি তার স্বামী আর স্বামীর পরিবার ভুল বুঝতে পেরে তাকে সসম্মানে নিতে আসে। দিন যায় মাস যায় বছর পেরিয়ে যায় আপুর অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়না।
প্রায় ছয় বছর পর।। আপু এখন একটা এতিমখানার শিশুদের দায়িত্ব নিয়েছে। ওদেরকে ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। এভাবেই আপুর দিন কাটে। সেই বিয়ে ভাঙ্গার পর আপু আর বিয়ে করেনি। একদিন এতিমখানার বাচ্চাদের সাথে আপু কানামাছি খেলছিল। গেটের দাড়োয়ান এসে জানালো আপুর সাথে কেউ দেখা করতে চায়। আপু দাড়োয়ানের সাথে গিয়ে গেটের সামনে দাড়াতেই আচমকা কেউ আপুকে জড়িয়ে ধরলো। ঘটনা এতটাই তাড়াতাড়ি ঘটলো যে সব আপুর মাথার উপর দেয়ে গেল। লোকটাকে দাড়োয়ান আর আপু মিলে অনেক কষ্টে ছাড়ালো। লোকটার চেহারার দিকে তাকাতেই আপুর দুনিয়া উলটপালট হয়ে গেল। এ যে তার স্বামী, এখন তো চেনাই যাচ্ছে না তাকে। চেহারায় নেই আগের মতো উজ্জ্বলতা,চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল আর গোলাপী ঠোট দুটো পুড়ে যাওয়া কয়লার রূপ ধারণ করেছে। আপুর চোখে পানি আসতেই আপু ঘুরে পিছনে তাকালো। তারপর সাবধানে চোখের পানি মুছে জিজ্ঞেস করলো,
__”কেনো এসেছেন এখানে?কি চাই?”
__”আমাকে কি একটিবার সুযোগ দেওয়া যায় না পরী(আপুর নাম)।বিশ্বাস করো,তোমাকে অনেক খুজেছি কোথাও পাইনি।”
__”পাবেন কি করে?আর যাতে আপনার মুখ দেখতে না হয় সেজন্য দূরে চলে এসেছি!এখন আবার কি কথা শুনাতে এসেছেন?” আসলে আপু তার বাবা মায়ের সাথে বাসায় ফেরার পর প্রতিবেশীরা কানাঘুষা শুরু করেছিল। তাই আপুর বাবা মা সহ্য করতে না পেরে বাসা ছেড়ে দিয়েছিল। আপুর কথা শুনে আপুর হাজবেন্ড আপুর পা ধরে কাদতে লাগলো। আপু চোখ মুখ খিচে পা ছাড়িয়ে নিল। আপুর হাজবেন্ড বললো,
__”প্লিজ পরী। তুমি যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছি তুমি আমার জন্য কি ছিলে।তুমি যাওয়ার পর আমার আর বড় ভাইয়ের চাকরি চলে যায়। যার জন্য তোমায় অবহেলা করতাম,যার জন্য আমার নবাগত সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখা থেকে বঞ্চিত করেছি সেই বিশ্বাসঘাতকতা করে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আমি আমার পাপের শাস্তি পেয়েছি পরী। আজ এতোদিন পর আমি আমার পাপ মোচন করার সুযোগ পেয়েছি। একটা বার দেবে সেই সুযোগ। তোমার কাছে তোমাকে ভিক্ষা চাইছি পরী। ফিরিয়ে দিও না আমাকে।” আপু শুধু প্রতুত্তরে এটাই বলেছিল,
__”আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া ছয়টি বছর আর আমার নবাগত সন্তানকে ফিরিয়ে দিন তাহলে আমি আপনাকে মেনে নেবো আর তা না পারলে আর কখনো আমার মুখোমুখি হবার চেষ্টা করবেন না।”
বলেই চলে গিয়েছিল আপু। সময়, স্রোত কখনো কারো জন্য অপেক্ষা করে না।মানুষ সময়ের সাথে সাথে তার করা সমস্ত কর্মের ফল ভোগ করবে। এটাই বাস্তবতা।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত